X
মঙ্গলবার, ২৩ এপ্রিল ২০২৪
১০ বৈশাখ ১৪৩১

প্রধানমন্ত্রী আমাদের কেন ডাকেন না!

জাকিয়া আহমেদ
১৩ ডিসেম্বর ২০১৬, ০৬:৩৫আপডেট : ১৩ ডিসেম্বর ২০১৬, ১৬:১০

বীরঙ্গনা শেখ ফাতেমা আলী প্রধানমন্ত্রী ঈদের দিন, ইফতার পার্টিসহ নানা সময়ে মুক্তিযোদ্ধাদের ডাকেন, যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদের জড়িয়ে ধরে কথা বলেন। কিন্তু কোনও দিবসেই আমাদেরকে ডাকেন না। তারা যুদ্ধ করছে, আমরা কি কিছুই করি নাই? সম্ভ্রম হারিয়েছি, আশ্রয় হারিয়েছি,পরিবার হারিয়েছি। সব হারিয়ে আবার ট্রেনিং নিয়ে যুদ্ধেও গিয়েছি। আমরা কি তার কাছে যাওয়ার যোগ্য না? হতাশা, কণ্ঠে কিছুটা ক্ষোভ আর আক্ষেপ নিয়ে বাংলা ট্রিবিউনকে এভাবেই বলছিলেন মহান মুক্তিযুদ্ধের সময়ে পাক হানাদার বাহিনীর হাতে নির্যাতিত শেখ ফাতেমা আলী।
ফাতেমা আলী বলেন, ‘একইসঙ্গে আমরা জানি, বুঝি এবং মানি- একমাত্র তিনিই (প্রধানমন্ত্রী) তার বাবার পথ ধরে আমাদের জন্য অনেক কিছু করেছেন। তিনি এতকিছু না করলে আজ এখানেও আসতে পারতাম না।’ রাজধানীর শ্যামলীতে অবস্থিত একটি সরকারি হাসপাতালের মাঠে বসে কথা হয় ফাতেমার আলীর সঙ্গে। তিনি এবং তার মতো নির্যাতিত আমেনা বেগম, নাজমা বেগমরা মুক্তিযুদ্ধে হানাদার বাহিনীর হাতে নির্যাতনের পর কীভাবে মুক্তিযোদ্ধারা তাদেরকে উদ্ধার করেন, কীভাবে ট্রেনিং নিয়ে রনাঙ্গণে যুদ্ধ করেছেন, সে কথা বলেন ফাতেমা।
পাশেই ১০ টাকা দরে শীতের কাপড় বিক্রি করছিলেন ফাতেমার মেয়ে ফারহানা (ছদ্মনাম)। মাকে লক্ষ্য করে চিৎকার করে বলে ওঠেন, ‘মা, আস্তে কথা বলো। এমনিতেই আমাদের অবস্থা খারাপ। এভাবে কথা বলে অবস্থা আরও খারাপ কোরো না। মান-সম্মান সবারই আছে।’
ফাতেমা আলী বলেন, ‘আমাদের মন চায় প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বসতে, তার হাতের ছোঁয়া আর গায়ের গন্ধ নিতে। সেই থেকে আমরা কেন বঞ্চিত হবো? আজ এত বছর পর তিনি আমাদের মূল্যায়ন করেছেন। কিন্তু তার সঙ্গ কেন আমরা পাই না, এটাই বুঝতে পারি না। মুক্তিযোদ্ধারা অস্ত্র ধরেছেন। আমরাও তার চেয়ে কম কিছু করিনি। মুক্তিযোদ্ধারা নানারকম সুযোগ সুবিধা পাচ্ছেন, আমরা পাই না। রাষ্ট্রীয় কোনও সুযোগ নেই আমাদের জন্য। আমরা যত বোনেরা (বীরঙ্গনা) আছি, সবাই এক হয়ে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করতে চাই। শুধু একটা সুযোগ আমরা তার কাছে চাই।’
প্রায় চার ঘণ্টা ধরে কথা হয় তার সঙ্গে। এর মধ্যে কখনও ধীরে ধীরে, কখনও উত্তেজিত হয়ে, কখনও চোখভরা জল নিয়ে, আবার কখনও হাউমাউ করে কাঁদতে থাকেন এই নারী। জানান নিজের জীবনের প্রতিটি পদে পদে বঞ্চনা আর হতাশার কথা।
দীর্ঘ সাক্ষাৎকারে শেখ ফাতেমা আলী বলেন, ‘জীবন বাজি রেখে যুদ্ধ করেছিলাম। তবে আমাদের যুদ্ধ এখনও শেষ হয়নি। ১৯৭১ সালে নির্যাতন সহ্য করতে পারছি। কিন্তু এখনও জীবনের প্রতি বাঁকে বাঁকে যে নির্যাতনের মুখে আমাদের পড়তে হচ্ছে, এই বয়সে এসেও যে দুঃখ-কষ্ট পাচ্ছি, সেটা সহ্য করা খুব কষ্টের। জীবনের সবকিছু দিয়ে দেশ স্বাধীন করছি। কিন্তু স্বাধীনতা এখনও পাইলাম না। জিয়াউর রহমান, এরশাদ, খালেদা জিয়া দেশ চালায়ে গেছেন বছরের পর বছর। কিন্তু আমরা কোথায় আছি, কেমন আছি সে খোঁজ কেউ নেয় নাই।’ কিছুটা চুপ থেকে আবার নিজেই স্বগতোক্তি করেন, ‘একাত্তরের কথা আর কিছু বলার নাই। সন্তান, নাতি-নাতনীদের কাছে এখন লজ্জা লাগে সে কথা বলতে।’
