X
শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪
১৪ বৈশাখ ১৪৩১

‘উধাও হয়ে হৃদয় ছুটেছে’: পথিক রবীন্দ্রনাথ

কুমার চক্রবর্তী
১৮ নভেম্বর ২০১৯, ০৬:০০আপডেট : ১৮ নভেম্বর ২০১৯, ০৬:০০

‘উধাও হয়ে হৃদয় ছুটেছে’: পথিক রবীন্দ্রনাথ গত পর্বের পর থেকে

৫.

কিন্তু তার জীবনের সেরা ভ্রমণটি ছিলো নিজ দেশেই, বাংলা-ভূমিতে—সময়, সৃষ্টি এবং স্মৃতিঝরার বিবেচনায়। এখানেই মূলত প্রথমবারের মতো প্রকৃত পান্থজন হয়ে ওঠেন তিনি। কারণ কী ছিল তার, যার জন্য নিজ দেশকে দেখেই আত্মহারা হয়ে পড়লেন তিনি?

পথিকের কাছে ভ্রমণের জন্য সেই স্থানই প্রিয় হয়ে ওঠে যেথায় মেলে অবসর, নির্জনতা, একাকিত্ব, নৈসর্গিক উপাদানের স্বাচ্ছন্দ্য সমাবেশ, প্রাকৃতিক অনুকূলতা, স্বাস্থ্যকর পরিবেশ, রুচিশীল ও পছন্দসই খাবার, দিনরাতের ঔদার্য, মানুষের সারল্য, কাজের সুষ্ঠুতা, প্রাকৃতিক বিস্তার, ভাবনার নিত্যনতুন খোরাক, সৃষ্টিশীলতার অবাধ আগমন, প্রাত্যহিকতার দায়মোচন, পিছুটানহীনতা ইত্যাদি ইত্যাদি। আর যা পথিকের অন্তরে সৃষ্টি করে এক লোকোত্তর স্মৃতির—যে-স্মৃতি উতল-করা, হ্লাদিনী; যে-স্মৃতি অনৈচ্ছিক। এর সবকটিই যে রবীন্দ্রনাথ পূর্ববঙ্গে, বিশেষত শিলাইদহ-সাজাদপুর-পতিসরকেন্দ্রিক পূর্ববঙ্গ ভ্রমণে পেয়েছিলেন, তাতে সন্দেহ নেই কোনো। প্রকৃতপক্ষে এখানেই তিনি প্রথমবারের এবং সম্ভবত শেষবারের মতো হয়ে ওঠেন মানসপথিক, নিজেকে ভাবতে পারলেন দলছাড়া: আপন মনের ভাবনাগুলো আর অখণ্ড অবসরকে নিয়ে মাঠের মধ্যে স্থানকালহীন হয়ে বেড়ানো, সন্ধ্যাকালে মাথা নীচু করে ধীরে ধীরে বেড়ানো। পথিকমনের বিচ্ছিন্নতা বা বিবিক্তিকে উপলব্ধি করলেন তিনি, বললেন, মানুষের সংসর্গ তাকে উদ্ভ্রান্ত করে দেয়, মানুষের ঘনিষ্ঠতা তার পক্ষে দুঃসহ।

শিলাইদহ বিষয়ক ভ্রমণ যেন তার জীবন ও সৃষ্টিকেই আমূল পাল্টে দিল। বিদেশে ভ্রমণ পথিককে চমৎকৃত করে, মুগ্ধও করে, কিন্তু নিজ দেশের ভ্রমণ, তা যদি হয় আত্মার পরিক্রমণ ও সঞ্চরণতায় পূর্ণ, তবে তার তুল্য ভ্রমণ পথিকের আর হয় না। কেননা এর মাধ্যমে পথিক পায় তার খাঁটি প্রতিস্বর খুঁজে পায়। পূর্ববঙ্গ যেন তাকে নিজের সঙ্গেই পরিচয় করিয়ে দিলো, খুলে দিলো তাকে এক মনের গাড় কুহুতান। আত্মা যেন হেঁটে বেড়ালো প্রকৃতির স্পষ্ট-অস্পষ্টতায়, আলোছায়ার স্ফুট ও অস্ফুটতার আবহে, আর খুঁজে নিলো অস্তিত্বের নির্যাস। কোনো কোনো স্মৃতি সারা জীবনের অর্জন হয়ে যায়, সৃষ্টি করে যায় আপন লীলায়, ব্যক্তিকে পরিণত করে সত্তায়, তার অস্তিত্বকে করে তোলে নিত্য-অনিত্যের কারিগর। শিলাইদহের স্মৃতি যেন রবীন্দ্রনাথের জন্য তা-ই করেছিল। তার প্রধান সৃষ্টিক্ষেত্রের—সাহিত্য, সংগীত এমনকি চিত্রকলা—সব জায়গাতেই এ ভূগোল পরিণত হয়েছিল এমন দাঢ্যতায় যেন রূপ আর অস্তিত্ব একাকার হয়ে শুধু মহিমা আত্মপ্রকাশ করে। ‘নিজেকে জানো’র পাশাপাশি ‘নিজেকে জানাও’-র কথাও তিনি বলেছিলেন, এই ভ্রমণ দুটোকেই করে তুলেছিল পুষ্ট।

