X
শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪
৬ বৈশাখ ১৪৩১

কঙ্গোর জন্য বিরাট দুর্ভাগ্য যে তারা অতীত ভুলে গেছে : মারিও বার্গাস ইয়োসা

দুপুরচন্দ্র
২৮ মার্চ ২০১৬, ১২:২৬আপডেট : ২৮ মার্চ ২০১৬, ১২:৫৬

অ্যাঙ্গুস মিশেল ও ইয়োসা মারিও বার্গাস ইয়োসা রাজনীতি এবং ইতিহাস সচেতন লেখক। বিখ্যাত ইতিহাসবিদ অ্যাঙ্গুস মিশেল ২ জুলাই, ২০০৯ সালে তার এই সাক্ষাৎকারটি নেন। এই সাক্ষাৎকারে ইতিহাসখ্যাত স্যার রজার কেইসমেন্টকে নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা প্রাধান্য পেয়েছে। আলোচ্য অংশে শুধু এইটুকুই রাখা হয়েছে। বাংলায় তর্জমা করেছেন দুপুরচন্দ্র

 

ইয়োসা : আমিই বলি প্রথমে, আপনার পাঠানো বই দুটি চমৎকার ছিল, সেইজন্য ধন্যবাদ। সত্যিই বইগুলো পড়ে খুবই আন্দোলিত হয়েছি আমি।
অ্যাঙ্গুস মিশেল : ধন্যবাদ। আমিও আপনার বই পড়ে আনন্দ পাই।
ইয়োসা : (হাসতে হাসতে) এটার নামই পারস্পারিক সম্পর্ক উন্নয়ন। রজার কেইসমেন্টকে নিয়ে অ্যামাজান জার্নালে প্রকাশিত আপনার লেখা সব সংস্করণই আমি পড়েছি। আমি মনে করি, এটা চমৎকার কাজ।
মিশেল : ধন্যবাদ। আমি মনে করি এটার দরকার ছিল।
ইয়োসা : বিশেষ করে কন্টেস্টের নোটগুলো খুবই কার্যকরি। সত্যিই চমৎকার কাজ এটি। আপনাকে আবারও অভিনন্দন।
মিশেল : আপনি কি রজার কেইসমেন্টের ‘হার্ট অব ডার্কনেস’-এর উপর আমার লেখা দ্বিতীয় খণ্ডটা দেখেছেন?
ইয়োসা : অবশ্যই। এর উপাদানগুলো সত্যিই অনেক সমৃদ্ধ। উপাদানগুলো ব্যবহার করে আমি আমার স্বাধীনমতো একটি উপন্যাস লিখছি।
মিশেল : কতদিন ধরে এই উপন্যাসটি লিখছেন?
ইয়োসা : এক থেকে দেড় বছর। এখনো আমি শুরুতেই আছি। কিন্তু এটা ব্যাপার না। আমি লিখতে মজা পাচ্ছি এটাই বড় ব্যাপার। শুরুতে একটু সমস্যা হচ্ছিল কিন্তু এখন ঠিক আছে।
মিশেল : কবে আপনি প্রথম রজার কেইসমেন্টের মুখোমুখি হলেন ?
ইয়োসা : আমি জোসেফ কনরার্ড-এর ভীষণ ভক্ত। যখন আমি কনরার্ড-এর নতুন জীবনী পড়ি তখনই অনুভব করলাম রজার কেইসমেন্টের ভূমিকা খুব গুরুত্বপূর্ণ। কনরার্ড-এর কঙ্গোর অভিজ্ঞতায় রজার কেইসমেন্টের সাহায্য ছাড়া ‘হার্ট অব ডার্কনেস’ লেখা সম্ভব হতো না। তখন থেকেই আমি রজার কেইসমেন্ট-এর বিষয়ে আগ্রহী হয়ে উঠি। আমি তাঁকে নিয়ে গবেষণা করি, এবং অ্যামাজানের মধ্যেই তাকে আবিষ্কার করি প্রথম। কাউছো ডাকাতের সময়ে বোমা শহরে তিনি কেন্দ্রিয়ভাবে নির্যাতিত মানুষের হয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। তাঁর জীবন ছিল খুবই উজ্জ্বল। বিভিন্ন রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে কাজ করতে করতে তাঁর করুণ মৃত্যু ঘটে। এরপর আমার প্রত্যেক লেখায় কোনো না কোনোভাবে রজার কেইসমেন্ট প্রেরণা হিসেবে কাজ করেছেন। রজার কেইসমেন্ট আমার মনে ও জীবনে নতুন আলোকশিখা জ্বালিয়ে দিয়েছিলেন।
