X
শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪
১৫ চৈত্র ১৪৩০

ঢামেক হাসপাতালে অ্যাম্বুলেন্স সিন্ডিকেট

রাফসান জানি
১৭ অক্টোবর ২০১৬, ১১:৩৩আপডেট : ১৭ অক্টোবর ২০১৬, ১৭:০৬

ঢামেক হাসপাতালে অ্যাম্বুলেন্স সিন্ডিকেট

সড়ক দুর্ঘটনায় আহত ইদ্রিস আলীর ছেলে মাসুম মিয়াকে হাসপাতাল থেকে রিলিজ দিয়েছে দুপুর আড়াইটায়। ছেলেকে টঙ্গি নিয়ে যেতে সাড়ে ৩ ঘণ্টায়ও খুঁজে পেলেন না একটি অ্যাম্বুলেন্স। এক-দুইটি অ্যাম্বুলেন্স রোগী নিয়ে মেডিক্যালের জরুরি বিভাগে আসলেও, পুনরায় রোগী নিয়ে যেতে রাজি হচ্ছে না। ঝামেলার ভয়ে কেউ আগ্রহ দেখাচ্ছে না। নিরুপায় ইদ্রিস আলী  সন্ধ্যা ৬ টার দিকে বাইরে থেকে একটি প্রাইভেটকার এনে ছেলেকে নিয়ে বাড়ির পথে রওনা হন। এ দৃশ্য ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালের জরুরি বিভাগ এলাকার। শুধু ইদ্রিস আলী নন, এমন আরও অসংখ্য রোগী বাড়ি ফেরা বা অন্য মেডিক্যালে যাওয়ার জন্য গতকাল রবিবার কোনও অ্যাম্বুলেন্স সেবা পাননি। অপরদিকে, হাজারো রোগীর জন্য মাত্র ৫টি সরকারি অ্যাম্বুলেন্সের মধ্যে সচল ৪টির সেবা কোথায় পাওয়া যাবে, সেই নির্দেশনাও খুঁজে পাননি রোগীদের স্বজনরা।

ঢামেক প্রাঙ্গণে অ্যাম্বুলেন্স সংকটের নেপথ্যের কারণ খোঁজ করতে গিয়ে জানা যায়, মূলত এখানে রয়েছে একটি শক্তিশালী অ্যাম্বুলেন্স সিন্ডিকেট। ঢামেকের চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীরা এসব অ্যাম্বুলেন্সের মালিক। এই সিন্ডিকেটের কারণে বেশিরভাগ সময় জিম্মি হয়ে পড়েন এখানে আসা রোগীরা। রোগী বা লাশ আনা নেওয়ার জন্য অতিরিক্ত ভাড়া আদায়ের অভিযোগ রয়েছে এদের বিরুদ্ধে। বাইরে থেকে আসা অ্যাম্বুলেন্সগুলো এদের কারণে রোগী আনা নেওয়া করতে পারছে না। ঢামেক প্রশাসন কিংবা পুলিশ এই সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে কখনও কার্যকর ব্যবস্থা নিয়েছে, এমন নজির নেই।।    

গত শনিবার সকাল ৯টায় ঢামেক হাসপাতালের ভেতরে প্রবেশের সময় ‘মানব সেবা’ নামক একটি অ্যাম্বুলেন্সের চাপায় নিহত হন চার জন। এ ঘটনায় ওই গাড়িতে চালকের আসনে থাকা সোহেলকে আটক করে পুলিশ। এরপর থেকেই মেডিক্যাল গেটের বাগান সংলগ্ন রাস্তার ওপরে অবস্থান করা বেসরকারি অ্যাম্বুলেন্সগুলোর মালিকরা সেগুলো সরিয়ে নেন। দুপুরে শাহবাগ থানা পুলিশ ও ট্রাফিক পুলিশ মেডিক্যাল ফটকের সামনের রাস্তার দু’ধারে ফুটপাতে থাকা দোকান উচ্ছেদসহ রাস্তার ওপর থাকা গাড়িগুলো সরিয়ে দেয়। একইদিনে রাত ৯টার দিকে কিছু অ্যাম্বুলেন্স রাস্তার ওপরে রাখার চেষ্টা করলে সেগুলোও সরিয়ে দেয় পুলিশ।

