X
শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪
৬ বৈশাখ ১৪৩১

আড়ালেই থেকে যাচ্ছে ‘ক্রসফায়ারে’র মূল গল্প

জামাল উদ্দিন
২০ জুন ২০১৬, ০৯:৫৬আপডেট : ২০ জুন ২০১৬, ২১:৫২

বন্দুকযুদ্ধ সম্প্রতি জঙ্গি ও সন্ত্রাসী হামলা মামলার অনেক সন্দেহভাজন আসামি ‘বন্দুক যুদ্ধে’ কিংবা ‘ক্রসফায়ারে’ নিহত হচ্ছে। পুলিশ হেফাজতে নেওয়ার পর অন্য সহযোগী সন্ত্রাসী-জঙ্গিদের গ্রেফতারে অভিযানে যাওয়ার পর প্রায়ই ‘বন্দুক যুদ্ধ’ ও ‘ক্রসফায়ারে’র ঘটনা ঘটছে। এতে মূল ঘটনা আড়ালেই থেকে যাচ্ছে বলে করছেন অনেকেই। মানবাধিকার কর্মীরা মনে করছেন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হেফাজতে থাকা অবস্থায় ‘বন্দুকযুদ্ধে’ আসামির মৃত্যু কখনোই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। এতে মামলার তদন্ত কাজ যেমন বাধাগ্রস্ত হয়, তেমনি ঘটনার সঙ্গে জড়িত অন্যদের পার পেয়ে যাওয়ারও আশঙ্কা থাকে।  এদিকে,  আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কর্মকর্তারাও মনে করেন, এসব আসামি বেঁচে থাকলে তদন্তকাজে সহায়ক হতো।
পুলিশ ও মানবাধিকার সংগঠনগুলোর দেওয়া তথ্য অনুযায়ী চলতি জুন মাসেই আজ পর্যন্ত ‘বন্দুক যুদ্ধ’ ও ‘ক্রসফায়ারে’ অন্তত, ১০ জন নিহত হয়েছেন। নিহতদের বেশিরভাগই বিভিন্ন জঙ্গি সংগঠনের সদস্য জানিয়েছে পুলিশ। যারা লেখক, ব্লগার ও প্রকাশক হত্যা ও হত্যাচেষ্টার সঙ্গে জড়িত ছিলেন। আইন ও সালিশ কেন্দ্রের তথ্য অনুযায়ী গত জানুয়ারি থেকে মে মাস পর্যন্ত পাঁচ মাসে আইন শৃঙ্খলারক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে কথিত বন্দুকযুদ্ধ কিংবা ক্রসফায়ারে ৫৩ জন নিহত হয়েছেন। ২০১৫ সালে হেফাজতে থাকা অবস্থায় ও ক্রসফায়ারে মারা যান ১৯২ জন। যাদের অনেকেই অনেক গুরুত্বপূর্ণ জঙ্গি ও সন্ত্রাসী হামলা মামলার আসামি ছিলেন।
মাদারীপুরের কলেজ শিক্ষক রিপন চক্রবর্তীর ওপর হামলার ঘটনায় গ্রেফতার হওয়া ফাইজুল্লাহ ফাহিম শনিবার বন্দুকযুদ্ধে নিহত হওয়ার পর নতুন করে হেফাজতে মৃত্যু নিয়ে আলোচনার ঝড় ওঠে। যে আসামিকে জনতা ধরে পুলিশে দিলো, হেফাজতে নেওয়ার পর সেই বন্দুকযুদ্ধে মারা গেলো। এতে নেপথ্যে থাকা খুনি ও তাদের পৃষ্ঠপোষকরা আড়াল হয়ে গেলো কিনা এমন প্রশ্নও অনেকের।
জনতার হাতে আটক জঙ্গি ফাইজুল্লাহ ফাহিম বন্দুকযুদ্ধে নিহত হওয়ার ঘটনায় রিপন চক্রবর্তী হত্যা চেষ্টা মামলাটির তদন্ত ব্যাহত হবে কিনা—এমন প্রশ্নের জবাবে মাদারীপুরের পুলিশ সুপার সারোয়ার হোসেন বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘মামলার তদন্তে কোনও ব্যাঘাত ঘটবে না।’ এরপর তিনি বিরক্তি প্রকাশ করে বলেন, ‘এ নিয়ে অনেক বলেছি। আর বলতে চাই না।’
গত ১৩ জুন জয়পুরহাট সদর উপজেলার ভাদসা ইউপি চেয়ারম্যান আবুল কালাম আজাদ হত্যা মামলার এজাহারভুক্ত দুই আসামি মোহাম্মদ সোহেল ও মুনির হোসেন বন্দুকযুদ্ধে মারা যান। এতেও মামলার তদন্তে কিংবা বিচারে কোনও প্রভাব ফেলবে না বলে মনে করেন ওই জেলার পুলিশ সুপার মোল্লা নজরুল ইসলাম। বাংলা ট্রিবিউনকে তিনি বলেন, মামলার তদন্তের ধারাবাহিকতা রয়েছে। এ মামলার তিন আসামি আদালতে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দিয়েছেন। কাজেই বন্দুক যুদ্ধে দুই জনের নিহতের ঘটনায় মামলার তদন্ত ও বিচারে কোনও ব্যাঘাত ঘটবে না। 

সর্বশেষ রাজধানীতে গোয়েন্দা পুলিশের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে নিহত হন ব্লগার ও লেখক অভিজিৎ রায় হত্যা মামলার প্রধান সন্দেহভাজন আসামি শরীফুল ইসলাম শরীফ। লেখক, প্রকাশক ও ব্লগার হত্যার সব ঘটনার সঙ্গে নিহত শরীফের সম্পৃক্ততা ছিল বলে দাবি পুলিশের। সাকিব, সালেহ, আরিফ ও হাদী নাম ব্যবহার করে দীর্ঘদিন থেকে পরিচয় গোপন করে আসছিলেন শরিফ। তাকে ধরিয়ে দিতে সম্প্রতি ডিএমপি’র পক্ষ থেকে পাঁচ লাখ টাকা পুরস্কারও ঘোষণা করা হয়েছিল। ব্লগার ও লেখক ও প্রকাশক হত্যাসহ টার্গেট কিলিংয়ে জঙ্গিরা জড়িত থাকার বিষয়ে পুলিশ নিশ্চিত হলেও তাদের ধরতে হিমশিম খাচ্ছিলেন গোয়েন্দারা। এসব হত্যাকাণ্ডের অন্যতম হোতা শরীফুল ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত হলেও এসব মামলায় তদন্ত বাধাগ্রস্ত হবে না বলে জানান ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের যুগ্ম কমিশনার আবদুল বাতেন।

রবিবার ডিএমপি’র মিডিয়া সেন্টারে এক সংবাদ সম্মেলনে গোয়েন্দা পুলিশের এই কর্মকর্তা বলেন, বিভিন্ন চাঞ্চল্যকর মামলার প্রধান আসামি ও সন্দেহভাজন ব্যক্তির মৃত্যুতে মামলার তদন্তে কোনও ব্যাঘাত ঘটে না। তবে এসব আসামিকে দিয়ে ১৬৪  ধারায় আদালতে জবানবন্দি দেওয়াতে পারলে মামলার তদন্তকাজে সহায়ক হতো বলেও মনে করেন তিনি।

আবদুল বাতেন বলেন, ‘বন্দুকযুদ্ধে’র বিষয়ে আগে থেকে কিছু বলা যায় না। অভিযানে যাওয়ার পর আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীগুলো এমন পরিস্থিতির মুখে পড়ে। তখন আক্রান্ত হলেই কেবল তারা আত্মরক্ষার্থে পাল্টা আক্রমন চালায়। তখন এসব প্রাণহানির ঘটনা ঘটে।

এরআগে বুধবার রাতে আনসারুল্লাহর সদস্য ও প্রকাশক আহমেদুর রশিদ টুটুলের ওপর হামলার ঘটনায় জড়িত থাকার অভিযোগে সুমন হোসেন পাটোয়ারী ওরফে সাকিব ওরফে শিহাব ওরফে সাইফুলকে গ্রেফতার করা হয়। তার গ্রেফতারের তথ্য জানাতে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে ডিএমপি’র অতিরিক্ত কমিশনার মনিরুল ইসলাম সাংবাদিকদের জানিয়েছিলেন, টুটুলের ওপর হামলার ঘটনার সমন্বয়ক ছিল শরীফ। তাকে ধরা গেলে আনসারুল্লাহর দ্বিতীয় ও প্রথম সারির জঙ্গি কারা এবং কাদের নির্দেশে এসব হত্যাকা- ঘটানো হচ্ছে সেটা জানা যেত। তার দু’দিনের ব্যবধানে গোয়েন্দা পুলিশের ‘বন্দুকযুদ্ধে’ মারা গেলেন শরীফ। 

