X
বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪
১৪ চৈত্র ১৪৩০

কৌশলে যুদ্ধের সংবাদ উপস্থাপন করতেন সাংবাদিকরা

রশিদ আল রুহানী
২৭ মার্চ ২০১৭, ১৪:২৫আপডেট : ২৭ মার্চ ২০১৭, ১৫:২০

কৌশলে যুদ্ধের সংবাদ উপস্থাপন করতেন সাংবাদিকরা

মহান মুক্তিযুদ্ধে সাংবাদিকদের ভূমিকা ছিল বিশাল। দেশকে স্বাধীন করার লক্ষ্যে সাংবাদিকরা ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন কলম হাতে। মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম হাতিয়ার ছিল অনুপ্রেরণামূলক সংবাদ। অবশ্য বাধাও ছিল তীব্র। দেশের বেশিরভাগ পত্রিকা অফিসে আগুন দিয়ে বন্ধ করে দিয়েছিল পাকিস্তান হানাদার বাহিনী। কিছু পত্রিকা পাকিস্তান সরকারের বন্দনা আর মুক্তিযুদ্ধ বিরোধী সংবাদ প্রকাশ করতো। তবে মুক্তিকামী সাংবাদিকরা থেমে থাকেননি। তারা বিভিন্ন কৌশল প্রয়োগ করে সংবাদ উপস্থাপন করতেন।

মুক্তিযুদ্ধে কলম-সৈনিকের ভূমিকায় অগ্রগণ্য ছিলেন শহীদ সিরাজুদ্দীন হোসেন। তিনি ছিলেন ইত্তেফাকের সাংবাদিক। ১৯৭১ সালে পত্রিকাটিতে সম্পাদকীয় ও উপ-সম্পাদকীয় ছাড়াও বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ পরিবেশন করতেন তিনি।

বাবার স্মৃতিচারণ করে সিরাজুদ্দীন হোসেনের সন্তান শাহীন রেজা নূর বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আমার বাবা তখন দৈনিক ইত্তেফাকের সাংবাদিক ছিলেন। তিনি তার লেখনীর মধ্যে দিয়ে দেশ স্বাধীনের জন্য অগ্রণী ভূমিকা রেখেছিলেন। তবে একাত্তরের মার্চে পত্রিকার ওপর অনেক সেন্সরশিপ আরোপ করা হয়। ফলে তিনি দেশের পক্ষে ভীষণ কৌশলী হয়ে সংবাদ উপস্থাপন করতেন। সরাসরি পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে লিখতে পারতেন না। তবে তার লেখা পড়ে বোঝা যেত, তিনি দেশের পক্ষেই লিখতেন।’

কলম হাতে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে দাঁড়িয়েছিলেন বহু সাংবাদিক। তাদের মধ্যে শহীদ শহীদুল্লাহ কায়সার, খোন্দকার আবু তালেব, নিজামুদ্দীন আহমদ, এস এ মান্নান (লাডু ভাই), আ ন ম গোলাম মোস্তফা, সৈয়দ নাজমুল হক, আবুল বাশার, শিব সাধন চক্রবর্তী, চিশতী শাহ হেলালুর রহমান, মুহম্মদ আখতার, সেলিনা পারভীন, এ কে এম শহীদুল্লাহ্ (শহীদ সাবের) অন্যতম। এই শহীদ সাংবাদিকদের নাম জাতীয় প্রেসক্লাবের নিচ তলায় শ্বেত পাথরে লেখা রয়েছে।

কৌশলে যুদ্ধের সংবাদ উপস্থাপন করতেন সাংবাদিকরা

একাত্তরে অনেক সাংবাদিক অস্ত্র হাতে সরাসরি যুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন। পাশাপাশি যুদ্ধের খবর দেশি-বিদেশি পত্রিকায় প্রকাশও করতেন তারা। তাদের মধ্যে অন্যতম হারুন হাবিব। মুক্তিযোদ্ধা, লেখক ও সাংবাদিক হারুন হাবিব বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘২৫ মার্চের আগ পর্যন্ত আবেগতাড়িত ও দেশপ্রেমে উজ্জীবিত হয়ে সংবাদ প্রকাশ করতো পত্রিকাগুলো। সংগ্রাম ও পয়গাম ছাড়া বাকি সব পত্রিকা বাঙালি জাতীয়তাবাদের তীব্র সমর্থক ছিল। তবে ২৫ ও ২৬ মার্চের পরে সাংবাদিকতার পুরোধা যারা ছিলেন, তারা খুব বেশি কাজ করতে পারেননি। বেশিরভাগ পত্রিকা অফিস বন্ধ হয়ে যায়, প্রচণ্ড সেন্সরশিপ জারি করা হয়। মিলিটারিরা অনেক খবরদারি করতো। কোন রিপোর্ট প্রকাশ হবে বা কোনটা হবে না, তা তারাই ঠিক করে দিতো।’

রণাঙ্গনের সংবাদপত্র ও সাংবাদিকতা বিষয়ে তিনি বলেন, ‘যুদ্ধের সময় দেশের সীমান্তবর্তী অঞ্চল থেকে অসংখ্য পত্রপত্রিকা বেরিয়েছিল, যেগুলো বেশিরভাগই হাতে লেখা এক, দুই বা তিন পৃষ্ঠার। আবার মুক্তিযোদ্ধারাও যুদ্ধের মধ্যে থেকেই পত্রিকা বের করতেন। সেগুলোকে আমি রণাঙ্গনের সংবাদপত্র বলি। এদের ভূমিকা ছিল বিশাল। আমি নিজেও যুদ্ধে সক্রিয় থাকার সময় ক্যামেরা হাতে ছবি তুলেছি। সেগুলো আজ রণাঙ্গন সাংবাদিকতা এবং কালের সাক্ষী।’

বিবিসিতে প্রকাশিত প্রখ্যাত সাংবাদিক অ্যান্থনি মাসকারেনহাসের প্রতিবেদন

মুক্তিযুদ্ধে বিদেশি গণমাধ্যমের বিরাট ভূমিকা ছিল উল্লেখ করে হারুন হাবিব বলেন, ‘বিদেশি সংবাদপত্রগুলো অনেক খবর প্রকাশ করতো ওই সময়। তাই অনেক বিদেশি সাংবাদিককে দেশ থেকে বের করে দেওয়া হয়েছিল। এর মধ্যেই অনেকে ছদ্মবেশে পালিয়ে থেকে বিদেশি পত্রিকায় খবর প্রকাশ করতেন।’

বিশিষ্ট সাংবাদিক ও মুক্তিযোদ্ধা আবেদ খান একাত্তরে কাজ করতেন ইত্তেফাকে। ২৫ মার্চের কালরাতে পাক হানাদার বাহিনী ইত্তেফাক ভবন আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দেওয়ার পর ২৯ মার্চ তিনি ঢাকা ছাড়েন। পরে জুন মাসে প্রত্যক্ষদর্শী হিসেবে দৈনিক সংবাদ, ডেইলি পিপল, ইত্তেফাক ভবন এবং সারা ঢাকার ওপর বয়ে চলা ভয়াল ধ্বংসলীলার চিত্র কলকাতার আকাশবাণী বেতার কেন্দ্রের মাধ্যমে বিশ্ববাসীর কাছে তুলে ধরেন তিনি।

জয় বাংলা

মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলো আজও আবেদ খানের স্মৃতিতে উজ্জ্বল। তিনি বলেন, ‘২৫ মার্চ রাতে আমি ইত্তেফাক অফিসে আটকে ছিলাম। সেদিন আটকে পড়াদের মধ্যে এখন আমি সহ কেবল তিনজন বেঁচে আছে। সেদিনের পরে পুরো ঢাকা শহরে সাইকেল চালিয়ে তাণ্ডবের দৃশ্য দেখেছি। পরে ভারতে গিয়ে তা প্রকাশ করেছি পত্রিকায়। চেষ্টা করেছি নিজের লেখা দিয়ে দেশ স্বাধীনের জন্য কাজ করতে। আজ আমরা স্বাধীনও হয়েছি।’

মুক্তিযোদ্ধা ও সাংবাদিক কামাল লোহানীরও ছিল বিশাল ভূমিকা। তার প্রতিবেদন ‘বিদ্রোহ ন্যায় সঙ্গত’ প্রকাশের পর চারদিকে হৈচৈ পড়ে গিয়েছিল। শিল্পী, সাংস্কৃতিক কর্মী, সংগঠকদের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে একতাবদ্ধ করে ‘বিক্ষুব্ধ শিল্পী সমাজ’ গঠনে তার অগ্রণী ভূমিকা ছিল।

মুক্তিযুদ্ধের সময় ঢাকায় এসে যুদ্ধের রিপোর্ট করেন নিউইয়র্ক টাইমসের সাংবাদিক সিডনি স্যানবার্গ

২৫ মার্চ গণহত্যার পর কলকাতা থেকে প্রকাশিত জয় বাংলা পত্রিকার সঙ্গে যুক্ত হন কামাল লোহানী। পরে যোগ দেন স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে। স্বাধীন বাংলা বেতারের সংবাদ বিভাগের দায়িত্ব পালনের সময় আবৃত্তি, সংবাদ, কথিকা ইত্যাদি প্রচার করে মুক্তিযোদ্ধাদের অনুপ্রাণিত করেছিলেন তিনি।

কামাল লোহানী বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘২৫ মার্চের আগে আমরা স্বাধীনভাবে দেশের পক্ষে লিখতে পারতাম। কিন্তু ওই দিনটির পর থেকে আর সেভাবে লেখার সুযোগ ছিল না। তবে যেগুলো আমরা দেশের পত্রিকায় ছাপতে পারতাম না, সেগুলো বিদেশি গণমাধ্যমে পাঠিয়ে দিতাম। সেখান থেকেই প্রকাশ করা হতো।’

তিনি আরও বলেন, ‘তবে দেশের সংবাদপত্রের জন্য লিখতে হলে কৌশলে লিখতে হতো, সরাসরি কোনও কিছু লেখা যেতো না। সোজাসাপ্টা না লিখে ঘুরিয়ে উপস্থাপন করতে হতো, যাতে সাধারণ মানুষ বুঝতে পারলেও পাকিস্তানিরা বুঝতে না পারে।’

/আরএআর/এএআর/

 

সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
পানিতে ডুবে ভাইবোনসহ ৩ শিশুর মৃত্যু
পানিতে ডুবে ভাইবোনসহ ৩ শিশুর মৃত্যু
‘এমপি হতে ১ কোটি ২৬ লাখ টাকা খরচ হয়েছে, এটা তুলবো, এটুকু অন্যায় করবো-ই’
‘এমপি হতে ১ কোটি ২৬ লাখ টাকা খরচ হয়েছে, এটা তুলবো, এটুকু অন্যায় করবো-ই’
ইডি হেফাজতে আরও ৪ দিন কেজরিওয়াল
ইডি হেফাজতে আরও ৪ দিন কেজরিওয়াল
ভাইস চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে নারী উন্নয়ন ফোরামের টাকা আত্মসাতের অভিযোগ
ভাইস চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে নারী উন্নয়ন ফোরামের টাকা আত্মসাতের অভিযোগ
সর্বাধিক পঠিত
আয়বহির্ভূত সম্পদ: সাবেক এমপির পিএস ও স্ত্রীর বিরুদ্ধে দুদকের মামলা
আয়বহির্ভূত সম্পদ: সাবেক এমপির পিএস ও স্ত্রীর বিরুদ্ধে দুদকের মামলা
বিএনপির ইফতারে সরকারবিরোধী ঐক্য নিয়ে ‘ইঙ্গিতময়’ বক্তব্য নেতাদের
বিএনপির ইফতারে সরকারবিরোধী ঐক্য নিয়ে ‘ইঙ্গিতময়’ বক্তব্য নেতাদের
নিউ ইয়র্কে পুলিশের গুলিতে বাংলাদেশি তরুণ নিহত, যা জানা গেলো
নিউ ইয়র্কে পুলিশের গুলিতে বাংলাদেশি তরুণ নিহত, যা জানা গেলো
কুড়িগ্রাম আসছেন ভুটানের রাজা, সমৃদ্ধির হাতছানি
কুড়িগ্রাম আসছেন ভুটানের রাজা, সমৃদ্ধির হাতছানি
মন্ত্রীর অপেক্ষায় তরমুজ বিক্রিতে দেরি, ক্ষুব্ধ ক্রেতারা
মন্ত্রীর অপেক্ষায় তরমুজ বিক্রিতে দেরি, ক্ষুব্ধ ক্রেতারা