X
শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪
১৫ চৈত্র ১৪৩০

পরিবার নেই পাশে, থাকে না রাষ্ট্রও

জাকিয়া আহমেদ
০১ ডিসেম্বর ২০১৬, ০৮:০৩আপডেট : ০১ ডিসেম্বর ২০১৬, ১৪:১৮

পরিবার নেই পাশে, থাকে না রাষ্ট্রও দেশে বেশিরভাগ এইডস রোগীরাই পরিবার ও সমাজে নিজেদেরকে এইচআইভি পজিটিভ বা আক্রান্ত হিসেবে প্রকাশ করে না। কারণ, কারও এইডস রোগের কথা  প্রকাশ পেলে পরিবার, সমাজ কিংবা রাষ্ট্র কেউই পাশে থাকে না। এ কারণে তারা পরিবারকে জানায় না। ফলে পরিবারেরই কেউ জানেই না তার স্বজনটি এইচআইভিতে আক্রান্ত। আর যাদের কথা কোনওভাবে প্রকাশিত হয়ে পড়ে তারা চাকুরি হারান, স্বজন হারান, হারান পরিবারের মানুষগুলোকে এবং রাষ্ট্র থেকেও কোন সহযোগিতা পান না। কয়েকজন এইচআইভি পজিটিভ রোগীর সঙ্গে কথা বলে এসব বিষয় জানা গেছে। এইডসবিরোধী প্রচারণার সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা জানাচ্ছেন, সচেতনতার অভাবেই এমনটা ঘটছে।

কয়েকমাস আগে ঢাকার একটি সরকারি হাসপাতালে হৃদরোগের চিকিৎসা করাতে হাসপাতালে ভর্তি হন এইচআইভি পজিটিভ সালাউদ্দিন (ছদ্মনাম)। কিন্তু সেখানকার চিকিৎসকরা তার এইচআইভি পজিটিভের কথা শোনার পর তাকে সেখানে চিকিৎসা দিতে অস্বীকৃতি জানান। বাধ্য হয়েই সরকারি ওই হাসপাতাল ছেড়ে তাকে চলে আসতে হয়। হৃদরোগের চিকিৎসা করাতে হয় বেসরকারি সংগঠন মুক্ত আকাশ বাংলাদেশ-এর মাধ্যমে। সালাউদ্দিন সৌদি আরব থাকতেন, ১৯৯৮ সালে তার শরীরে এইচআইভি  ধরা পড়ে। এরপরই তাকে চাকুরিচ্যুত করে দেশে ফেরত পাঠায় কর্তৃপক্ষ। জানা গেল, সালাউদ্দিনের এইচআইভি পজিটিভ জানার পর চিকিৎসকরা তাকে বলেছেন, আপনি আর আমাদের কাছে আসবেন না। আপনাকে আমরা চিকিৎসা দিতে পারব না।

এইচআইভি আক্রান্ত ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এই ‘জনগোষ্ঠী’ পরিবার, সমাজ কিংবা রাষ্ট্র কোথাও থেকে সহযোগিতা পায় না। তাদের নিয়ে সমাজে যে প্রচলিত ভ্রান্ত ধারনা রয়েছে সেখান থেকে কেউ বের হতে পারছে  না।  একধরণের ভীতি তাদেরকে একাকী করে রেখেছে। এমনকি, কোনও পরিবারের কেউ যদি এইচআইভি পজিটিভ হন তাহলে তার পুরো পরিবারও সামাজিকভাবে হেয় হচ্ছেন, অনেকটা একঘরে করে রাখার মতো। তাদেরকে চাকুরিচ্যুত করা হয়, বিদেশে থাকলে দেশে পাঠিয়ে দেওয়া হয়, দেশে এসে নিজ দেশেও হতে হয় পরবাসী।