পিতার সঙ্গে প্রথম রবীন্দ্রনাথ শিলাইদহে আসেন ১৮৭৫ সালের ডিসেম্বরে, কিছুদিন অবস্থান করেন সেখানে, কিন্তু ওই ভ্রমণটি হয়ে ওঠেনি বিশেষত্বময়। কিন্তু পরের বছরই আবার তিনি যান শিলাইদহে, ‘আকাশে বাতাসে চ’রে বেড়ানো মন’-এর খোরাকের জন্য, আর এ বাসনা যে পূর্ণ হয়েছে বলাই বাহুল্য। অবস্থানের অনুভূতি ছিল কাব্যিক: ‘একলা থাকার মন নিয়ে আছি...উড়ো ভাবনা ভাবছি তো ভাবছিই।...খাতা ভরে উঠতে আরম্ভ করেছে পদ্যে।’ ফুলের রঙিন রস দিয়ে কবিতা লেখার যে-শখ তার ছিল, তার ব্যাপক বাস্তবায়নে হাস্যকরভাবে তৎপর হলেন তিনি সেখানে। মন হয়ে উঠল প্রকৃত অর্থেই আহ্লাদিত, এবং রাগিণীময়। এ ভ্রমণ তাকে দিলো স্বাধীনতা, দিলো বন্ধনমুক্তি, যা আগে কখনো তিনি পাননি।

বাংলার সৌম্য রূপ, ঠিক স্থবির নয় তবে গতিকে নিয়েও যেন কোথায় মন্দ্র এবং বিলম্বিত, কোথায় যেন প্রকৃতির নির্লিপ্ত কথকতা, বটপাতার হাওয়াচল, শালিখের বলবৎ, শস্যদানার নৈকট্য, নদীর অনন্তগামিতা, ফলন্ত শস্যের নান্দীমুখ, আর সাধারণ মানুষের ত্রিসন্ধ্যার সুখদুঃখ। সমভূমির দিগন্তবিস্তৃতি, জলের ব্যাপ্তি ও সৌন্দর্য, এবং লোকজীবনের সাধনা ও সংগীত, এসব কারণেই শিলাইদহকেন্দ্রিক তার পরের ভ্রমণগুলো হয়ে উঠেছিলো আরো তীব্র, সংরাগমুখর এবং সৃষ্টিশীল। ছিন্নপত্রাবলীতে তিনি তাই নানা ছলে প্রকাশ করেছেন তার আকুলতা এবং ভালোবাসা। সমগ্র রবীন্দ্রসাহিত্যে অনুভূতির সত্যসন্ধানের ভোরের শেফালি বা সন্ধ্যামণির প্রকাশস্বাচ্ছন্দ্যের মতো যে প্রাবল্য দেখা দেয়, তা আসলে তার স্মৃতির অবলোকন এবং অবলেপন। পথিক হিসেবে রবীন্দ্রনাথ স্মৃতিই সঞ্চয় করেছেন বলা যায়, সে-স্মৃতিই তার নামে লিখে গেছে বস্তুত।

