X
মঙ্গলবার, ১৯ মার্চ ২০২৪
৫ চৈত্র ১৪৩০

নাইপলের গল্প ও গল্পপাঠ

অনুবাদ ও আলোচনা : মোজাফফর হোসেন
১০ নভেম্বর ২০১৫, ১২:১০আপডেট : ০৭ ডিসেম্বর ২০১৫, ০০:০১

cover

ভি. এস. নাইপল আগামি ১৯-২১ নভেম্বর অনুষ্ঠিতব্য ঢাকা লিটারেরি ফেস্টিভ্যালে যোগ দিতে ঢাকায় আসছেন। এ উপলক্ষ্যে বাংলা ট্রিবিউনের বিশেষ আয়োজনে তাঁর লেখা বা তাকে নিয়ে লেখা প্রকাশ করা হবে।

 

বি. ওয়ার্ডসওয়ার্থ || ভি. এস. নাইপল

প্রায় তিনজন করে ফকির প্রতিদিনই নিয়ম করে আমাদের মিগুয়েল স্ট্রিটের বাড়িটায় আসতো। দশটার দিকে ধুতি ও সাদা জ্যাকেট পরিহিত একজন ভারতীয় আসলো, আমরা তাকে এক মগ চাল দিয়ে বিদায় করলাম। বারোটার দিকে একজন বয়স্ক মহিলা আসলো, এক টাকা নিয়ে চলেও গেল। দু’টার দিকে এক অন্ধ ভিখারি একটা ছোট বালককে লাঠি বানিয়ে হাজির হলো, তাকেও এক টাকা দিয়ে বিদায় করলাম। মাঝে মধ্যে কিছু ধূর্ত প্রকৃতির ভিক্ষুক আসতো। একদিন এক ভিখারি দরজায় বাড়ি দিয়ে বলল যে, সে খুব ক্ষুধার্ত। আমরা তাকে খেতে দিলাম। তারপর সে একটা সিগারেট চাইলো এবং ততক্ষণ নড়লো না যতক্ষণ না আমি তার সিগারেটে আগুন লাগিয়ে দিলাম। তাকে আর কোনদিন দেখা যায়নি। একদিন বিকেল চারটার দিকে আজব প্রকৃতির একজন মানুষ দরজায় এসে দাঁড়াল। আমি সবে স্কুল থেকে ফিরেছি।
‘শোনো বাবা, আমি কি একটু ভিতরে আসতে পারি?’ সে আমাকে বলল। লোকটি বেশ খাট, পরনে ছিল সাদা শার্ট ও কালো ট্রাউজার। মাথায় টুপি।
আমি জিজ্ঞেস করলাম, আপনি কি চান?
‘আমি তোমাদের মৌমাছিগুলো একবার দেখতে চাচ্ছিলাম।’ সে বলল।
আমাদের উঠোনে চারটি পাম গাছ ছিল, সেখানে বেশ কয়েকটি মৌমাছির চাক ছিল। আমি ঘরের দিকে কয়েক পা এগিয়ে চেঁচিয়ে বললাম– মা, গেটে একজন লোক আছে, সে বলছে যে সে আমাদের মৌমাছিগুলো একবার দেখতে চায়!
মা ঘর থেকে বেরিয়ে এসে লোকটিকে একবার দেখে নিয়ে কর্কশ গলায় বললেন– ‘কি চাওয়া হয়?’
‘আমি আপনাদের মৌমাছিগুলো একবার দেখতে চাচ্ছিলাম।’ লোকটি বলল।
তার ইংরেজি ছিল খুব গোছানো। বোঝায় যাচ্ছিল এটা তার মাতৃভাষা না। মাকে বেশ চিন্তিত মনে হলো। মা আমাকে বললেন– ‘যতক্ষণ উনি থাকেন, তুমি এখান থেকে একপাও নড়বে না।’
‘ধন্যবাদ ম্যাডাম! আপনার অশেষ মেহেরবানী।’ সে খুব ধীরে ধীরে গুছিয়ে কথাটা বলল, যেন প্রতিটা শব্দ তার টাকা দিয়ে কেনা! আমরা পাম গাছের নিচে হাঁটুর উপর ভর দিয়ে বসে প্রায় এক ঘণ্টা ধরে মৌমাছিগুলো দেখলাম।
‘মৌমাছি দেখতে আমার বেশ ভালো লাগে। তা, তোমার কেমন লাগে?’ লোকটি বলল।
আমার অত সময় নেই। বললাম আমি।