গোপালগঞ্জের মকসুদপুরের তারাইল গ্রামের বাসিন্দা ফাতেমা। মুক্তিযুদ্ধের সময় তার বয়স ছিল ১৮ বছর। তখন তিনি ছিলেন তিন মাসের অন্তঃসত্ত্বা। বাবার সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের বিভিন্নভাবে সহযোগিতা করতেন। যেদিন পাক হানাদারদের বর্বরতার শিকার হন, সেদিন এলাকার রাইমদে গ্রামের বাজারে মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য রান্না করছিলেন তিনি। ফাতেমা বলেন, ‘সেদিন ছিল বর্ষাইতের (বর্ষাকাল) দিন। ভাত কেবল চুলা থেকে নামাইছি। তরকারির জন্য কড়াই দিছি চুলায়। হঠাৎ করেই পাকিস্তানি আর্মি আর কয়েকজন বাঙালি এসে আক্রমণ করে বাড়িতে। পালাইতে গিয়েও পারি নাই। ওরা গুলি করে আমাকে। বাম পায়ের পাতা ভেদ করে গুলি বের হয়ে যায়। তখন আমি মাটিতে পড়ে গেলে রাইফেলের আগা দিয়ে ডান স্তনে আঘাত করতে থাকে।’
ফাতেমা বলতে থাকেন, ‘বাবাকে ধরে নিয়ে গেল। আমাকেও ধরে নিয়ে গেল। কোথা থেকে কোথায় নিয়ে গেল, আমি কিছুই জানি না। তারপর এক সময় জানতে পারি, যশোরের শার্সার বাঘাআছড়া এলাকায় এক পাক বাহিনীর ক্যাম্পে (বর্তমানে সেটি মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিল অফিস) আটকা ছিলাম। আমার মতো করে ধরে নিয়ে আসা অনেক নারী ছিল ওইখানে। কিন্তু মা, কারও গায়ে দশ হাতি (দশ হাত) কোনও কাপড় ছিল না। সব বিবস্ত্র। বড় বড় চুল ছিল অনেকের। সেই চুল কেটে ফেলছে। সেখানে যে কীভাবে নির্যাতনের শিকার হয়েছি সেসব কথা এখন মনে করলেও ভয় পাই।’
ফাতেমা বলেন, ‘বাবারে! সে কী দৃশ্য ছিল। সে দৃশ্যের কথা মনে আর আমাকে মনে করাইস না। সেসব দৃশ্যের কথা মনে হলে মনে হয় নিজের জীবন নিজে দিয়ে দেই।’ বলেই গলা ছেড়ে কাঁদতে থাকেন। কিছুটা শান্ত হয়ে বলেন, ‘যশোরের স্থানীয় মেয়ে মোমেনাও সেখানে বন্দী ছিল। আর ওর বাবা বাহার আলী মেয়েসহ সবাইকে বাঁচাইতে গিয়ে চোখের সামনে গুলি খেয়ে মরে গেল।’
অবশেষে মুক্তিযোদ্ধা রবিউল হাওলাদার, মুক্তিযোদ্ধা সাওগাত আলী, মুক্তিযোদ্ধা আলী আহমেদ, মুক্তিযোদ্ধা এসএম সাঈদ আলীসহ হেমায়েত বাহিনীর মুক্তিযোদ্ধারা একদিন উদ্ধার করেন তাদের। কিন্তু ততদিনে পাকবাহিনীর নির্যাতনে গর্ভের সন্তান নষ্ট হয়ে গেছে ফাতেমার। তিনি বলেন, ‘বাড়ি ফিরলে স্বামী তালাক দেয়। বাবা-মা তখন নিঁখোজ। গ্রামের মানুষরা বাড়িতে ঠাঁই দিলো না। শ্বশুড়বাড়ি থেকেও ফেরত এলাম। গ্রামের মানুষ বলতে লাগলো, আমি নষ্টা মেয়ে। এক সময় হেমায়েত বাহিনীর সঙ্গে আবার দেখা হলো। তখন মকসুদপুর, কাশিয়ানী, কোটালীপাড়া, টুঙ্গিপাড়ার একদিকে, নারকেল বাড়িয়া এলাকাতে যুদ্ধ করলাম।’
১৯৭২ সালে আবার বাড়ি যান ফাতেমা। কিন্তু তাকে গ্রহণ করে না সমাজ। তিনি বলেন, ‘বাড়িতে গেলে এলাকার মানুষরা মা-বাবাকে চাপ দেয় আমাকে না রাখার জন্য। আবার ফিরলাম হেমায়েত বাহিনীতে। বঙ্গবন্ধু তখন একদিন কোটালীপাড়ায় গেলে আমিসহ ৫৫ জন বীরঙ্গনাকে নিয়ে আসা হয় তার সামনে। তিনি আমাদের ঢাকায় এনে কয়েকদিন ঢাকার বিভিন্ন জায়গায় রেখে ১৯৭২ সালের শেষের দিকে আগারগাঁয়ে আমাদের থাকার জায়গা করে দেন। মাসে ২ হাজার টাকা আর ওসমানীর (মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক জেনারেল এম এ জি ওসমানী) একটা সনদ দিয়েছিলেন। কিন্তু খালেদা জিয়ার সরকার আসার পর সে বস্তি পুড়িয়ে দিলে একেবারেই এতিম হয়ে যাই। কীট-পতঙ্গের মতো রাস্তাঘাটে থাকি এখন।’
এরশাদের আমলে ফাতেমা আলীর বাবা তার বিয়ে দেন বীরাঙ্গনা পরিচয় গোপন রেখে। কিন্তু সেই পরিচয় গোপন থাকেনি। ফাতেমা বলেন, ‘এক মেয়ে যখন সাড়ে তিন বছরের, আরেক সন্তান গর্ভে, তখন স্বামী জেনে যায় আমি বীরঙ্গনা। তালাক দেয়। বিচার বসায়। বিচারে চুল কেটে চুনকালি মাখিয়ে বাড়ি থেকে বের করে দিতে বলে। তারপরও রেহাই পাই নাই। বড় মেয়েকে পালক দিয়েছিলাম ভাতের অভাবে। আরেক মেয়ের বিবাহবিচ্ছেদ হয়েছে বীরঙ্গনার মেয়ে বলেই। এরপর রাস্তায় রাস্তায় ঘুরতাম। এক সময় দেখা হয় আলী আহমেদ সাহেবের সঙ্গে। উনি আমাদের উদ্ধারকারী দলে ছিলেন। তিনি আমাকে বিয়ে করে মাথার ওপর ছাদ দেন। এখন কোনওভাবে আছি। কিন্তু বড়ই দুঃখের জীবন আমাদের। এখনও রাতে দুঃস্বপ্ন দেখি।’

