X
বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪
১১ বৈশাখ ১৪৩১

সাধু-চলিত ভাষায় এখনও লেখা হয় সরকারি আদেশ, প্রজ্ঞাপন ও নোটিশ

শফিকুল ইসলাম
২২ ফেব্রুয়ারি ২০১৭, ১২:১১আপডেট : ২২ ফেব্রুয়ারি ২০১৭, ১২:১৪

সাধু-চলিত ভাষায় এখনও লেখা হয় সরকারি আদেশ, প্রজ্ঞাপন ও নোটিশ

সরকারি বিভিন্ন কার্যালয় থেকে জারি করা আদেশ, প্রজ্ঞাপন ও নোটিশে বাংলা ভাষার ব্যবহার বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। বাংলা ভাষার ব্যবহার চালুও হয়েছে। কিন্তু সরকারি নোটিশ, প্রজ্ঞাপন বা আদেশে যে বাংলা ভাষার ব্যাবহার করা হচ্ছে তা জনসাধারণের কাছে ঠিক বোধগম্য নয়। কারণ সাধু ও চলিত ভাষার মিশ্রণ করে এসব লেখায় অধিকাংশই বেশ জটিল দুর্বোধ্য। ফলে কেউ কেউ এসব নোটিশ, আদেশ ও প্রজ্ঞাপনে ব্যবহৃত ভাষার ভুলও বোঝেন। অনেক দিন থেকেই সরকারি আদেশ, নোটিশ ও প্রজ্ঞাপনের ভাষা সহজ করার দাবি রয়েছে। কিন্তু সে দাবি মানা হচ্ছে না।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দেশে এখনও ভাষা জরিপ হয়নি। নেই কোনো জাতীয় ভাষানীতি। সর্বস্তরে বাংলা ভাষার ব্যবহার নিশ্চিত করাসহ প্রশাসন, রাষ্ট্র পরিচালনা, শিক্ষা-প্রযুক্তির প্রসার, ভাষার উন্নয়ন আর পাহাড়িদের ভাষার অধিকার ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠা করতে এ জন্য জোরালো কোনও উদ্যোগও নেয়নি কোনও সরকার। তাই মানা হচ্ছে না বাংলা ভাষা প্রচলন আইন। সরকারি অফিসগুলোয় সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের ‘বাংলা ভাষা বাস্তবায়ন কোষ’ এবং বাংলা একাডেমি ‘প্রমিত বানানরীতি’ ও মানা হচ্ছে না। ফলে ব্যবহৃত জটিল ভাষার এখনও ব্যবহৃত হচ্ছে।

এ প্রসঙ্গে সরকারের সাবেক সচিব ও তত্ত্ববধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ড. এম শওকত আলী ১৯৭৪-৭৫ সালের একটি ঘটনার কথা বলেছেন। ওই সময় বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডের এক জেষ্ঠ সহকর্মী, পরবর্তী সময়ে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের সচিব হয়েছিলেন। টিসিবির পরিচালক (অর্থ) টেলিফোনে পানি উন্নয়ন বোর্ডের সরকারি কর্মকর্তাকে তাৎক্ষণিকভাবে টিসিবির অফিসে আসতে অনুরোধ করেন। পরিচালক (অর্থ)-এর কক্ষে প্রবেশ করে পানি উন্নয়ন বোর্ডের সদস্য (প্রশাসন) দেখতে পান পরিচালক (অর্থ) প্রশাসনিক পরিভাষা হাতে নিয়ে হাসাহাসি করছেন। তিনি এক সদস্য (প্রশাসন)-কে পরিভাষার একটি প্রতিশব্দ দেখিয়ে বলেন, ‘দেখো দেখো কী লেখা আছে।’ সিভিল সার্ভেন্টের প্রতিশব্দ ‘জনপালনকৃত্যক’। সিভিল লিস্ট নামে এক সরকারি প্রকাশনা ছিল। এর বাংলা প্রতিশব্দ ছিল ‘রাজপুরুষ সূচি’। ১৯৭১ সালের পর এ প্রকাশনা আর নিয়মিত প্রকাশ করা হয়নি।

সাধু-চলিত ভাষায় এখনও লেখা হয় সরকারি আদেশ, প্রজ্ঞাপন ও নোটিশ

এম. শওকত আলী বলেছেন, সংবিধানে রাষ্ট্রের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী বলা আছে। প্রশাসনিক কাজে এ শব্দটি খুব একটা ব্যবহার হয় না। কারণ, প্রশাসনিক কাজ করতে নির্বাহী বিভাগে কর্মরত ব্যক্তিদের সরকারি কর্মচারী হিসেবে গণ্য করা হয়। এদের আচরণ সম্পর্কিত বিধির শিরোনাম হলো, সরকারি চাকুরেদের আচরণবিধি। দ্বিতীয়ত, সরকারি কর্মচারীসহ আধা-সরকারি সংস্থার কর্মচারীদের চাকরির বয়স সীমা বিষয়ক আইনের শিরোনাম হলো গণকর্মচারী (অবসর) আইন। ইংরেজিতে বলা হয়, পাবলিক সার্ভেন্ট (রিটায়ের্ডমেন্ট) অ্যাক্ট। মূলত ক্ষেত্রভেদে একই ইংরেজি শব্দের ভিন্নতর শব্দ ব্যবহার করা হয়। প্রশাসনিক পরিভাষা প্রণয়নের সময় এসব বিষয় গভীরভাবে চিন্তা করা হয়নি। প্রশাসনিক ইংরেজি শব্দের বাংলা অনুবাদে এ কারণে কিছু কঠিন বাংলা শব্দ ব্যবহারের প্রবণতা দেখা যায়। এসব শব্দ সাধারণ মানুষের সহজে বোঝা কষ্টকর। সাধারণ মানুষের দৈনন্দিন কথাবার্তায় কিছু ইংরেজি শব্দের ব্যবহারও হয়। যেমন- বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবর্তে ইউনিভার্সিটি শব্দটি মানুষ সহজে বোঝে। কলেজ এবং টেবিল শব্দটির সম্পর্কে একই কথা প্রযোজ্য বলে জানান এম. শওকত আলী।

তিনি আরও বলেছেন, ১৯৭২-এর সংবিধানে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষার স্বীকৃতি দেওয়ার পর অল্প সময়ের মধ্যে সরকারি কার্য সম্পাদনে বাংলা ভাষা চালু করা সম্ভব হয়নি। এ ধারা পরিবর্তনের জন্য তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান একটি আদেশ জারি করেন ১৯৭৩ সালের ১ ফেব্রুয়ারি। ওই আদেশ অনুযায়ী প্রধানমন্ত্রীর কাছে পেশকৃত সব নথি বাংলায় লিখতে হবে। সিদ্ধান্তটি প্রধানমন্ত্রীর সচিবালয় সব মন্ত্রণালয়ের সচিবের কাছে প্রেরণ করে। এ সিদ্ধান্তে অন্য একটি বিষয়ও ছিল। রাষ্ট্রীয় কার্য সম্পাদনে সব ধরনের ফরম ও অন্যান্য দলিল বাংলায় ছাপাতে হবে। এ সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে কিছু বাধা-বিপত্তিও ছিল। প্রধান বাধা ছিল বাংলা টাইপ রাইটারের স্বল্পতা। ব্যবহৃত ইংরেজি শব্দের বিপরীতে সঠিক বাংলা শব্দ ব্যবহারের বিষয়টিও ছিল অন্য একটি বাধা। আর ছিল ভাষাগত বিভ্রান্তি। দাফতরিক বিষয়ে সাধু ভাষা না চলতি ভাষা ব্যবহার করা হবে, এ নিয়ে কিছু অস্পষ্টতা ছিল। প্রাথমিকভাবে দুই ধরনের বাংলা ভাষাই ব্যবহার করা হয়। তবে বাংলা প্রতিশব্দ নির্ণয় করা কর্মরত ব্যক্তিদের জন্য কিছুটা মুশকিল ছিল। এ বাধা উত্তরণের জন্য সরকার বাংলা একাডেমিকে প্রশাসনিক পরিভাষা প্রকাশের দায়িত্ব প্রদান করে।  ১৯৭৫ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি প্রশাসনিক পরিভাষা প্রকাশ করা হয়। তবে এর পরও প্রশাসনিক পরিভাষায় কিছু শব্দ পাওয়া যায়, যা সহজে বোঝা কঠিন ছিল। যা আজও রয়ে গেছে।

সাংবিধানিক বিধান অনুযায়ী, দেশের অফিস-আদালতে বাংলা ভাষার প্রচলন নিশ্চিত করার লক্ষ্যে ১৯৮৭ সালের ৮ মার্চ ‘বাংলা ভাষা প্রচলন আইন’ প্রণয়ন করা হয়। এ আইনের ৪ ধারায় আইনটি কার্যকর করতে সরকারের ক্ষমতা সম্পর্কে বলা আছে। কিন্তু সরকার এখন পর্যন্ত এ বিষয়ে কোনও বিধি প্রণয়ন না করায় আইনটি মানতে বাধ্য করা যাচ্ছে না। অথচ আইনের ১৯৮৭ সালের আইনটির ২ ও ৩ (১) ধারায় বলা আছে, কোনও কর্মস্থলে যদি কোনও ব্যক্তি বাংলা ভাষা ছাড়া অন্য কোনও ভাষায় আবেদন বা আপিল করেন, তাহলে তা বে আইনি ও অকার্যকর বলে গণ্য হবে। ৩ ধারায় বলা আছে, কোনও কর্মকর্তা বা কর্মচারী এ আইন অমান্য করলে তা সরকারি কর্মচারী শৃঙ্খলা ও আপিল বিধির অধীনে অসদাচরণ বলে গণ্য হবে এবং তার বিরুদ্ধে বিধি অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে। অসদাচরণের সর্বোচ্চ শাস্তি চাকরিচ্যুতি।

এ প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘ভাষার শৃঙ্খলা ও নিজের ভাষা রক্ষা করতে বিভিন্ন রাষ্ট্রের ভাষানীতি থাকলেও আমাদের নেই। নিঃসন্দেহে এটা আমাদের ব্যর্থতা। সর্বস্তরে বাংলা প্রচলনের জন্য ভাষানীতির দরকার। আর সরকারি অফিসে মাতৃভাষার ব্যবহার সহজ করতে প্রয়োজনে প্রশিক্ষণ প্রয়োজন। সবাই বোঝেন এমন সহজবোধ্য ভাষাই ব্যবহার করা উচিত।’

এ প্রসঙ্গে ভাষাসৈনিক আহমদ রফিক বলেন, ‘সংবিধানে প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রভাষা বাংলা। তার মানে জাতীয় জীবনে সর্বস্তরে বাংলা ভাষা ব্যবহার বাধ্যতামূলক। শুধু বাধ্যতামলকই নয়, বাংলা ভাষাকে টিকিয়ে রাখতে হলে এ ভাষার ব্যবহার সহজ করার কোনও বিকল্প নেই। সরকারি আদেশ নোটিশ ও প্রজ্ঞাপনে এমন সব শব্দ ব্যবহার করা হয়, যার অর্থ বুঝতে ডিকশনারি খুঁজতে হয়।’

এ প্রসঙ্গে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের সচিব মোহম্মদ শফিউল আলম বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘সরকারি অফিসে বাংলা ভাষার ব্যবহার বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। প্রচলিত ভাষায়ই চিঠিপত্র লেখা হয়। সরকারি অফিস থেকে লেখা চিঠিপত্রে ব্যবহৃত ভাষা একেবারেই কঠিন বা বুঝতে সমস্যা হয়- এমন অভিযোগ বোধ হয় ঠিক না। তবে ভাষা সহজ করার চেষ্টা থাকবে।’

 /এসটি/

আরও পড়ুন:

পাড়ায় পাড়ায় শিশুদের শহীদ মিনার

ব্যাংক খাতে উপেক্ষিত বাংলা ভাষা

ফেসবুকজুড়ে একুশের গান, একুশই প্রাণ

ভাষা আন্দোলনের সাক্ষী সেই আম গাছটির শেষ রক্ষা হয়নি

একুশে ফেব্রুয়ারি ভুলে গেছে পুলিশ!

বিজ্ঞাপনে বদলে গেছে একুশ!

ব্রিটেনে যতো শহীদ মিনার

 

সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
ছাত্রলীগের ‘অনুরোধে’ গ্রীষ্মকালীন ছুটি পেছালো রাবি প্রশাসন
ছাত্রলীগের ‘অনুরোধে’ গ্রীষ্মকালীন ছুটি পেছালো রাবি প্রশাসন
সাজেকে ট্রাক খাদে পড়ে নিহত বেড়ে ৯
সাজেকে ট্রাক খাদে পড়ে নিহত বেড়ে ৯
বার্সেলোনার সঙ্গে থাকছেন জাভি!
বার্সেলোনার সঙ্গে থাকছেন জাভি!
চার বছরেও পাল্টায়নি ম্যালেরিয়া পরিস্থিতি, প্রশ্ন নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি নিয়ে
চার বছরেও পাল্টায়নি ম্যালেরিয়া পরিস্থিতি, প্রশ্ন নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি নিয়ে
সর্বাধিক পঠিত
সিয়াম-মেহজাবীনের পাল্টাপাল্টি পোস্টের নেপথ্যে…
সিয়াম-মেহজাবীনের পাল্টাপাল্টি পোস্টের নেপথ্যে…
‘মারামারি’র ঘটনায় মিশা-ডিপজলের দুঃখপ্রকাশ
‘মারামারি’র ঘটনায় মিশা-ডিপজলের দুঃখপ্রকাশ
মিয়াবতী থেকে পিছু হটলো মিয়ানমারের বিদ্রোহীরা?
মিয়াবতী থেকে পিছু হটলো মিয়ানমারের বিদ্রোহীরা?
আজকের আবহাওয়া: কোথায় কেমন গরম পড়বে
আজকের আবহাওয়া: কোথায় কেমন গরম পড়বে
ছয় দিনের সফরে ব্যাংকক গেলেন প্রধানমন্ত্রী
ছয় দিনের সফরে ব্যাংকক গেলেন প্রধানমন্ত্রী