X
শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪
১২ বৈশাখ ১৪৩১

চিকিৎসকের নিজের হার্টে রিং, রোগীর হার্টে ব্লকের চিকিৎসা বিনা ‘কাটাছেঁড়ায়’

উদিসা ইসলাম
২৬ ডিসেম্বর ২০১৬, ১২:০১আপডেট : ২৬ ডিসেম্বর ২০১৬, ২০:০০


হার্টে ব্লক। ছবি: সংগৃহীত ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালের এক চিকিৎসকের হার্টে ব্লক ধরা পড়লে তিনি এর চিকিৎসায় হার্টে রিং পরিয়েছিলেন। কিন্তু তিনিই আবার হার্টে ব্লক থাকা রোগীদের চিকিৎসা করছেন ‘কাটাছেঁড়া’ ও বাইপাস ছাড়াই। শুধু ওই চিকিৎসক-ই নন, মোহাম্মদপুর এলাকার একদল চিকিৎসকই দাবি করছেন, এটাই আধুনিক চিকিৎসা পদ্ধতি। তারা বলছেন, সামর্থ্যহীনরা চাইলেই এই চিকিৎসা পদ্ধতি গ্রহণ করতে পারেন। তবে হৃদরোগ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এটি রোগীদের সঙ্গে প্রতারণা ছাড়া আর কিছুই নয়। হার্টে ব্লক ধরা পড়লে কেবল ওষুধ খাইয়ে সেটা সারিয়ে তোলা সম্ভব নয়।

পত্রিকার বিজ্ঞাপন থেকে মোহাম্মদপুরের বেশ কয়েকটি ডায়াগনসিস্ট সেন্টারের খবর পাওয়া যায়, যেখানে কাটাছেঁড়া ও বাইপাস ছাড়াই হার্টের ব্লকের ‘আধুনিক’ চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। বিভিন্ন সরকারি হাসপাতালের সাবেক ও বর্তমান চিকিৎসকরাই তুলনামূলকভাবে দরিদ্র রোগীদের এই চিকিৎসা দিয়ে যাচ্ছেন। রোগীদের আকৃষ্ট করতে শীর্ষস্থানীয় সব পত্রিকায় দিচ্ছেন চটকদার বিজ্ঞাপন।

চিকিৎসকের নিজের হার্টে রিং, রোগীর হার্টে ব্লকের চিকিৎসা বিনা ‘কাটাছেঁড়ায়’ সরেজমিনে মুন ডায়াগনিস্ট সেন্টার ও ডায়োমেড ডায়াগনিস্ট সেন্টারে গিয়ে দেখা যায়, অনেক রোগীই বসে আছেন চিকিৎসা নেওয়ার জন্য। এক কোনায় নতুন রোগীর হিস্ট্রি লেখা হচ্ছে। আরেক টেবিলে পুরোনো রোগীদের প্রেসক্রিপশন করে দেওয়া হচ্ছে। এসব প্রেসক্রিপশনের সবগুলো ওষুধেই ‘চলবে’ লেখা। কতদিন এসব ওষুধ চলবে জানতে চাইলে চিকিৎসকের সহকারীরা বলেন, ‘সেটা স্যার বলতে পারবেন।’

কাটাছেঁড়া ও বাইপাস ছাড়াই হার্টের ব্লকের এই চিকিৎসা নিচ্ছেনও অনেকেই। তাদেরই একজন ঝিনাইদহের জেবুন্নেসা। বুকে ব্যাথা নিয়ে ভর্তি হয়েছিলেন স্থানীয় একটি হাসপাতালে। পরে ঢাকায় এসে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করান। জানতে পারেন, তার হার্টে ব্লক আছে। এর চিকিৎসায় রিং পরানো যাবে না, দরকার বাইপাস সার্জারি। তার জন্য প্রয়োজন বেশকিছু টাকাও। টাকা জোগাড়ের চেষ্টা করতে থাকেন জেবুন্নেসা।