সে গম্ভীরভাবে মাথা ঝাঁকালো। ‘আমি এই কাজটিই করি। এটা-ওটা দেখতে আমার খুব ভালো লাগে। শুধু পিঁপড়ে দেখতে দেখতেই আমি দিনের পর দিন কাটিয়ে দিতে পারি। তুমি কি কখনও পিঁপড়েদের লক্ষ করে দেখেছ? কিংবা মাকড়সা, কেন্নোই– এদেরকে ভালো করে দেখছ?’
আমি মাথা নাড়ালাম। আপনি আসলে কি করেন, বলুন তো?
তিনি উঠে দাঁড়ালেন– ‘আমি কবি।’
‘খুব ভালো কবি?’ আমি কোন রকম ভণিতা না করেই জানতে চাইলাম।
‘পৃথিবীর সব চেয়ে বড় কবি।’ সে অকপটে বলল।
আপনার নামটা কি একবার বলবেন?
‘বি. ওয়ার্ডসওয়ার্থ।’
‘বি মানে কি বিল?’
‘ব্লাক। ব্লাক ওয়ার্ডসওয়ার্থ। সাদা ওয়ার্ডসওয়ার্থ ছিলেন আমার ভাই। আমাদের হৃদয় ছিল একটাই। আমি খুব খুদে একটা ফুলকেও সকালের মতোই শুভ্র ও মহৎ মনে করি, এবং সেটা দেখে আমার কান্না পায়।’
কেন? এতে কান্না পাওয়ার কি আছে? আমি জিজ্ঞেস করলাম।
‘বুঝলে না বালক! তুমি যখন বড় হবে তখন বুঝবে। তুমিও যে একজন কবি, তুমি কি জানো সেটা? এবং একজন কবি যখন তখন যে কোনও কারণে কাঁদতে পারে!’
আমি না হেসে আর পারলাম না!
‘তুমি তোমার মাকে পছন্দ করো?’ সে জানতে চাইলো।
হুম, তবে যখন সে আমাকে মারে না, তখন।
সে তখন তার পেছনের পকেট থেকে একটা প্রিন্টেড কাগজ বের করে বলল– ‘এই কাগজে মাকে নিয়ে লেখা পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ কবিতাটি আছে। আমি এটা বিক্রি করবো। কোনও দরদস্তুর চলবে না, একদাম– চার টাকা।’
আমি ভেতরে গিয়ে মাকে বললাম– মা, তুমি কি চার টাকা দিয়ে একটি কবিতা কিনবে?
মা রেগে গিয়ে গলার লাগাম ছেড়ে বলল– ‘ওই ফালতু লোকটাকে গিয়ে বল, ও যদি এখনই আমার সীমানা থেকে বেরিয়ে না যায়, আমি তার লেজ টেনে ছিঁড়ে ফেলব; কি, কানে যায় আমার কথা?’
আমি বাইরে এসে বি. ওয়ার্ডসওয়ার্থকে বললাম– মার কাছে এখন চার টাকা নেই।
বি. ওয়ার্ডসওয়ার্থ বলল– ‘এখানেই তো কবির ঐতিহাসিক পরাজয়!’
তারপর সে তার কাগজটি পূর্বের স্থানে রেখে দিল। সে মার কথায় কিছু মনে করেছে বলে মনে হলো না।
আমি বললাম– এভাবে কবিতা বিক্রি করে বেড়ানোটা কি ভালো দেখায়? শুধুমাত্র ক্যালিপসনিয়ানরা এই কাজ করে বেড়ায়। খুব বেশি কি বিক্রি হয়?
‘এখন পর্যন্ত এক কপিও হয়নি।’
তাহলে আপনি এই ভাবে ঘুরে ঘুরে কবিতা বেচে বেড়াচ্ছেন কেন?
‘এর ফলে আমি অনেককিছু দেখার সুযোগ পাই। এবং আমি সবসময় কবিদের সাথে সাক্ষাৎ করতে চাই।’
আপনি কি সত্যি সত্যিই আমাকে কবি মনে করেন?
‘তুমি আমার চেয়ে কোনও অংশে কম নও।’ তিনি উত্তরে বললেন।
যখন বি. ওয়ার্ডসওয়ার্থ চলে গেলেন, আমি মনে মনে প্রার্থনা করলাম যেন তার সাথে আবার আমার সাক্ষাৎ ঘটে।

