X
বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪
১০ বৈশাখ ১৪৩১

সীমান্তের বাল্যবিবাহে নির্যাতন বেশি, টিকছে না ঘর

উদিসা ইসলাম
০৯ ডিসেম্বর ২০১৬, ০৯:১৬আপডেট : ০৯ ডিসেম্বর ২০১৬, ১৩:১৭

বাল্য বিয়ে (সংগৃহীত) চাঁপাইনবাবগঞ্জের বিনোদপুর এলাকার চতুর্থ শ্রেণির শিক্ষার্থী মাহবুবাকে মাত্র ১১ বছর বয়সেই বিয়ে দেওয়া হয় তার ২০ বছর বয়সী মামাতো ভাই রোমেলের সঙ্গে। রাজশাহীর একটি ক্লিনিকে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তার সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, বিয়েতে সে ও তার বাবা-মা রাজি না থাকলেও আশপাশের মানুষের কারণে বিয়ে দিতে বাধ্য হয়েছেন। মামাতো ভাই তাদের বাসায় থাকতো বলে সমাজের সবাই ‘কিছু ঘটে গেলে এর দায়-দায়িত্ব কে নেবে’ বলে বিয়ের জন্য চাপ দেয়। 

‘সেই কিছু ঘটে যাওয়ার’ শঙ্কা থেকে বিয়ে হলেও সংসারের কাজ পারে না, ঠিকমতো সেবা করে না, এমন নানা অভিযোগে প্রায়ই নির্যাতন করা হতো মাহবুবাকে। একসময় সে বাবার বাড়িতে পালিয়ে চলে আসে। আবারও তাকে ফেরত যেতে হয় রোমেলের কাছে। খুব অল্প বয়সে অন্তঃসত্ত্বা হয়ে পড়লে, মাহবুবাকে হুজুরের পানি পড়ার চিকিৎসা দিয়ে আরও অসুস্থ করে ফেলা হয়। পরে রোমেল অসুস্থ বউ রাখবে না বলে তালাক দেয় মাহবুবাকে।

কেবল মাহবুবা না, বাংলাদেশের সীমান্ত ও চর এলাকাজুড়ে সরেজমিনে একই চিত্র দেখা যায়। হাতিয়ার চর এলাকায় একটি পরিবারে ছয় জন শিশু দেখা গেছে, যে শিশুদের মায়ের বয়স মাত্র ২৪ বছর। এলাকাবাসী বলছে, এখানে বাবা-মায়েরা বেশি দিন মেয়ে সন্তানকে ঘরে রাখতে চান না। ১২ থেকে ১৩ বছর হলেই বিয়ে হয়, ১৫ বছরে সন্তানের মা। দস্যু বাহিনীর ভয়ে,আর দারিদ্র্যতার কারণে কিশোর বয়সে বিয়ে করতে বাধ্য হচ্ছে বিচ্ছিন্ন এ দ্বীপের কিশোর-কিশোরীরা।

সীমান্ত বা চর এলাকায় বাল্যবিবাহের হার যেমন বেশি, তেমনই বাল্যবধূদের ওপর নির্যাতনও হয় বেশি। পরিণত বয়সে এদের বিয়ে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই টেকে না, এমন চিত্র আমরা দেখলেও এ বিষয়ে তেমন কোনও গবেষণা বা ডেটা আমাদের হাতে নেই,বলে উল্লেখ করেন নারী ও শিশু পাচার নিয়ে কর্মরত বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতির প্রধান সালমা আলী।

তিনি বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘সীমান্তে মেয়েশিশুদের নিয়ে কী যে করা হয়, তা ঢাকায় বসে কল্পনা করা যাবে না। এরা বাল্যবিবাহের কারণে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের শিকার হয়। শিশুবয়সে মাতৃত্বের কারণে এরা নানা ঝুঁকিতে পড়ে। তারপর স্বামী একাধিক বিয়ে করায় তাকেই নিপীড়নের শিকার হতে হয়।’  