চিকিৎসকের নিজের হার্টে রিং, রোগীর হার্টে ব্লকের চিকিৎসা বিনা ‘কাটাছেঁড়ায়’ এর মধ্যেই জেবুন্নেসার ছেলে মোহম্মদপুরের কলেজ গেটের একটি ফার্মেসি থেকে জানতে পারেন হুমায়ুন রোডের ঢাকা ল্যাব বিল্ডিংয়ে অবস্থিত ডায়োমেড হার্ট সেন্টারের কথা। জানতে পারেন, জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের সাবেক অধ্যাপক প্রফেসর ডা. এস এম সিদ্দিকুর রহমান ও কে এস এম শামীমসহ আরও কয়েকজন চিকিৎসক সেখানে কোনও ধরনের বাইপাস অপারেশন বা সার্জারি ছাড়াই ব্লকের চিকিৎসা দিয়ে থাকেন। এরপর আট মাস ধরে জেবুন্নেসা সেখানেই চিকিৎসা করাচ্ছেন। এখনও বুকে ব্যাথা হয় কিনা জানতে চাইলে তিনি বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘ওষুধ না খেলে হয়। ডাক্তার বলেছেন, সময় লাগবে। এখন যতদিন বাঁচি ওষুধ চালিয়ে যেতে হবে।’ এর চেয়ে বাইপাস করা ভালো হতো কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমার অত সামর্থ্য নাই।’

মোহাম্মদপুর মুন ডায়াগনিস্টে শমসের হার্ট কেয়ারে চিকিৎসা নিচ্ছেন মুগদার মফিজ উদ্দিন। তিনি বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আগে হাঁটার সময় বুকে ব্যথা করত। মুগদা হাসপাতালে অ্যানজিওগ্রাম করে দেখা গেল ব্লক আছে। কিন্তু ব্লকটি এমন জায়গায় যে রিং পরানো যাবে না, বাইপাস করতে হবে। আমার অত টাকা-পয়সা নেই। আমি পত্রিকায় শমশের হার্ট কেয়ারের বিজ্ঞাপন দেখে এখানে আসি। এখন আমার বলতে গেলে সবকিছুই খাওয়া বন্ধ। ওষুধ খেলে ভালো থাকি, না হলে বুকের ওই ব্যথাটা ফিরে আসে।’

চিকিৎসকের নিজের হার্টে রিং, রোগীর হার্টে ব্লকের চিকিৎসা বিনা ‘কাটাছেঁড়ায়’ কতদিন ওষুধ খেতে বলা হয়েছে জানতে চাই এই রোগীর কাছে। তিনি বলেন, ‘আমার এক বছর হয়ে গেল। আজকে (রবিবার) আবারও আগের ওষুধগুলোই চলবে বলে লিখেছে প্রেসক্রিপশনে। সঙ্গে নতুন একটি ওষুধও দিয়েছে।’ ইসিপি করতে বলেছে কিনা জানতে চাইলে মফিজ উদ্দিন বলেন, ‘সবাইকেই বলা হয়। কিন্তু এর জন্য ৩৫ দিনে এক লাখেরও ওপরে টাকা লাগবে। এত টাকা একসঙ্গে জোগাড় করার সামর্থ্য যাদের নাই তারাই এসব জায়গায় আসে।’ এই চিকিৎসকের নিজেরই হার্টেই রিং লাগানো আছে সেটা জানেন কিনা- এ প্রশ্নে থতমত খেয়ে বললেন, ‘হবে হয়তো। জানি না।’

