X
শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪
১২ বৈশাখ ১৪৩১

চুক্তি নয়, তিস্তা নিয়ে ‘টেকনিক্যাল বোঝাপড়া’ হতে পারে

রঞ্জন বসু, দিল্লি
২৩ মার্চ ২০১৭, ০৪:৩৪আপডেট : ২৩ মার্চ ২০১৭, ০৪:৪২


চুক্তি নয়, তিস্তা নিয়ে ‘টেকনিক্যাল বোঝাপড়া’ হতে পারে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আসন্ন ভারত সফরে তিস্তা নদীর পানি ভাগাভাগি নিয়ে বহুল প্রতীক্ষিত চুক্তি স্বাক্ষরিত হওয়ার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। কিন্তু নিদেনপক্ষে দুই পক্ষই যেন তিস্তা নিয়ে একটি ‘টেকনিক্যাল পড়ায় পৌঁছাতে পারে,তার জন্য এখন জোরালো চেষ্টা চলছে। আশা করা হচ্ছে, আগামীতে এই বোঝাপড়াই গড়ে দেবে পূর্ণাঙ্গ চুক্তির (‘ট্রিটি’) ভিত।






গত দশ-বারোদিনে ভারতের কোনও কোনও গণমাধ্যমে লেখা হয়েছে, শেখ হাসিনার সফরে তিস্তা চুক্তি সই হলেও হতে পারে। কারণ এই চুক্তির পথে প্রধান বাধা যিনি,পশ্চিমবঙ্গের সেই মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এই মুহূর্তে প্রবল রাজনৈতিক চাপে আছেন। প্রথমত উত্তরপ্রদেশের মতো রাজ্যে বিজেপির বিপুল বিজয়, দ্বিতীয় নারদ স্টিং অপারেশনের ঘটনায় সিবিআই-এরতদন্তের জন্য হাইকোর্টের নির্দেশ। এই জোড়া ধাক্কায় তিনি অনেকটাই কুপোকাত। এছাড়া কেন্দ্রীয় সরকারের সঙ্গে তার দর কষাকষির ক্ষমতাও অনেকটা কমে গেছে। ফলে তিস্তা চুক্তিতে তিনি সম্মতি দিয়েও দিতে পারেন এমনটাই অনেকে মনে করছেন।

কিন্তু বাংলা ট্রিবিউন গত কয়েকদিনে কেন্দ্রীয় সরকারের একাধিক শীর্ষস্থানীয় কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে আঁচ করতে পেরেছে, শেষ মুহূর্তে মমতা বন্দ্যোপাধ্যয়ের সম্মতি যদিও বা মেলে, এখন আর পূর্ণাঙ্গ চুক্তি করার মতো যথেষ্ট সময় হাতে নেই। কিন্তু তিস্তা নিয়ে যেন বাংলাদেশকে একেবারে খালি হাতে ফিরতে না হয়, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি তথা ভারত সরকার সেটা নিশ্চিত করতেও বদ্ধপরিকর। তাই দিল্লি সফরকে সফল করে তুলতে মাঝামাঝি একটি রাস্তা খোঁজার চেষ্টা চলছে প্রাণপণে।

কিন্তু ঠিক কী আছে সেই তিস্তা পরিকল্পনায়, যা চুক্তির রাস্তায় দুই দেশকে এগিয়ে নিতে পারে ?

(১) প্রথম কথা হলো, ২০১১ সালে যে খসড়া চুক্তি নিয়ে দুই পক্ষ সই করার পথে অনেকটা এগিয়ে গিয়েছিল এবং মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বাধার কারণে যা শেষ মুহূর্তে ভেস্তে যায়, সেই চুক্তির খসড়া পুরোপুরি বাতিল করে দেওয়া হয়েছে। তার বদলে তৈরি করা হচ্ছে নতুন খসড়া চুক্তির প্রস্তাব, যার ভিত হবে ২০১৬ সাল অবধি পাওয়া সর্বশেষ টেকনিক্যাল ডাটা এবং তিস্তার বিভিন্ন পয়েন্টে বছরের বিভিন্ন সময়ে জলের গড় পরিমাণ। সেই অনুযায়ী দুই দেশই তাদের মতো করে চুক্তির খসড়া প্রস্তাব তৈরি করছে। শেখ হাসিনার সফরে সেই খসড়া নিয়ে দুই দেশ নিজেদের মধ্যে বিনিময় করতে পারে।

