X
শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪
৬ বৈশাখ ১৪৩১

স্মৃতিতে জগন্নাথ হলের ভয়াল রাত

রাফসান জানি
২৫ মার্চ ২০১৭, ২৩:৩৫আপডেট : ২৫ মার্চ ২০১৭, ২৩:৩৫

 

জগন্নাথ হল মাঠে গণসমাধি একাত্তরের ২৫ মার্চ মুক্তিকামী নিরস্ত্র বাঙালির ওপর নির্মম হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছিল পাকিস্তান সেনাবাহিনী। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হলেও চলেছিল ভয়াবহ তাণ্ডব। সেই কালরাতের বিভীষিকা বুকে ধারণ করে চলেছেন কয়েকজন প্রত্যক্ষদর্শী। তাদের অন্যতম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিখ্যাত মধুর ক্যান্টিনের মালিক শহীদ মধুসূদন দে’র ছেলে অরুণ কুমার দে।

২৫ মার্চ রাতে বাবা-মা, বড় ভাই-বৌদি (ভাবি) হারানো অরুণ দে সেই ভয়াবহ ঘটনার বর্ণনা দিতে গিয়ে শিউরে ওঠেন আজও। মধুর ক্যান্টিনের বর্তমান পরিচালক বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘তখন ছোট ছিলাম। সেই রাতে ঘুটঘুটে অন্ধকারে নিস্তব্ধ ছিল পুরো বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা। স্তব্ধতা ভেঙে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে মৃত্যুপুরীতে পরিণত করেছিল পাকিস্তানি সেনারা। তারা যাকে যেখানে পেয়েছে, সেখানেই হত্যা করেছে। চারদিকে গুলির শব্দ, আর্তনাদ শোনা যাচ্ছিল।’

তিনি বলেন, ‘জগন্নাথ হলের পাশেই ছিল আমাদের বাসা। বারান্দার দাঁড়িয়ে দেখেছি, জগন্নাথে ঢুকার পর চোখের সামনে যাকেই পেয়েছে তাকেই গুলি করে মেরেছে। কর্মচারীদের ঘরগুলো পুড়িয়ে দিয়েছিল।’

বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় রাতভর তাণ্ডব চললেও সবার প্রিয় মধুদা’র বাসায় আক্রমণ চালানো হয় ভোরে। অরুণ দে বলেন, ‘বাসায় ঢুকেই বাবা কোথায় আছে জানতে চায় পাক হানাদাররা। বাবা থাকতেন চারতলায়। সেখানে দরজায় নক করলে বাবা দরজা খুলে দেন। ১৪-১৫ জনের একটি দল বাবাকে ধরে পাশের ফ্ল্যাটে নিয়ে যায়। প্রথমে বড় ভাইকে ও বৌদিকে গুলি করে হত্যা করে। একটা গুলি আমার ছোট দিদির গায়ে লাগে। বাবাকে মারতে গেলে মা বাবাকে জড়িয়ে ধরে রাখেন। বলেন, আমার স্বামীকে মেরো না। তাকে ছেড়ে দাও। এসময় মাকে গুলি করা হয়। তখন বাবার ডান হাতে গুলি লাগে। তিনি বসে নীরবে কাঁদছিলেন। এরপর পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সদস্যরা চলে যায়।’

তিনি বলেন, ‘পাক বাহিনী চলে যাওয়ার কয়েক ঘণ্টা পর বাবা এবং আরও দুজনকে  বাইরে নিয়ে যাওয়া হয়। জগন্নাথ হলের মাঠে বাবা সহ আরও অনেককে একসঙ্গে ব্রাশফায়ার করে মারা হয়। এরপর বড় গর্ত করে মৃত-অর্ধমৃত সবাইকে পুঁতে ফেলা হয়।’

অরুণ দে বলেন, ‘আমরা মা, বড় ভাই, বৌদির লাশ নিয়ে তিন দিন কাটাই। ২৭ মার্চ কারফিউ উঠলে ভাই-বোনদের নিয়ে প্রথমে বিক্রমপুর যাই। এরপর চার দিন চার রাত হেঁটে সীমান্ত পার হয়ে ত্রিপুরায় যাই। সেখানেই থাকি নয় মাস। স্বাধীনতার পর দেশে ফিরে আসি।’