হৃদরোগ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এটা এক ধরনের প্রতারণা। দিনের পর দিন ওষুধ খাইয়ে এবং কখনও কখনও চড়া দামে ইসিপি  চিকিৎসা দিয়ে কেবল রোগীর রোগকে দীর্ঘস্থায়ী করা হচ্ছে। রিং পরানো বা বাইপাসের দরকার হলে তা অন্য কোনও উপায়ে ঠিক করার উপায় এখনও চিকিৎসাবিজ্ঞান বের করতে পারেনি। এমনকি চটকদার বিজ্ঞাপন দিয়ে মানুষকে বিভ্রান্ত করছেন যে চিকিৎসক, সেই শমসের আলীর হার্টেও রিং পরানো আছে বলে তার সহকর্মীরা দাবি করেছেন।

ডা. শমসের আলীর সহকর্মীরা দাবি করছেন, বছর দেড়েক আগে শমসের আলীর হার্ট অ্যাটাক হয়। ডা. মোমেনুজ্জামান তার হার্টে স্ট্যান্ট (রিং) বসিয়ে দেন। এ বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে ডা. শমসের আলী বলেন, ‘আমি রিং পড়েছি তাতে কী হয়েছে? সবার কি রিং পরার সামর্থ্য আছে? নাকি যারা এই চিকিৎসা পদ্ধতির বিরোধিতা করছেন তারা বিনামূল্যে রিং পরায়ে দিবে? তা না দিলে এইসব রোগী কোথায় যাবে?’

চিকিৎসকের নিজের হার্টে রিং, রোগীর হার্টে ব্লকের চিকিৎসা বিনা ‘কাটাছেঁড়ায়’ ডা. শমসের আলী আরও বলেন, ‘যারা আমার পদ্ধতির বিরোধিতা করেন তারা নিজেদের স্বার্থের জন্য করেন। তাদের প্রশ্ন করুন, একবার রিং পরালেই কি মুক্তি মিলবে? পূর্বাচলের স্কুল শিক্ষক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এপ্রিলে বাইপাস করেছে। আবারও ব্লক দেখা দিয়েছে। সে কী করবে? আবার বাইপাস করবে? সব প্রশ্নের উত্তর মেলে না।’

রোগ নির্ণয় ও চিকিৎসা সম্পর্কে জানতে চাইলে চিকিৎসকের সহকারীরা বলেন, ‘৮শ টাকা দিয়ে স্যারের সিরিয়াল নিতে হয়। আগে থেকে টেস্ট করানো থাকলে সাধারণত আর কোনও টেস্ট করা হয় না। নিয়ন্ত্রিত কায়িক শ্রম ও আচার-আচরণগত পরিবর্তন এনে ওষুধের মাধ্যমে ব্লক দূর করা হয়। আমাদের এমন অনেক রোগী আছে।’ ব্লক সেরে গেছে এমন কোনও রোগীর নাম-ঠিকানা জানতে চাইলে নিরাপত্তার অজুহাতে কোনও রোগীর ঠিকানা দিতে রাজি হননি তারা। আর রোগীদের যাদের অবস্থা বেশি খারাপ, তাদের ক্ষেত্রে ইসিপি করা হয় বলে জানান তারা।

চিকিৎসকরা বলছেন, হার্টের রোগীদের যাদের বাইপাস বা এ্যানজিওপ্লাস্টি করা যায় না তাদের জন্য ইসিপি বা এক্সটার্নাল কাউন্টারপালসেশন পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়। এই পদ্ধতিতে কম্পিউটারের মাধ্যমে পায়ে বাড়তি চাপ সৃষ্টি করে হার্টের ছোট ছোট রক্তনালীর মধ্য দিয়ে রক্ত সরবরাহ করার চেষ্টা করা হয়। তবে এই পদ্ধতিতে হার্টের ব্লক ছোটানো কখনই সম্ভব হয় না।

