X
শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪
৬ বৈশাখ ১৪৩১

একাত্তরের অনুচ্চারিত কণ্ঠ যোদ্ধা মাহমুদুর রহমান বেনু

তানভীর আহমেদ, লন্ডন
১৬ ডিসেম্বর ২০১৬, ০৪:৪৯আপডেট : ১৬ ডিসেম্বর ২০১৬, ০৭:০৮



মাহমুদুর রহমান বেণু ১৯৭১ সালে ২৫ মার্চ পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী কর্তৃক গণহত্যা শুরু হওয়ার পর থেকেই পূর্ব পাকিস্তানে যুদ্ধ হয়ে উঠে অনিবার্য। মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ ক্যাম্প, মুক্তাঞ্চল ও শরনার্থী শিবিরে মুক্তিবাহিনীর মনোবল যোগাতে যেসকল শিল্পীরা সংগ্রাম ও স্বাধীনতার গান গেয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের অনুপ্রেরণা ও শরনার্থী শিবিরের জন্য অর্থ সংগ্রহ করতেন মাহমুদুর রহমান বেনু তাদের অন্যতম। ইচ্ছে ছিল সরাসরি মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেবেন, সেই অনুযায়ী প্রশিক্ষণেও যোগ দিয়েছিলেন। কিন্তু হঠাৎ করে তার ভাইয়ের ছেলে পাকবাহিনীর হাতে ধরা পড়ে যায়। পরিবারের বড় সন্তান হওয়ায় তাকে উদ্ধার করতে গিয়ে প্রশিক্ষণ ছেড়ে বাড়ী যেতে চাইলে কমান্ডার তাকে ছুটি দেননি, তাই প্রশিক্ষণ বাদ দিয়ে ফিরে আসেন বেনু। ভাইকে পাকবাহিনী থেকে মুক্ত করে প্রশিক্ষণ ক্যাম্পে ফিরতে চাইলে ক্যাম্প কমান্ডার তাকে বলেন, যুদ্ধ ক্ষেত্র থেকে একবার ফিরে গেলে তাকে দ্বিতীয়বার গ্রহণ করা হয় না। কিন্তু দেশের জন্য নিজের জীবন বাজি রেখে যুদ্ধ করবেন বলেই ঘর ছেড়েছিলেন, তাই তিনি থেমে থাকার পাত্র ছিলেন না। সাংস্কৃতিক আন্দোলনের মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেয়ার পরিকল্পনা গ্রহণ করেন বেনু।

কলকাতার লেলিন রোডের ১৪৪ নম্বর বাড়িতে একদল শিল্পী মিলে গড়ে তুলেছিলেন ‘বাংলাদেশ মুক্তি সংগ্রামী শিল্পী সংস্থা’ নামে সাংস্কৃতিক সংগঠন। বেনু ছিলেন সেই সাংস্কৃতিক সংগঠনের সেক্রেটারি, যেখানে যুক্ত ছিলেন চলচ্চিত্রকার জহির রায়হান, নাট্যব্যক্তিত্ব আলী জাকের, শিল্পী মোস্তফা মনোয়ার, নজরুল সঙ্গীত শিল্পী শাহীন সামাদ, ছায়ানটের সনজিদা খাতুনসহ ৭৫ জনের মতো সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব। যাতে সমর্থন যুগিয়েছিলেন কলকাতার বুদ্ধিজীবী, লেখক ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বরা। লন্ডনের বাংলাদেশ সেন্টারে গানের ক্লাসের ফাঁকে কথা হয় তার সঙ্গে। ৪৫ বছর পর আবারও স্মৃতিচারণ করলেন একাত্তরের।