নিরাপত্তা না থাকার অজুহাতে নিজেদের নিয়ন্ত্রণে থাকা ৭০-৮০টি অ্যাম্বুলেন্সের সেবা বন্ধ করে দেন মালিকরা। সেবা বন্ধের পাশাপাশি তারা বাইরে থেকে আসা অ্যাম্বুলেন্সগুলোকেও ঢামেক থেকে রোগী নিতে বাধা দিচ্ছেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। কোনও কোনও ক্ষেত্রে বাইরে থেকে আসা অ্যাম্বুলেন্সের চালকদের সঙ্গে ভেতরে থাকা মালিক-চালক সিন্ডিকেটের লোকদের বাকবিতণ্ডার ঘটনাও ঘটেছে।

মালিক-চালক সিন্ডিকেটের  বাধার কারণে রবিবার সারাদিন অ্যাম্বুলেন্সের অপেক্ষায় জরুরি বিভাগের সামনে দাঁড়িয়ে দুর্ভোগ পোহাতে দেখা গেছে রোগী ও স্বজনদের। দীর্ঘ সময় ধরে অ্যাম্বুলেন্সের জন্য অপেক্ষারত মোশাররফ হোসেন জানান, ছোটভাই মামুনকে পেটে ব্যাথার কারণে ঢামেক হাসপাতালের ২১৮ নম্বর ওয়ার্ডে ভর্তি করা হয়। চিকিৎসা শেষে হাসপাতাল থেকে রিলিজ পেয়ে প্রায় ২ ঘন্টা ধরে গাড়ির জন্য অপেক্ষা করছেন তারা। কিন্তু কোনও গাড়ি পাচ্ছেন না।

একই অভিযোগ করেন ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে আসা মো. মানিক মিয়া। তিনি বলেন, ‘এইখানে কি হইছে বাবা জানি না। মেলা সময় দাঁড়ায়া থাইককাও অ্যাম্বুলেন্স পাইতাছি না। কেউ যাইতে চায় না।’

তিনি আকুতি জানিয়ে বলেন, ‘ঝামেলা হইলে এইডা মিটায়া ফেলতে কন। আমাদের কেন কষ্ট দিচ্ছেন? আমারে একটা অ্যাম্বুলেন্স ঠিক কইরা দেও বাবা।’

ঢামেক হাসপাতালে আসা অ্যাম্বুলেন্সগুলোতে রোগী তুলতে বাধা দেওয়া হচ্ছে, এ বিষয়ে পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ এসআই বাচ্চু মিয়া’র দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে তিনি বলেন, ‘আমাদের কাছে এ ধরনের কোনও অভিযোগ আসেনি। আমি খোঁজ নিয়ে দেখছি।’

ঢামেকে কৃত্রিম অ্যাম্বুলেন্স সংকটের কারণ খুঁজতে গিয়ে দেখা গেছে, আনুমানিক ৭০-৮০টি অ্যাম্বুলেন্স রয়েছে বেসরকারি মালিকানায়।  ‘বেসরকারি অ্যাম্বুলেন্স পরিচালনা মালিক সমিতি’ নামে একটি অনিবন্ধিত সংগঠনও রয়েছে। ঢামেক জরুরি বিভাগের ফটকের সামনে মূল সড়কের দু’পাশে প্রায় অর্ধেকের বেশি রাস্তা দখল করে রাখে এই অ্যাম্বুলেন্সগুলো।  একক আধিপত্য বিস্তার করে এই মালিকরা তাদের ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে। মালিকদের অধিকাংশই হাসপাতালের চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী। তারা কেউই নিজেদের মালিকানার কথা স্বীকার করেন না।