এক সপ্তাহ পরে, আমি যখন স্কুল থেকে ফিরছিলাম তখন মিগুয়েল স্ট্রিটের এক বাঁকে তার সাথে দেখা হয়ে গেল।
‘আমি অনেকক্ষণ থেকে তোমার জন্যে এখানে অপেক্ষা করছি।’
এ কয়দিনে একটা কবিতাও কি বিক্রি করতে পারলেন? আমি জানতে চাইলাম।
সে মাথা নাড়াল। বলল– ‘আমার আঙিনায় এই অঞ্চলের শ্রেষ্ঠ আম গাছটি রয়েছে। এখন গাছটিতে আম পেকে টসটস করছে। আমি তোমাকে আম খাওয়ার দাওয়াত দিতে এসেছি।’
সে আলবার্তো স্ট্রিটের এক মোড়ে এক কক্ষ বিশিষ্ট একটি বাসায় বসবাস করত। বাড়ির সামনেটা সবুজে ভরা। সেখানে বিশাল একটি আম গাছ আছে, আর আছে নারিকেল ও তাল গাছ। জায়গাটি জঙ্গল হয়ে আছে, দেখে মনে হচ্ছে, শহরের বাইরে কোথাও এসেছি। এখান থেকে রাস্তার ওপারের বিশাল বিশাল দালানকোঠাগুলো দেখা দুষ্কর ব্যাপার।  
সে একটুও বাড়িয়ে বলেনি, আমগুলো সত্যিই চমৎকার। আমি প্রায় আটটা সাবাড় করে ফেললাম। আমের হলুদ রস আমার কনুই চুইয়ে জামায় লেগে গেল। আমি যখন বাড়ি ফিরলাম, মা বললেন– ‘এতক্ষণ কোথায় ছিলে, হতচ্ছাড়া? মনে করেছ খুব বড় হয়ে গেছ, যেখানে খুশি যেতে পারবে, তাই না? যাও, আমার জন্যে একটি কঞ্চি কেটে আনো।’
তিনি আমার কাটা কঞ্চি দিয়ে আমাকেই পেটালেন– আচ্ছা পিটুনি পেটালেন! আমি কাঁদতে কাঁদতে রেগেমেগে বাড়ি থেকে বের হয়ে আসলাম। প্রতিজ্ঞা করলাম– আর কিছুতেই বাড়ি ফিরব না। বি ওয়ার্ডসওয়ার্থ-এর বাড়িতে গেলাম। আমার নাক রাগে লাল হয়ে গিয়েছিল।
বি. ওয়ার্ডসওয়ার্থ বলল– ‘কান্না এবার থামাও। চল কোথাও ঘুরে আসি।’
আমি কান্না থামিয়ে দিলাম। তখনও বেশ জোরে জোরে নিঃশ্বাস নিচ্ছিলাম। আমরা হাঁটতে বের হলাম। এস. টি. এভিনিউ এর ভেতর দিয়ে সাভান্নাহ হয়ে রেসকোর্সে চলে গেলাম।
বি. ওয়ার্ডসওয়ার্থ বলল– ‘আসো, দু’জনে ঘাসের উপর চিৎ হয়ে শুয়ে আকাশ দেখি। আর আমি চাই যে তুমি এখন চিন্তা করে দেখবে ঐ তারাগুলো আমাদের থেকে কত দূরে অবস্থান করছে।’
তার কথা মতো আমি কাজ শুরু করলাম। তার উদ্দেশ্যটা একটু পরেই পরিষ্কার হল। নিজেকে খুব হালকা মনে হচ্ছিল। এবং একই সাথে খুব মহান আর বিশাল মনে হচ্ছিল, ঠিক ঐ আকাশটার মতন; জীবনে আর কখনো কোনোদিন এই অনুভূতি হয়নি। আমি আমার সমস্ত ক্রোধ, অশ্রু ও আঘাতকে ভুলে গেলাম। যখন আমি বললাম যে, আমি খুব ভালো অনুভব করছি, সে তখন এক এক করে তারাদের নাম বলতে লাগল। সহসা একটা টর্চের আলো এসে আমাদের মুখের উপর পড়ল। দেখলাম– পুলিশের লোক, ঘাস থেকে উঠে দাঁড়ালাম।
‘তোমরা এখানে কি করছ?’ পুলিশটি জিজ্ঞেস করল।
বি. ওয়ার্ডসওয়ার্থ উত্তরে বলল– ‘নিজেকে আমি চল্লিশ বছর ধরে এই একই প্রশ্ন জিজ্ঞেস করে ফিরছি।’

