X
শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪
১২ বৈশাখ ১৪৩১

জাতিগত হীনম্মন্যতায় বাড়ছে না সর্বস্তরে বাংলা ভাষার ব্যবহার

জাকিয়া আহমেদ
২১ ফেব্রুয়ারি ২০১৭, ২১:১১আপডেট : ২১ ফেব্রুয়ারি ২০১৭, ২১:৪৫

তিন ভাষাসৈনিক

সংবিধান স্বীকৃত হলেও দেশের বেশিরভাগ ক্ষেত্রে বাংলা ভাষার প্রচলন নেই। দোকানপাটের নাম থেকে শুরু করে বিভিন্ন সাইনবোর্ড, চিকিৎসকদের ব্যবস্থাপত্র, আদালতের রায়, বিয়ে, জন্মদিন, বউভাত কিংবা কোনও কিছুর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানেও ইংরেজির আধিপত্য লক্ষ্য করা যায়। এ নিয়ে বাংলা ট্রিবিউনের কাছে হতাশা প্রকাশ করেছেন তিন ভাষাসৈনিক অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক ফুলে হোসেন, আহমদ রফিক ও ড. রফিকুল ইসলাম। ইংরেজি মাধ্যমের স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষাগ্রহণের হার বেড়েছে বলেও মন্তব্য তাদের। এজন্য জাতিগত হীনম্মন্যতাকেই দায়ী করেছেন তারা।

ভাষাসৈনিক ফুলে হোসেন

ভাষাসৈনিক আহমদ রফিক বাংলা ট্রিবিউনকে তারাশংকর বন্দ্যোপাধ্যায়ের একটি উপন্যাসের উদাহরণ টেনে বলেন, গল্পের মূল নায়ক ছিলেন একজন শিক্ষক। তাকে প্রশ্ন করা হয়েছিল— অন্যরা যেমন ইংরেজি ও বাংলা মিশিয়ে কথা বলে, আপনি বলেন না কেন? উনি তখন উত্তর দিয়েছিলেন, ‘আমি বাংলা এবং ইংরেজি দুটো ভাষাই ভালো করে জানি। তাই কোনও একটি বলতে গেলে দুটো ভাষা আমাকে মেশাতে হয় না।’ আহমদ রফিক বলেন, ‘এতোবড় একটি কথা তারাশংকর বহুদিন আগে বলে গিয়েছিলেন। আর আমরা আজও সেই দোষে দুষ্ট। কিন্তু আমরা না ইংরেজি ভালো জানি, না ভালো বাংলা জানি।’

একুশে পদকপ্রাপ্ত এই ভাষাসৈনিক মনে করেন, ভাষার ব্যবহার এখন চরম নৈরাজ্যিক অবস্থায় রয়েছে। সঠিক শব্দের ব্যবহার, নির্ভুল ব্যবহার, সঠিক ভাষার ব্যবহার, নির্ভুল উচ্চারণে কথা বলা কোনও দিক থেকেই বাংলা ভাষা ভালো অবস্থানে নেই এখন। বাংলা ট্রিবিউনকে তিনি আরও বলেন, ‘বাইরে বেরুলেই চারপাশের সাইনবোর্ডে দেখি অসংখ্য ভুল। এসব ভুল নিয়ে কারও মধ্যে সচেতনতাও নেই। কেউ দেখিয়ে দিলেও সংশ্লিষ্টরা এটাকে ভুল বা ত্রুটি মনে করে না। তেমনই একই অবস্থা টিভি চ্যানেলের টক শোতেও দেখি। তারা (বক্তারা) বাংলা এবং ইংরেজির মিশেলে অবিরাম কথা বলে যাচ্ছেন। তারা একটু সচেতন হলেই এমনটা হতো না।’

সাইনবোর্ড প্রসঙ্গে আরেক ভাষাসৈনিক অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক ফুলে হোসেন বাংলা ট্রিবিউনকে জানালেন, ‘মুক্তিযুদ্ধের পরপর দেশের সাইনবোর্ডগুলো বাংলা লেখা শুরু হয়েছিল এবং সেটা প্রতিষ্ঠা পেয়েছিল। কিন্তু, নব্বই দশকের পর থেকে সেই চিত্র বদলে যেতে থাকলো। বাংলার পরিবর্তে সবকিছুতে এখন ইংরেজির আধিপত্য।’