শহীদদের নামফলক জগন্নাথ হলের দুঃসহ ঘটনার আরেক প্রত্যক্ষদর্শী রবীন্দ্রমোহন দাস। একাত্তরে অষ্টম শ্রেণির ছাত্র রবীন্দ্রমোহন বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘২৬ মার্চ হরতাল হওয়ার কথা ছিল। ২৫ মার্চ সন্ধ্যা থেকেই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা প্রস্তুতি নিচ্ছিল। রাত পৌনে ১২টার দিকে গোলাগুলির শব্দ শোনা যায় রাজারবাগের দিকে। আমরা ভেবেছিলাম ওদের কোনও ঝামেলা। কিছুক্ষণ পর পিলখানার দিকে গুলির শব্দ শুনি। তখন আমরা বুঝতে পারি ঝামেলা সারা শহরে শুরু হয়েছে।’

তিনি বলেন, ‘আমাদের বাসা ছিল পূর্ব পাশের দেয়াল ঘেঁষে। রাস্তায় গুলির শব্দ শোনা যাচ্ছিল। আমি সাহস করে বাসার বাইরে এসে মাথা উঁচু করে দেখি, রাস্তা জুড়ে সেনারা মার্চ করছে। মার্চ করতে করতে তারা সামনে এসে পুরো জগন্নাথ হল ঘেরাও করে রাখে। কিছুক্ষণ পর ব্ল্যাক আউট হয়, অন্ধকারে ছেয়ে যায় গোটা ক্যাম্পাস। সেনারা সার্চ লাইট জ্বালিয়ে হলের ৭ নং বাংলোর পাশের ভাঙা দেয়াল দিয়ে প্রবেশ করে। সেখান দিয়ে প্রবেশ করানো হয় ট্যাংক। এরপর শুরু হয় তাণ্ডব। চলে মুহুর্মুহু গুলি, চিৎকারে ভেসে যায় পুরো এলাকা।’

রবীন্দ্রমোহন বলেন, ‘সেনারা বড় ভাইকে মেরে আহত করে বাইরে নিয়ে যায়। কিন্তু বড় ভাই উর্দু ভাষায় কথা বলায় ধরে নিয়ে যাওয়ার কিছুক্ষণ পর তাকে ছেড়ে দেয়। ঘরের দরজার ভেঙে পাক সেনারা ঢুকে। এরপর আমরা খাটের নিচ থেকে বেরিয়ে আসি। আমাদের ঘরে আগুন দেওয়া হয়। পুড়িয়ে দেওয়া হয় সবকিছু।’

তিনি জানান, মাঠের পাশে একটি গোয়ালঘরে তাকে সহ ৩১ জন পুরুষকে আটকে রাখে পাকিস্তানিরা। ফজরের আজানের পর শক্তসমর্থ ১৫ জনকে নিয়ে গিয়ে বিভিন্ন স্থানে পড়ে থাকা লাশ টেনে এনে মাঠে স্তুপ করে রাখা হয়। এরপর স্তুপের ওপরেই ওই ১৫ জনকে ব্রাশফায়ার করে মেরে ফেলা হয়। গোয়ালঘর থেকে বাকিদের নিয়ে এসে স্তুপের পাশে লাইন ধরে দাঁড় করানো হয়। বয়স কম ও কয়েক দফা মারধরে জ্ঞান হারানোর কারণে বেঁচে যান রবীন্দ্রমোহন।

কম্পিত কণ্ঠে তিনি বলেন, ‘কপালের জোরে বেঁচে ফিরেছিলাম। আমার সঙ্গে থাকা সবাইকে মেরে ফেলেছিল হানাদার বাহিনী। জ্ঞান ফেরার পর দেখলাম সেনাবাহিনী চলে গেছে। লাশের স্তুপ থেকে হাতের ইশারায় একজন ডাকছিল। তার কাছে গিয়ে দেখলাম বেঁচে আছে। সে পানি খেতে চাচ্ছিল। আমি হাতে করে পুকুর থেকে দুইবার পানি আনার চেষ্টা করলেও পানি রাখতে পারছিলাম না। পরে একটা টিনের কৌটা জোগাড় করে একটু পানি মুখে দিতেই লোকটি মারা যায়। তার পরিচয় জানতে পারিনি।’