আমরা খুব দ্রুত বন্ধু হয়ে গেলাম। সে আমাকে বলল– ‘তুমি কাউকে কখনও আমার সম্পর্কে বলবে না। আমার ঐ গাছগুলো সম্পর্কেও না। সমস্ত বিষয়টা গোপন রাখবে। কাউকে বললেই আমি কিন্তু ধরে ফেলব, কারণ আমি কবি।’
আমি তাকে কথা দিয়েছিলাম, এবং আজ অবধি আমি আমার কথা রেখেছিলাম। তার ছোট্ট কক্ষটি আমার ভালো লাগতো। এত সুন্দর, গোছানো ও পরিষ্কার! তবে বেশ নিঃসঙ্গ দেখাত। একদিন আমি জিজ্ঞেস করলাম– আপনি উঠানের আবর্জনাগুলো কেটে ফেলেন না কেন? এটা তো জায়গাটাকে আরও স্যাঁতস্যাঁতে করে তুলছে, তাই না?
‘শোনো, তোমাকে তাহলে ঘটনাটা বলেই ফেলি– একদা একটা মেয়ে আর একটা ছেলের সাক্ষাৎ ঘটলো এবং তারা পরস্পরের প্রেমে পড়ে গেল। কাজেই তারা বিয়ে করে ফেলল। ছেলেটি শব্দ বুনতে ভালোবাসতো, আর মেয়েটি ভালোবাসতো ঘাস, ফুল এবং গাছপালা। তারা একটি কক্ষে বেশ সুখেই দিন যাপন করছিল। তারপর একদিন মেয়ে কবিটি ছেলে কবিকে বলল– আমরা পরিবারে আর একজন কবিকে পেতে চলেছি। কিন্তু সেই কবির আর জন্ম হয়নি; কারণ মেয়েটি মারা গেল। এবং শিশু কবিটি মায়ের সাথে, মায়ের ভেতরে সমাধিস্থ হলো। ছেলেটি খুব কষ্ট পেল। সে প্রতিজ্ঞা করল যে, বাগানের একটি জিনিসও সে আর কোনোদিন স্পর্শ করবে না। কাজেই, বাগানটি রয়ে গেল, বেড়ে উঠল, তারপর একসময় জঙ্গলে পরিণত হলো।’ বি. ওয়ার্ডসওয়ার্থ গল্পটি এখানেই শেষ করলো।
আমি মুগ্ধ হয়ে তার দিকে তাকালাম। তাকে আরও বয়স্ক দেখাচ্ছিল। আমি তার গল্পটি বুঝতে পারলাম। আমরা সেদিন দীর্ঘ পথ হেঁটেছিলাম। বোটানিক্যাল গার্ডেনে গেলাম, তারপর গেলাম রক গার্ডেনে। সন্ধ্যের আগ দিয়ে চ্যান্সেলর হিলে উঠলাম, দেখলাম– সমস্ত জায়গাটাকে অন্ধকার কেমন করে গিলে ফেলল। তারপর আবার শহরের বাতিগুলো শহরটাকে অন্ধকারের হাত থেকে উদ্ধার করল। সে প্রত্যেকটি কাজ এমন মনোযোগ দিয়ে করত, মনে হত যেন জীবনে প্রথম সেই কাজটি করছে। আর মনে হত, যেন ঈশ্বরের উদ্দেশ্যে সবকিছু করছে। সে আমাকে বলত– ‘এখন এককাপ আইসক্রিম খেলে কেমন হয়?’ এবং আমি যখন বলতাম– মন্দ হয় না। সে খুব গম্ভীর হয়ে বলত– ‘এখন আমরা কোন দোকানের সেবা গ্রহণ করব?’ যেন এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটা বিষয়। সে এটা নিয়ে কিছুক্ষণ চিন্তা করে বলত– ‘আমার মনে হয়, ওই দোকানের সাথে এ ব্যাপারে আলোচনায় বসা যেতে পারে!’ তখন পৃথিবীকে আমার খুব উপভোগ্য বলে মনে হত।