দিনাজপুর জেলা শহর থেকে প্রায় ৬৫ কিলোমিটার দূরে বিরামপুরের সেলিনা পড়তে চেয়েছিল। চার মেয়ে হওয়ায় বাবা একের পর এক মেয়েকে বিয়ে দিতে থাকেন। এই যুক্তিতে যে, মেয়ে পাচারকারীদের হাতে পড়ার চেয়ে, এলাকার খারাপ ছেলেরা তুলে নিয়ে যাওয়ার আগে বিয়ে দিয়ে সম্মান রক্ষা করা জরুরি। বাবা তার দায়িত্ব ও সম্মান রক্ষা করলেন বটে, কিন্তু স্বামীর পাশবিক নির্যাতন থেকে রক্ষা পেল না সেলিনা। স্বামী সেলিনার হাতে গরম ডাল ফেলে পুড়িয়ে দেওয়ায় তার এক হাতের অনেকটাই হারাতে হয়েছে।

দিনাজপুর, চাপাইনবাবগঞ্জ, টেকনাফ ও হাতিয়ার বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, এসব জায়গায় বিয়ের আইনি বয়স নিয়ে কারোর কোনও মাথাব্যথা নেই। মেয়ের বিয়ের বয়স কতো জানতে চাইলে টেকনাফের রেজ্জাকুল হায়দার বলেন, ‘মেয়ে সমস্ত হলেই বিয়ের বয়স।’ সরকার যে ১৮ বছর বয়স নির্ধারণ করে রেখেছে জানানো হলে তিনি বলেন, ‘এসব আইনের কথা আমরা ছোটলোকেদের জন্য না। মেয়ের কোনও ক্ষতি হলে পরে সেটা কে দেখবে।’

রাজশাহীর প্রেমতলী এলাকার পাশ ঘেঁষে পদ্মা নদী, ওপারেই চরের পর ভারত। দেশের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ এই সীমান্তবর্তী এলাকা চোরাচালান অর্থনীতির ভিত্তি হলেও নারীদের জন্য এটা বিরাট বিপদ বয়ে এনেছে। চোরাচালানের কাজে এপার-ওপার করেন যারা, তাদের কাছে কাঁচা টাকা থাকায় অল্প বয়সী মেয়েদের বিয়ে করে নিয়ে যাচ্ছেন। আবার কখনও বিয়ে করে বাবার বাড়িতে রেখে যাচ্ছেন। কিন্তু তারপর এদের আর কোনও খবর পাওয়া যায় না।

কেন এধরনের পুরুষের সঙ্গে কিশোরী মেয়ের বিয়ে দেন, প্রশ্নে তিনবছর ধরে মেয়ের খোঁজ না পাওয়া এক বাবা রাকিবুল ইসলাম বলেন, ‘মেয়ের কোনও অঘটন ঘটার আগে ভালো ঘরে বিয়ে দিতে কে না চায়। টাকা পয়সাওয়ালা লোক দেখে বিয়ে দিয়েছি। তাদের ঘরবাড়ি দেখিনি। কিন্তু আত্মীয়রা এসে মেয়ে নিয়ে গেছে। এখনতো আর মেয়ের দেখা পাই না। নদীর ওপারে চলে গেছে।’ বাল্যবিয়ে

কেন সীমান্ত এলাকায় বাল্যবিবাহ ও তার মাধ্যমে নির্যাতন বেশি প্রশ্নে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সীমান্তের ‘অশিক্ষিত’ অভিভাবকরা সচেতনতার অভাবে মনে করেন,কন্যার বিয়ে দেওয়া মানে মাথা থেকে একটা বোঁঝা নেমে গেল। মূলত এমন ভাবনা থেকেই তারা মেয়েদের অল্প বয়সে বিয়ে দেন। পরবর্তীতে কিশোর বয়সের এসব মেয়ে নতুন সংসারে গিয়ে তুচ্ছ কারণে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের শিকার হয়ে পুনরায় বাবার বাড়িতে ফিরে আসতে বাধ্য হয় এবং সেই পরিবারে নতুন করে জটিলতা সৃষ্টি হয়।

মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের টেকনাফে কর্মরত প্রকল্প কর্তকর্তা সুব্রত সরকার বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘গত পাঁচ মাসে টেকনাফ ওসিসিতে সেবা নিতে আসা এমন ভিকটিমের সংখ্যা ১০ এর অধিক (মোট ভিকটিম ৫০+ ,৫ মাসে)।ভিকটিমদের বড় একটা অংশ তাদের বয়স (৮ জন) বলেছে ১৮/১৯ বছর। বর্তমানে ১৮ কিংবা ১৯ বছরের এসব মেয়ের বিয়ে হয়েছে মূলত আরও ২-৩ বছর পূর্বে। এর অর্থ হলো, নির্যাতনের শিকার হয়ে ওসিসিতে আসা ভিকটিমদের প্রায় অর্ধেকের বেশী বাল্যবিবাহের শিকার।’

তিনি আরও বলেন, ‘কিশোরী বয়সের এসব মেয়ে অল্পদিনেই দুই-তিন সন্তানের মা হওয়ায় শারীরিক ও মানসিক নানা জটিলতা তৈরি হয়। অনেক ক্ষেত্রে বয়স ত্রিশের কোটায় ৩/৪ সন্তানের মা হওয়ার পর, তাকে ছেড়ে স্বামী রোহিঙ্গা শরণার্থী কম বয়সী মেয়েদের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন করে। এসব কিছুই পরিবারে অশান্তি সৃষ্টি করে বলে ওসিসিতে সেবা নিতে আাসা অনেক ভিকটিম অভিযোগ করেন।

পাচারের জন্যও সীমান্তের মেয়েদের টার্গেট করে বিয়ে করা হয় বলে উল্লেখ করেন বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতির প্রধান সালমা আলী। বাংলা ট্রিবিউনকে তিনি বলেন, ‘সীমান্তে সচেতনতা বৃদ্ধির কাজ কম হয় কিন্তু ঝুঁকি বেশি। এসব এলাকায় বাবা-মা চান সন্তানকে দ্রুত বিয়ে দিয়ে বিদায় করতে। আর যারা বিয়ে করছেন তাদের মধ্যে অসহিষ্ণু মানসিকতা লক্ষ্য করা গেছে।একজন কিশোর তার চেয়ে বয়সে ও মমনে বড় কাউকে প্রতিরোধ করবে কিভাবে?’

আরও পড়ুন- 

প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফর স্থগিতের নেপথ্যে যে তিন কারণ

বিলুপ্তির পথে বেগম রোকেয়ার বাড়ি, স্মৃতিকেন্দ্রও বন্ধ

/ইউআই /এপিএইচ/

সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
আদালতে সাক্ষ্য দিতে এসে কাঁদলেন মিতুর মা
আদালতে সাক্ষ্য দিতে এসে কাঁদলেন মিতুর মা
‘ভুঁইফোড় মানবাধিকার প্রতিষ্ঠানগুলো মানবাধিকার লঙ্ঘন করছে’
‘ভুঁইফোড় মানবাধিকার প্রতিষ্ঠানগুলো মানবাধিকার লঙ্ঘন করছে’
গরমে স্বস্তির খোঁজে লোকালয়ে ঢুকছে সাপ, সচেতনতার আহ্বান ডিএমপির
গরমে স্বস্তির খোঁজে লোকালয়ে ঢুকছে সাপ, সচেতনতার আহ্বান ডিএমপির
৩ ঘণ্টা গ্যাস থাকবে না কয়েকটি এলাকায়
৩ ঘণ্টা গ্যাস থাকবে না কয়েকটি এলাকায়
সর্বাধিক পঠিত
মিশা-ডিপজলদের শপথ শেষে রচিত হলো ‘কলঙ্কিত’ অধ্যায়!
চলচ্চিত্র শিল্পী সমিতিমিশা-ডিপজলদের শপথ শেষে রচিত হলো ‘কলঙ্কিত’ অধ্যায়!
আজকের আবহাওয়া: তাপমাত্রা আরও বাড়ার আভাস
আজকের আবহাওয়া: তাপমাত্রা আরও বাড়ার আভাস
ডিবির জিজ্ঞাসাবাদে যা জানালেন কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান
ডিবির জিজ্ঞাসাবাদে যা জানালেন কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান
সকাল থেকে চট্টগ্রামে চিকিৎসাসেবা দিচ্ছেন না ডাক্তাররা, রোগীদের দুর্ভোগ
সকাল থেকে চট্টগ্রামে চিকিৎসাসেবা দিচ্ছেন না ডাক্তাররা, রোগীদের দুর্ভোগ
ব্যাংক একীভূতকরণ নিয়ে নতুন যা জানালো বাংলাদেশ ব্যাংক
ব্যাংক একীভূতকরণ নিয়ে নতুন যা জানালো বাংলাদেশ ব্যাংক