রবীন্দ্রমোহন জানান, বড় ভাই-ভাবী ও বাবাকে নিয়ে বকশিবাজার, জিঞ্জিরা হয়ে একটি গ্রামে আত্মীয়ের বাড়িতে আশ্রয় নেন তারা। ২৮ মার্চ ফিরে আসেন ঢাকায়। তিনি বলেন, ‘জগন্নাথ হলে এসেছিলাম। সেখানে ঢোকা যাচ্ছিল না লাশ পচা গন্ধে। আকাশে কাক-শকুন উড়ছিল। এরপর আবার গ্রামে ফিরে যাই। পরিবেশ কিছুটা শান্ত হলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিরে আসি। কিন্তু সেসব দৃশ্য মনে পড়লে এখনও গা শিউরে ওঠে।’

জগন্নাথ হলের শহীদ মিনার ওই রাতে হত্যা করা হয়েছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের অধ্যাপক জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতাকে। তার মেয়ে মেঘনা গুহঠাকুরতা বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘২৫ তারিখ গুলিবিদ্ধ হয়েও ২৭ মার্চ পর্যন্ত বেঁচে ছিলেন বাবা। কারফিউ থাকার কারণে আমরা বের হতে পারিনি। ২৭ তারিখ সকালে কারফিউ ভাঙার পর আমরা বাড়ির উল্টো দিকে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে বাবাকে নিয়ে যাই। তিনি তখনও জীবিত৷’

একাত্তরে দশম শ্রেণির ছাত্রী মেঘনা গুহঠাকুরতা স্মৃতি হাতড়ে বলেন, ‘বাবা খাতা দেখছিলেন সেই রাতে৷ আমি ঘুমিয়ে ছিলাম। আর মা বাড়িতেই অন্য একটা ঘরে ছিলেন৷ হঠাৎ প্রচণ্ড গোলাগুলির শব্দে ঘুম ভেঙে যায়। এরপরই পাকিস্তানি সেনারা এসে বাড়িতে ঢোকে। তিনজন সেনা লাথি দিয়ে দরজা ভেঙে বাগান দিয়ে ঢুকে বাবাকে নিয়ে যায়৷ ২৭ তারিখ ঢাকা মেডিক্যালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় বাবা মারা যান।’

এএআর/

সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
থার্ড টার্মিনালের বাউন্ডারি ভেঙে বিমানবন্দরে বাস, প্রকৌশলী নিহত
থার্ড টার্মিনালের বাউন্ডারি ভেঙে বিমানবন্দরে বাস, প্রকৌশলী নিহত
ভারত-পাকিস্তান টেস্ট হবে দারুণ: রোহিত
ভারত-পাকিস্তান টেস্ট হবে দারুণ: রোহিত
জাতীয় পতাকার নকশাকার শিব নারায়ণ দাস আর নেই
জাতীয় পতাকার নকশাকার শিব নারায়ণ দাস আর নেই
পথের পাশের বাহারি শরবতে স্বাস্থ্যঝুঁকি কতটা?
পথের পাশের বাহারি শরবতে স্বাস্থ্যঝুঁকি কতটা?
সর্বাধিক পঠিত
সয়াবিন তেলের দাম পুনর্নির্ধারণ করলো সরকার
সয়াবিন তেলের দাম পুনর্নির্ধারণ করলো সরকার
নিজ বাহিনীতে ফিরে গেলেন র‍্যাবের মুখপাত্র কমান্ডার মঈন
নিজ বাহিনীতে ফিরে গেলেন র‍্যাবের মুখপাত্র কমান্ডার মঈন
ডিএমপির ৬ কর্মকর্তার বদলি
ডিএমপির ৬ কর্মকর্তার বদলি
আমানত এখন ব্যাংকমুখী
আমানত এখন ব্যাংকমুখী
বৈধ পথে রেমিট্যান্স কম আসার ১০ কারণ
বৈধ পথে রেমিট্যান্স কম আসার ১০ কারণ