X
বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪
১২ বৈশাখ ১৪৩১

ব্রিটেনে যতো শহীদ মিনার

তানভীর আহমেদ, লন্ডন
২১ ফেব্রুয়ারি ২০১৭, ১৩:১০আপডেট : ২১ ফেব্রুয়ারি ২০১৭, ১৬:৪৯

ওল্ডহ্যামে ১৯৯৭ সালে স্থাপিত শহীদ মিনার ব্রিটেনের বিভিন্ন শহরে বাংলাদেশি কমিউনিটির উদ্যোগে এখন পর্যন্ত পাঁচটি স্থায়ী শহীদ মিনার নির্মাণ হয়েছে। ষষ্ঠ শহীদ মিনার নির্মাণের জন্য ইতোমধ্যে অনুমতি পাওয়া গেছে। মূলত ইউনেস্কো ১৯৯৯ সালে ২১ ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার পর থেকেই এর ব্যাপ্তি ছড়িয়ে পড়ে বিশ্বব্যাপী। এরপর থেকে ব্রিটেনে একে একে তৈরি হতে থাকে শহীদ মিনারগুলো।

শুধু বাংলা ভাষার মানুষের কাছেই নয়, ভিন্ন সংস্কৃতির মানুষের কাছেও শ্রদ্ধার প্রতীক হয়ে উঠেছে শহীদ মিনারগুলো। একুশে ফেব্রুয়ারি ছাড়াও ব্রিটেনের সাধারণ পর্যটকদের কাছে এগুলো ব্যাপক আগ্রহ সৃষ্টি করেছে। বাংলা ভাষার জন্য যারা প্রাণ দিয়েছেন তাদের স্মরণ করতে এই শহীদ মিনারগুলো নির্মাণের পেছনে রয়েছে বাংলাদেশি কমিউনিটির সংগ্রামের ইতিহাস। প্রবাসী বাংলাদেশিদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেলো স্মরণীয় ঘটনাগুলো।

ওল্ডহ্যামে প্রথম শহীদ মিনার
১৯৯৭ সালের ৫ অক্টোবর ব্রিটেনে বাংলাদেশিদের উদ্যোগে প্রথম স্থায়ী শহীদ মিনার নির্মাণ করা হয় ওল্ডহ্যামে। লন্ডন থেকে এই শহরের দূরত্ব প্রায় ২৬৩ কিলোমিটার। এটি ব্রিটেনের তৃতীয় বৃহত্তম বাঙালি অধ্যুষিত অঞ্চল। ওল্ডহ্যাম বাংলাদেশ ইয়ুথ অ্যাসোসিয়েশনের উদ্যোগে ও স্থানীয় বাংলাদেশি ও কাউন্সিলের সহযোগিতায় তৈরি হয় ব্রিটেনের এই প্রথম শহীদ মিনার। তবে স্থানীয় বাংলাদেশি কাউন্সিলর আবদুল জব্বার ওল্ডহ্যাম কাউন্সিলের অনুমোদন লাভে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন।

শুরুর দিকে ওল্ডহ্যাম বাংলাদেশি হিস্ট্রি অ্যান্ড কালচারাল সেন্টারে অস্থায়ী শহীদ মিনারে ভাষা দিবসের শ্রদ্ধাঞ্জলির আয়োজন করা হতো। স্থায়ী শহীদ মিনার নির্মাণের পর থেকে একুশে ফেব্রুয়ারি উদযাপনের জন্য ওল্ডহ্যামের আশপাশের শহর ম্যানচেস্টার, ব্র্যাডফোর্ড ও লিডসে বসবাসরত বাংলাদেশিরা সমবেত হন।

লন্ডনের আলতাব আলী পার্কে ১৯৯৯ সালে স্থাপিত শহীদ মিনার লন্ডনে দ্বিতীয় ও ব্রিটেনের বৃহত্তম শহীদ মিনার
১৯৯৯ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি পূর্ব লন্ডনের আলতাবী আলী পার্কে স্থাপিত হয় লন্ডনের একমাত্র স্থায়ী শহীদ মিনার। এটাই ইংল্যান্ডে স্থাপিত শহীদ মিনারগুলোর মধ্যে সর্ববৃহৎ। তবে টাওয়ার হ্যামলেটস কাউন্সিলের কাছে শহীদ মিনার নির্মাণের জন্য স্থানীয় বাংলাদেশিরা দাবি জানিয়ে আসছিলেন ১৯৮১ সাল থেকে। ১৯৮৫ সালে শহীদ দিবস উদযাপন কমিটি গঠনের পর টাওয়ার হ্যামলেটস কাউন্সিল পূর্ব লন্ডনে শহীদ মিনারের স্থান দিতে সম্মতি জানায়। এটি নির্মাণ করতে কাউন্সিলকে অর্থসহায়তা হিসেবে কমিউনিটির ৪৫টি সংগঠনের প্রত্যেকে ৫০০ পাউন্ড করে মোট ২২ হাজার পাউন্ড অনুদান দিয়েছিলেন। এসব সংগঠনের তালিকা রয়েছে শহীদ মিনারের পাশে।

