বিশ্বের বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ বন সুন্দরবনের বাঘ সংরক্ষণে বাংলাদেশ-ভারত যৌথভাবে কাজ শুরু করেছে। একটি পাইলট প্রকল্পের মধ্য দিয়ে বাঘ হত্যা রোধ ও মানুষের ওপরে বাঘের আক্রমণ এড়াতে বেশ কিছু সিদ্ধান্ত যৌথভাবে কার্যকর করার চেষ্টা শুরু করেছে উভয় দেশ।
জানা গেছে, এই পাইলট প্রকল্পের অংশ হিসেবে বৃহস্পতিবার (১৫ ফেব্রুয়ারি) থেকে বাংলাদেশ পরীক্ষামূলক সুন্দরবনের দুটি স্থানে নাইলনের তৈরি জালের বেড়া দেওয়ার কাজ শুরু করবে।
জানা গেছে, বাংলাদেশ অংশের সুন্দরবনে বাঘের আক্রমণ রোধে বনকর্মী ও এনজিও কর্মীরা স্থানীয় মানুষজনকে, বিশেষ করে শিশুদের সচেতন করার কাজে সফল হচ্ছে। এর আগে বাংলাদেশ অংশে সুন্দরবনে নাইলনের জালগুলো বনের সীমানার প্রায় ১৮০ কিলোমিটারজুড়ে লাগানো হয়েছে। এই জাল লাগানোর ফলে বেশ কয়েক বছর ধরে আশপাশের গ্রামগুলোতে বাঘের এবং গ্রামবাসীর বনে প্রবেশের ঘটনা রোধ করতে কার্যকর ভূমিকা রেখেছে। বর্তমান পাইলট প্রকল্পের আওতায় বাংলাদেশের সাতক্ষীরা ফরেস্ট রেঞ্জের কৈখালী স্টেশনে, সুন্দরবন পশ্চিম বিভাগের অংশে এবং চাঁদপাই রেঞ্জের ধানসাগর স্টেশনে, সুন্দরবন পূর্ব বিভাগের অংশে নাইলন জালের বেড়া দেওয়া হবে।
সুন্দরবন পশ্চিমের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা ও বাংলাদেশ বন বিভাগের ‘সুন্দরবন বাঘ সংরক্ষণ প্রকল্পের’ পরিচালক আবু নাসের মোহসিন হোসেন বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘এই নাইলনের বেড়া মোট ২০ কিলোমিটার এলাকা কভার করবে, দুটি পকেটে ১০ কিলোমিটার করে। এটি একটি পাইলট প্রকল্প। যদি এটি কার্যকর হয়—তবে বেড়াটি পর্যায়ক্রমে সম্প্রসারিত করা হবে।’
তিনি আরও বলেন, ‘ভোলা নদী, যা বন ও গ্রামকে পৃথক করেছে। বছরের পর বছর ধরে ভারী পলি জমে যাওয়ার কারণে নদীর বেশিরভাগ অংশ সরু হয়ে গেছে। গ্রাম থেকে গবাদিপশু সহজেই নদী পার হয়ে বনের কাছাকাছি তৃণভূমিতে চলে যেতে পারে। বাঘও নদী পার হয়ে গ্রামে ঢুকে যেতে পারে। চাঁদপাই রেঞ্জে দুই মাস আগে বাঘের আক্রমণে এক জেলে নিহত হয়েছেন।’
এই পাইলট প্রকল্পের অংশ হিসেবে পশ্চিমবঙ্গের সুন্দরবনের দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলার কুলতলীতে দুটি স্কুল থেকে ১২ জন শিক্ষার্থীর একটি দল, যাদের বলা হয় ‘টাইগার স্কাউটস’—তারা ৪ থেকে ৯ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশ সফর করেছিল। তারা ‘বাঘ সংরক্ষণে ট্রান্স-বাউন্ডারি’র কার্যকারিতার কর্মশালায় অংশ নেয়। এছাড়া ভারতের ওয়াইল্ড লাইফ ট্রাস্ট অব ইন্ডিয়া, লোকমাতা রানী রাসমনি মিশন জয়নগরে (দক্ষিণ ২৪-পরগনা) এবং ওয়াইল্ড টিম, বাংলাদেশ—এই কর্মসূচির সঙ্গে জড়িত। বাংলাদেশে ওয়াইল্ড টিম বাঘ সংরক্ষণে স্থানীয়দের নিয়ে ব্যাপকভাবে কাজ করছে। ষষ্ঠ থেকে দশম শ্রেণির শিক্ষার্থী, যারা বনের ধারে গ্রামের স্কুলে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত তাদের নিয়ে ‘টাইগার স্কাউট’ গড়ে তোলা হয়েছে। ওয়াইল্ড টিমের সিইও এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের সাবেক অধ্যাপক মোহম্মদ আনোয়ারুল ইসলাম বলেন, ‘‘স্কাউটরা তাদের আশপাশে সচেতনতা গড়ে তোলার কাজ করছে। তারা এলাকার মানুষদের হরিণের মাংস খাওয়া থেকে বিরত রাখার বিষয়ে সচেতনতা তৈরি করছে। তারা বনজসম্পদের ওপর নির্ভরতা কমানোর গুরুত্বের ওপর প্রচার করছে। এছাড়া ‘বাঘবন্ধু’ (বাঘের বন্ধু), শিক্ষক এবং জনপ্রতিনিধিদের নিয়ে স্থানীয় জনগণের ওপর প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা করে। তারা বাঘ সংরক্ষণেও সাহায্য করে। আমাদের ৫০ জন ‘টাইগার স্কাউট’ এবং ৫৫ জন ‘বাঘবন্ধু’ রয়েছে।’
বাংলাদেশের আদলে পশ্চিমবঙ্গের কুলতলীতে সুন্দরবনের মধ্য-পূর্ব গুরগুরিয়া আদর্শ বিদ্যাপীঠ এবং অম্বিকানগর হরিপ্রিয়া উচ্চবিদ্যালয়ের দুটি শিক্ষাকেন্দ্রে টাইগার স্কাউটদের প্রশিক্ষণ দেওয়া শুরু হয়েছে। এই টাইগার স্কাউটরা ও ‘বাঘবন্ধুদের’ একটি দল বাংলাদেশের বাগেরহাট জেলার জয়মণিতে গিয়েছিল। তারা ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন ফর কনজারভেশন অব নেচারের ‘ইন্টিগ্রেটেড টাইগার হ্যাবিট্যাট কনজারভেশন প্রোগ্রামে’ অংশ নেয়। ডব্লিউটিআই’র মানব-বন্যপ্রাণী সংঘাত প্রশমন বিভাগের প্রধান অভিষেক ঘোষাল বলেন, ‘স্থানীয় মানুষের পাশাপাশি বাঘের নিরাপত্তা ও বিকাশ নিশ্চিত করতে ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে সহযোগিতামূলক প্রচেষ্টা অপরিহার্য।’ দক্ষিণ ২৪ পরগনা বন বিভাগের আধিকারিক মিলন মল বলেন, ‘বাঘেরা সীমানা জানে না। সুতরাং, আরও ভালো সহযোগিতা দরকার। আমাদের উচিত বাঘদের মন বোঝার চেষ্টা করা এবং সেভাবেই পদক্ষেপ গ্রহণ করা।’
সুন্দরবন ১০ হাজার বর্গকিলোমিটারজুড়ে বিস্তৃত, যার ৬০ শতাংশ বাংলাদেশে। ২০১৮ সালে বাংলাদেশে পরিচালিত সর্বশেষ জরিপ অনুসারে, দেশটির সুন্দরবনে ১১৪টি বাঘ ছিল। ভারতের সাম্প্রতিক বাঘ শুমারি অনুসারে, যে রিপোর্টটি এপ্রিল ২০২৩ সালে প্রকাশিত হয়েছিল, তাতে সুন্দরবনের ভারতীয় অংশে প্রায় ১০০টি বাঘ রয়েছে। ওই রিপোর্টে বলা হয়েছে, ‘সুন্দরবনের বাঘ ম্যানগ্রোভ ইকোসিস্টেমের জন্য উপযুক্ত, কিন্তু তাদের আবাসস্থল সীমাবদ্ধ। বাঘের সংখ্যা এবং ল্যান্ডস্কেপ উভয়ই বন অন্বেষণের আকারে জৈবিক হস্তক্ষেপের কারণে হুমকির মুখোমুখি। এ এলাকার পরিবেশগত অখণ্ডতা রক্ষার জন্য, বাংলাদেশ ও ভারতের মাঝে আন্তসীমান্ত সহযোগিতা এবং জ্ঞান বিনিময় অপরিহার্য।’