একদিন, যখন আমি তার উঠানে দাঁড়িয়ে ছিলাম, আমাকে বলল– ‘আমার খুব গোপন একটা বিষয় আজ তোমাকে বলব।’
খুব কি গোপন কিছু?– আমি জানতে চাইলাম।
‘এই মুহূর্তে তা তো বটেই।’
আমি তার দিকে তাকালাম। এবং সেও আমার দিকে তাকাল। আমি ভেতরে ভেতরে বেশ শিহরিত হলাম। সে বলল– ‘মনে রেখো, এটা শুধু তোমার আর আমার ভিতরে। একটি কবিতা লিখছি।’
ওহ, সেই কথা! বেশ হতাশ হলাম শুনে। আমি আরও গুরুত্বপূর্ণ কিছু শোনার অপেক্ষায় ছিলাম।
‘কিন্তু এটা ভিন্ন ধাঁচের একটি কবিতা।’ সে বলল। ‘এটা পৃথিবীর সব থেকে মহৎ একটি কবিতা।’
আমি শিষ দিলাম।  
সে বলে চলে– ‘এটা নিয়ে আমি পাঁচ বছরেরও বেশি সময় ধরে কাজ করছি। আজ থেকে বাইশ বছর পরে কবিতাটি শেষ করব। তবে সেটা সম্ভব হবে আমি যে গতিতে এখন লিখছি সেটা ধরে রাখতে পারলে।’
তুমি তাহলে প্রচুর লেখ? আমি বললাম।
‘এখন আর না। এখন আমি প্রতি মাসে একটা করে লাইন লিখি। তবে নিশ্চিত করি যেন ওটাই শ্রেষ্ঠ লাইন হয়।’
গত মাসের শ্রেষ্ঠ লাইনটা কি? আমি জানতে চাইলাম।
সে আকাশের দিকে তাকাল, তারপর বলল– ‘অতীত বড় গভীর, বিষণ্নময়।’
বেশ ভালো লাইন। আমি বললাম।
‘আমি আমার একটি মাসের সমস্ত অভিজ্ঞতাকে জ্বালিয়ে কবিতার একটি লাইনে ঘনিভূত করতে চাই। কাজেই, বাইশ বছর পরে আমি যে কবিতাটি লিখব সেটা বিশ্ব-মানবতার সঙ্গীত হয়ে উঠবে।’
আমি বেশ বিস্মিত হলাম।
আমাদের হাঁটা চলতেই থাকল। একদিন ডকসাইটে সি-ওয়ালের পাশ দিয়ে হেঁটে যাওয়ার সময় আমি বললাম– ওয়ার্ডসওয়ার্থ, যদি আমি এই পিনটি পানিতে ফেলে দিই, তোমার কি ধারণা এটি ভেসে থাকবে?
‘পৃথিবীটা বড় আজব। ওটা ফেলে দাও, দেখি কি ঘটে!’
পিনটি ঢুবে গেল।
আমি বললাম– এ মাসের লাইনটি কতদূর?
সে আর কোনও লাইন শোনায়নি। শুধু বলত– ‘এই তো চলে এসেছে...হয়ে যাবে...।’
আমরা তখন সি-ওয়ালের উপরে বসে যাত্রীবাহী জাহাজগুলোকে বন্দরে ভিড়তে দেখতাম। পৃথিবীর সেই শ্রেষ্ঠ কবিতাটি আমার আর শোনা হয়নি।
আমার মনে হত, সে একটু জলদিই বুড়িয়ে যাচ্ছে।
তুমি কিভাবে বেঁচে আছ?– একদিন জানতে চাইলাম।
‘মানে, তুমি বলতে চাইছ আমি কিভাবে আয় রোজগার করি, তাই তো?’
আমাকে তোতলাতে দেখে সে মুচকি হেসে বলল–
‘আমি ক্যালিপসোর সময়ে ক্যালিপসো গেয়ে বেড়াই।’
তাতেই তোমার হয়ে যায়?
‘খুব ভালো মতোই।’
কিন্তু তুমি যখন পৃথিবীর বিখ্যাত কবিতাটি লেখা শেষ করবে তখন তো তুমি বেশ ধনী হয়ে যাবে?
সে কোনও উত্তর দিলো না।