কেবল মৃত্যুতেই এর মুক্তি, বলে চোখের জল ফেলেন ফাতেমা আলী।

আরও পড়ুন-

নারী মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়েও বিতর্ক!

‘ইজ্জতের বিনিময়ে’ শব্দগুচ্ছ যুদ্ধাপরাধকে সহনীয় করে দেয়!

 /টিআর/

সম্পর্কিত
নানা আয়োজনে রাজধানীবাসীর বিজয় উদযাপন
বিজয় দিবস উপলক্ষে বঙ্গভবনে রাষ্ট্রপতির সংবর্ধনা
জাবিতে আলোকচিত্র প্রদর্শনী
সর্বশেষ খবর
দলের সিদ্ধান্ত অমান্য করে ভোটে লড়ছে ভাই-ছেলে, শাজাহান খান বললেন, ‘পরিবারের ঐতিহ্য’
উপজেলা নির্বাচনদলের সিদ্ধান্ত অমান্য করে ভোটে লড়ছে ভাই-ছেলে, শাজাহান খান বললেন, ‘পরিবারের ঐতিহ্য’
সিলিং ফ্যানের যত্নে ৬ টিপস
সিলিং ফ্যানের যত্নে ৬ টিপস
শাসন করতে গিয়ে ছুরির আঘাতে মেয়ের মৃত্যু, গ্রেফতার বাবা
শাসন করতে গিয়ে ছুরির আঘাতে মেয়ের মৃত্যু, গ্রেফতার বাবা
ঢাকা লিগের কারণে জিম্বাবুয়ে সিরিজের শুরুতে খেলবেন না সাকিব!
ঢাকা লিগের কারণে জিম্বাবুয়ে সিরিজের শুরুতে খেলবেন না সাকিব!
সর্বাধিক পঠিত
আজকের আবহাওয়া: তাপমাত্রা আরও বাড়ার আভাস
আজকের আবহাওয়া: তাপমাত্রা আরও বাড়ার আভাস
মাতারবাড়ি ঘিরে নতুন স্বপ্ন বুনছে বাংলাদেশ
মাতারবাড়ি ঘিরে নতুন স্বপ্ন বুনছে বাংলাদেশ
সকাল থেকে চট্টগ্রামে চিকিৎসাসেবা দিচ্ছেন না ডাক্তাররা, রোগীদের দুর্ভোগ
সকাল থেকে চট্টগ্রামে চিকিৎসাসেবা দিচ্ছেন না ডাক্তাররা, রোগীদের দুর্ভোগ
অতিরিক্ত সচিব হলেন ১২৭ কর্মকর্তা
অতিরিক্ত সচিব হলেন ১২৭ কর্মকর্তা
ডিবির জিজ্ঞাসাবাদে যা জানালেন কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান
ডিবির জিজ্ঞাসাবাদে যা জানালেন কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান