X
রবিবার, ২৮ এপ্রিল ২০২৪
১৫ বৈশাখ ১৪৩১

‘ঋত্বিক ঘটকের গল্প’ : পাঠ-প্রতিক্রিয়া

সারোয়ার রাফি
০৪ নভেম্বর ২০২২, ১৬:১০আপডেট : ০৪ নভেম্বর ২০২২, ২০:২১

বাংলা চলচ্চিত্র জগতে সত্যজিৎ রায়, মৃণাল সেনের সাথে যার নাম সমভাবে উচ্চারিত হয় তিনি হলেন ঋত্বিক ঘটক। ‘অযান্ত্রিক’, ‘বাড়ি থেকে পালিয়ে’, ‘তিতাস একটি নদীর নাম’, ‘নাগরিক’, ‘যুক্তি তক্কো আর গপ্পো’-এর পাশাপাশি পার্টিশান ট্রিলজি (‘মেঘে ঢাকা তারা’, ‘কোমল গান্ধার’ এবং ‘সুবর্ণরেখা’) ইত্যাদি চলচ্চিত্রগুলোর মাধ্যমে তিনি বাংলা চলচ্চিত্রে অমর হয়ে আছেন। তবে পরিচালক পরিচয় ছাপিয়ে তিনি একজন ছোটগল্পকারও। লিখেছেন বহু গল্প। গল্পগুলোতে চরিত্রদের মাধ্যমে তিনি নিজের চিন্তা-ভাবনা, প্রতিবাদী মনোভাব, সমাজ চেতনা, জীবনের টানাপোড়েন এবং প্রেম ইত্যাদি বিষয়গুলো নানাভাবে তুলে ধরেছেন।

‘ঋত্বিক ঘটকের গল্প’-বইয়ের দ্বিতীয় গল্পটির নাম ‘এজাহার’। এই গল্পটি প্রেমের কিন্তু এই প্রেমের পরিণতি খুবই করুণ। আমরা দেখতে পাই গল্পটির কেন্দ্রীয়চরিত্র হাজতে বসে তার পরিচয়সমেত স্বীকারোক্তি দিচ্ছে। পুরো গল্পটি এই স্বীকারোক্তির উপরেই নিমজ্জিত। এই স্বীকারোক্তিতে আমরা জানতে পারি তার নাম ভবেশ রঞ্জন বাগচী এবং তাকে খুনের দায়ে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। সে জয়া নামের একজনকে খুন করেছে। আমরা খুনের পেছনের করুণ গল্পটি শুনি। জয়ার বড়লোক পাত্রের সাথে বিয়ে হয়ে যায়। তবুও সে ভালো থাকে না। বিরাট বাড়িতে একা থাকে। পিসিমা এবং স্বামী চৌধুরী মশাইয়ের নির্যাতনের স্বীকার হয়। ঋত্বিক ঘটক আমাদেরকে বাঙালি মেয়েদের দুঃখ-দুর্দশার সেই চিরাচরিত গল্প শোনায় যেখানে এমন নির্যাতন সহজেই মুখ বুজে মেনে নেয় মেয়েরা। জয়াও এর ব্যতিক্রম নয়। ভবেশ তার এই নির্মম পরিস্থিতি সহ্য করতে না পেরে জয়াকে মুক্তি দিতে চায় এবং দিয়েও ফেলে। কিন্তু খুনের মাধ্যমে এই মুক্তিই কী একমাত্র পথ ছিল? এটাই কী ভালোবাসার নমুনা? আমাদের কাছে এর উত্তর নেই। ভবেশ বড় তৃপ্তি পায় খুনটি করে কারণ সেও এরপরে আত্মহত্যা করতে চেয়েছিল কিন্তু আমরা দেখি ঋত্বিক ঘটকের এই চরিত্র পুলিশের হাতে ধরা খায়। উনি এই গল্পের মাধ্যমে বহু প্রশ্ন ছুঁড়ে দেন আমাদের দিকে।