কাটাছেঁড়া না করে অর্থাৎ সার্জারি না করে আদৌ ব্লকের চিকিৎসা সম্ভব কিনা, এ বিষয়ে হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ রাকিবুল ইসলাম সংবাদপত্রে নিবন্ধ লিখেছেন। তাতে তিনি লিখেছেন, হার্টে ব্লকের প্রচলিত চিকিৎসা অপারেশন অথবা রিং পরানো। এর বিকল্প হিসেবে শুধু খাদ্যাভ্যাস ও জীবনধারা পরিবর্তনের মাধ্যমেই চিকিৎসা করা যায় বলে প্রায়ই পত্রিকার পাতায় আকর্ষণীয় বিজ্ঞাপন দেখা যায়। এর মাধ্যমে জনগণকে বিভ্রান্ত করা হচ্ছে। তেল ছাড়া তরকারি খেলে হার্টের ব্লকের প্রবণতা কমে যায়, এটা ঠিক। কিন্তু ব্লক একবার হয়ে গেলে তা কখনই ছোটে না।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে নামকরা একজন হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘নিজেদের মধ্যে দ্বন্দ্বের আশঙ্কায় অনেক সময় বলা হয় না। তবে এটা সত্য যে, এ ধরনের চিকিৎসা পদ্ধতির মাধ্যমে আর যাই হোক, ব্লক দূর করা সম্ভব না।’

চিকিৎসায় এ ধরনের প্রতারণার শাস্তি কী, জানতে চাইলে স্বাস্থ্য অধিদফতরের পরিচালক (হাসপাতাল ও ক্লিনিক) সাইদুর রহমান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘এটা খুবই টেকনিক্যাল একটা বিষয়। এটা নিয়ে হুট করে আমরা সিদ্ধান্ত দিতে পারব না। যারা এর সঙ্গে জড়িত, তারাই বলতে পারবেন কোনটা করা ঠিক বা বেঠিক।’

প্রতারণা ও বিভ্রান্ত করতে পারে, এ ধরনের বিজ্ঞাপনের ক্ষেত্রে তাদের মনিটরিংয়ের কোনও ব্যবস্থা আছে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমাদের কাছে এসব নিয়ে কোনও অভিযোগ আসেনি। কেউ অভিযোগ করলে কমিটি করে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

/টিআর/আপ-এসএনএইচ/

সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
জেলা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ককে দল থেকে বহিষ্কার
জেলা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ককে দল থেকে বহিষ্কার
সড়কে প্রাণ গেলো মোটরসাইকেল আরোহী বাবা-ছেলের
সড়কে প্রাণ গেলো মোটরসাইকেল আরোহী বাবা-ছেলের
দেশের তথ্যপ্রযুক্তি বিশ্ব দরবারে উপস্থাপন করতে চান রাশেদুল মাজিদ
দেশের তথ্যপ্রযুক্তি বিশ্ব দরবারে উপস্থাপন করতে চান রাশেদুল মাজিদ
আগুন নেভাতে ‘দেরি করে আসায়’ ফায়ার সার্ভিসের গাড়িতে হামলা, দুই কর্মী আহত
আগুন নেভাতে ‘দেরি করে আসায়’ ফায়ার সার্ভিসের গাড়িতে হামলা, দুই কর্মী আহত
সর্বাধিক পঠিত
দুদকের চাকরি ছাড়লেন ১৫ কর্মকর্তা
দুদকের চাকরি ছাড়লেন ১৫ কর্মকর্তা
বাংলাদেশ ব্যাংকের চাকরি ছাড়লেন ৫৭ কর্মকর্তা
বাংলাদেশ ব্যাংকের চাকরি ছাড়লেন ৫৭ কর্মকর্তা
স্কুল-কলেজে ছুটি ‘বাড়ছে না’, ক্লাস শুরুর প্রস্তুতি
স্কুল-কলেজে ছুটি ‘বাড়ছে না’, ক্লাস শুরুর প্রস্তুতি
কেন গলে যাচ্ছে রাস্তার বিটুমিন?
কেন গলে যাচ্ছে রাস্তার বিটুমিন?
ধানের উৎপাদন বাড়াতে ‘কৃত্রিম বৃষ্টির’ পরিকল্পনা
ধানের উৎপাদন বাড়াতে ‘কৃত্রিম বৃষ্টির’ পরিকল্পনা