কাউসার নামে একজন অ্যাম্বুলেন্স মালিক জানান, তাদের গাড়িগুলোর কোনও নিরাপত্তা নেই। কয়েকদিন পরপর পুলিশ আইসা তাদের সরিয়ে দেয়। রেকার করার নামে টাকা নেয়। ড্রাইভার হেল্পারদের ধরে নিয়ে যায়। এসব কারণে নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন। আর এ কারণেই তারা অ্যাম্বুলেন্স সেবা বন্ধ রেখেছেন।

তিনি বলেন, ‘আমাদের চাকা ঘুরলে টাকা আসে। চাকা বন্ধ রাইখাতো  লাভ হচ্ছে না। সুদের ওপর টাকা আইনা গাড়ি কিনছি। একদিন চালাইয়া আমার থাকবো পাঁচশো থেকে এক হাজার টাকা। পুলিশের রেকার থেইকা ছুটাইতে লাগে দুই-আড়াই হাজার টাকা। তাইলে আর গাড়ি চালাইয়া কী লাভ?’

একই কথা জানান আরেক অ্যাম্বুলেন্সের মালিক পাপ্পু। তিনি বলেন, ‘আমরা মানব সেবার কাজ করি। আমাদের কোনও নিরাপত্তাই নাই। যে যার মতো আইসা তুইলা দেয়। একটা গাড়ি অ্যাক্সিডেন্ট করলো, আর আমাদের তুইলা দিলো। আমাদের নিরাপত্তা দিতে হবে। নইলে আমরা গাড়ি নামাবো না।’

এসমস্যার সমাধান কী জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমাদের জন্য মেডিক্যাল প্রশাসন থেকে  নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। তাইলেই আমরা গাড়ি নামামু।’

এ ব্যাপারে ‘বেসরকারি অ্যাম্বুলেন্স পরিচালনা মালিক সমিতি’র সাধারণ সম্পাদক দিনারের সঙ্গে মুঠোফোনে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করেও সংযোগ পাওয়া যায়নি।

জানাগেছে, সমিতির সভাপতি ওসমান হলেও দিনার অ্যাম্বুলেন্সগুলো নিয়ন্ত্রণ করেন। এতে কয়েকজন লাইনম্যান হিসেবে কাজ করেন। যারা প্রতিটি গাড়ি থেকে সপ্তাহে ৩’শ টাকা ও দিনে ২০টাকা করে তোলেন। লাইনম্যানদের একজন হাসেম। তার সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করলে, তিনি এ ব্যাপারে কথা বলতে রাজি হননি।

এদিকে ঢামেক হাসপাতালে প্রতিদিন হাজারো রোগীর আসা যাওয়া থাকলেও মাত্র ৫টি অ্যাম্বুলেন্স রোগী সেবার জন্য রয়েছে বলে জানিয়েছেন ঢামেক হাসপাতালের সরকারি অ্যাম্বুলেন্স চালক  নান্নু মিয়া।

সরকারি অ্যাম্বুলেন্স খাতা-কলমে মাত্র ৫টি থাকলেও এর মধ্যে সচল রয়েছে  চারটি। আর সচল অ্যাম্বুলেন্সগুলোর সেবাও খুব সহজে পাওয়া যায় না বলে অভিযোগ ঢামেক হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসা রোগী ও স্বজনদের।

জরুরি বিভাগের ঠিক বিপরীত পাশে একটি সাইনবোর্ডে বড় করে ‘সরকারি অ্যাম্বুলেন্স সার্ভিস’ লেখা থাকলেও যোগাযোগের কোনও নম্বর খুঁজে পাওয়া যায়নি।

তবে সরকারি অ্যাম্বুলেন্স সেবা পেতে হাসপাতালের বিভিন্ন দেয়ালে লিফলেট লাগানো রয়েছে বলে জানান ঢামেক হাসপাতালের উপ-পরিচালক খাজা আব্দুল গফুর। তিনি বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘বাইরের অ্যাম্বুলেন্স যাবে কি যাবে না,সেটা দেখার বিষয় আমাদের না। জরুরি বিভাগসহ বিভিন্ন ওয়ার্ডের দেয়ালে অ্যাম্বুলেন্স সেবা নম্বর ১৬২৬৩ তে ফোন করে সেবা নেওয়ার জন্য লিফলেট লাগানো হয়েছে। এই নম্বরে কল দিলেই অ্যাম্বুলেন্স সেবা পাওয়া যাবে।’

