X
শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪
১৩ বৈশাখ ১৪৩১

হাসপাতাল নাকি আবাসিক হোটেল!

উদিসা ইসলাম ও রাফসান জানি
০৮ ডিসেম্বর ২০১৬, ১৬:৩১আপডেট : ০৯ ডিসেম্বর ২০১৬, ১২:১২

রাজধানীর অভিজাত হাসপাতাল

রাত ১০টায় উচ্চ রক্তচাপ নিয়ে রাজধানীর মনোয়ারা হাসপাতালে ভর্তি হন শাহিনা ইসলাম (ছদ্মনাম)। চিকিৎসক জানান, রক্তচাপ কমে কিনা তা দেখতে কেবল পর্যবেক্ষণে রাখা হবে তাকে। পাশাপাশি কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষাও করা হবে। রাতেই সব পরীক্ষা-নিরীক্ষা শেষে সকালে সব ফলাফলও হাতে চলে আসে। কিন্তু চিকিৎসক সেগুলো দেখবেন বিকেলে উল্লেখ করে রোগীকে রেখে দেওয়া হয়। ছাড়া পাওয়ার পর বিল দিতে গিয়ে রোগীর স্বজনরা দেখেন ১৪ ঘন্টার জন্য রুম ভাড়া দিতে হচ্ছে দুইদিনের! রাত ১০টা থেকে পরদিন দুপুর দুইটা কীভাবে দুইদিন হয় জানতে চাইলে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ জানায়, তাদের চেকইন টাইম বেলা ১২টা, চেক আউটও বেলা ১২টা। ফলে তার এক ঘন্টা এদিক ওদিক হলেও গুনতে হবে দুইদিনের ভাড়া। আবার ২৩ ঘন্টা থাকার জন্য দুইদিনের ভাড়া দিতে রোগী বাধ্য হয়েছেন এমন উদাহরণও আছে।

বাংলা ট্রিবিউনের অনুসন্ধানে দেখা যায়, সব বড় বড় বেসরকারি হাসপাতালেই চেক ইন চেক আউট সিস্টেম চালু রয়েছে। নিয়মটা দুপুর ১২টা থেকে পরদিন দুপুর ১২টা পর্যন্ত। রোগীকে ডাক্তার বাসায় যাওয়ার অনুমতি দিলেও কেবল একদিন কেবিন ভাড়া বাড়িয়ে নিতে এক-দুই ঘন্টা পরে ছাড়পত্র দেওয়ার উদাহরণ অজস্র। ভুক্তভোগীদের বক্তব্য, যদি তাই হয় তাহলে ঘন্টা হিসেবে ভাড়া নেওয়া হোক। কারণ রোগীকে কখন ছাড়া হবে তা পুরোপুরি নির্ভর করছে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের ওপর। অন্যদিকে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষগুলো বলছে, ঘন্টা ধরে ভাড়া নেওয়ার কোনও সুযোগ নেই। এর ফলে হিসাবের অসুবিধা হয়।

গ্রিন লাইফ হাসপাতালের একটি বিল গ্রীনলাইফ হাসপাতালের এক রোগী বিকেলে অপারেশনের জন্য দুপুরের পর ভর্তি হন এবং তার দুইদিন পর দুপুরের আগেই তিনি হাসপাতাল ছেড়ে গেলেও তিনদিনের ভাড়া দিতে হয় তাকে। চেক ইন-চেক আউটের এই ‘হোটেলীয় সিস্টেম’ নিয়ে হাসপাতালটির ডেপুটি ডিরেক্টর কর্নেল আব্দুর রহমান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘এটা থাকতেই হবে। তবে কিছু কনসিডার তো করাই হয়।’ কেউ রাত ১১টায় ভর্তি হয়ে পরের দিন দুপুর ২টায় চলে গেলে কেন তাকে দুইদিনের ভাড়া দিতে হবে এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘দুপুর ১১টা থেকে দুপুর ১২টা একদিন। তা সে যখনই ভর্তি হোক বা বের হোক।’

ল্যাব এইড হেল্প ডেস্কের আব্দুল কাইয়ুম জানান, ল্যাব এইড হাসপাতালে নানা ধরনের কেবিনের ব্যবস্থা আছে। এছাড়া প্রতিদিন বাধ্যতামূলক চিকিৎসকের জন্য এবং  নিউট্রিশিয়ান চার্জ ১ হাজার টাকার সঙ্গে রোগীর খাবার ৪০০ টাকা দিতে হয়। তিনি বলেন, ‘আমাদের এখানে জোর করে রাখা হয় এমন অভিযোগ রোগীরা করেন না। তবে রুম রেন্টে এই চেক ইন-চেক আউটের নিয়ম বুঝতে না পারায় প্রায়ই ভুল বোঝাবুঝির ঘটনা ঘটে।’

মনোয়ারা হাসপাতালে রোগীকে করা একটি বিল হাসপাতালটির কর্পোরেট কমিউনিকেশন বিভাগের অ্যাসিসটেন্ট জেনারেল ম্যানেজার সাইফুর রহমান লেলিন চেক ইন-চেক আউট সিস্টেম থাকার বিষয়টি স্বীকার করে বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আমাদের এখানে স্বীকৃত এমন কোনও সিস্টেম নেই। কাজের হিসেবের সুবিধার্থে একটা নির্দিষ্ট টাইম ধরা হয়ে থাকে। এর বাইরে কিছু নয়।’ ঘন্টা হিসেবে কেবিন ভাড়া করা যায় কিনা এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘এমন ব্যবস্থা কোথাও নেই। সেক্ষেত্রে আমাদেরও কিছু করার সুযোগ নেই। এমনটা হতে পারে না।’

আনোয়ার খান হাসপাতালে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, তাদের জেনারেল ওয়ার্ড ও সিঙ্গেল কেবিন রয়েছে। অ্যাডমিশন কাউন্টারের সেলিম বাংলা ট্রিবিউনকে জানান, ডাক্তার ও রোগীর অবস্থা ভেদে কেবিন ও ওয়ার্ড চার্জ ভিন্ন ভিন্ন হয়। পূর্ব নির্ধারিত নেই, কোনটার চার্জ কত। তবে এতো বিলের মধ্যে একদিন করে কেবিন ভাড়া যে বাড়িয়ে দেওয়া হয় এটা বেশিরভাগ ক্ষেত্রে রোগীর লোকজন খেয়াল করেন না। ভুক্তভোগীরা বলছেন, ‘আমরা চিকিৎসা করতে আসি দূর-দূরান্ত থেকে। নানা উপায়ে বাড়তি টাকা দিতে দিতে ঘরভাড়া যে একদিনের বেশি নেওয়া হয় সেটা খেয়াল করার উপায় থাকে না।’

আনোয়ার খান মেডিক্যাল কলেজ অ্যান্ড হাসপাতাল আনোয়ার খান মডার্ন মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ডিরেক্টর প্রফেসর ড. মো: এহতেশামুল হক চেক ইন-চেক আউট সিস্টেমের কথা অস্বীকার করেন। হাসপাতালের অ্যাডমিশন কাউন্টার থেকে চেক ইন-চেক আউট সিস্টেম এর কথা জানিয়েছে বলে তাকে অবহিত করার পরও তিনি অস্বীকার করে বলেন, ‘আমাদের এখানে এমন কোনও সিস্টেম নেই। এটা আছে হোটেলে। যদি কোথাও এমনটা থেকে থাকে তাহলে আমি এই ব্যবস্থার বিরোধী।’ ঘন্টা হিসেবে কেবিন বা ওয়ার্ডে রোগীদের রাখার ব্যবস্থা করার ব্যাপারে তিনি বলেন, ‘এটা কিছুতেই করা সম্ভব না। এই ব্যবস্থা চালু করলে উল্টো আরও অনেক বদনামের সম্মুখীন হতে হবে।’

এ বিষয়ে মনোয়ারা হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের কোনও বক্তব্য পাওয়া যায়নি।

রাজধানীর প্রায় সব বেসরকারি হাসপাতালের চিত্র একই রকম। রোগীর স্বজনরা বলছেন, চেক ইন-চেক আউটের নিয়ম সরকারের পর্যবেক্ষণ করা দরকার। আবাসিক হোটেলের মতো হাসপাতালের রুম রেন্ট নির্ধারণ মোটেই গ্রহণযোগ্য না।