মিশেল : আপনার কিছু কাজ সম্পর্কে জেনে আমি খুব অবাক হয়। যেমন ১৯৮০ সালে উচুরাচায়তে সাংবাদিক নিহত হবার পর আপনাকে তদন্তের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল। এখানে নড়েচড়ে সেই কেইসমেন্টের ব্যাপার চলে আসে। এই কেসে কেইসমেন্ট আপনাকে অনুপ্রাণিত করেছিল কী ?
ইয়োসা : সম্ভবত। এই ঘটনার পর রজার কেইসমেন্টের অভিজ্ঞতা আরও আকর্ষণীয় করে তুলেছিল আমাকে। উচুরাচায়তে যে আট জন সাংবাদিক নিহত হয়েছিলেন, এই তদন্তের অভিজ্ঞতা আমার জীবনে ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করেছিল। আমি আমার দেশের অন্যরকম পরিবর্তন দেখেছিলাম যেটা আগে কখনো অনুভব করিনি। এই ঘটনায় পৃথক একটি সাংস্কৃতিক পৃথিবী ও পরিবেশের মুখোমুখি হলাম। আমি আবিষ্কার করলাম ভিন্ন একটি সমাজ, রাজনীতি যেটা কিনা সমস্যায় জর্জরিত। এতকাল এখানেই বাস করে আসছিলাম আমি। এসব ব্যাপার আমার রজার কেইসমেন্টের কথা স্মরণে এনে দেয়, তাঁর সমস্যাগুলোও ছিল খুব স্পর্শকাতর এবং তিনি অনেক কঠিন সমস্যার মোকাবেলা করেছে জীবনভর। তিনি ছিলেন আমাদের ট্যাজিক ফিগার। খুব কঠিন জীবন পার করেছেন তিনি। তাঁর চারপাশ ছিল নিঃসঙ্গতায় ঘেরা। তাঁর মতো একজন প্রো-ব্রিটিশ আইরিশ এর পক্ষে জাতীয়তাবাদী হওয়া কঠিন ছিল। রাজ্য ও সাম্রাজ্যবাদের বিপরীতে গিয়ে যৌবনে তিনি আধুনিক গণতন্ত্রের কথা ভেবেছিলেন। তাঁর এই রূপান্তের চিন্তা বিশেষত্ব দান করে অবশ্যই। সম্পূর্ণ একাই লড়াই করে যাওয়া এই ব্যক্তির জীবন অভিজ্ঞতা সত্যিই নাটকীয় নয় কি?
মিশেল : জ্বি। সত্যিই এটা অবিশ্বাস্য কাহিনি। এটাই মৌলিক উপাদান আমার লেখায়।
ইয়োসা : তিনি এমন একটি চরিত্র যার চারপাশের প্রাকৃতিক পরিবেশকে নিয়ে একটি মহৎ উপন্যাস লেখা সম্ভব। যেটা সত্যিকারের পৃথিবীর বাইরের কোনো জগৎ।
রজার কেইসমেন্ট মিশেল : বইটি লেখার প্রস্তুতিকালে আপনি কঙ্গোতে ভ্রমণে করেছিলেন। কোথায় গিয়েছিলেন? কঙ্গোর কোন্ জিনিসটা আপনাকে মুগ্ধ করেছিল? বর্তমানে কঙ্গোতে কেইসমেন্টকে টিকিয়ে রাখার জন্য কোনো তথ্য পেয়েছিলেন কী?
ইয়োসা : এটা ছিল মাত্র দু’সপ্তাহের কিন্তু খুব কাজের ভ্রমণ। আমি এমন একটি জায়গা খুঁজছিলাম যেখানে রজার দীর্ঘদিন থেকেছেন। বোমা এবং মাতাদি শহর তেমন পরিবর্তন হয়নি। মাতাদি উধাও কিন্তু এখনো আপনি সেই কলোনিয়াল শহর খুঁজে পাবেন। সমস্ত প্রশাসনিক কাজ বোমা থেকে সরিয়ে কিনশাসাতে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। বোমা অরক্ষিত। বাস্তবে আগের থেকে তেমন পরিবর্তন হয়নি। ওখানে কলোনিয়াল বাড়িঘর দেখতে পাওয়া যায় এখনো। এটা খুব অবাক করার ব্যাপার। আপনাকে পরিবেশ পুনর্নির্মাণ করেই চিন্তা করতে হবে, অনেক বছর ধরে এখানে রজার কেইসমেন্ট থাকতেন। আমি খুব ভাগ্যবান ছিলাম। আমার পরিচয় ঘটেছিল মি. মনসিউর প্লাসিডক্লেমেন্ট নামে একজন মজাদার মানুষের সঙ্গে। তিনিই একমাত্র ব্যক্তি যে, বোমার অতীত নিয়ে আগ্রহী। তিনি সবকিছুই উদ্ধার করে সংগ্রহ করতে চান অতীতের। একজন লাইব্রেরিয়ানের মতো তিনি বোমার সব অতীত সংরক্ষণ করছেন। কিন্তু সমস্যা হল, বোমার উপর কোনো বই নেই। উপান্তর না দেখে, তিনি খবরের কাগজ, চিঠিপত্র যখন যেখানে যা পেরেছেন সংগ্রহ করে রেখে দিয়েছেন তার অফিসে। কারণ সেখানে কোনো আঞ্চলিক আর্কাইভ নেই। বোমার অতীত ইতিহাসের সংগ্রাহক হিসেবে তিনি খুবই গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি।
মিশেল : রজার কেইসমেন্টের উপর গুরুত্বপূর্ণ কোনো তথ্য পেয়েছিলেন কী? সেখানকার মানুষের তার সম্পর্কে ধারণা কী?
ইয়োসা : এটা খুব দুঃখের বিষয় যে, খুব কম সংখ্যক মানুষই কেইসমেন্ট সম্পর্কে জানে। যে মানুষটি কঙ্গোর জন্য প্রায় একাই যুদ্ধ করলো অথচ সেই মানুষটির কথা তারা একেবারেই ভুলে গেল। কেউ তার কথা মনে রাখেনি। কিছু কিছু বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা জানে, তবুও সেটা ঝাপসা ঝাপসা। এটা কঙ্গোর জন্য বিরাট দুর্ভাগ্য যে, তারা তাদের অতীত ভুলে গেছে, অতীতের কোনো কিছুই নিয়ে তারা আগ্রহী নয়। কারণ হয়তো এটা যে, তারা অতীতের ভেতর কেবলমাত্র কিছু ভয়ংকর দৃশ্য দেখতে পায়। এরচেয়ে বরং তাদের কাছে এটাই ভালো যে, অতীতের ঐতিহ্য ও ইতিহাস ভুলে থাকা। তারা সম্পূর্ণরূপে বর্তমানে ডুবে আছে। আর আপনি জানেন যে, বর্তমান খুব নির্দয়। আপনি সেখানকার দুর্নীতি, দারিদ্র, সন্ত্রাস সম্পর্কে চিন্তাই করতে পারবেন না। আমি ল্যাটিন আমেরিকার দুর্দশা ও সন্ত্রাস সম্পর্কে অবগত কিন্তু আপনি যখন কঙ্গোতে যাবেন তখন মনে হবে ল্যাটিন আমেরিকা পৃথিবীর আধুনিকতম ও সভ্য জাতি। কঙ্গোর দুর্ভাগ্য বর্ণনা করা সত্যিই কষ্টকর। কিন্তু একই সময়ে ব্যক্তিগতভাবে দেখলে এটা খুব মজাদার বিষয় যে, তাদের এই সমাজ বিঘটনে সবাই সমভাবে বাস করছে।
মিশেল : রজার কেইসমেন্ট বলেছিলেন, আজ থেকে একশ বছর পরও একই ঘটনা ঘটবে। এ বিষয়ে আপনার মতামত?
ইয়োসা : অবশ্যই। কেইসমেন্টের কথা কঙ্গোর জন্য এখনো খুবই কার্যকর। আপনি এখনো দেখবেন, যেসব বর্বরতা পৃথিবীর অন্যান্য জায়গায় নেই এমনকি আফ্রিকাতেও, সেসবগুলো কঙ্গোতে এখনো রয়ে গেছে। দাসপ্রথা এখনো বহুল তবিয়াতে সেখানে বহাল। দেশ বিকেন্দ্রিকরণের সঙ্গে সঙ্গেই তাদের কেন্দ্রিয় ক্ষমতা হারিয়ে গেছে। কেন্দ্রিয় কোনো পাওয়ারই নেই সেখানে এখন। সুতরাং কেইসমেন্ট যেটা দেখেছিলেন কঙ্গোতে সেটারই বর্ণণা দিয়েছিলেন এবং এখনো সেটা বিদ্যমান।