একদিন তাকে আমি তার সেই ছোট্ট ঘরটিতে দেখতে গেলাম। সে শুয়ে ছিল। তাকে খুব বয়স্ক আর ক্লান্ত দেখাচ্ছিল। তার এই অবস্থা দেখে আমার কাঁদতে ইচ্ছে করছিল।
‘কবিতাটি আসতে আসতে কোথায় যেন থমকে গেছে।’ সে বলল।
সে তখন জানালা দিয়ে বাইরের নারিকেল গাছটির দিকে তাকিয়ে ছিল। এমন ভাবে কথা বলছিল যেন আমার উপস্থিতি টের পায়নি। ‘যখন আমার বয়স বিশের কাছাকাছি ছিল, নিজের ভিতরে একটা শক্তি অনুভব করতাম।’ তারপর আমার চোখের সামনেই তাকে আরও বুড়িয়ে ও ক্ষয়ে যেতে দেখলাম। ‘কিন্তু, সেটা ছিল অনেক অনেক দিন আগে।’
তার কথা শুনে, সবকিছু এতটাই তীব্রভাবে আমার চেতনায় এসে ধরা দিল যে মনে হল, মা আমার গালে কষে একটা থাপ্পড় মারল। মৃত্যু তার সঙ্কুচিত হয়ে আসা মৃতপ্রায় মুখমণ্ডলে জীবন্ত হয়ে উঠলো– এটা যেন সবার জন্যেই উপস্থিত হয়েছিল।
সে আমার দিকে তাকালো, আমার চোখের অশ্রু দেখে উঠে বসল।
‘এ দিকে এসো।’ সে বলল। আমি তার পায়ের কাছে হাঁটু গেড়ে বসলাম।
সে আমার চোখের দিকে তাকাল, এবং বলল– ‘তুমিও তাহলে এটাকে দেখতে পাচ্ছ? আমি জানতাম, তোমার চোখ দুটো কবির চোখ।’
তাকে একটুও চিন্তিত দেখাচ্ছিল না। তার বোকার মতো শান্ত চেহারা দেখে আমি চিৎকার দিয়ে কেঁদে উঠলাম।
সে তার শুকনো বুকে আমাকে টেনে নিল। ‘তুমি কি চাও যে আমি তোমাকে এখন একটা মজার গল্প বলি?’ তারপর আমার ভেতরে উৎসাহ যোগাতে হেসে উঠল। কিন্তু আমি কোনও উত্তর দিলাম না।
সে বলল– ‘যখন আমি গল্পটি বলা শেষ করব, আমি চাই যে তুমি আমাকে ছেড়ে চলে যাবে এবং আর কোনদিন ফিরে আসবে না। তুমি এখন আমাকে প্রতিশ্রুতি দিবে।’
আমার কণ্ঠস্বর যেন রুদ্ধ হয়ে আসছিল!
সে বলল– ‘বেশ, তবে শোনো। আমি তোমাকে ঐ ছেলে কবি ও মেয়ে কবিকে নিয়ে যে গল্পটা বলেছিলাম, তোমার মনে পড়ে? ওটা সত্য ছিল না। গল্পটা আমি তোমাকে বানিয়ে বলেছিলাম। তোমাকে কবিতা এবং আমার বিখ্যাত কবিতাটি নিয়ে যে সমস্ত কথা বলেছি তাও সত্য ছিল না। এটা কি তোমার জীবনের শোনা সব থেবে মজার বিষয় হল না?’
কিন্তু তার কণ্ঠস্বর আস্তে আস্তে ক্ষয়ে যেতে লাগল।
আমি ঘর থেকে বেরিয়ে আসলাম। এবং একজন কবির মতো যা কিছু দেখলাম তাই দেখে কাঁদতে কাঁদতে বাড়ি ছুটে আসলাম।
 
এক বছর পরে এলবার্তো স্ট্রিট ধরে একাকী হেঁটে যাচ্ছিলাম। ঐ কবির বাড়ির কোনও চিহ্ন খুঁজে পেলাম না। এটা ঠিক উবেও যায়নি, মনে হচ্ছে কে বা কারা যেন এটাকে গুঁড়িয়ে ফেলেছে, এবং বেশ বড় দু’তলা একটি ভবন জায়গাটি দখল করে নিয়েছে। সেই বিশাল আম গাছটিসহ, নারিকেল ও তাল গাছটিও কেটে ফেলা হয়েছে। এখন সেখানে শুধু ইট, পাথর আর লোহা দেখা যাচ্ছে, যেন বি. ওয়ার্ডসওয়ার্থ কোনোদিনই ছিল না।

 

 

ভি. এস. নাইপল

 

গল্পপাঠ : বি. ওয়ার্ডসওয়ার্থ

ঔপনিবেশিক প্রভাব বা পোস্টকলোনিয়াল ইমপ্যাক্ট

নাম হল মানুষের পরিচয়। নামটি বাদ দিলে কোনো মানুষের নিজস্বতা বলে আর কিছু থাকে না। নাম আধুনিককালে একজন মানুষের অস্তিত্বের অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে উঠেছে। এখন লক্ষ্য করার বিষয় হল– এই গল্পে মূল চরিত্রের নামটি তার নিজের নয়। একধরনের অস্তিত্বের সংকট থেকেই চরিত্র নিজেই তার জন্য একটি নাম নির্বাচন করেছেন। তিনি যে নামটি বেছে নিয়েছেন সে নামটি তার নিজের দেশীয় সংস্কৃতির বা গোত্রের নাম নয়। তিনি বিখ্যাত ইংরেজ কবি ওয়ার্ডসওয়ার্থের নামটি নিজের জন্য নির্বাচন করেছেন। বোঝা যায়, তিনি ইনফিওরিটি কমপ্লেক্স বা হীনমন্যতায় ভুগছেন। তিনি কবি হতে চান, নিজের মতো করে নয়; তিনি ওয়ার্ডসওয়ার্থের মতো করে কবি হতে চান। মানে তিনি অন্য একজন হতে চান। নিজের অস্তিত্ব বা পরিচয় গোপন করার প্রধান উদ্দেশ্য সেটাই। কিন্তু তিনি যে সাদা চামড়ার ওয়ার্ডসওয়ার্থ হতে পারবেন না, এটিও তিনি তার মাথায় রেখেছেন। এজন্য তিনি নামের আগে বি. অর্থাৎ ব্লাক শব্দটা যোগ করে রেখেছেন। লক্ষ্য করার বিষয়, গল্পের ন্যারেটিভে মূল চরিত্রের নিজস্ব কোনো স্বর দেওয়া হয়নি। গল্পটি বয়ান করা হয়েছে প্রথম ব্যক্তির (ফার্স্ট পারসন ন্যারেটিভ) চোখে। গল্পের ন্যারেটর স্কুল পড়ুয়া এক শিশু। অর্থাৎ তিনি প্রধান চরিত্রের আসনে থেকেও নিজেকে প্রকাশ করার জন্যে একজন স্কুল পড়ুয়া বালকের ওপর নির্ভর করেছেন। পাঠক সরাসরি বি. ওয়ার্ডসওয়ার্থের ভাবনাটা জানতে পারছে না। শিশু ন্যারেটর যা বলছে, ভাবছে এবং অনুমান করছে তাই দিয়েই তাকে বুঝে নিতে হচ্ছে। এই ন্যারেটিভ টেকনিক থেকেও বোঝা যাচ্ছে, বি. ওয়ার্ডসওয়ার্থের অস্তিত্ব অন্যের কাছে গচ্ছিত।
দীর্ঘদিন ব্রিটিশ উপনিবেশ থাকার কারণে ট্রিনিদাদ বাসিন্দা বি. ওয়ার্ডসওয়ার্থের ভেতর অস্তিত্বের সংকট দেখা দিয়েছে। তার ভেতর ধারণা তৈরি হয়েছে, ইউরোপিয়ান বা সাদা চামড়ারাই শ্রেষ্ঠ। এজন্যে তিনি নিজের জন্যে নিজ দেশের বিখ্যাত কোনো কবির নাম নির্বাচন না করে উপনিবেশিক রাষ্ট্রের একজন বিখ্যাত কবির নাম নির্বাচন করেছেন। সাথে তিনি বর্ণবৈষম্যের ব্যাপারেও সচেতন। তার উত্তর-ঔপনিবেশ উপলব্ধি হল– তিনি যত ভাল কবিতাই লিখুন না কেন, তার নামের আগে ব্ল্যাক শব্দটা থেকে যাবে, এজন্যে তিনি নিজেই নিজের নামের আগে ব্ল্যাক শব্দটা জুড়ে নিয়েছেন।
গল্পের শেষে দেখা যায়, বি. ওয়ার্ডসওয়ার্থের মতো এমন ভাল ইংরেজি জানা ও কবিসত্ত্বার মানুষ মৃত্যুর পরপরই কেমন ‘নেই’ হয়ে যায়। গল্পের ন্যারেটর বালক এক বছর বাদে তার আবাসস্থানের কাছে গিয়ে দেখে, পুরানো সেই বাড়ির স্থানে বিশাল এক বহুতল ভবন গড়ে উঠেছে। এরপর সে বলে, "It was just as though B. Wordsworth had never existed."। যেখানে ইংরেজ কবি ওয়ার্ডসওয়ার্থের বাড়ি তাঁর মৃত্যুর পর জাদুঘর হিসেবে সংরক্ষন করা হয় সেখানে তাঁরই ছোটভাই হিসেবে দাবি করা কবি বি. ওয়ার্ডসওয়ার্থের এমন দশা হয়। কারণ বি. ওয়ার্ডসওয়ার্থ কবি হওয়ার চেষ্ঠা করে গেলেও শেষ পর্যন্ত আক্ষরিক অর্থে তার কবি হওয়া হয়ে ওঠে না। সে অতি সাধারণের ভিড়েই কেমন বিলীন হয়ে যায়! ওয়ার্ডসওয়ার্থের কবি হতে না পারার পেছনেও ঔপনিবেশিক শক্তি দায়ী। কেননা, গল্পে দেখা যায়, বি. ওয়ার্ডসওয়ার্থের কবিতা কেউ শোনেও, কেনেও না। এর দুটো কারণ– এক. ট্রিনিদাদের মানুষের পর্যাপ্ত অর্থ নেই। তাদের জীবনযাত্রার মান বেশ নিচু। দুই. কবিতা বোঝার মতো শিক্ষা তারা পাইনি। তারা খাতা কলমে কিছুটা শিক্ষিত হলেও মানবিক বোধে পুরোপুরি জাগ্রত নয়। এখন প্রশ্ন হল, যে দেশটি ১৭৫৭ সাল থেকে ১৯৬২ সাল পর্যন্ত পর্যায়ক্রমে স্পেন, ফ্রান্স ও ইংল্যান্ডের উপনিবেশ ছিল তারা কেন অর্থনীতি ও দীক্ষায় এত পিছিয়ে? ঔপনিবেশিক রাষ্ট্রগুলো তো তাদের নিজেদের ভাষায় ‘এনলাইট’ বা আলোকিত করতেই গিয়েছিল! বি. ওয়ার্ডসওয়ার্থের পরিণতি এমন অনেক প্রশ্নের সামনে আমাদের দাঁড় করিয়ে দেয়।

 
গল্পের ব্যাকগ্রাউন্ড

নাইপল নিজে কলোনিয়াল প্রোডাক্ট। নাইপল নিজের জাতিস্বত্তার প্রশ্নে বলেছেন, “Many-Sided Background”। এটা বলার কারণ হল, নাইপলের পরিবার ভারত থেকে ট্রিনিদাদে আসে। সেই কারণে নাইপলের জন্ম ট্রিনিদাদে হলেও তিনি আসলে ভারতীয় বংশোদ্ভূত। আবার নাইপলের যখন জন্ম তখন ট্রিনিদাদ ছিল ব্রিটিশ উপনিবেশ। ফলে তিনি হিন্দু সংস্কৃতিতে বেড়ে উঠলেও মিশেছেন-পড়াশুনা করেছেন খ্রিস্টান কম্যুনিটিতে। এরপর অক্সফোর্ডে পড়তে গিয়ে তিনি সেখানেই থেকে গেছেন।
ইংল্যান্ডে থেকে নাইপল তাঁর ট্রিনিদাদে বেড়ে ওঠার দিনগুলো নিয়ে গল্প লিখেছেন। পরবর্তীতে ১৯৫৯ সালে মিগুয়েল স্ট্রিট নামে এক গল্পসংকলনে সেই গল্পগুলো একত্রিত হয়ে প্রকাশ পায়। আলোচ্য গল্পটিও এই সংকলনের। গল্পগুলোর ন্যারেটর একজন শিশু, নাইপল নিজেও বলা যেতে পারে। তবে নাইপলের মতো যৌথ পরিবারের ছেলে এই কিশোর ন্যারেটর নয়, সে বেড়ে উঠছে শুধুমাত্র তার মায়ের সঙ্গে। চরিত্রকে চারপাশের সঙ্গে আরও বেশি জড়ানোর জন্য নাইপল এই ছোটখাটো পরিবর্তনগুলো এনেছেন। তাঁর নিজের ভাষায়– গল্পের “narrator more in tune with the life of the street than I had been.”

সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
নিয়ম ভাঙায় পয়েন্ট কাটা গেলো নটিংহ্যাম ফরেস্টের
নিয়ম ভাঙায় পয়েন্ট কাটা গেলো নটিংহ্যাম ফরেস্টের
আজকের আবহাওয়া: সব বিভাগেই ঝড়ো হাওয়াসহ বৃষ্টির পূর্বাভাস 
আজকের আবহাওয়া: সব বিভাগেই ঝড়ো হাওয়াসহ বৃষ্টির পূর্বাভাস 
রাফাহতে হামলা ভুল হবে, নেতানিয়াহুকে বাইডেনের সতর্কবার্তা
রাফাহতে হামলা ভুল হবে, নেতানিয়াহুকে বাইডেনের সতর্কবার্তা
ইসরায়েলি হামলায় হামাসের জ্যেষ্ঠ নেতার মৃত্যু: যুক্তরাষ্ট্র
ইসরায়েলি হামলায় হামাসের জ্যেষ্ঠ নেতার মৃত্যু: যুক্তরাষ্ট্র
সর্বাধিক পঠিত
সুইডেনের রাজকন্যার জন্য দুটি হেলিপ্যাড নির্মাণ, ৫০০ স্থানে থাকবে পুলিশ
সুইডেনের রাজকন্যার জন্য দুটি হেলিপ্যাড নির্মাণ, ৫০০ স্থানে থাকবে পুলিশ
পদ্মার গ্রাহকরা এক্সিম ব্যাংক থেকে আমানত তুলতে পারবেন
একীভূত হলো দুই ব্যাংকপদ্মার গ্রাহকরা এক্সিম ব্যাংক থেকে আমানত তুলতে পারবেন
সঞ্চয়ী হিসাবের অর্ধকোটি টাকা লোপাট করে আত্মগোপনে পোস্ট মাস্টার
সঞ্চয়ী হিসাবের অর্ধকোটি টাকা লোপাট করে আত্মগোপনে পোস্ট মাস্টার
‘সরলতার প্রতিমা’ খ্যাত গায়ক খালিদ আর নেই
‘সরলতার প্রতিমা’ খ্যাত গায়ক খালিদ আর নেই
দিন দিন নাবিকদের সঙ্গে কঠোর আচরণ করছে দস্যুরা
দিন দিন নাবিকদের সঙ্গে কঠোর আচরণ করছে দস্যুরা