ব্যারিস্টার রুমীন ফারহানা চেক ইন-চেক আউটের বদলে ঘন্টা ধরে ভাড়া নির্ধারণের পক্ষে মত দেন। তিনি বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘মনে রাখা দরকার বেসরকারি হাসপাতালের ক্ষেত্রে কোনটার দাম কত হবে, তা আইনে নির্ধারণ করে দেওয়া আছে। কিন্তু কেবিনের বিষয়ে এমন কোনও নিয়ম নেই।’ তিনি আরও বলেন, ‘হাসপাতাল আর আবাসিক হোটেল এক নয়। হাসপাতালে মানুষ অবসর কাটাতে আসে না, কিন্তু হোটেলে তারা অবসর কাটাতে যায়। যারা পরিচিতির ভিত্তিতে কিছু সুযোগ-সুবিধা পান তারা বিষয়টা বুঝতে পারেন না বলে প্রশ্নটা উত্থাপিত হয় না। কিন্তু এটা মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে অবশ্যই বিবেচনায় নেওয়া উচিত।’

২৪ ঘন্টাকে একদিন ধরে বিষয়টি সুরাহা করা যায় কিনা বা ঘন্টার ভিত্তিতে রোগীর কেবিন চার্জের ব্যবস্থা করা যায় কিনা প্রশ্নে তিনি বলেন, এই ভাঙা হিসাব করা মুশকিল।

এ বিষয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক আবুল কালাম আজাদ বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘হাসপাতালে এটা হওয়া উচিত না। বেসরকারি হাসপাতালগুলো তাদের ব্যবসায়িক মানসিকতা থেকে এটা করে থাকে। কিন্তু রোগীদের সঙ্গে তাদের কখনোই এটা করা উচিত না।’

/ইউআই/এএআর/
আরও পড়ুন: 
‘নম্বর ঠিক রেখে অপারেটর বদল’ সেবা চালু নিয়ে জটিলতা বাড়ছেই

 

সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
সাদি মহম্মদ: ভাইয়ের কান্না, বন্ধুর স্মৃতি, সতীর্থদের গানে স্মরণ…
সাদি মহম্মদ: ভাইয়ের কান্না, বন্ধুর স্মৃতি, সতীর্থদের গানে স্মরণ…
খালি বাসায় ফ্যানে ঝুলছিল কিশোরী গৃহকর্মীর লাশ
খালি বাসায় ফ্যানে ঝুলছিল কিশোরী গৃহকর্মীর লাশ
গরমে রেললাইন বেঁকে যাওয়ার শঙ্কায় ধীরে চলছে ট্রেন
গরমে রেললাইন বেঁকে যাওয়ার শঙ্কায় ধীরে চলছে ট্রেন
মন্দিরে সেলফি তুলতে গিয়ে প্রদীপে দগ্ধ নারীর মৃত্যু
মন্দিরে সেলফি তুলতে গিয়ে প্রদীপে দগ্ধ নারীর মৃত্যু
সর্বাধিক পঠিত
পুলিশের সব স্থাপনায় নিরাপত্তা জোরদারের নির্দেশ
পুলিশের সব স্থাপনায় নিরাপত্তা জোরদারের নির্দেশ
সরকারি না হলেও সলিমুল্লাহ কলেজে অধ্যাপক ১৪ জন
সরকারি না হলেও সলিমুল্লাহ কলেজে অধ্যাপক ১৪ জন
মৌসুমের সব রেকর্ড ভেঙে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা চুয়াডাঙ্গায়
মৌসুমের সব রেকর্ড ভেঙে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা চুয়াডাঙ্গায়
এগিয়েছে ‘ওমর’, চমকে দিলো ‘লিপস্টিক’!
ঈদের ছবিএগিয়েছে ‘ওমর’, চমকে দিলো ‘লিপস্টিক’!
হোটেল রুম থেকে এই ৫ জিনিস নিয়ে আসতে পারেন ব্যাগে ভরে!
হোটেল রুম থেকে এই ৫ জিনিস নিয়ে আসতে পারেন ব্যাগে ভরে!