X
বুধবার, ০৮ মে ২০২৪
২৫ বৈশাখ ১৪৩১

মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে জামায়াত-শিবিরের নানা কৌশল

সালমান তারেক শাকিল
২৭ মার্চ ২০১৭, ১৩:১৮আপডেট : ২৭ মার্চ ২০১৭, ১৯:৩৫

জামায়াত ও শিবির

জামায়াতে ইসলামীর মহান মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করার কথা কারও অজানা নয়। বাংলাদেশের সবচেয়ে গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায়ের বিরুদ্ধে দলটির কেন্দ্রীয় ও তৎকালীন ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্র সংঘের প্রায় সবাই অবস্থান নিয়েছিল। অথচ স্বাধীনতার পর কাল পরিক্রমায় বাংলাদেশের মূলধারার রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সখ্যতা গড়ে তোলে জামায়াত, শক্ত অবস্থান গড়ে সংসদীয় রাজনীতিতে।

মুক্তিযুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে এখন পর্যন্ত মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হয়েছে জামায়াতের শীর্ষস্থানীয় পাঁচ নেতার। বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার বিরুদ্ধে সরাসরি অবস্থান নিলেও গত কয়েক বছরে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে নানা কৌশল অবলম্বন করেছে জামায়াত ও দলটির বর্তমান ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্রশিবির। মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক দিনগুলো পালন তো করছেই, এমনকি বেশ কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধাকে দলেও ভিড়িয়েছে দলটি।

জামায়াত অবশ্য অনেক দিন ধরেই বলে আসছে, মুক্তিযুদ্ধের সময় তাদের ‘অখণ্ড’ পাকিস্তানের পক্ষে থাকার সিদ্ধান্ত ছিল রাজনৈতিক, তারা কোনও অপরাধে জড়ায়নি। ২০১২ সালের ১১ জানুয়ারি আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে হাজির হওয়ার আগে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর প্রতিষ্ঠাতা গোলাম আযম বলেছিলেন, ‘১৯৭১-এ মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করতে না পারা রাজনৈতিক নেতাগণ জনগণকে জুলুম থেকে রক্ষা করার জন্য সাধ্যমতো চেষ্টা করেছেন। নির্বাচনে বিজয়ী নেতৃবৃন্দ দেশে না থাকায় সাহায্যপ্রার্থী অসহায় জনগণের সমস্যার সমাধান করাই তাদের একমাত্র দায়িত্ব ও চেষ্টা ছিল। আমিও এ চেষ্টাই করেছি।’

২০০১ সালে বিএনপি-জামায়াতের চারদলীয় জোট ক্ষমতা গ্রহণের পর জাতীয় দিবসগুলো আড়ম্বরের সঙ্গে পালন করেছিল জামায়াত-শিবির। বিশেষ করে ছাত্রশিবিরের উদ্যোগে দেশজুড়ে বিজয় দিবস, স্বাধীনতা দিবস সহ অন্যান্য জাতীয় দিবসে র‌্যালি-আলোচনা সভা হয়েছে, পালিত হয়েছে বৃক্ষরোপণ কর্মসূচি। অবশ্য ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন ১৪ দলীয় জোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর রাজনৈতিকভাবে কোণঠাসা জামায়াত-শিবির জাতীয় দিবসগুলো পালনে গ্রহণ করে নানা কৌশল। ভোরবেলায় ঝটিকা র‌্যালি, গোপনে মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মাননা-সহায়তা প্রদান, অজ্ঞাতস্থানে ছোট পরিসরে আলোচনাসভার আয়োজন করছে গত আট বছর ধরে। যদিও মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক বিভিন্ন পত্রিকা প্রকাশের পাশাপাশি সাহিত্য ও সঙ্গীত রচনার সঙ্গে জড়িত জামায়াতের বিভিন্ন সংগঠন। জামায়াত ঘরানার পরিবারের শিশুদের দিয়ে শিশু উপযোগী গানও প্রচার করা হচ্ছে কয়েক বছর ধরে। সাংস্কৃতিক ধারায় কাজ করছে সাইমুম শিল্পী গোষ্ঠীসহ শতাধিক শিল্পী গোষ্ঠী।

সমাজচিন্তক ও বিশ্লেষকরা বলছেন, জামায়াত-শিবির মুক্তিযুদ্ধকে প্রাধান্য দিয়ে রাজনৈতিক কৌশল গ্রহণ করলেও সাধারণ মানুষ ও শিক্ষার্থীরা তাদের কৌশল ধরতে সক্ষম। যদিও অনেকে মনে করছেন, সাধারণ শিক্ষার্থীদের সংগঠনে ভেড়াবার জন্যই মুক্তিযুদ্ধ, ভাষা আন্দোলন ও বিভিন্ন সময়ের গণআন্দোলনকে তারা ব্যবহার করছে। এরই মধ্যে গোলাম আযমকে ভাষা আন্দোলনের অন্যতম সৈনিক হিসেবে দাবি করেছে জামায়াত-শিবির। এমনকি যুদ্ধাপরাধের দায়ে সাজাপ্রাপ্ত সাবেক আমীরকে ‘ভাষা সৈনিক’ স্বীকৃতির দাবিও জানিয়েছে তারা।

প্রগতিবাদী চিন্তাবিদ ও স্বাধীনতা পুরস্কারপ্রাপ্ত লেখক যতীন সরকার এ প্রসঙ্গে বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘জামায়াতে ইসলামী মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করে এখন মুক্তিযুদ্ধকেই ব্যবহার করছে, এটা নিতান্ত হাস্যকর। অন্যান্য রাজনৈতিক দলগুলোর আশকারা পেয়েই তারা এখন মুক্তিযুদ্ধের দিকে ঝুঁকেছে।’ এটা ঠেকাতে না পারলে মুক্তিযুদ্ধ ও ভাষা আন্দোলনের অর্জন নষ্ট হয়ে যাবে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেন তিনি।

গত বছরের ১৭ নভেম্বর জামায়াতের আমীরের দায়িত্ব নেওয়ার পর বক্তব্য রাখতে গিয়ে শুরুতেই মুক্তিযুদ্ধে শহীদ ও জাতীয় নেতাদের স্মরণ করেন মকবুল আহমাদ। তিনি বলেন, ‘১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে যে সব জনগণ ও বীর মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্বপূর্ণ ভূমিকা ও অকৃত্রিম ত্যাগের বিনিময়ে আমরা স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ পেয়েছি, তাদের কথা আজ গভীর শ্রদ্ধা ও কৃতজ্ঞতার সঙ্গে স্মরণ করছি। বিশেষভাবে স্বাধীনতার স্থপতি শেখ মুজিবুর রহমান, শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান বীর উত্তম, জননেতা মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী এবং মহান মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক জেনারেল আতাউল গনি ওসমানী সহ বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের  অবিসংবাদিত নেতাদের আমি সশ্রদ্ধ চিত্তে স্মরণ করছি।’

এমনকি জামায়াতের নতুন সংশোধিত গঠনতন্ত্রেও বলা হয়েছে মুক্তিযুদ্ধের কথা। ৬৩ তম সংস্করণের ভূমিকায় বলা আছে, “যেহেতু বাংলাদেশের জনগণ ও মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্বপূর্ণ সংগ্রামের মধ্য দিয়া বাংলাদেশ মানচিত্রে স্বাধীন ও সার্বভৌম জাতি-রাষ্ট্রের মর্যাদা লাভ করিয়াছে; ‘সেহেতু এই মৌলিক বিশ্বাস ও চেতনার ভিত্তিতে শোষণমুক্ত ন্যায়ভিত্তিক সমাজ গঠনের উদ্দেশ্যে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর এই গঠনতন্ত্র প্রণীত ও প্রবর্তিত হইল।’’

ছাত্রশিবিরের একজন শীর্ষস্থানীয় নেতা জানান, প্রতি বছরই স্বাধীনতা দিবস নিয়ে নানা কর্মসূচি পালন করে ছাত্র সংগঠনটি। এবারও স্বাধীনতা দিবসে অর্থাৎ ২৬ মার্চের ভোরে তারা র‌্যালি করেছে এবং পরে রাজধানীর একটি মিলনায়তনে আলোচনা সভার আয়োজন করে।

তবে এসব কর্মসূচি পালনের তীব্র বিরোধিতা করেছেন ১৪ দলীয় জোটের অন্যতম শরিক তরিকত ফেডারেশনের মহাসচিব এম এ আউয়াল এমপি। তিনি বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতা উপলক্ষে ছাত্র শিবিরের মিছিল দেখে নতুন প্রজন্ম বিভ্রান্ত হচ্ছে। তারা মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মাননা দেওয়ার নামে মুক্তিযুদ্ধকে অসম্মান করছে। সরকারের উচিত বিষয়টিকে গুরুত্ব দিয়ে দায়িত্বশীল কর্তৃপক্ষের সঙ্গে দ্রুত কথা বলা। চিরতরে এসব নষ্টামি, মুক্তিযুদ্ধের নামে শিবিরের র‌্যালি বন্ধ করা উচিত।’

ছাত্র ফেডারেশনের ঢাকা মহানগর সভাপতি কাঁকন বিশ্বাসও জামায়াত-শিবিরের এ ধরনের কর্মসূচির ঘোর বিরোধী। তিনি বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘প্রতি বছরই নিয়ম করে ছাত্রশিবির এ ধরনের কর্মসূচি পালন করে। তারা ভালো করেই জানে, বাংলাদেশে রাজনীতি করতে হলে মুক্তিসংগ্রাম, রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে মানুষের আত্মত্যাগের কথা বাদ দিয়ে রাজনীতি করা সম্ভব না। এ কারণেই মুক্তিযুদ্ধকে ব্যবহার করে নানা কৌশলে নতুন প্রজন্মকে টানতে চাইছে তারা।’

/এএআর/আপ-এসটি

সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
ডায়ালাইজার কিটে শুল্ক কমানোর দাবি
ডায়ালাইজার কিটে শুল্ক কমানোর দাবি
গানে-কবিতায় রবীন্দ্রজয়ন্তী উদযাপন সঙ্গীতালয়ের
গানে-কবিতায় রবীন্দ্রজয়ন্তী উদযাপন সঙ্গীতালয়ের
কালবৈশাখী হতে পারে ৮ বিভাগে
৩ দিনের সতর্কবার্তাকালবৈশাখী হতে পারে ৮ বিভাগে
দুবাইতে মুদ্রার উল্টো পিঠও দেখলেন ফাহাদ
দুবাইতে মুদ্রার উল্টো পিঠও দেখলেন ফাহাদ
সর্বাধিক পঠিত
ব্যারিস্টার সুমনকে একহাত নিলেন চুন্নু
ব্যারিস্টার সুমনকে একহাত নিলেন চুন্নু
গ্রাম আদালত বিল পাস, জরিমানা বাড়লো চার গুণ
গ্রাম আদালত বিল পাস, জরিমানা বাড়লো চার গুণ
শনিবারে স্কুল খোলা: আন্দোলন করলে বাতিল হতে পারে এমপিও
শনিবারে স্কুল খোলা: আন্দোলন করলে বাতিল হতে পারে এমপিও
শেখ হাসিনাই হচ্ছেন ভারতে নতুন সরকারের প্রথম বিদেশি অতিথি
শেখ হাসিনাই হচ্ছেন ভারতে নতুন সরকারের প্রথম বিদেশি অতিথি
প্রথম ধাপের উপজেলা নির্বাচন আজ
প্রথম ধাপের উপজেলা নির্বাচন আজ