(২) তিস্তাকে শুধু একক নদী হিসেবে না দেখে সার্বিক গঙ্গা-মেঘনা-ব্রহ্মপুত্র অববাহিকার অংশ হিসেবে দেখারও একটি প্রস্তাব দেবে ভারত। এর উদ্দেশ্য হলো, কোনও শুকনো মৌসুমে তিস্তায় পানির প্রবাহ যদি কমও হয়, তাহলে সেই বেসিনের ‘ওয়াটার সারপ্লাস’ (যেখানে জল উদ্বৃত্ত) নদীগুলো থেকে (যেমন ব্রহ্মপুত্র) সেখানে খাল দিয়ে বাড়তি জল টেনে আনার ব্যবস্থা করা। এই চেষ্টা যদিও ব্যয়বহুল, তারপরেও তিস্তায় জলের ঘাটতি মেটানোর জন্য তা সাহায্য করতে পারে।

প্রসঙ্গত, মমতা ব্যানার্জিও বছরদুয়েক আগে বলেছিলেন, ব্রহ্মপুত্র বেসিনের মানস-সঙ্কোশের মতো নদীগুলো থেকে বাড়তি জল টেনে এনে তিস্তার প্রবাহ বাড়ানো যায়, তাহলে তিস্তার জল ভাগাভাগি করতে তার কোনও আপত্তি থাকবে না!

(৩)বাংলাদেশ-ভারতের মধ্যে যে যৌথ নদী কমিশন (জেআরসি) ১৯৭২ সালে তৈরি করা হয়েছিল, সম্প্রতি তাদের কাজকর্ম বেশ ঢিলে হয়ে পড়েছে। জেআরসির পরবর্তী বৈঠক ঢাকায় হওয়ার কথা, কিন্তু বছরের পর বছর ধরে তা থমকে আছে। ভারতের জলসম্পদমন্ত্রী উমা ভারতী বছর তিনেক হলো দায়িত্ব নিয়েছেন। কিন্তু সেই বৈঠকের দিনক্ষণ স্থির করে, তার এখনও ঢাকা আসাই হয়ে ওঠেনি। শেখ হাসিনার সফরে চেষ্টা হবে, জেআরসিকে পুনরুজ্জীবিত করে যত দ্রুত সম্ভব তাদের বৈঠক ডাকা। সেখানেও যথারীতি তিস্তা নিয়ে কথা হবে।

(৪) তিস্তার পাশাপাশি বাংলাদেশ যে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্প নিয়ে এগোতে চাইছে, সেই ‘গঙ্গা ব্যারাজ’ প্রসঙ্গেও ইতিবাচক মনোভাব দেখানোর প্রস্তুতি নিয়েছে ভারত। রাজবাড়ি থেকে চাঁপাইনবাবগঞ্জ পর্যন্ত গঙ্গা-পদ্মার সমান্তরালে প্রস্তাবিত এই সুদীর্ঘ ব্যারাজ প্রকল্পে বর্ষা মৌসুমের অতিরিক্ত জল ধরে রেখে, শুষ্ক সময়ে তা কাজে লাগাতে চায় বাংলাদেশ।  ভারত তাতে নীতিগতভাবে অসুবিধার কোনও কারণ দেখছে না। যদিও মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এই গঙ্গা ব্যারাজ নিয়েও বেশ সন্দিহান। কিন্তু এ ক্ষেত্রে তার অভিমতকে দিল্লি বিশেষ আমল দিচ্ছে না। আর সে কথা প্রধানমন্ত্রী হাসিনাকে জানিয়েও দেওয়া হবে।

(৫) শেখ হাসিনার দিল্লি সফরের সময় ভারত সরকার রাজধানীতে যাওয়ার জন্য আমন্ত্রণ জানাবে আসাম, পশ্চিমবঙ্গ, মেঘালয় বা ত্রিপুরার মতো রাজ্যগুলোর মুখ্যমন্ত্রীদের, যে সব রাজ্য বাংলাদেশের সঙ্গে আন্তর্জাতিক সীমান্তের লাগোয়া। আসামের সর্বানন্দ সোনোয়াল বা ত্রিপুরার মানিক সরকার সেই আমন্ত্রণ গ্রহণ করলেও পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তাতে সাড়া দেবেন কিনা, তা এখনও নিশ্চিত নয়। কিন্তু দিল্লি আশা করছে, সৌজন্য দেখিয়ে তিনি শেষ পর্যন্ত যাবেন এবং সফররত শেখ হাসিনার সঙ্গে একান্তে বৈঠকও করবেন। দুই নেত্রীর নিজেদের মধ্যে খোলামেলা আলাপচারিতা হলে অনেক ভুল বোঝাবুঝি সহজেই মিটতে পারে, এমনটাই ধারণা করছে দিল্লির সাউথ ব্লক ও প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়।

