X
শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪
৭ বৈশাখ ১৪৩১

ঘর পুড়েছে, জমি থাকবে তো?

আমানুর রহমান রনি
০৫ ডিসেম্বর ২০১৬, ২২:০৬আপডেট : ০৫ ডিসেম্বর ২০১৬, ২২:২৫

আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে গেছে সব, এখন নিঃস্ব মানুষগুলোর শুধুই আহাজারি মাথাগোঁজার ঠাঁই আগুন পুড়ে ছাই হয়ে মাটিতে মিশে আছে। খোলা আকাশের নিচে সেই ছাইয়ের স্তুপের উপর দাঁড়িয়ে আছে নারী-পুরুষ-শিশু। ভাগ্যবঞ্চিত এসব মানুষ কিছুক্ষণ পরপর ছাইয়ের মধ্যে নিজেদের শেষ সঞ্চয় খুঁজলেও তাতে ছাই ছাড়া মিলছে না কিছু। খিচুরি আর শুকনা চিড়া-মুড়ি খেয়ে চলছে অন্তত দুই হাজার খেটে খাওয়া মানুষের অর্ধাহার জীবন। সেই জীবনে যোগ হয়েছে জায়গা হারানোর শঙ্কা।

সোমবার দুপুরে রাজধানীর বনানীর কড়াইল বস্তিতে গিয়ে এমন আশঙ্কার কথা জানা যায়। রবিবার বেলা ২ টা ৪০ মিনিটের দিকে সূত্রপাত হওয়া আগুন সোয়া একঘন্টা পর বিকাল ৪টার দিকে নিয়ন্ত্রণে আনে ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা। আগুনে অন্তত পাঁচ শতাধিক ঘর পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। এক অন্তঃসত্ত্বা নারীসহ অন্তত ১৫ জন আহত হয়েছেন। ঘটনা তদন্তে তিন সদস্যের কমিটি গঠন করেছে ফায়ার সার্ভিস।



সোমবার কড়াইল বস্তিতে গিয়ে দেখা যায়, ঘরপোড়া মানুষগুলো ছাইয়ের উপর বসে আছেন। তাদেরই একজন লুৎফর রহমান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘কড়াইল বস্তিতে পরিবার নিয়ে আমি ৯ বছর ধরে আছি। আমার ১৭ টি ঘর ছিল। সব পুড়ে গেছে। প্রতিটি ঘর দুই হাজার থেকে আড়াই হাজার টাকায় ভাড়া দিতাম। কিন্তু এখন একটিও নেই। আমি পথে বসে গেছি।’

ঘটনার পর খোলা আকাশের নিচেই আছেন লুৎফর রহমান। যেখানে ঘরগুলো ছিল সেখানেই দাঁড়িয়ে-বসে সময় কাটাচ্ছেন তিনি। কারণ জায়গা যেন অন্য কেউ দখল না করতে পারে।

নাজমা ও আফিল দম্পতিও ৯ বছর ধরে কড়াইল বস্তিতে থাকেন। তাদের গ্রামের বাড়ি শেরপুর। এক ছেলে ও এক মেয়েকে নিয়ে ছোট্ট একটি ঘরে থাকতেন তারা। মাসিক আড়াই হাজার টাকা ভাড়া। নাজমা বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আমি বাসাবাড়িতে কাজ করি। আমরা স্বামী রিকশা চালায়। ঘটনার সময় বাসায় ছিলাম না। এসে দেখি সব পুড়ে গেছে। বাসা থেকে কিছু বের করতে পারিনি।’


তিনি বলেন, ‘কি খাবো, কি করবো জানি না। কয়েক বেলা খিচুড়ি খেয়ে কোনও রকম বেঁচে আছি। এক কাপড়ই দুদিন পরে আছি। অনেকে পুরনো কাপড় দিয়েছে, তবে তা কারো গায়ে লাগে না।’