বেনু জানালেন, দূর দূরান্ত থেকে মুক্তিপাগল মানুষ ছুটে আসতেন বাংলাদেশ মুক্তি সংগ্রামী শিল্পী সংস্থার শিল্পীদের গান আর পাপেট শো দেখতে। গান শুনে অর্ধভুক্ত মানুষগুলো যেন প্রাণ ফিরে পেত। যেই মুক্তিবাহিনীর সদস্যরা দিনভর যুদ্ধ করে ক্লান্ত হয়ে ক্যাম্পে ফিরতেন তারাও রাতের বেলা গান শুনে অনুপ্রাণিত হয়ে সকালে পূর্ণ উদ্যমে ঝাঁপিয়ে পড়তেন। একদিন আনুমানিক ৮০ বছর বয়স্ক একজন বৃদ্ধা, যার ঘর পুড়িয়ে ও পরিবারের সবাইকে হত্যা করেছিল পাকিস্তানি সেনারা সেই তিনি এসে বেনুর হাত ধরে বলেন, ‘বাবা পাকিস্তানিরা আমার পরিবারের সবাইকে গুলি করে মেরেছে। আমাকে কেন বাঁচিয়ে রেখেছে জানি না, তুই আমার গলাটা টিপে দিয়ে যা, আমি আর বাঁচতে চাই না।’

স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে বেনু বলেন, ‘কলকাতার একটি শরণার্থী শিবিরে আমাদের গান গাইবার কথা, কিন্তু এমন এক পরিবেশে আমাদের নিয়ে যাওয়া হলো সেখানে গান গাওয়া তো দূরের কথা, পানির মধ্যে গরু-ছাগলেরও বেঁচে থাকা সম্ভব ছিল না। সেই পরিবেশে আমরা গান গাইব না শুনতে পেয়ে শরণার্থী শিবিরের লোকজন বলছিল, বাবা এই পানির মধ্যেই আমরা তিন দিন ধরে অপেক্ষা করছি আপনাদের জন্য, আপনারা আসবেন , আমরা মুক্তির গান শুনব।’ কথা বলতে বলতে অঝোর ধারায় কেঁদে ফেললেন বেনু। টিস্যু দিয়ে নিজেই চোখ মুছে আবারও খালি গলায় গাইতে শুরু করলেন, ‘ওরা হিন্দুও নয় বৌদ্ধও নয় ওরা বাঙালি। একের পর এক তিনি গাইতে থাকলেন ‘জয় বাংলা বাংলার জয়’, ‘জনতার সংগ্রাম চলবে’র মতো একাত্তরের সেই কালজয়ী গানগুলো।

ট্রাকে অন্য শিল্পীদের সঙ্গে বেণু ১৯৭১ সালে বাঙালিদের উপর পাকিস্তানিদের নির্যাতনের চিত্র ধারণ করে প্রামাণ্যচিত্র নির্মাণের জন্য মার্কিন চলচ্চিত্রকার লিয়ার লেভিন বাংলাদেশে এসে যুক্ত হয়েছিলেন বেনু ও তার সঙ্গীদের সাথে। কিন্তু শিল্পীদের বিভিন্ন প্রত্যন্ত অঞ্চলে যাওয়ার জন্য যাতায়াতের ভালো কোনও ব্যবস্থা না থাকায় লেয়ার লেভিন মুক্তিযুদ্ধের পুরো সময়টা জুড়ে দলটিকে একটি ট্রাকের ব্যবস্থা করে দেন। সেই ট্রাকে করে বাংলাদেশ মুক্তি সংগ্রামী শিল্পী সংস্থার শিল্পীরা ঘুরে বেড়িয়েছেন বাংলাদেশ ও ভারতের প্রত্যন্ত অঞ্চলে, যেখানে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ ক্যাম্প ও শরণার্থী শিবির ছিল। পরবর্তীতে অর্থাভাবে লিয়ার লেভিন তার তোলা ২২ ঘণ্টার ভিডিও চিত্রগুলো দিয়ে প্রামান্যচিত্র তৈরি করতে পারেননি। প্রয়াত চলচ্চিত্র নির্মাতা তারেক মাসুদ সম্পর্কে বেনুর চাচাতো ভাই, ১৯৯০ সালে বেনুর মাধ্যমে তারেক মাসুদ জানতে পারেন লিয়ার লেভিনের সম্পর্কে এবং লেভিনের সেই ভিডিওচিত্রগুলো কিনে নেন। পরবর্তীতে লিয়ার লেভিনের ভিডিও ও বিভিন্ন দেশ থেকে সংগৃহিত ভিডিও চিত্রের  উপর ভিত্তি করে তারেক মাসুদ ও ক্যাথরিন মাসুদ তৈরি করেছিলেন ‘মুক্তির গান’ চলচ্চিত্রটি। ‘মুক্তির গান‘ চলচ্চিত্রের কথা অনেকে জানলেও এর মূল চরিত্র একাত্তরের কণ্ঠ যোদ্ধা বেনুর কথা বলতে গেলে অনুচ্চারিতই রয়ে গেছে। বাংলাদেশ মুক্তি সংগ্রামী শিল্পী সংস্থার সদস্যদের মধ্যে অনেক শিল্পীই পেয়েছেন একুশে পদক ও স্বাধীনতা পদকের মতো রাষ্ট্রীয় সম্মাননা। কিন্তু যিনি ছিলেন বাংলাদেশ মুক্তি সংগ্রামী শিল্পী সংস্থার অন্যতম উদ্যোক্তা ও সেক্রেটারি তিনি কেন রাষ্ট্রীয় পদকের আওতায় এলেন না এমন প্রশ্নের উত্তরে বেনু বলেন, তিনি কখনও পদক পাওয়ার আশায় গান করেননি। তার তখন একটাই লক্ষ্য ছিল বাংলাদেশকে স্বাধীন করতে হবে।