আরেকটি গল্পের নাম ‘শিখা’। গল্পটার চরিত্রই হলো মামা-ভাগ্নী। মামা তার ভাগ্নী শিখার ছোটবেলা থেকে বড়বেলার স্মৃতিচারণ করে। সময়ের সাথে সাথে একটা মানুষের আমূল পরিবর্তনের ব্যাপারটায় মামা পুরো গল্পে বলে যায়। ছোটবেলায় শিখার দুষ্টুমি, শাসন অর্থে তার উপর হাত তোলার ব্যাপারগুলো, এমনকি বাড়ির বাইরে ধাওড়ায় থাকা কৌশল্যার সাথে মিশবার ব্যাপারেও ব্যাপক অভিযোগ বাবা-মায়ের। তাছাড়া বকা দেওয়াতো আছেই। এসব থেকে নিস্তার পেতে শিখাকে মামা পাশে রাখে। তাকে সময় দেয়। শিখারও মামার প্রতি টান বাড়ে এবং একটা সময় সে এই টানের বাহুডোরে পড়ে যায়। মামার পাশাপাশি শিখার প্রতি এমন আচরণের বিপরীতে থাকে তার ঠাকুরদা কিন্তু কোনো লাভ হয় না। মেয়ে কেন খেলনার বদলে নুড়ি দিয়ে খেলবে এসব কিছু নিয়ে বিস্তর অভিযোগ বাবা-মায়ের। আমরা শিখার পাশাপাশি গল্পে ঝব্বুর মায়ের একমাত্র সন্তান ঝব্বুর চাপা পড়ে মরে যাওয়ার কাহিনিও দেখতে পাই। ঋত্বিক ঘটক এর মাধ্যমে নিম্নবিত্ত, খেটে খাওয়া মানুষদের অবস্থার জানান দেন আমাদের । এমনকি শিখাকে বোর্ডিং স্কুল দেওয়ারও বিরোধীতা করে মামা। একসময় শিখা বড় হয়।তার বিয়ে হয়ে যায়। মামার সাথে তার দূরত্ব বাড়ে। তখন তার আলাদা ধনীর জীবন। আমূল পরিবর্তন হয় শিখার। আগের সরলতা আর থাকে না। মামা তার সাথে দেখা করতে গিয়ে বোঝে সে আর আগের মতো নেই। নিভে গেছে। সামাজিক সম্পর্কের পরিবর্তনগুলো ঋত্বিক ঘটকের চরিত্রগুলো আমাদের সামনে স্পষ্ট করে। আমরা একটা উজ্জ্বল সময়কে হারাতে দেখি উনার গল্পগুলোতে।

ঋত্বিক ঘটকের আরেকটা চমৎকার গল্প হলো ‘রূপকথা’। একটা পত্রিকার সম্পাদক ও মালিককে নিয়ে। সেই মালিকের নাম হরনাথবাবু। উনার গড়নের বর্ণনা দেওয়ার পর গল্পকথক আমাদের আভাস দেন যে তিনি কোনো কারণে খুবই রাগান্বিত। আর এই রাগের কারণ হলো সম্পাদক পত্রিকায় একটি সম্পাদকীয় ছাপার জন্যে। গল্পকথক জানায় এটি হলো সোনাপুরা কটন মিলস নিয়ে যেটি সম্পাদকের ছাপানো উচিত হয়নি। সম্পাদক চেয়ারে বসে সবকিছু শুনে ৷ বাইরের প্রকৃতি দেখে। সম্পাদক সত্যের পক্ষে দাঁড়িয়ে থাকলে হরনাথবাবু তাকে বরখাস্ত করে। সম্পাদক ধীরে ধীরে ওঠে ছড়িটা নিয়ে বেরিয়ে যাবার জন্যে প্রস্তুতি নেয় কারণ সে আজকে মাথা নোয়াবে না। ২০ বছরের চাকরি জীবনে সে অনেক কিছু সহ্য করে, তাই চলে যাবার আগে সে কথার ফাঁকে ফাঁকে হরনাথবাবুর উপর ছড়ি চালায়। বেধড়ক মারে। সম্পাদকের এতোদিনকার জমিয়ে রাখা তীব্র প্রতিবাদী চরিত্র সামনে চলে আসে। সে আর আপোষ করতে চায় না। ঋত্বিক ঘটক এই আপোষ করতে না চাওয়ার পেছনে সম্পাদকের মানসিক টানাপোড়েনের জ্বলজ্বলে ইঙ্গিত টানেন যা একসময় হরনাথবাবুর রক্তে সারাঘর ছড়িয়ে যাবার মাধ্যমে সমাপ্ত হয়।তার নিথর দেহ পড়ে থাকে। কথা বলতে, ঠিকঠাক কাজ করতে না দেওয়ার ক্ষোভ কীভাবে প্রকাশিত হয় তা সম্পাদকের মাধ্যমে জানান দেয় ঋত্বিক ঘটক।

আরেকটি গল্পের কথা বলতে হয়। নাম কমরেড। মজুরদের কলের কাজ বন্ধ করা নিয়ে। তাদের ন্যায্য দাবি মানা হয়নি। তাদের নেতা ঝাব্বুর উপর ভরসা করে তরা এই আন্দোলনে নেমেছে। ফলে অনেকের চাকরি চলে গেছে। অনেকে সম্বল বেচে দিয়েছে। তবুও তারা তাদের দাবিতে অটুট থাকে। গল্পকথক লালবাহাদুর আমাদের এই কথাগুলি বলে যায়। কিন্তু একদিন মালিক পক্ষের লোকেদের সাথে ঝাব্বুকে দেখে তার মনে সন্দেহ জন্মে। সে ঝাব্বুর সাথে দেখা করতে যায়। কথার পিঠে মজুরদের নেতা ঝাব্বু আপোস করতে বলে যা লালবাহাদুরের কাছে অবাক হওয়ার মতোন কথা। মূহুর্তেই তার সামনে থাকা নেতার এতোদিনকার একটা প্রতিবাদী চিত্র মিলিয়ে যায়। সে আর তাকে চিনতে পারেনা। এখানেও খুনের ঘটনা। লালবাহাদুর এই অচেনা, এতোদিনকার প্রিয়বন্ধুকে কাপড় পেঁচিয়ে মেরে ফেলে। সে চায় না আন্দোলনের এ গতি 'আপোসের' ছলে থেমে যাক। লালবাহাদুর খুনের মাধ্যমে পাল্টা বিদ্রোহ করে। সে মজুরদের এতোদিনকার ত্যাগ দমাতে চায় না। ঋত্বিক ঘটকের গল্পে এই দুঃখগুলো, চরিত্রের এই প্রিয় থেকে প্রতিবাদী কণ্ঠের মধ্যে ঢুকে পড়বার ব্যাপারগুলো ঘুরে ফিরে আসে।

বাম মতাদর্শে বিশ্বাসী ঋত্বিক ঘটক আমাদেরকে এই প্রতিবাদী চরিত্রগুলোর মাধ্যমে সমাজের অন্তর্নিহিত সমস্যাগুলো ও কাঠামো উপচে ফেলার গল্প শোনায়। সমাজে অন্যায় ছড়িয়ে পড়েছে। ছড়িয়ে পড়েছে হতাশা। মুখ থুবড়ে পড়েছে সামাজিক কাঠামো। ঋত্বিক ঘটক এই সমাজেরই একজন হয়ে চলচ্চিত্র বানিয়েছিলেন, গল্প লিখেছিলেন। তাঁর বিশ্বাস ও চিন্তাকে ফুটিয়ে তোলবার চেষ্টা করেছিলেন। আমাদের চারপাশের ফাঁদগুলোকে ধরিয়ে দেওয়ার প্রয়াস ছিল তাঁর মধ্যে। গল্পগুলোও এর ব্যতিক্রম নয়। যার জন্যে আমরা যেমন তাঁর প্রেমের গল্পে অপূর্ণতা দেখি, তেমনি দেখি মুক্তির নামে প্রিয়জনকে খুন করতে, এতেই যেন চরিত্রের আনন্দ। তেমনি দেখি শিশুকে কঠোরতার মধ্যে রেখে তার সরলতাকে নষ্ট করে দেওয়া ফলে একটা সময় বড়লোকি জালে আটকে পড়া, যেখানে শৈশব বলতে আর কিছু থাকে না। তেমনি দেখি মৃতকে বাঁচানোর অব্যর্থ ঔষধ আবিষ্কার করে এবং এই ঔষধের তালিকা হারিয়ে ফেলার পরে পাগল হয়ে যাওয়া, তেমনি দেখি আপোসের ঘেরাটোপে না পড়ে যাওয়া, যাকে কেন্দ্র করে আন্দোলন তাঁর বিরুদ্ধেই একক বিদ্রোহ করা ইত্যাদি এইসমস্ত নানান চরিত্র ঋত্বিক ঘটকের গল্পের পরিসরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। যে চরিত্রগুলো সৃষ্টির এতোবছর পরেও আমাদেরকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে দেখো এই সমাজ কেমন,  দেখো তোমরা কোথায় আছো আর কোথায় বা পালাচ্ছো !

/জেড-এস/
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যে বিএনপির লজ্জা পাওয়া উচিত: কাদের
পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যে বিএনপির লজ্জা পাওয়া উচিত: কাদের
ভূমি ব্যবস্থাপনায় চলছে জরিপ, যেসব কাগজ প্রস্তুত রাখতে হবে
ভূমি ব্যবস্থাপনায় চলছে জরিপ, যেসব কাগজ প্রস্তুত রাখতে হবে
১৩ বছর পর ইউপি নির্বাচন, ভোটারদের মাঝে উৎসবের আমেজ
১৩ বছর পর ইউপি নির্বাচন, ভোটারদের মাঝে উৎসবের আমেজ
মার্কিন শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়েছে ইউরোপ-অস্ট্রেলিয়ায়
যুক্তরাষ্ট্রের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বিক্ষোভ অব্যাহতমার্কিন শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়েছে ইউরোপ-অস্ট্রেলিয়ায়
সর্বাধিক পঠিত
ইমিগ্রেশনেই খারাপ অভিজ্ঞতা বিদেশি পর্যটকদের
ইমিগ্রেশনেই খারাপ অভিজ্ঞতা বিদেশি পর্যটকদের
তাপপ্রবাহে যেভাবে চলবে শ্রেণি কার্যক্রম
প্রাক-প্রাথমিক বন্ধই থাকছেতাপপ্রবাহে যেভাবে চলবে শ্রেণি কার্যক্রম
এমন আবহাওয়া আগে দেখেনি ময়মনসিংহের মানুষ
এমন আবহাওয়া আগে দেখেনি ময়মনসিংহের মানুষ
বিক্রি না করে মজুত, গুদামে পচে যাচ্ছে আলু
বিক্রি না করে মজুত, গুদামে পচে যাচ্ছে আলু
মিয়ানমারে গিয়ে সেনা ট্রেনিং নিলেন ২ রোহিঙ্গা, বাংলাদেশে ঢুকলেন বুলেট নিয়ে
মিয়ানমারে গিয়ে সেনা ট্রেনিং নিলেন ২ রোহিঙ্গা, বাংলাদেশে ঢুকলেন বুলেট নিয়ে