আগুনে ঘর হারানো আরেক নারীর নাম জামিরুন (৫৫)। তার গ্রামের বাড়ি শেরপুরের নালিতাবাড়ি। স্বামী আব্দুর রহিম মৃত। এই বয়সেও তিনি বাসাবাড়িতে কাজ করেন। ছোট বোন রেনুয়ারার সঙ্গে থাকেন। রেনুয়ারা মেসে রান্না করেন। তার স্বামী আতাহার বিভিন্ন ধরনের কাজ করেন। তারা ২০ বছর ধরে এই কড়াইল বস্তিতেই থাকেন। সোমবার দুপুরে জামিরুন ছোট্ট লাঠি দিয়ে ছাই খুড়েখুড়ে কিছু খুঁজছিলেন। কী খুঁজছেন জিজ্ঞাসা করলে তিনি বলেন, ‘কিছু রুপার জিনিস ছিল ঘরের ভেতরে। কিন্তু সেগুলো খুঁজে পাচ্ছি না।’

ঘর পুড়েছে, জমি থাকবে তো? খুঁজতে খুঁজতে তিনি গোল একটি ধাতব বস্তু পেলেন। আগুনে পুড়ে সাদা ধাতব বস্তুটি চকচক করছে। তিনি বললেন এটি রুপার। কথা বলতে বলতে তিনি কেঁদে ফেললেন। কিভাবে আবার নতুন করে জীবন শুরু করবেন তা তার জানা নেই। ছাইয়ের উপরই তিনি বসে রইলেন।

আকলিমা বেগম (৪৫)। তার স্বামী নাম আনসার। তিনি মাটিকাটার কাজ করেন। স্বামী-স্ত্রী দুজনে একটি বাসায় থাকতেন। ছেলেমেয়ে বড় হওয়ায় তাদের নিজেদের সংসার হয়েছে। তাই তারা আলাদা থাকেন। আগুনে তাদের সবকিছু পুড়ে গেছে। তারা এখন নিঃস্ব।  

বস্তিতে তাদের মতো এরকম পাঁচ শতাধিক পরিবার খোলা আকাশের নিচেই রয়েছে। বস্তির একটি অংশ পানির উপর ছিল। পুড়ে তা এখন ছাই হয়ে পানিতে ভাসছে। সেখানে যারা বসবাস করতেন, তারা এখন তীরে বসে সেই ছাইয়ের দিকে নির্বাক তাকিয়ে আছেন। সাফিয়া বেগম (৫০) তাদেরই একজন। তিনি বলেন, ‘ঘর তো পুড়েছে, এখন ভয় পাচ্ছি আমাদের এখান থেকে সরিয়ে দেয় কিনা? তাই সারাদিন এখানেই বসে আছি।’ সাফিয়া বেগমের গ্রামের বাড়ি বরিশালে। এই বস্তিতে ৩০ বছর ধরে তিনি থাকেন।

পুড়ে যাওয়া কড়াইল বস্তি সাফিয়ার সঙ্গে কথা বলার সময় তার পাশেই দাঁড়িয়ে ছিলেন কনা (৫২) নামে আরেক নারী। তাদের গ্রামের বাড়ি জামালপুরে। তিনি জানান, পানির উপর বাঁশ দিয়ে তৈরি করা একটি ঘরে ছেলে, মেয়ে, মেয়েজামাই ও নাতিদের নিয়ে তারা থাকতেন। ২২ বছর ধরে এই বস্তিতেই তারা আছেন।

কনা বলেন, ‘ছোট ছোট দশটি রুম বানিয়ে ভাড়া দিয়েছিলাম। একটি ঘরও নেই। ঘরে টিভি, ফ্রিজ ছাড়াও অনেক আসবাবপত্র ছিল। সব পুড়ে গেছে।’

ছাইয়ের ভেতর থেকে পোড়া টিন বেছে তা সংগ্রহ করছেন তারা। যদি পরবর্তীতে তা ব্যবহার করতে পারেন। কনা বলেন, ‘সারা রাত এই ছাইয়ের উপরেই বসেছিলাম। সারা দিনও একই অবস্থায় আছি। এখনও কোনও টাকাপয়সা সাহায্য পাইনি।’

বস্তির বাসিন্দাদের অভিযোগ, বউবাজার লেপ-তোষকের দোকান থেকে আগুনের সূত্রপাত হয়েছে। পরে আগুন দ্রুত বস্তিতে ছড়িয়ে পড়ে। আগুনে অন্তত পাঁচ শতাধিক ঘর পুড়েছে। অগ্নিকাণ্ডের সময় বস্তির অধিকাংশ বাসিন্দা কাজে বাসার বাইরে ছিল।

ঘর পুড়েছে, জমি থাকবে তো? ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) মেয়র আনিসুল হক সাংবাদিকদের জানান, ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোকে সহায়তা দেয়া হবে। তাদের তালিকা তৈরি করা হচ্ছে। ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোতে খাবার সরবরাহ করা হচ্ছে।

ঘটনাস্থল পরিদর্শন শেষে  ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদফতরের মহাপরিচালক (ডিজি) ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আলী আহাম্মেদ খান বলেন, ‘আমরা একজন আহত হওয়ার তথ্য পেয়েছি। অন্তত চার থেকে পাঁচশ ঘর পুড়েছে। ঘটনা তদন্তে তিন সদস্যের কমিটি গঠন করা হয়েছে। তাদের পাঁচদিনের মধ্যে রিপোর্ট দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

এদিকে সোমবার দুপুর পর্যন্ত ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের সংখ্যা হিসাব করতে পারেনি সিটি করপোরেশন। কড়াইল বস্তিতে আওয়ামী লীগের অফিসে ক্ষতিগ্রস্তদের তথ্য দিয়ে আসার জন্য মাইক থেকে ঘোষণা করা হয়েছে। কয়েকটি এনজিও কর্মীদের সেখানে তথ্য সংগ্রহ করতে দেখা গেছে। তবে এখনও ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোর কেউ কোনও সহায়তা পায়নি।

সোমবার সকাল থেকে জনপ্রতিনিধি, সমাজকর্মী, রাজনৈতিক নেতা ও মানবাধিকারকর্মীরা কড়াইল বস্তি পরিদর্শন করেছেন। তারা ক্ষতিগ্রস্তদের সহায়তার আশ্বাস দিয়েছেন।

/এআরআর/এএআর/

সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
৫ বছর বন্ধ সুন্দরবন টেক্সটাইল, সংকটে শ্রমিকরা
৫ বছর বন্ধ সুন্দরবন টেক্সটাইল, সংকটে শ্রমিকরা
বঙ্গবন্ধু ও বঙ্গমাতা গোল্ডকাপের ফাইনাল আজ
বঙ্গবন্ধু ও বঙ্গমাতা গোল্ডকাপের ফাইনাল আজ
টিভিতে আজকের খেলা (২০ এপ্রিল, ২০২৪)
টিভিতে আজকের খেলা (২০ এপ্রিল, ২০২৪)
চাটমোহরে ঐতিহ্যবাহী ঘোড় দৌড় প্রতিযোগিতা শুরু
চাটমোহরে ঐতিহ্যবাহী ঘোড় দৌড় প্রতিযোগিতা শুরু
সর্বাধিক পঠিত
বাড়ছে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মানি, নতুন যোগ হচ্ছে স্বাধীনতা দিবসের ভাতা
বাড়ছে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মানি, নতুন যোগ হচ্ছে স্বাধীনতা দিবসের ভাতা
ইরান ও ইসরায়েলের বক্তব্য অযৌক্তিক: এরদোয়ান
ইস্পাহানে হামলাইরান ও ইসরায়েলের বক্তব্য অযৌক্তিক: এরদোয়ান
উপজেলা চেয়ারম্যান প্রার্থীকে অপহরণের ঘটনায় ক্ষমা চাইলেন প্রতিমন্ত্রী
উপজেলা চেয়ারম্যান প্রার্থীকে অপহরণের ঘটনায় ক্ষমা চাইলেন প্রতিমন্ত্রী
ইরানে হামলা চালিয়েছে ইসরায়েল!
ইরানে হামলা চালিয়েছে ইসরায়েল!
সংঘাত বাড়াতে চায় না ইরান, ইসরায়েলকে জানিয়েছে রাশিয়া
সংঘাত বাড়াতে চায় না ইরান, ইসরায়েলকে জানিয়েছে রাশিয়া