১৯৭৩ সাল থেকে লন্ডনে বসবাস করছেন নিভৃতচারী এই কণ্ঠ যোদ্ধা। ৭৫ বছর বয়সেও তার কণ্ঠ একাত্তরের মতোই তেজোদ্দীপ্ত। এখনও বাংলাদেশ সেন্টারে নিয়ম করে প্রতি সপ্তাহে তিনি বিলেতের আগ্রহী সঙ্গীত প্রেমীদের গান শেখান।

/এফএইচএম/

সম্পর্কিত
নানা আয়োজনে রাজধানীবাসীর বিজয় উদযাপন
বিজয় দিবস উপলক্ষে বঙ্গভবনে রাষ্ট্রপতির সংবর্ধনা
জাবিতে আলোকচিত্র প্রদর্শনী
সর্বশেষ খবর
ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি লিভারপুল, সেমিফাইনালে আটালান্টা
ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি লিভারপুল, সেমিফাইনালে আটালান্টা
ইরানের ওপর কোনও ক্ষেপণাস্ত্র হামলা হয়নি: ইরানি কর্মকর্তা   
ইরানের ওপর কোনও ক্ষেপণাস্ত্র হামলা হয়নি: ইরানি কর্মকর্তা  
সিলেটে আবারও শুরু হচ্ছে করোনাভাইরাসের টিকাদান কার্যক্রম
সিলেটে আবারও শুরু হচ্ছে করোনাভাইরাসের টিকাদান কার্যক্রম
ভ্রমণ শেষে ভারত থেকে তিন দিনে ফিরলেন ১৫ হাজার পর্যটক
ভ্রমণ শেষে ভারত থেকে তিন দিনে ফিরলেন ১৫ হাজার পর্যটক
সর্বাধিক পঠিত
সয়াবিন তেলের দাম পুনর্নির্ধারণ করলো সরকার
সয়াবিন তেলের দাম পুনর্নির্ধারণ করলো সরকার
ডিএমপির ৬ কর্মকর্তার বদলি
ডিএমপির ৬ কর্মকর্তার বদলি
পিএসসির সদস্য ড. প্রদীপ কুমারকে শপথ করালেন প্রধান বিচারপতি
পিএসসির সদস্য ড. প্রদীপ কুমারকে শপথ করালেন প্রধান বিচারপতি
নিজ বাহিনীতে ফিরে গেলেন র‍্যাবের মুখপাত্র কমান্ডার মঈন
নিজ বাহিনীতে ফিরে গেলেন র‍্যাবের মুখপাত্র কমান্ডার মঈন
পরীমনির বিরুদ্ধে ‘অভিযোগ সত্য’, গ্রেফতারি পরোয়ানা জারির আবেদন
পরীমনির বিরুদ্ধে ‘অভিযোগ সত্য’, গ্রেফতারি পরোয়ানা জারির আবেদন