সারাদিন সেবা নিতে আসা রোগী ও স্বজনরা  দুর্ভোগ পোহালেও  ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মোহাম্মদ মিজানুর রহমান জরুরি বিভাগ এলাকায় আসেন সন্ধ্যার আগে। সঙ্গে নিয়ে আসেন শাহবাগ থানার পুলিশ। নির্দেশনা দিয়ে যান পুলিশকে।

পরিচালকের পক্ষ থেকে কী নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে জানতে চাইলে শাহবাগ থানার এসআই  মোস্তাফিজুর রহমান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘স্যার বলে গেলেন ভিড় কমাতে। বাইরের গাড়ি দীর্ঘ সময় দাঁড়াতে দেওয়া যাবে না। যদি কোনও গাড়ি রোগী নিতে বাইরে থেকে আসে তবে ৫-১০ মিনিটের মধ্যে রোগী নিয়ে চলে যাওয়ার  নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

পরিচালকের এ নির্দেশের পর পুলিশের তৎপরতা বৃদ্ধি পায়। সড়িয়ে দেওয়া হয় প্রাইভেট কারসহ সিএনজি চালিত অটোরিক্শাগুলো। তবে সন্ধ্যা ৭টা নাগাদ হাসপাতাল এলাকাতেই অবস্থান করছিলেন অঘোষিতভাবে ধর্মঘট ডেকে ‘অ্যাম্বুলেন্সের কৃত্রিম সংকট’ সৃষ্টিকারী মালিক-চালক সিন্ডিকেটের সদস্যরা।

আরজে/এপিএইচ/

সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
ক্যানসারে আক্রান্ত অভিনেতা রুমি, ভর্তি হাসপাতালে
ক্যানসারে আক্রান্ত অভিনেতা রুমি, ভর্তি হাসপাতালে
বুয়েটে মধ্যরাতে ছাত্রলীগের প্রোগ্রাম, ক্লাস-পরীক্ষা বর্জন শিক্ষার্থীদের
বুয়েটে মধ্যরাতে ছাত্রলীগের প্রোগ্রাম, ক্লাস-পরীক্ষা বর্জন শিক্ষার্থীদের
শিশুশিক্ষার্থীকে বেধড়ক মারপিট, মাদ্রাসাশিক্ষক আটক
শিশুশিক্ষার্থীকে বেধড়ক মারপিট, মাদ্রাসাশিক্ষক আটক
এবার ‘হুব্বা’ নামে হলো গানচিত্র
এবার ‘হুব্বা’ নামে হলো গানচিত্র
সর্বাধিক পঠিত
অ্যাপের মাধ্যমে ৪০০ কোটি টাকার রেমিট্যান্স ব্লক করেছে এক প্রবাসী!
অ্যাপের মাধ্যমে ৪০০ কোটি টাকার রেমিট্যান্স ব্লক করেছে এক প্রবাসী!
প্রথম গানে ‘প্রিয়তমা’র পুনরাবৃত্তি, কেবল... (ভিডিও)
প্রথম গানে ‘প্রিয়তমা’র পুনরাবৃত্তি, কেবল... (ভিডিও)
বিএনপির ইফতারে সরকারবিরোধী ঐক্য নিয়ে ‘ইঙ্গিতময়’ বক্তব্য নেতাদের
বিএনপির ইফতারে সরকারবিরোধী ঐক্য নিয়ে ‘ইঙ্গিতময়’ বক্তব্য নেতাদের
নেচে-গেয়ে বিএসএমএমইউর নতুন উপাচার্যকে বরণে সমালোচনার ঝড়
নেচে-গেয়ে বিএসএমএমইউর নতুন উপাচার্যকে বরণে সমালোচনার ঝড়
চিয়া সিড খাওয়ার ৮ উপকারিতা
চিয়া সিড খাওয়ার ৮ উপকারিতা