অনেকবার শিলাইদহে এসেছেন রবীন্দ্রনাথ, একা ও পরিবারসমেত। প্রতিবারই নতুন প্রাপ্তিতে তিনি উৎফুল্ল হয়ে পড়েছিলেন। আবিষ্কার করেছেন অন্য সৌন্দর্য, প্রকৃতির ভাবরূপ, পৃথিবীর মন্থরতা, আত্মউদাসীনতা এবং অলসগামিতার আনন্দকে। নিঃসঙ্গ চরের ওপর ‘রাতে শত সহস্র নক্ষত্রের নিঃশব্দ অভ্যুদয়’কে প্রত্যক্ষ করেছেন কখনো, কখনো শিখেছেন জার্মান, পড়ছেন ফাউস্ট বা হাইনে, লিখেছেন ছোটোগল্প বা কবিতা। সাজাদপুরে এসে আবিষ্কার করেন বিস্মৃত জগতের নিস্তব্ধ নদীতীর। শিলাইদহে লিখতে শুরু করেন সোনার তরী কাব্য। এখানেই তিনি নিজেকে বিবিক্তির মধ্যে, আদিমতার মধ্যে আবিষ্কার করেন, যাপনের মেকিপনা থেকে বের হওয়ার জন্য ছটফট করতে থাকেন, ইন্দিরা দেবীকে পত্রে লিখে বসেন: এ-সব শিষ্টাচার আর ভালো লাগে না—আজকাল প্রায় বসে বসে আওড়াই— ‘ইহার চেয়ে হতেম যদি আরব বেদুইন!’ বেশ একটা সুস্থ সবল উন্মুক্ত অসভ্যতা! দিনরাত্রি বিচার আচার বিবেক বুদ্ধি নিয়ে কতকগুলো বহুকেলে জীর্ণতার মধ্যে শরীর মনকে অকালে জরাগ্রস্ত না করে একটা দ্বিধাহীন চিন্তাহীন প্রাণ নিয়ে খুব একটা প্রবল জীবনের আনন্দ করি। এখানেই তিনি পেয়ে যান তার নির্জনের প্রিয় বন্ধু আমিয়েলস জার্নাল-এর, যা তাকে আপ্লুত করে রাখে। অঁরি ফ্রেদেরিক আমিয়েল-এর জন্ম জেনেভায়, ১৮২১ সালের সেপ্টেম্বরে। ১৮৮২ সালের ডিসেম্বরের শেষদিকে তার জার্নাল ইনটাইম-এর প্রথম খণ্ড জেনেভা থেকে ফরাসি ভাষায় প্রকাশিত হয়। ইংরেজিতে জার্নালটি প্রথম অনুবাদ হয়ে প্রকাশিত হয় ১৮৮৭ সালে। রবীন্দ্রভবনে সংরক্ষিত বইটির ইংরেজি অনুবাদক মিসেস হামফ্রে ওয়ার্ড, প্রকাশক: লন্ডন/ম্যাকমিলান অ্যান্ড সি. কিউ./ নিউ ইয়র্ক/ ১৮৮৯। রবীন্দ্রনাথ তার বন্ধু লোকেন্দ্রনাথ পালিতের কাছ থেকে বইটি পেয়েছিলেন। আমিয়েল ছিলেন এক নিঃসঙ্গ মানুষ, তিনি তার এই জার্নালে তার ব্যক্তিগত এবং অন্তরঙ্গ ভাবনাকে তুলে ধরেন। এই ভাবুক নিজের অন্তর্গত জীবনের বিষয়ে সচেতন হয়ে পড়েছিলেন, তিনি তার দুর্বলতা ও ব্যর্থতার এক স্বীকারোক্তি এই জার্নালে প্রকাশ করেন। ‘জীবন প্রতিদিনকার দ্রোহ আর সমর্পণের দোলন ছাড়া কিছুই না’, ‘ঈশ্বরকে পাওয়াই একমাত্র প্রয়োজন’, ‘বুড়ো হওয়া মৃত্যুর চেয়েও কঠিন কাজ’, ইত্যাদি আকর্ষণীয় কথাবার্তায় ঠাঁসা তার এই জার্নাল। ৭ ফেব্রুয়ারি ১৮৭২ তারিখের ভুক্তিতে দেখা যায় তিনি লিখেছেন, ‘বিশ্বাস ছাড়া একজন মানুষ কিছুই করতে পারে না। কিন্তু বিশ্বাস-বিজ্ঞানকে দমবন্ধ করে রাখে।...কোনোরকম প্রমাণ ছাড়াই বিশ্বাস এক মানসিক নিশ্চিন্তি। মানসিক নিশ্চিন্তি বলে তা কর্মপ্রক্রিয়ার এক প্রাণবন্ত নীতিবোধ।’ তো এই নিঃসঙ্গ প্রতিভার একাকিত্বময় উচ্চারণ বোধহয় ভালো লেগেছিলো রবীন্দ্রনাথের। আবার তার অতি দুঃখময় উচ্চারণ আবার রবীন্দ্রনাথের জন্য নতুন ভাবনা জুগিয়েছিল; তিনি যখন বলেন, ‘সবকিছুর পরে থাকে শুধু বিষণ্ণতা, যেমন সব নদীর গন্তব্য সমুদ্র’, তখন আশাবাদী রবীন্দ্রনাথের তা ভালো না-লাগারই কথা। সম্ভবত ছিন্নপত্রবলীর পত্রগুলো লেখার সময় আমিয়েলের জার্নাল পরোক্ষ প্রভাব রেখেছিল রবীন্দ্রনাথের মনে। আর জার্নাল এবং পত্রাবলি দুজনের আন্তরভ্রমণের এক শব্দরূপ যা উৎকর্ষে ও মনোব্যঞ্জনায় অসাধারণ।