অপরদিকে, মিশেল ভাষাকে বাংলা ভাষার সবচেয়ে বড় শত্রু বলে উল্লেখ করেছেন ভাষাসৈনিক ড. রফিকুল ইসলাম। বাংলা ট্রিবিউনকে তিনি বলেন, ইদানিং দেখি একটি টেলিভিশনে আঞ্চলিক গানভিত্তিক একটি অনুষ্ঠান হয়, কিন্তু সেখানে সব কথা হচ্ছে ইংরেজিতে। এটা কেন হবে? হয় প্রমিত বাংলা বলতে হবে, নয়তো আঞ্চলিক বাংলাতে বলতে হবে অথবা শুদ্ধ ইংরেজিতে বলতে হবে। আর বিজ্ঞাপনের ভাষা, নাটকের যেসব সংলাপ শুনছি তাতে বাংলাভাষা মিশেল হয়ে গেছে। এই মিশেল ভাষা বাংলা ভাষার সবচেয়ে বড় শত্রু।

তিনি আরও বলেন, সামাজিক ক্ষেত্রে হীনম্মন্যতা অথবা সচেতনতার অভাব যেটাই হোক আমরা ইংরেজি ছাড়া কিছু ভাবতে পারি না। দোকানপাট, ভবন, বাড়ি সবকিছুর নাম ফলক ইংরেজিতে। অ্যাপার্টমেন্টগুলোর নামও ইংরেজিতে। এই হীনমন্যতার কারণ ৪০০ বছর ছিল সুলতানি আর মোঘল আমল, ২০০ বছর ইংরেজি আমল—এই ৬০০ বছর আমরা বিদেশি ভাষা দ্বারা শাসিত হয়েছি। শুধু তাই নয়, সামাজিক অনুষ্ঠানগুলোতেও আমরা প্রমিত বাংলা, ইংরেজি ও আঞ্চলিক বাংলার মিশেল দেখতে পাচ্ছি।

তিনি বলেন, ‘২১ ফেব্রুয়ারি না হলে বাংলাদেশ হতো না, বাংলাদেশ না হলে বাংলা রাষ্ট্রভাষা হতো না। ৪৮ সাল থেকে আজ ৬৮ বছর হয়ে গেছে। এতো বছরে প্রশাসনিক ভাষা বাংলা হলেও কিন্তু আদালতের রায়ে এর প্রতিফলন নেই। সম্প্রতি নিম্ন আদালতের রায় বাংলাতে লেখা হলেও উচ্চ আদালতের রায় এখনও ইংরেজিতে লেখা হচ্ছে। এর কারণ হিসেবে বলা হয়, আইনগুলো সব ইংরেজিতে। এখানে আমাদের কথা হচ্ছে আইনগুলো বাংলা কে করবে, এটাতো উচ্চ আদালতের দায়িত্ব।’

ভাষা নিয়ে হীনম্মন্যতা বোধ করায় সমাজের একটি বড় অংশ ইংরেজি মাধ্যমের স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষাগ্রহণ করছে বলেও মন্তব্য দুই ভাষাসৈনিক ফুলে হোসেন ও আহমদ রফিকের। তাদের দৃষ্টিতে বাংলা, ইংরেজি এবং আরবি—এই ত্রিমুখী শিক্ষাব্যবস্থায় বাংলা ভাষা সবচেয়ে দুর্দশাগ্রস্ত।

ভাষাসৈনিক আহমদ রফিক

এ প্রসঙ্গে আহমদ রফিক বলেন, ‘আমাদের জাতিগত হীনম্মন্যতাই এজন্য দায়ী। ইংরেজিকে আমরা যত প্রাধান্য দেই, বাংলাকে ততটা দেই না। চীন এবং জাপান যদি তাদের পিকটোরিয়াল বর্ণমালা নিয়ে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে গবেষণা করতে পারে আমরা কেনও সমৃদ্ধ, উন্নত আধুনিক বাংলা ভাষা নিয়ে তা পারবো না? আসলে সমস্যা আমাদের মস্তিষ্কে, আন্তরিকতায়, বিশ্বাসে, শ্রেণি স্বার্থপরতায়। মাতৃভাষা ও রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলার প্রতি আমাদের মমত্ব ও মর্যাদাবোধ এতো কম যে, বাংলা আমাদের অধিকার আন্দোলনের ব্যাপারটা যেন আমরা ছুড়ে ফেলে দিয়েছি!’