 

সাক্ষাৎকারটি Society for Irish Latin American Studies, 2009 থেকে নেওয়া হয়েছে।

সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
শিশুকে পালাক্রমে ধর্ষণের অভিযোগে ৪ কিশোর সংশোধনাগারে
শিশুকে পালাক্রমে ধর্ষণের অভিযোগে ৪ কিশোর সংশোধনাগারে
পাঞ্জাবের আশুতোষের ঝড়ও যথেষ্ট হলো না, মুম্বাইয়ের তৃতীয় জয়
পাঞ্জাবের আশুতোষের ঝড়ও যথেষ্ট হলো না, মুম্বাইয়ের তৃতীয় জয়
কানের সমান্তরাল বিভাগে ঢাকার দুই নির্মাতার স্বল্পদৈর্ঘ্য
কানের সমান্তরাল বিভাগে ঢাকার দুই নির্মাতার স্বল্পদৈর্ঘ্য
এআই প্রযুক্তিতে প্রথম বাংলা গানের অ্যালবাম
এআই প্রযুক্তিতে প্রথম বাংলা গানের অ্যালবাম
সর্বাধিক পঠিত
সয়াবিন তেলের দাম পুনর্নির্ধারণ করলো সরকার
সয়াবিন তেলের দাম পুনর্নির্ধারণ করলো সরকার
ফিলিস্তিনের পূর্ণ সদস্যপদ নিয়ে জাতিসংঘে ভোট
ফিলিস্তিনের পূর্ণ সদস্যপদ নিয়ে জাতিসংঘে ভোট
ডিএমপির ৬ কর্মকর্তার বদলি
ডিএমপির ৬ কর্মকর্তার বদলি
পিএসসির সদস্য ড. প্রদীপ কুমারকে শপথ করালেন প্রধান বিচারপতি
পিএসসির সদস্য ড. প্রদীপ কুমারকে শপথ করালেন প্রধান বিচারপতি
পরীমনির বিরুদ্ধে ‘অভিযোগ সত্য’, গ্রেফতারি পরোয়ানা জারির আবেদন
পরীমনির বিরুদ্ধে ‘অভিযোগ সত্য’, গ্রেফতারি পরোয়ানা জারির আবেদন