প্রসঙ্গত, বাংলাদেশে এইচআইভি সংক্রমণের হার এখনও শূন্য দশমিক এক শতাংশেরও নীচে। ঝুঁকিপূর্ণ জনগোষ্ঠীর মধ্যে ১ শতাংশেরও কম।  সম্প্রতি জাতিসংঘের সদর দফতরে অনুষ্ঠিত এক সভায় স্বাস্থ্যসচিব সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম জানিয়েছেন, বাংলাদেশে এইচআইভি সংক্রমণের হার শতকরা এক ভাগেরও নিচে। একইসঙ্গে, শহরাঞ্চলের কোনও কোনও জায়গায় নেশাকারী কিছু ব্যক্তির মধ্যে বেশি মাত্রায় এইচআইভি সংক্রমণের হার রয়েছে বলেও জানিয়েছেন তিনি।

এইচআইভি পজিটিভ আক্রান্তদের নিয়ে কাজ করে বেসরকারি সংগঠন মুক্ত আকাশ বাংলাদেশ। প্রতিষ্ঠানটির নির্বাহী পরিচালক এমএস মুক্তি বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘এইচআইভি পজিটিভরা বিভিন্ন ধরণের বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন। তাদের নিয়ে নানা স্টিগমা রয়েছে সমাজে।এখন পর্যন্ত তারা নিজেদের কথা বলে হাসপাতাল থেকে চিকিৎসা নিতে পারেন না, পরিবার তাদের গ্রহণ করে না, সমাজ তাদের ভিন্ন দৃষ্টিতে দেখে, রাষ্ট্র তাদের কোনও মৌলিক সুবিধাই দিতে পারে না।’

এমএস মুক্তি বলেন, ‘আমাদের দেশে চিকিৎসকরা এই রোগটা সনাক্ত করার বেলায় উদাসীন।চিকিৎসার ক্ষেত্রে এসব রোগীরা সব হারিয়ে আমাদের কাছে আসে। তাহলে এসব মানুষ কোথায় যাবে চিকিৎসার জন্য? আর আমরা সরকারের অর্থায়নে এইডস আক্রান্তদের নিয়ে কাজ করি। তবে সরকারি অর্থায়ন ৩১ ডিসেম্বরে শেষ হয়ে যাবে, তখন আমাদের কী হবে আমরা জানি না। এ বিষয়ে কোনও উদ্যোগও নেওয়া হয়নি। সরকার ও দাতাদের কাছ থেকে আমরা এ বিষয়ে কোনও আশ্বাস পাইনি।’

একইসঙ্গে প্রচার প্রচারণার অভাবে এইডস রোগীরা বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন বলে জানিয়েছেন বেসরকারি সংগঠন আশার আলো-র নির্বাহী পরিচালক হাবিবা আক্তার। তিনি বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘প্রচারণার অভাবে এই রোগ নিয়ে সচেতনতা তৈরি হচ্ছে না এবং এর প্রতিরোধের বিষয়ে মানুষ কিছু জানতে পারছে না। কারণ, প্রচারের মাধ্যমেই মানুষ জানতে পারত, কীভাবে এইডস ছড়ায় এবং এটা প্রতিরোধের জন্য কী করা উচিত।একইসঙ্গে এর মাধ্যমে তাদের প্রতি যেসব বৈষ্যম তৈরি হয় পরিবার ও সমাজে সেগুলো দূর হবে।এভাবেই একসময় এসব মানুষগুলোকে তাদের পরিবার এবং সমাজ গ্রহণ করবে। এইডসকে অন্যান্য সব রোগের মতোই দেখতে হবে- এই সচেতনতা তৈরি করতে হবে সমাজে।’

এইচআইভি পজিটিভ সনাক্ত হওয়ার পর থেকে ২০১৫ সালের ১ ডিসেম্বর পর্যন্ত জরিপ অনুযায়ী দেশে এইচআইভি পজিটিভ রোগীর সংখ্যা ৪ হাজার ১৪৩ জন বলে জানান হাবিবা আক্তার। তবে এই সংখ্যা প্রায় ৯ হাজার হতে পারে বলেও জানান তিনি। আক্রান্তদের মধ্যে ৬০০ জন মারা গেছেন।

প্রসঙ্গত, বাংলাদেশের পাশের দেশ নেপালে ৪৯ হাজার, ভারতে দুই দশমিক এক লাখ, ভুটানে এক হাজার, পাকিস্তানে ৮৭ হাজার, মালয়শিয়াতে ৮২ হাজার, মিয়ানমারে ২ লাখ, থাইল্যান্ডে সাড়ে চার লাখ মানুষ এইচআইভিতে আক্রান্ত।

চিকিৎসা ক্ষেত্রে এইডস রোগীরা বৈষম্যের শিকার হচ্ছে এ অভিযোগের কথা আমলে নিয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রোভিসি ডা. শরফুদ্দিন আহমেদ বলেন, “বাঁচতে হলে জানতে হবে’ এই স্লোগান দিয়ে এইডসের প্রচারণা শুরু হয়েছিল। আমি বলতে চাই, একজন রোগীকে  রোগী হিসেবেই দেখতে হবে। আমাদের মানতে হবে তিনি কোনও অপরাধ করেননি এবং এর জন্য তিনি দায়ীও নন। একথা মাথায় রেখে তাদের চিকিৎসা দিতে হবে।’ চিকিৎসকরা যেন এইডস আক্রান্ত রোগীদের অন্যান্য রোগীদের মতো সমান চোখে দেখে তিনি সে আহ্বান জানান।  তিনি আরও বলেন, ‘সবাইকে ‍বুঝতে হবে এইডস ছোঁয়াচে নয়, কিছু সচেতনা ও কিছু উপসর্গ মেনে চললে এটি ছড়াবে না।’

স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. সিরাজুল ইসলাম বলেন, ‘এইডস রোগীরা চিকিৎসাক্ষেত্রে বৈষম্যের শিকার হন, এটি কোনওভাবেই ঠিক নয় এবং মেনে নেওয়া যায় না। এইডস রোগী বলে তাদের ভিন্ন হওয়ার কোনও কারণ নেই। যদি এটা হয়ে থাকে তাহলে এইডস নির্মূলে আমরা যে অঙ্গীকার করেছি সেটি ভঙ্গ হবে।’ 

/জেএ/এএ/এআর/

সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
চিয়া সিড খাওয়ার ৮ উপকারিতা
চিয়া সিড খাওয়ার ৮ উপকারিতা
ইউক্রেনের শান্তি পরিকল্পনা অর্থহীন: ল্যাভরভ
ইউক্রেনের শান্তি পরিকল্পনা অর্থহীন: ল্যাভরভ
বিএনপির নিগৃহীত নেতাকর্মীদের তালিকা চাইলেন ওবায়দুল কাদের
বিএনপির নিগৃহীত নেতাকর্মীদের তালিকা চাইলেন ওবায়দুল কাদের
৭ বছর পর নজরুল বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের নতুন কমিটি
৭ বছর পর নজরুল বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের নতুন কমিটি
সর্বাধিক পঠিত
অ্যাপের মাধ্যমে ৪০০ কোটি টাকার রেমিট্যান্স ব্লক করেছে এক প্রবাসী!
অ্যাপের মাধ্যমে ৪০০ কোটি টাকার রেমিট্যান্স ব্লক করেছে এক প্রবাসী!
প্রথম গানে ‘প্রিয়তমা’র পুনরাবৃত্তি, কেবল... (ভিডিও)
প্রথম গানে ‘প্রিয়তমা’র পুনরাবৃত্তি, কেবল... (ভিডিও)
নিউ ইয়র্কে পুলিশের গুলিতে বাংলাদেশি তরুণ নিহত, যা জানা গেলো
নিউ ইয়র্কে পুলিশের গুলিতে বাংলাদেশি তরুণ নিহত, যা জানা গেলো
বিএনপির ইফতারে সরকারবিরোধী ঐক্য নিয়ে ‘ইঙ্গিতময়’ বক্তব্য নেতাদের
বিএনপির ইফতারে সরকারবিরোধী ঐক্য নিয়ে ‘ইঙ্গিতময়’ বক্তব্য নেতাদের
নেচে-গেয়ে বিএসএমএমইউর নতুন উপাচার্যকে বরণে সমালোচনার ঝড়
নেচে-গেয়ে বিএসএমএমইউর নতুন উপাচার্যকে বরণে সমালোচনার ঝড়