(৬) তবে এই সব পারিপার্শ্বিক উদ্যোগের চূড়ান্ত লক্ষ্য হবে একটাই, তা হলো তিস্তার পানিবণ্টন চুক্তি স্বাক্ষর করা, আর তা একটা নির্দিষ্ট সময়সীমার ভেতর। আরও পরিষ্কার করে বললে, দিল্লি শেখ হাসিনাকে এক রকম কথাই দিয়ে রেখেছে, ২০১৯ সালের গোড়ায় বাংলাদেশে পরবর্তী সাধারণ নির্বাচনের আগেই যে কোনোভাবে হোক তিস্তা চুক্তি স্বাক্ষরিত হবে। ফলে চুক্তির খসড়া বিনিময় বা তার স্টাডি, কিংবা জেআরসি-র বৈঠকে টেকনিক্যাল আলোচনা, অথবা হাসিনা-মমতার কূটনৈতিক আলোচনা, সবই এগোবে সেই চূড়ান্ত লক্ষ্য আর সময়সীমা মাথায় রেখে।

দিল্লিতে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে বিষয়টি নিয়ে নিয়মিত আলোচনা চালাচ্ছেন, সাউথ ব্লকের এমন এক কর্মকর্তা এই প্রতিবেদককে বলেছেন, ‘তিস্তা চুক্তি সই করা যদি সম্ভব নাও হয়, আমরা কিছুতেই চাইব না তিস্তা নিয়ে বাংলাদেশ পুরোপুরি হতাশ হোক। সে জন্যই এ রকম একটা ব্রড-বেসড টেকনিক্যাল বোঝাপড়ার লক্ষ্য নিয়ে আমরা এগোচ্ছি, যেন এখনই না হলেও বড়জোর বছর দেড়েকের মধ্যেই চুক্তিটা সেরে ফেলা যায়।’

/এপিএইচ/এমএনএইচ/

 

সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
ট্রাকের চাপায় অটোরিকশার ২ যাত্রী নিহত
ট্রাকের চাপায় অটোরিকশার ২ যাত্রী নিহত
বাংলাদেশের উন্নয়ন দেখলে আমাদের লজ্জা হয়: শাহবাজ
বাংলাদেশের উন্নয়ন দেখলে আমাদের লজ্জা হয়: শাহবাজ
৬ ম্যাচ পর জয় দেখলো বেঙ্গালুরু 
৬ ম্যাচ পর জয় দেখলো বেঙ্গালুরু 
সাদি মহম্মদ স্মরণে ‘রবিরাগ’র বিশেষ আয়োজন
সাদি মহম্মদ স্মরণে ‘রবিরাগ’র বিশেষ আয়োজন
সর্বাধিক পঠিত
দুদকের চাকরি ছাড়লেন ১৫ কর্মকর্তা
দুদকের চাকরি ছাড়লেন ১৫ কর্মকর্তা
বাংলাদেশ ব্যাংকের চাকরি ছাড়লেন ৫৭ কর্মকর্তা
বাংলাদেশ ব্যাংকের চাকরি ছাড়লেন ৫৭ কর্মকর্তা
স্কুল-কলেজে ছুটি ‘বাড়ছে না’, ক্লাস শুরুর প্রস্তুতি
স্কুল-কলেজে ছুটি ‘বাড়ছে না’, ক্লাস শুরুর প্রস্তুতি
কেন গলে যাচ্ছে রাস্তার বিটুমিন?
কেন গলে যাচ্ছে রাস্তার বিটুমিন?
ধানের উৎপাদন বাড়াতে ‘কৃত্রিম বৃষ্টির’ পরিকল্পনা
ধানের উৎপাদন বাড়াতে ‘কৃত্রিম বৃষ্টির’ পরিকল্পনা