‘ক্রসফায়ারে’ নিহত হলে মামলার তদন্ত বাধাগ্রস্ত হয় কিনা—জানতে চাইলে র‌্যাবের মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক কমান্ডার মুফতি মাহমুদ বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, মামলার তদন্ত বাধাগ্রস্ত হয় কিনা—সেটা পুলিশ বলতে পারবে। তবে র‌্যাবের সঙ্গে এ পর্যন্ত যারা ‘ক্রসফায়ারে’ মারা গেছেন তারা প্রত্যেকেই দাগী সন্ত্রাসী। র‌্যাব-সন্ত্রাসী গুলি-পাল্টা‍গুলির সময় অনেক র‌্যাব সদস্য আহত হয়েছেন। যাদের অনেকেই এখনও চিকিৎসাধীন রয়েছেন। যাদের একজন র‌্যাব-১২-এর এসআই মুনির। ‘বন্দুকযুদ্ধে’র সময় তার গলায় গুলিবিদ্ধ হয়েছিল। এছাড়া আক্রান্ত হলে আত্মরক্ষার অধিকার তো আইনই তাদের দিয়েছে।

অন্যদিকে মানবাধিকারকর্মীরা বলছেন, ভিন্ন কথা। তারা বলছেন, ‘ক্রসফায়ার’ কিংবা ‘বন্দুকযুদ্ধে’ আসামি বা সন্দেহভাজন ব্যক্তির মৃত্যু হলে তদন্ত বাধাগ্রস্ত হবে। নেপথ্যে থাকা অনেক তথ্যই আর জনসম্মুখে আসবে না।

আইন ও সালিশ কেন্দ্রের ভারপ্রাপ্ত নির্বাহী পরিচালক নূর খান বলেন, ‘ক্রসফায়ার’ কিংবা ‘বন্দুকযুদ্ধে’র সব ঘটনার গল্প একই। এছাড়া গুরুত্বপূর্ণ একজন আসামিকে নিয়ে যখন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা অভিযানে যায়, তখন আসামির সার্বিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করা জরুরি। হেফাজতে মৃত্যু কখনোই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না।

নূর খান বলেন, একটি মামলার তদন্তসহ বিভিন্ন পর্যায়ে প্রয়োজন হতে পারে একজন আসামির। সেক্ষেত্রে ওই আসামি যদি ‘বন্দুকযুদ্ধে’ মারা যান, তাহলে ওই মামলার তদন্ত বাধাগ্রস্ত হওয়াটাই স্বাভাবিক। এছাড়া সহযোগী জঙ্গি, সন্ত্রাসী ও নেপথ্যে থাকা কুশলীবদের আড়াল করার জন্য এসব ‘ক্রসফায়ার’ কিংবা ‘বন্দুকযুদ্ধ’ হয় কিনা—সেই প্রশ্নও সাধারণ মানুষের মনে আসতে পারে বলে মনে করেন তিনি।

/এমএনএইচ/আপ- এপিএইচ

আরও পড়ুন:

রবিনের রিমান্ড শেষ, এখনও অনিশ্চয়তায় পুলিশ

অভিজিৎ হত্যায় সন্দেহভাজন শরীফ ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত

জিডি করে তদন্ত: এত অস্ত্র কোথা থেকে এলো?

সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
যুক্তরাষ্ট্র দূতাবাসের পুরস্কার পেলেন কুবির চার শিক্ষার্থী
যুক্তরাষ্ট্র দূতাবাসের পুরস্কার পেলেন কুবির চার শিক্ষার্থী
গরমে বেড়েছে অসুখ, ধারণক্ষমতার তিন গুণ বেশি রোগী হাসপাতালে
ময়মনসিংহ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালগরমে বেড়েছে অসুখ, ধারণক্ষমতার তিন গুণ বেশি রোগী হাসপাতালে
টিভিতে আজকের খেলা (১৯ এপ্রিল, ২০২৪)
টিভিতে আজকের খেলা (১৯ এপ্রিল, ২০২৪)
মিয়ানমার থেকে চোরাই পথে আসা ৫ টন কফি পাউডার জব্দ
মিয়ানমার থেকে চোরাই পথে আসা ৫ টন কফি পাউডার জব্দ
সর্বাধিক পঠিত
সয়াবিন তেলের দাম পুনর্নির্ধারণ করলো সরকার
সয়াবিন তেলের দাম পুনর্নির্ধারণ করলো সরকার
ফিলিস্তিনের পূর্ণ সদস্যপদ নিয়ে জাতিসংঘে ভোট
ফিলিস্তিনের পূর্ণ সদস্যপদ নিয়ে জাতিসংঘে ভোট
ডিএমপির ৬ কর্মকর্তার বদলি
ডিএমপির ৬ কর্মকর্তার বদলি
পিএসসির সদস্য ড. প্রদীপ কুমারকে শপথ করালেন প্রধান বিচারপতি
পিএসসির সদস্য ড. প্রদীপ কুমারকে শপথ করালেন প্রধান বিচারপতি
নিজ বাহিনীতে ফিরে গেলেন র‍্যাবের মুখপাত্র কমান্ডার মঈন
নিজ বাহিনীতে ফিরে গেলেন র‍্যাবের মুখপাত্র কমান্ডার মঈন