X
মঙ্গলবার, ১৬ এপ্রিল ২০২৪
৩ বৈশাখ ১৪৩১

কবিতা || তসলিমা নাসরিন

১৩ জানুয়ারি ২০১৬, ১৫:৩০আপডেট : ১৩ জানুয়ারি ২০১৬, ১৯:১১
তসলিমা নাসরিন 
 
 
‘কবিতা পালিয়ে যাচ্ছে খলসেখালি গ্রাম থেকে অনেক দূরে। সে আর ফিরবে না গ্রামে। তখনও রাত্তির, সোজা মাঠ ধরে হেঁটে গেলে সকাল সকাল পিচরাস্তা পেয়ে যাবে। প্রথম বাসটা ধরেই শহরের দিকে চলে যাবে। মিশে যাবে মানুষের থিকথিকে ভিড়ে। কতদিন পর বুকের ভেতর ছলাৎ ছলাৎ শব্দ হয়। মুহূর্তে সে পেতে থাকে সোঁদা মাটির গন্ধ, পেতে থাকে গাজনের বাজনা, যতদূর চোখ যায় সবুজ আর সবুজ, আর পালা ধানের নাচ।’
ওই ভিড়ে কে কাকে খুঁজে পায়! কবিতা যে শহর চেনে না তা নয়, চেনে সে, সন্তোষের সঙ্গে শহরেই বেঁধেছিল ঘর, সোনারপুরেই ছিল তার সোনার সংসার।
কবিতা ফিরবে না আর এই গ্রামে। ফিরতে চাইলেও বোধহয় তাঁকে আর ফিরতে দেবে না কেউ। সন্তোষকে ঠাণ্ডা মাথায় খুন করেছে সে, রক্তের হাত দুটো বাড়ির কলের জলেই ধুয়ে নিয়েছে। জীবনে এটা কবিতার প্রথম খুন। খুন করলে শুনেছে সে গা কাঁপে, কিন্তু কবিতার, প্রায় দু’ঘণ্টা হলো খুন করেছে, এখনও কিছুই কাঁপছে না। নিজেকে এত ভারমুক্ত হতে আর কখনও সে দেখেনি। গ্রামের লোকেরা পিছু নিতে পারে, পুলিশে খবর হতে পারে, এসব যে সে ভাবছে না তা নয়। ভাবলেও এসব তাকে মনের ভেতর কোনও ভয় ঢুকিয়ে দিচ্ছে না। যদি তাঁকে কেউ জিজ্ঞেস করে ‘সন্তোষকে খুন করেছিস?’, সে বলবে, ‘হ্যাঁ করেছি।’
কবিতা বলে দেখলো কেমন শুনতে লাগে, ‘হ্যাঁ করেছি।’ বেশ কয়েকবার সে বলে ‘হ্যাঁ করেছি।’ অসম্ভব ভালো লাগছে তার উচ্চারণ করতে ‘হ্যাঁ করেছি’। ওই রাত্তিরেই সে দিগন্ত ছোঁয়া মাঠে চিৎকার করে এলোমেলো ছড়িয়ে থাকা দুটো তিনটে তারার আকশটির দিকে মুখ করে বলে, ‘হ্যাঁ করেছি’।
ষোল বছরের শরীর কবিতার। সাপের ফণার মতো ধারালো শরীর। শরীরটার দিকে লোলুপ চোখে তাকায় খলসেখালির বারো থেকে বাহাত্তর সবাই। নিজের বাপেও তাকাতো। তাকিয়ে তাকিয়ে জিভের রস গিলে বলত, ‘মেয়ের তো বিয়ের ব্যবস্থা করতে হয়।’ ‘তা করতে হয় বৈকি, করলে খলসেখালির পুরুতঠাকুরের ছেলে সন্তোষ চক্কোত্তির সাথে কর।’ বাবা মা দুজনেই জিভ কাটে। ‘ও নাম মুখে নিসনি। ওরা তো বাম্মন।’ ‘বাম্মন তো কী হয়েছে, বাম্মনের ছেলের সাথে আমি যে যা নয় তা করে বেড়াচ্ছি।’ এর কোনও উত্তর কারও কাছে নেই। কবিতা, সাপের ফণা, বেরিয়ে যায় সমুদ্রের ধারে। সন্তোষকে খুঁজে বেড়ায়। ঘন্টা দুই বসে থাকার পর মাছ ধরতে আসে সন্তোষ। কালো ছিপছিপে শরীরে সাদা পৈতেটা চিকচিক করে, ধুতিখানা লেঙটি করে বাঁধা। ‘ও সন্তোষ, বাবা তো বিয়ের কথা বলছে।’
‘বিয়ের কথা বলছে তো বলছে।’
‘বলছে তো বলছে মানে? বিয়ে যদি দিয়ে দেয়!’