লন্ডনের শহীদ মিনার কমিটির তৎকালীন ট্রেজারার মাহমুদ স্মৃতিচারণ করে বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘লন্ডনের শহীদ মিনার নির্মাণের ইতিহাসের সঙ্গে ব্রিকলেনের ৩৯ ফরনিয়ার স্ট্রিটের শহীদ ভবনটির ইতিহাস জড়িয়ে আছে। বর্তমানে যেখানে বাংলাদেশ ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশনের কার্যালয় সেখানেই মূলত শহীদ মিনার নির্মাণের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়। কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার কমিটির প্রথম ১২ সদস্যের নির্বাহী কমিটি গঠন করা হয় ১৯৯৯ সালে, এর চেয়ারপারসন ছিলেন শফিকুর রহমান চৌধুরী।’

বাংলাদেশ ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশনের জেনারেল সেক্রেটারি ও শহীদ দিবস উদযাপন কমিটির সাধারণ সম্পাদক নূরুল ইসলাম জানালেন, এই শহীদ মিনার নির্মাণের আগে লন্ডনের বাংলাদেশিরা ষাটের দশক থেকেই লন্ডনের বিভিন্ন কমিউনিটি সেন্টারে ও হলে ভাষা শহীদদের শ্রদ্ধা জানিয়ে আসছিলো। সেই সময় কাঠের ফ্রেমে ইনডোরে শহীদ দিবস উদযাপিত হতো। এছাড়া পূর্ব লন্ডনের সেন্ট মেরিজ সেন্টার, বাংলাদেশ সেন্টার, পূর্ব লন্ডনের নজরুল সেন্টারেও পৃথকভাবে অস্থায়ী শহীদ মিনারের প্রতিকৃতিতে শ্রদ্ধা জানাতেন লন্ডনপ্রবাসী বাংলাদেশিরা।

লুটনে ২০০৪ সালে শহীদ মিনার উদ্বোধনের মুহূর্ত ব্রিটেনের তৃতীয় শহীদ মিনার লুটনে
২০০৪ সালের ৮ আগস্ট লুটনে উদ্বোধন করা হয় ব্রিটেনের তৃতীয় শহীদ মিনার। লন্ডন থেকে লুটনের দূরত্ব ৪৬ কিলোমিটার। লুটনের ব্যারিপার্ক অঞ্চলেই অধিকাংশ বাংলাদেশি কমিউনিটির বসবাস। সত্তরের দশকে ব্রিটেনে বর্ণবাদীদের কর্মকাণ্ড চরম আকার ধারণের সময় লুটনে বর্ণবাদী হামলা রুখে দিতে বাংলাদেশি কমিউনিটির তরুণদের উদ্যোগে গঠিত হয়েছিলো বাংলাদেশ ইয়ুথ লীগ। বর্তমানে লুটনের লে-গ্রিব রোডের যে স্থানে সিওয়াই সিডি সেন্টার তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করছে সেখানেই ১৯৭৯ সালে বাংলাদেশ ইয়ুথ লীগ স্থাপিত হয়েছিলো। বাংলাদেশ ইয়ুথ লীগের ২৫ বছর পূর্তিকে স্মরণীয় করে রাখতে লুটনে শহীদ মিনার নির্মাণের উদ্যোগ গ্রহণ করে সংগঠনটির উদ্যোক্তারা।

বার্মিংহ্যামে ২০১১ সালে প্রতিষ্ঠিত শহীদ মিনার চতুর্থ শহীদ মিনার বার্মিংহ্যাম শহরে
ব্রিটেনের দ্বিতীয় বৃহত্তম বাংলাদেশি অধ্যুষিত অঞ্চল হলো বার্মিংহ্যাম। লন্ডন থেকে এই শহরের দূরত্ব ১৬৪ কিলোমিটার। এখানে বার্মিংহ্যাম বাংলাদেশ মাল্টিপারপাস সেন্টারের উদ্যোগে ২০১১ সালে নির্মাণ করা হয় ব্রিটেনের চতুর্থ শহীদ মিনার। তবে বার্মিংহ্যামের স্মলহিথ পার্কে শহীদ মিনার নির্মাণের জন্য দীর্ঘদিন ধরে একাধিক কমিউনিটি গ্রুপ উদ্যোগ নিলেও স্থানীয় কাউন্সিল থেকে নানান কারণে চূড়ান্ত অনুমোদন পায়নি।

পরবর্তীতে বাংলাদেশ মাল্টিপারপাস সেন্টারের উদ্যোগে ও সেন্টারের নিজস্ব অর্থায়নে শহীদ মিনার নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হয় সেন্টারের নিজস্ব স্থানে। শহীদ মিনারটির নির্মাণ ব্যয়ের ২০ হাজার পাউন্ডের পুরো অর্থ যোগান দিয়েছেন বাংলাদেশ মাল্টিপারপাস সেন্টার। ১৬ ফেব্রুয়ারি ২০১১ সালে বার্মিংহ্যামে আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধন হয় ব্রিটেনের চতুর্থ শহীদ মিনারটি।

ইপ্সউইচে আলেকজান্ড্রা পার্কে শহীদ মিনার উদ্বোধনের মুহূর্ত ইপ্সউইচে ব্রিটেনের পঞ্চম শহীদ মিনার
সাফোর্ক বাংলাদেশি সোসাইটি ইপ্সউইচে স্থায়ী শহীদ মিনার নির্মাণের পরিকল্পনা গ্রহণ করে ২০১২ সালে। সেই সময় স্থানীয় বাংলাদেশিরা শহীদ মিনারের কাঠের প্রতিকৃতি বানিয়ে বিভিন্ন কমিউনিটি সেন্টারে ভাষা শহীদদের শ্রদ্ধা জানিয়ে আসছিলেন। ভাষার প্রতি এমন শ্রদ্ধাবোধ ও বাঙালির আত্মত্যাগের কথা ইপ্সউইচের কাউন্সিলকে স্থায়ী শহীদ মিনার নির্মাণে অনুপ্রাণিত করে। ২০১৫ সালে স্থানীয় কাউন্সিলের সম্পূর্ণ অর্থায়নে ইপ্সউইচের আলেকজান্দ্রা পার্কে শহীদ মিনার নির্মাণের কাজ শুরু হয়। ২০১৬ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি আলেকজান্ড্রা পার্কে উদ্বোধন হয় ব্রিটেনের পঞ্চম স্থায়ী শহীদ মিনার।

কার্ডিফের নির্মিতব্য শহীদ মিনারের নামফলক কার্ডিফে হচ্ছে আরেকটি শহীদ মিনার
বাংলাদেশিদের উদ্যোগে সম্প্রতি কার্ডিফের আরেকটি শহীদ মিনার নির্মাণের অনুমতি পেয়েছেন প্রবাসীরা। শহীদ মিনার নির্মাণের জন্য স্থানীয় কাউন্সিলর দিলওয়ার আলী প্রায় দশ বছর ধরে কার্ডিফের প্রশাসনের সঙ্গে লবিং করে আসছিলেন। সম্প্রতি কার্ডিফের বাংলাদেশি কমিউনিটির একটি প্রতিনিধি দল বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করে সহায়তার আশ্বাস পেলে শহীদ মিনার নির্মাণের পথ প্রশস্ত হয়। কার্ডিফ সিটি কাউন্সিলও শহীদ মিনার নির্মাণের জন্য স্থান বরাদ্দ দেয়। কার্ডিফ শহীদ মিনারের অন্যতম উদ্যোক্তা আনোয়ার আলী বাংলা ট্রিবিউনকে জানালেন, এই শহীদ মিনারের নির্মাণকাজ শেষ হবে ২০১৮ সালে। সেই সঙ্গে কার্ডিফের শিক্ষা কার্যক্রমেও যুক্ত হবে ভাষা শহীদদের আত্মত্যাগের কথা।

/জেএইচ/

 

সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
গোপনে ইউক্রেনকে দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র
গোপনে ইউক্রেনকে দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র
টিপু-প্রীতি হত্যা মামলার অভিযোগ গঠন বিষয়ে আদেশ ২৯ এপ্রিল
টিপু-প্রীতি হত্যা মামলার অভিযোগ গঠন বিষয়ে আদেশ ২৯ এপ্রিল
ধানের উৎপাদন বাড়াতে ‘কৃত্রিম বৃষ্টির’ পরিকল্পনা
ধানের উৎপাদন বাড়াতে ‘কৃত্রিম বৃষ্টির’ পরিকল্পনা
ক্যাসিনো কাণ্ডের ৫ বছর পর আলো দেখছে ইয়ংমেন্স ও ওয়ান্ডারার্স
ক্যাসিনো কাণ্ডের ৫ বছর পর আলো দেখছে ইয়ংমেন্স ও ওয়ান্ডারার্স
সর্বাধিক পঠিত
বাংলাদেশ ব্যাংকের চাকরি ছাড়লেন ৫৭ কর্মকর্তা
বাংলাদেশ ব্যাংকের চাকরি ছাড়লেন ৫৭ কর্মকর্তা
কেন গলে যাচ্ছে রাস্তার বিটুমিন?
কেন গলে যাচ্ছে রাস্তার বিটুমিন?
‘বয়কট’ করা তরমুজের কেজি ফের ৬০ থেকে ১২০ টাকা
‘বয়কট’ করা তরমুজের কেজি ফের ৬০ থেকে ১২০ টাকা
২৪ ঘণ্টা পর আবার কমলো সোনার দাম
২৪ ঘণ্টা পর আবার কমলো সোনার দাম
আপিল বিভাগে নিয়োগ পেলেন তিন বিচারপতি
আপিল বিভাগে নিয়োগ পেলেন তিন বিচারপতি