একই সুরে ভাষাসৈনিক অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক ফুলে হোসেন বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘বাংলা ভাষা সংবিধানস্বীকৃত। কিন্তু কোথাও বাংলার প্রচলন নেই। দেশের বড়সড় দোকানগুলো নাম দেখা যায় ইংরেজিতে। চিকিৎসকরা ব্যবস্থাপত্র লেখেন ইংরেজিতে। আদালতের রায়ও হয় ইংরেজিতে। বিয়ে, জন্মদিন, বউভাত কিংবা কোনও কিছুর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানগুলোতেও ইংরেজির আধিপত্য। যেন ইংরেজি না বলতে পারলে আমরা শিক্ষিত হই না! আসলে আমাদের শিক্ষার উচ্চতা বোঝানোর জন্য এখন ইংরেজি বলতে হয়। তবে ইংরেজিসহ যে কোনও ভাষায় দখল থাকা ভালো, কিন্তু রাষ্ট্রীয় এবং জাতীয় জীবনে বাংলাকে হটিয়ে ভাষার জন্য জীবন দিয়ে যাওয়া শহীদদেরকে কোথায় নিচ্ছি সেটা ভেবে দেখার সময় এসেছে।’

ভাষাসৈনিক ড. রফিকুল ইসলাম

যারা ভাষার জন্য যুদ্ধ করেছিলেন তাদের উত্তরসূরীরাই বাংলাকে সরিয়ে দিচ্ছেন মন্তব্য করে আহমদ রফিক বলেন, ‘তাহলে কীভাবে বাংলা প্রতিষ্ঠিত হবে?’ রেডিওতে যেসব ভাষা প্রচার করা হয় সেগুলো সরকারের নিয়ন্ত্রণে রাখা উচিত বলে মনে করেন তিনি। তার মতে, ভাষা নিয়ে সংগ্রাম এখনও শেষ হয়নি। নতুন প্রজন্মকে সেটা চালিয়ে যেতে হবে। নয়তো ৫২-র শহীদদের আত্মত্যাগ এবং মহিমা কখনও প্রতিষ্ঠিত হবে না। ভাষা নিয়ে এখন যা হচ্ছে তা ১৯৫২ সালের ভাষার দাবিতে আন্দোলন করা ভাষাসৈনিকদের কাঙ্ক্ষিত ছিল না বলেও মন্তব্য তার। তিনি বলেন, ‘আমরা যারা এখনও বেঁচে আছি, তারা হতাশ নই। তরুণ প্রজন্ম ঠিক একদিন বাংলা নিয়ে কাজ করবে। তারা বাংলায় কথা বলবে, বাংলাকে ধারণ করবে।’

আশা ছাড়েননি অধ্যাপক ফুলে হোসেনও। তিনি বলেছেন, ‘এই ৮৬ বছর বয়সে এসেও আমি আশাবাদী। আমার দৃঢ় বিশ্বাস, তরুণ প্রজন্ম এই অবস্থার পরিবর্তন ঘটাবে, তারাই বাংলাকে সবক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠা করবে।’

/জেএ/জেএইচ/টিএন/

সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
বাংলাদেশের উন্নয়ন দেখলে আমাদের লজ্জা হয়: শাহবাজ
বাংলাদেশের উন্নয়ন দেখলে আমাদের লজ্জা হয়: শাহবাজ
৬ ম্যাচ পর জয় দেখলো বেঙ্গালুরু 
৬ ম্যাচ পর জয় দেখলো বেঙ্গালুরু 
সাদি মহম্মদ স্মরণে ‘রবিরাগ’র বিশেষ আয়োজন
সাদি মহম্মদ স্মরণে ‘রবিরাগ’র বিশেষ আয়োজন
‘নীরব এলাকা’, তবু হর্নের শব্দে টেকা দায়
‘নীরব এলাকা’, তবু হর্নের শব্দে টেকা দায়
সর্বাধিক পঠিত
দুদকের চাকরি ছাড়লেন ১৫ কর্মকর্তা
দুদকের চাকরি ছাড়লেন ১৫ কর্মকর্তা
বাংলাদেশ ব্যাংকের চাকরি ছাড়লেন ৫৭ কর্মকর্তা
বাংলাদেশ ব্যাংকের চাকরি ছাড়লেন ৫৭ কর্মকর্তা
স্কুল-কলেজে ছুটি ‘বাড়ছে না’, ক্লাস শুরুর প্রস্তুতি
স্কুল-কলেজে ছুটি ‘বাড়ছে না’, ক্লাস শুরুর প্রস্তুতি
কেন গলে যাচ্ছে রাস্তার বিটুমিন?
কেন গলে যাচ্ছে রাস্তার বিটুমিন?
ধানের উৎপাদন বাড়াতে ‘কৃত্রিম বৃষ্টির’ পরিকল্পনা
ধানের উৎপাদন বাড়াতে ‘কৃত্রিম বৃষ্টির’ পরিকল্পনা