‘দেয় তো দেবে!’
‘যদি তোমার সাথে না দেয়!’
‘আমার সাথে না দিলে কার সাথে দেবে, শুনি!’
‘কী করে দেবে তোমার সাথে। তুমি তো বাম্মনের ছেলে।’
‘তাতে কী! বাম্মনের ছেলে হয়েছি বলে কী ভালোবাসা করিনি!’
সন্তোষ মাছ ধরা বন্ধ করে কবিতাকে সেদিন শুনিয়েছিল পালা গান। যাত্রা দলে গান গায় সন্তোষ। একলা নদীর ধারে সেইসব সুরেলা গান কবিতার মন ছুঁয়ে যায়। গত শীতেই সে শুনেছিল যাত্রাদলে সন্তোষের গলা। আগে থেকেই ছেলেটাকে চিনত সে। পুরুতঠাকুরের ওইটুকুন ছেলে সে অতটা ডাঙর হয়ে গেছে জানত না। ওই গান কবিতাকে এমন কাঁপিয়েছিল যে পুরুতঠাকুরের বাড়ি গিয়ে সে সন্তোষের খোঁজ করেছে।
‘কী রে তুই কে রে?’
‘মাধব মন্ডলের মেয়ে।’
‘কী চাস?’
‘গান খুব ভালো গেয়েছ।’
 সন্তোষ এক গাল হেসে তাকে ঘরে ডেকেছিল। সেদিনই আরও দুটো গান ওকে শুনিয়ে বলেছিল, ‘তুই দেখতে তো খুব সুন্দর হয়েছিস! তুই গা না আমার সাথে।’
কবিতা লজ্জায় লাল হয়ে শাড়ির আঁচলে মুখ ঢেকে বলেছিল, ‘কী করে গাইতে হয় জানিই না।’
সন্তোষ কবিতার গায়ে ধাক্কা দিয়ে বলেছিল, ‘শিখিয়ে দেব। শিখবি?’ গান শেখানো শুরু হয়ে যায়। প্রতিদিন সন্তোষের বাড়ির সময়ে অসময়ে যেতে থাকে কবিতা। একদিন দেরি হয়ে গেল, তো সন্তোষ ছুটে আসে। সন্তোষের বাড়ির কিনারে ছোট্ট বেড়ার ঘরটিতে দুজন গানে গল্পে কাটাতে কাটাতে দেখে সমুদ্রের জোয়ারের চেয়ে আরও দ্বিগুণ জোয়ার উঠেছে কবিতার শরীরে। সেই জোয়ারে ভাসিয়ে নিয়ে যায় সন্তোষ কবিয়ালকে। খলসেখালি গ্রামে জেনে যায় কবিতার সঙ্গে কবিয়ালের ভাবের কথা। খলসেখালি গ্রাম, গ্রাম ছাড়িয়ে আরও কয়েক গ্রাম জেনে যায়, ছোটজাত বড়জাতে ভাব হতে পারে, বিয়ে হবে না।
হ্যাঁ, বিয়ে অসম্ভব। শূদ্রে আর বামুনে বিয়ে হয় না। কবিতাকে ধরে বেঁধে খলসেখালির গায়ে লাগা গ্রাম মিঠেখালির দিনমজুরের ছেলে হারাধনের সঙ্গে বিয়ে দেওয়া হয়ে গেল। নগদ এক হাজার টাকা পণ দিয়ে কানের একটা সোনার দুল গড়িয়ে দিয়ে লাল একটা শাড়ি পরিয়ে বিয়ে হলো। মনে মনে যাকে শ্বশুরমশাই ডেকেছে কবিতা, সে-ই এসে বিয়ে পড়িয়ে গেল। বিশ্বনাথ চক্রবর্তী। সন্তোষের বাপ। হেঁটে হেঁটেই খলসেখালি থেকে কবিতাকে যেতে হয়েছিল মিঠেখালির শ্বশুরবাড়ি। গিয়েই উদয়াস্ত সংসারের কাজ। মাটির ঘর গোবর দিয়ে মোছো, গোবর চাবড়া দিয়ে ঘুঁটে বানাও, ধান ঝাড়ো, সেদ্ধ করো, কাঠ কেটে আনো, নাড়া খড় ঘুঁটে জ্বালিয়ে রান্না করো, কলমিশাক তুলে আনো, শাক আলু বেগুন দিয়ে লাবড়া রান্না করো।আর বাড়ির বেবাককে খাওয়াও দাওয়াও।দিন রাত্তির দম ফেলার সময় নেই। এত খেটে গা যখন ভেঙে আসে, মাঝে রাত্তিরে চুল্লু খেয়ে এসে হারাধন-স্বামী ভোর রাত্তির অবধি লাথি গুঁতো দিয়ে গা পচিয়ে ফেলে।এহেন সংসার থেকে বাপের বাড়ির নাম করে কবিতা পালায় বারবার।ছুটে ছুটে যায় সন্তোষের কাছে। ‘ও কাবিয়াল, আমি আর ফিরবো না ওই অসুরের বাড়ি।’
সন্তোষ হাঁ করে চেয়ে থাকে সুন্দরীর মুখে। কী করবে সে ভেবে পায় না।বুকের মধ্যে পুরে রাখবে কবিতাকে! বাপ ঠাকুরদার সঙ্গে সে তর্ক করে, ‘ব্রাহ্মণ তো কী হয়েছে, যাকে মনে লেগেছে, তাকে কেন বে করতে পারবো না?’ বাপের বাড়ি তো বটেই, পাড়ার লোকও ছি ছি করলো। কবিতা স্বামীর ঘর করছে এখন এসব কথা মুখে নেওয়াও তো পাপ। কবিতার বদনাম গ্রাম থেকে গ্রামে ছড়িয়ে যায়। ভাতার নাকি মারে। হয়েছাটা কী তাতে? ভাতারই তো মারে, অন্য কেউ তো নয়! গাল টিপলে দুধ বেরোয়, এত দেমাগ কোত্থেকে পেলো মেয়ে! সন্তোষকে নিরুত্তর দেখে কবিতা ঝাঁপ দিতে যায় নদীতে। সেই মরণকে দু’হাত দিয়ে ঠেকায় সন্তোষ। বুকের মধ্যে জাপটে ধরে মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলে, ‘কবিতা, এইবার তুই ফিরে যা। আমি কিছু টাকা জোগাড় করে নিই। তোকে নিয়ে পালিয়ে যাবো।’
 ‘সত্যি তো?’
‘সত্যি। তুই দেখে নিস।’
যাত্রাদলের কাছে শ’দুয়েক টাকা সন্তোষ চাইবে। এতদিন যে মাগনা মাগনা গান গেয়েছে, পেলেও পাঁচ দশ টাকা ছাড়া তো কিছু পায়নি! সন্তোষ নিজে বুঝিয়ে সুঝিয়ে কবিতাকে শ্বশুরবাড়ি রেখে আসে। জেনেই রেখে আসে যে হারাধনের বাড়িটা বাড়ি নয়, নরক। হারাধনের বাড়ির কীর্তিকলাপ জেনেও বাপের বাড়ির কেউই কবিতাকে একটি রাত্তিরও রাখে না। গ্রামে নাকি তাহলে আর তিষ্ঠোনো যাবে না। তিষ্ঠোক গ্রামে ওরা, কবিতা মার খেয়ে খেয়ে মরুক। কতবার যে ইচ্ছে হয়েছে তার নদীতে ভেসে যেতে। বাপের বাড়ির কাউকে আর কবিতা একবিন্দু বিশ্বাস করে না। যারা নিজের মেয়েকে হাত পা বেঁধে নরকে ফেলে দিয়ে স্বস্তিতে ঘুমোচ্ছে, তাদের মুখ দেখবার ইচ্ছে তার নেই। সন্তোষই ভরসা দিচ্ছে। সন্তোষই দুটো আশার কথা শোনাচ্ছে। কবিয়ালের শেখানো গান সে গুনগুন করে শ্বশুরবাড়ির খাটাখাটনির ভেতরে নিভৃতে গেয়ে যায়।
স্বপ্ন একদিন সফল হল কবিতার। ভোর রাত্তিরে সে পালায় সন্তোষের সঙ্গে। সন্তোষের বুক পকেটে দুশো টাকা। আর কারও হাতে কিছু নেই। মাঠের পর মাঠ পেরিয়ে পিচের রাস্তা। ভোর রাত্তিরে রওনা হলে পিচের রাস্তায় এসে সোনারপুরের বাস ধরা যায়। সোনারপুরে থাকে কবিতার বাপের পিসি, তার মায়ের পিসশাশুড়ি, তার ঠাকুমা, মঙ্গলা। মঙ্গলার বাড়ি কোনওদিন আসেনি কবিতা। তার মা এসেছে, মায়ের কাছেই গল্প শুনেছে সে মঙ্গলা ঠাকুমার। ঠাকুমার বাড়ি যখন পৌঁছায় কবিতা, সঙ্গে সন্তোষ, রাত এগারোটা বেজে গেছে। মঙ্গলার পাড়া জেগে উঠলো।
‘এত রাত্তিরে কে এল?’
‘জামাই নিয়ে নাতনি এসেছে।’
মঙ্গলার ঘরের কাছে ঘর ভাড়া নিয়ে কবিতা থাকতে শুরু করেছে। সঙ্গে স্বামী। লোকে তাই জানে। মঙ্গলা কবিতাকে নিয়ে কলকাতায় ঠিকে কাজে লাগিয়ে দিল। নিজেও সে ঠিকের কাজই করে। জামাইকে নিয়ে যোগালির কাজে গেল হরিচরণ, মঙ্গলার স্বামী। কবিতার সিঁথিতে মোটা করে সিঁদুর। হাতে শাঁখা পলা, হাতে লোহা। এক মঙ্গলা আর হরিচরণ ছাড়া আর কেউ জানে না এ আসলে কবিতার স্বামী নয়, স্বামীকে ফেলে কবিতা এর সঙ্গে পালিয়ে এসেছে। সন্তোষের কাজ আজ জোটে, কাল জোটে না। কিন্তু কবিতা ঠিকের কাজ করে মাসে হাজার বারাশো টাকা পায়। সকাল আটটায় যায়, দুপুর বারোটায় ফিরে আসে। প্রথম প্রথম মঙ্গলার সঙ্গে যেত, এরপর ভিড়ের ট্রেনে একা একাই যেতে শিখে গেছে। গ্রামেও যেমন, শহরেও সাপের ফণার দিকে হাঁ করে লোকে তাকিয়ে থাকে। কবিতা কারও দিকে ফিরে তাকায় না। উল্কার মতো হেঁটে যায়। ঘর ভাড়া, খাওয়া খরচ, কাপড় জামার খরচ-এসব বাদ দিয়ে যত টাকা জমলো, সবই মাটির তলায় পিতলের ঘটিতে রেখে দেয় কবিতা। তার বড় শখ এই সোনারপুরেই এক কাঠা জায়গা কিনে একটা ঘর তুলবে। বড় শখ সোনারপুর বাজারে একটা ফলের দোকান দেবে। মঙ্গলা অনেকদিন বলেছে, ‘ব্যাংকের বই করে টাকাগুলো রেখে দে রে কবিতা।’
কবিতা শোনে না। রাত্তিরে নিজের চোখে টাকাগুলো একবার না দেখলে তার ঘুম হয় না। ব্যাংকে রাখলে চোখের এই সুখটুকু তো সে পাবে না।
এতদিনে গ্রামেও জানাজানি হয়ে গেছে সন্তোষের সঙ্গে কবিতার সংসার করার কথা। গ্রামের মেয়েদের অত আলদা করে বে থা হতে হয় না। সন্তোষই তার সিঁথিতে সিঁদুর পরিয়ে দিয়েছে সোনারপুরের ঘরে, সন্তোষই তার স্বামী। সাক্ষী আকাশ বাতাস। কবিতার মা বাবা বৌদি এসে দেখে গেছে সংসার। হপ্তাখানেক থেকেও গেছে। জামাইকে আদর যত্নও করে গেছে প্রাণ ভরে। এভাবেই কাটছিল সুখে স্বস্তিতে কবিতার জীবন। হঠাৎ একদিন সন্তোষের খুশি খুশি গলা শোনে, ‘ও কবিতা, তোর ননদের তো বিয়ে, দেশে চল।’
‘দেশে?’
আমোদে চিকচিক করে কবিতার চোখ। কতদিন পর বুকের ভেতর ছলাৎ শব্দ হয়। মুহূর্তে সে পেতে থাকে সোঁদা মাটির গন্ধ, পেতে থাকে গাজনের বাজনা, যতদূর চোখ যায় সবুজ আর সবুজ, আর পাকা ধানের নাচ। হ্যাঁ, দেশে তো যাবেই কবিতা। তবে সন্তোষের আবদার বোনের বিয়েতে তার তো টাকা ঢালতে হবে, অত টাকা তড়িঘড়ি জোগাড় করা তার পক্ষে এখন সম্ভব হবে না। সে টাকা কবিতার কাছ থেকে নিয়ে সে দেবে, পরে কবিতার এক কাঠা জমি কেনার স্বপ্নের ভেতর গুঁজে দিলেই হবে দু’হাজার।
পিতলের ঘটি থেকে টাকা বের করে দিয়ে দেয় সে সন্তোষকে। বেড়ার ঘরটা তালাবন্ধ করে আঁচলে চাবি নিয়ে কবিতা চলল তার স্বামী নিয়ে দেশে ননদের বিয়েতে। কবিতার আনন্দ আর ধরে না। এই প্রথম সন্তোষের বাড়িতে সে বউ হয়ে ঢুকবে। ব্রাহ্মণের বাড়ির বউ, তার পুলক পুলক লাগে। চণ্ডালের বাড়িতে বিয়ে হয়েছিল, ওই নরককুন্ডে কম মরা সে মরেনি। পুরুতঠাকুর গরিব হোক, মানুষ তো! বড় জাতের মানুষেরা অসুর হয় না। কবিতাকে সারাপথ দোলায় স্বপ্ন। সারাপথ সে স্বপ্নের ঘোরে।
কবিতাকে তার বাপের বাড়ি নামিয়ে দিয়ে গেল সন্তোষ। কথা, কাল সকালে বাপ ঠাকুরদাকে বলে ঘরে তুলবে তাকে। গ্রামের ক’টা লোককে না খাওয়ালে লোকে বলবে কী! বাপের বাড়িতে কবিতার আদর যত্নের শেষ নেই। ননদের বিয়েতে এসেছে কবিতা। ব্রাহ্মণের বাড়ির বউ। কম কথা নাকি। কবিতাকে মান্য গণ্য করে সবাই। বাপও পর্যন্ত চোখ তুলে কথা বলে না। এক ফাঁকে বৌদি জানিয়ে দেয়, হারাধন বিয়ে করে নিয়েছে পাড়াগাঁয়ের এক চাষির মেয়েকে। শুনে চুকচুক করে চাষির মেয়েটার জন্য দুঃখ করে কবিতা।
কিন্তু পরদিন তো সন্তোষ আসে না কবিতাকে নিতে। ব্রাহ্মণের বাড়ির বউ, আগের মতো তো মাঠে পাড়ে ছুটোছুটি করতে পারে না। লোকে মন্দ বলবে। বাপ মায়েরা বলে, শান্ত হয়ে বসতে। সন্তোষ নিশ্চয়ই বোনের বিয়ের কাজে ব্যস্ত। তাই বউকে ঘরে তুলতে পারছে না। বিয়ের দিনই একেবারে তুলবে। আশায় বসে থাকে কবিতা। উঠোনে দাঁড়িয়ে থাকে পথের দিকে তাকিয়ে। ঘরের জানালায় চোখ রেখে নাওয়া খাওয়া ভুলে বসে থাকে। স্বামী তার এই আসবে, এই আসছে বলে।
কোথায় স্বামী! স্বামীর খবর নেই। চারদিন পার হয়ে গেলে কবিতা বেরোয়। বাড়িতে তার ননদের বিয়ের তোড়জোড় চলছে। কেউ তাকালো না বাড়ির বউটির দিকে। বাড়ির সবাই তো জানে যে শহরে গিয়ে ছেলে বিয়ে করে নিয়েছে কবিতাকে, তারা সংসার পেতেছে সোনারপুরে, এখনও তালার চাবিটি কবিতার আঁচলে বাঁধা! না শ্বশুর, না শাশুড়ি, না ননদ— কেউ ফিরে তাকালো না। যেন চেনেই না। যেন এ গাঁয়ের মেয়ে নয় কবিতা। কবিতার গায়ে যে জৌলুস বেড়েছে শহরের জল হাওয়া লেগে, তার দিকেও কারও নজর নেই। কবিতা ঠিক বোঝে, এ ইচ্ছাকৃত অবজ্ঞা, সন্তোষকে সে পাগলের মতো খোঁজে। খুঁজতে খুঁজতে নদীর পাড়। ওখানে মাছ ধরছে কবিয়াল জেলে। জাল ধরে টান দিয়ে কবিতা চেঁচিয়ে বলে, ‘কী হয়েছে তোমার? চারদিন ধরে বসে আছি কোনও খবর নেই? বাড়ি নিচ্ছ না কেন?’
সন্তোষ জালটি কবিতার হাত থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে বলেম ‘তুই কে?’
‘মানে?’কবিতা কোমরে দু’হাত রেখে দাঁড়ায়। মাছে মন দেয় সন্তোষ, কথা বলে না।
‘কী ব্যাপার? হয়েছে কী তোমার, বলো। ননদের বিয়ে, কাজ কম্ম করতে হবে না?’
সন্তোষ আবারও বিস্ময়ে তাকায় কবিতার দিকে, বলে, ‘তুই কে? তোকে আমি চিনি না।’
‘আমাকে চেনো না?’
‘না।’
‘আমি তোমার বউ। বউ। বউ।’
‘আমি তোকে চিনি না। সরে যা সামনে থেকে।’
কবিতা হেঁচকা টানে সন্তোষকে জল থেকে সরিয়ে এনে আঙুল দিয়ে নিজের সিঁথির সিঁদুর দেখিয়ে বলে, ‘এই যে সিঁদুর দেখছো, এ তুমি আমায় পরিয়েছো।আমাকে বিয়ে করেছো। তুমি আমার বর। বুঝলে? আমি তোমার বউ। গাঁয়ের সবাই জানে। শহরের লোক জানে। ভগবান জানে।’
‘সরে যা। সরে যা।’ অবজ্ঞায়, ঘৃণায় সন্তোষের মুখ বিকৃত হয়ে থাকে।
‘কেন সরবো? বিয়ে করেছ, ঘরে তোলো। বাপের বাড়ি কদ্দিন ফেলে রাখবে আমাকে। ননদের বিয়ের জন্য তো টাকাও নিলে দু’হাজার। চেনো না আমাকে? খুব চেনো।’
সন্তোষ ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেয় কবিতাকে। সে চেনে না তাকে। কোনওদিন দেখেনি আগে। অচেনা মাগ-এত সাথে কোনও কথাও সে কইতে নারাজ। হনহন করে বাড়ির দিকে সে হেঁটে যায়।
কবিতা জল কাদা থেকে নিজেকে তুলে আনে। সামনে ফুঁসে উঠতে থাকা জোয়ার। ফুঁসতে থাকে কবিতা। একবার, শুধু একবারই কবিতা ভেবেছিল জোয়ারে ঝাঁপিয়ে পড়বে। কিন্তু পরক্ষণেই সে নিজেকে বলে, না। না, সে মরবে না। সে তার স্বামীর পেছন পেছন হাঁটবে না, তাকে আর কাতর অনুনয় করবে না। সে বরং নদীর পাড় ধরে হাঁটতে হাঁটতে নদীর সঙ্গে মনের কিছু কথা বলবে। বলল সে কথা। বলল সোনারপুরে তার সোনার সংসারের কথা। বলল তার কবিয়াল স্বামীর কথা। মন-ভুলো স্বামীকে নদী যেন ক্ষমা করে দেয়।
ক্ষমা কিন্তু সে নিজে করলো না। রাত্তিরেই দরজা খুলে, সবাই যখন ঘুমে মরে আছে, চুপচপ করে বেরিয়ে পড়ল, হাতে দা। সেই দা হাতে নিয়েই সন্তোষের ঘরের দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকে বড় নিশ্চিন্তে বড় সুখে ঘুমোতে থাকা সন্তোষের মাথায় কোপ দেয়। এক কোপ, দুই কোপ, তিন কোপ। ক্যোৎ ক্যোৎ করে সামান্য শব্দ বেরোয় মূখ দিয়ে। তারপর মুখ আর মুখ থাকে না, রক্তে ভাসতে থাকে। বীভৎস সেই মুখ। কবিতার মনে হয়, সন্তোষের আসল চেহারা আসলে এই। ঠিক এরকমই বীভৎস সে। এরকমই অসুর।
কবিতা মাঠ পেরোতে থাকে, পালিয়ে যাচ্ছে সে। ঠিক এরকম ভোর হওয়ায় আগে আগেই সন্তোষের সঙ্গে পালিয়েছিল সে, ছ’মাস আগে এই পথে। পিচরাস্তা পেতে আরও দু’মাইল হাঁটতে হবে তাকে, তার ঠিক মনে আছে। একদিন ঠিক এভাবে এই পথ ধরেই পালিয়েছিল তারা দু’জন। এবার সে একাই। কবিতা বুঝে গেছে একা হাঁটলেই সবচেয়ে নিশ্চিন্তের হাঁটা হয়। হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ এক খাল পেয়ে খালের পাড়ে সে দাঁড়ায়। আঁচলা ভরে জল নিয়ে সিঁথিতে ঘসে ঘসে সিঁদুর মোছে। হাত থেকে শাঁখা পলা লোহা সব খুলে ছুঁড়ে দেয় খালের জলে। এবার হাঁটতে থাকে। বড় ভারমুক্ত লাগে নিজেকে।
 
 
 
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মুজিবনগর দিবস পালনের নির্দেশ
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মুজিবনগর দিবস পালনের নির্দেশ
মাদারীপুরে বজ্রাঘাতে ২ জনের মৃত্যু
মাদারীপুরে বজ্রাঘাতে ২ জনের মৃত্যু
শিগগিরই অনলাইন নিউজ পোর্টালের বিজ্ঞাপন নীতিমালা: তথ্য প্রতিমন্ত্রী
শিগগিরই অনলাইন নিউজ পোর্টালের বিজ্ঞাপন নীতিমালা: তথ্য প্রতিমন্ত্রী
ইরান ইস্যুতে তৃতীয় বৈঠকে বসছে ইসরায়েলের মন্ত্রিসভা
ইরান ইস্যুতে তৃতীয় বৈঠকে বসছে ইসরায়েলের মন্ত্রিসভা
সর্বাধিক পঠিত
শেখ হাসিনাকে নরেন্দ্র মোদির ‘ঈদের চিঠি’ ও ভারতে রেকর্ড পর্যটক
শেখ হাসিনাকে নরেন্দ্র মোদির ‘ঈদের চিঠি’ ও ভারতে রেকর্ড পর্যটক
বিসিএস পরীক্ষা দেবেন বলে ক্যাম্পাসে করলেন ঈদ, অবশেষে লাশ হয়ে ফিরলেন বাড়ি
বিসিএস পরীক্ষা দেবেন বলে ক্যাম্পাসে করলেন ঈদ, অবশেষে লাশ হয়ে ফিরলেন বাড়ি
ঘরে বসে আয়ের প্রলোভন: সবাই সব জেনেও ‘চুপ’
ঘরে বসে আয়ের প্রলোভন: সবাই সব জেনেও ‘চুপ’
ডাবের পানি খাওয়ার ১৫ উপকারিতা
ডাবের পানি খাওয়ার ১৫ উপকারিতা
ফরিদপুরে সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ গেলো ১৩ জনের
ফরিদপুরে সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ গেলো ১৩ জনের