শিলাইদহ-সাজাদপুর-পতিসরকেন্দ্রিক পূর্ববঙ্গভ্রমণের মানসচিত্র এবং মনোগতিভঙ্গি আমরা পাই ছিন্নপত্রাবলীর চিঠিগুলোতে, যা রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন ভ্রাতুষ্পুত্রী ইন্দিরা দেবীকে। চিঠিগুলোতে তার মনোচ্ছ্বাস, ভাবোন্মেষ এবং বাহ্যিক প্রকৃতির অন্তরের সঙ্গে তার অন্তরের প্রকৃতির একাত্মতা এমনভাবে বিভাসিত যে রবীন্দ্রনাথের চিত্তের নিরন্তর গতায়াতের ছবি যেন অসাধারণরূপে বাক্সময়তা পেয়েছে । তিনি যে মুক্ত হতে চাচ্ছেন বা হচ্ছেন, তিনি যে আত্মস্থ হতে চাইছেন বৃহতের সাথে, তিনি যে প্রকৃতির মন্থরতা এবং অদৃশ্য গতিভঙ্গির সাথে মানিয়ে নিচ্ছেন, তিনি যে আলস্যকে উদ্যাপন করছেন, এর আন্তরিক এবং মনস্তাত্ত্বিক বিবরণ ফুটে উঠেছে। ইংল্যান্ডে ভ্রমণের সময় তিনি বিস্তীর্ণতার সীমাবদ্ধতা দেখেছিলেন, তা যে নিজ দেশে নেই, এই উপলব্ধি তাকে প্রাণপ্রদ করে তুলেছে। চলবে

//জেডএস//
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
সাদি মহম্মদ: ভাইয়ের কান্না, বন্ধুর স্মৃতি, সতীর্থদের গানে স্মরণ…
সাদি মহম্মদ: ভাইয়ের কান্না, বন্ধুর স্মৃতি, সতীর্থদের গানে স্মরণ…
খালি বাসায় ফ্যানে ঝুলছিল কিশোরী গৃহকর্মীর লাশ
খালি বাসায় ফ্যানে ঝুলছিল কিশোরী গৃহকর্মীর লাশ
গরমে রেললাইন বেঁকে যাওয়ার শঙ্কায় ধীরে চলছে ট্রেন
গরমে রেললাইন বেঁকে যাওয়ার শঙ্কায় ধীরে চলছে ট্রেন
মন্দিরে সেলফি তুলতে গিয়ে প্রদীপে দগ্ধ নারীর মৃত্যু
মন্দিরে সেলফি তুলতে গিয়ে প্রদীপে দগ্ধ নারীর মৃত্যু
সর্বাধিক পঠিত
পুলিশের সব স্থাপনায় নিরাপত্তা জোরদারের নির্দেশ
পুলিশের সব স্থাপনায় নিরাপত্তা জোরদারের নির্দেশ
সরকারি না হলেও সলিমুল্লাহ কলেজে অধ্যাপক ১৪ জন
সরকারি না হলেও সলিমুল্লাহ কলেজে অধ্যাপক ১৪ জন
মৌসুমের সব রেকর্ড ভেঙে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা চুয়াডাঙ্গায়
মৌসুমের সব রেকর্ড ভেঙে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা চুয়াডাঙ্গায়
এগিয়েছে ‘ওমর’, চমকে দিলো ‘লিপস্টিক’!
ঈদের ছবিএগিয়েছে ‘ওমর’, চমকে দিলো ‘লিপস্টিক’!
কুষ্টিয়ায় এযাবৎকালের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা
কুষ্টিয়ায় এযাবৎকালের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা