প্রতিবছর ডিসেম্বর থেকে পরবর্তী বছরের ফেব্রুয়ারি মাসের মধ্যে হাওরাঞ্চলে ফসল রক্ষার জন্য বাঁধ পুনর্নির্মাণসহ মাটি ফেলার কাজ করা হয়। এ বছরও সেরকমই হওয়ার কথা ছিল। ১৫ ডিসেম্বর থেকে ২৮ ফেব্রুয়ারির মধ্যে ২৩০ কিলোমিটার বাঁধ নির্মাণ, পুনর্নির্মাণ ও মাটি ভরাটের কথা থাকলেও সেই কাজ সম্পন্ন হয়নি। তাহিরপুর, ছাতক, জামালগঞ্জ, দোয়রা বাজার, দিরাইসহ মোট ১১টি উপজেলার বিভিন্ন হাওরের বাঁধের কাজও ছিল দায়সারা। ফলে অতিবৃষ্টির কারণে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে লাখ লাখ একর জমির একমাত্র বোরো ফসল ডুবে সর্বস্বান্ত হয়েছেন হাওরাঞ্চলের মানুষ।
এডিপি প্রকল্পের অধীনে ২২৫টি প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটি (পিআইসি) এবং ৪৮টি প্যাকেজে ঠিকাদারদের মাধ্যমে ভাটি এলাকার ওইসব বাঁধ নির্মাণ ও পুনর্নির্মাণের কথা ছিল পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো)। প্রতিবছর ১৫ ডিসেম্বর থেকে ২৮ ফ্রেরুয়ারির মধ্যে জেলার হাওরের বেড়িবাঁধের নির্মাণ কাজ শেষ করার সরকারি নির্দেশ থাকলেও গত কয়েকবছর ধরে তা মানা হচ্ছে না বলে অভিযোগ রয়েছে। এই কাজে দুর্নীতির অভিযোগে কোনও ব্যবস্থা না নেওয়ায় এরকম ভয়ঙ্কর পরিস্থিতি দাঁড়িয়েছে বলে মনে করছেন ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকরা।
পাউবোর একাধিক সূত্র বলছে, প্রতিবছর মোটামুটি চল্লিশ শতাংশ কাজ অযত্ন-অবহেলায় করা হয় বলে অভিযোগ থাকে। এবার সেটা মাত্রা ছাড়িয়ে যাওয়ায় এই অনাকাঙ্ক্ষিত অবস্থা তৈরি হয়েছে। যদিও পাউবোর নির্বাহী প্রকৌশলী আফসার উদ্দিন শুরু থেকেই অভিযোগ অস্বীকার করে আসছেন। কাজ শুরু করতে দেরির কথা স্বীকার করলেও সময়মতো কাজ শেষ না হওয়া বিষয়ে তিনি কোনও কথা বলেননি।
উল্লেখ্য, গত বছর সুনামগঞ্জের ছোট বড় ৪৬টি হাওরে সময় মতো ও সঠিকভাবে বাঁধ মেরামত না করায় ১৫টি বাঁধ ভেঙে যায় এবং ২৫টি হাওরের ৬০-৭০ ভাগ বোরো ধান সম্পূর্ণ পানিতে তলিয়ে যায়।
ফসল রক্ষা বাঁধ নির্মাণে দুর্নীতি ও অনিয়ম তদন্তে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) পাশাপাশি পানিসম্পদ মন্ত্রণালয় ও পাউবো থেকে পৃথক দু’টি কমিটি করে দেওয়া হয়েছে।
অভিযোগ আছে, পানি উন্নয়ন বোর্ড এর নির্বাহী প্রকৌশলী ও অন্যান্যরা ঠিকাদারদের যোগসাজশে কোনও কাজ না করেই দুর্নীতি ও অনিয়মের মাধ্যমে ২৫ কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছে। দুদক পরিচালক বেলাল হোসেন বৃহস্পতিবার (২০ এপ্রিল) সুনামগঞ্জ এলাকা পরিদর্শন শেষে বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘দুর্নীতির সঙ্গে যারা জড়িত তাদের বিন্দুমাত্র ছাড় দেওয়া হবে না।’ বাঁধ পরিদর্শনে গিয়ে দুদকের দল এলাকায় প্রকল্পের কোনও কর্মকর্তা বা ঠিকাদারের দেখা পাননি বলেও জানিয়েছেন।
এর আগে দুদক কর্মকর্তা মোহাম্মদ বেলাল হোসেন সিলেটে সাংবাদিকদের বলেন, ‘প্রাথমিক তদন্তে প্রকল্প দীর্ঘায়িত করার অনিয়ম পাওয়া গেছে। সুনামগঞ্জে প্রকল্পের মেয়াদ ছিল ২৮ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত। তবে তা বাড়ানো হয়েছে। এসময়ের মধ্যে কাজ শেষ না করায় ঠিকাদারদের কাজ বাতিল না করে কাজের সময় বাড়ানো যথাযথ হয়েছে কিনা তা যাচাই করে দেখা হবে।’
বাংলাদেশের মোট আয়তনের ছয় ভাগের এক ভাগ হলো হাওরাঞ্চল। সুনামগঞ্জ, সিলেট, হবিগঞ্জ, মৌলভীবাজার, নেত্রকোনা, কিশোরগঞ্জ ও ব্রাহ্মণবাড়িয়া এই সাতটি জেলার বিভিন্ন অংশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে বেশিরভাগ হাওর। সুনামগঞ্জের অধিকাংশই হাওরাঞ্চল। উপজেলা কৃষি অফিসের হিসাব অনুযায়ী, ধর্মপাশার এই হাওরগুলোতে রয়েছে ২৪ হাজার ৮শ হেক্টর জমি, যার ২৩ হাজার ৮১৮ হেক্টরই পানিতে তলিয়ে গেছে। তবে এখনও ক্ষয়ক্ষতির চূড়ান্ত হিসেব জানাতে পারেনি কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর। এ বছর হাওরের পানিতে ডুবে যাওয়া ধান পচে মাছ মারে ভেসে উঠছে। আর বিষাক্ত মাছ খেয়ে হাঁস-মুরগি মারা যাচ্ছে। খর ও খাবারের অভাবে গবাদি পশু নিয়েও বিপাকে পড়েছেন কৃষকরা।
বারবার শঙ্কার কথা জানিয়েও কোনও ব্যবস্থা না নেওয়ার অভিযোগ তুলে দিরাইয়ে খাগাউড়া গ্রামের নব্বই বছর বয়সী দিজেন্দ্রনাথ মজুমদার বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘ফসল রক্ষা বাঁধের কাজ যদি সঠিক সময়ে হতো তাহলে অকাল বন্যাতে হাওড়ের ফসল তলিয়ে যেত না। বাঁধ নির্মাণে কর্তাদের অবহেলার কারণেই ক্ষতির মুখে পড়েছে। আমাদের পক্ষ থেকে বারবারই শঙ্কার কথা জানানো হয়। অসময়ের ঢল সবসময়তো আসে না, এবার এলো এবং সর্বনাশ করে দিয়ে গেল।’
উত্তরবংশিপুন্ডা ইউনিয়নের ধর্মপাশার জইনউদ্দিন বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আগামীতে ফলস রক্ষা বাঁধ নির্মাণের কাজ যদি মনিটরিং করা না হয় তাহলে আমাদের কপালে এরচেয়েও খারাপ সময় আসতে পারে। গুরুত্ব না দেওয়া, অবহেলা করার কারণেই এ সমস্যা হয়েছে। আমরা যারা এ এলাকার মানুষ তারা জানি, বাঁধ দেওয়া থাকে। তবে প্রতিবছর ফসল রক্ষায় সে বাঁধের রক্ষণাবেক্ষণ করতে হয়, পুনর্নির্মাণের কাজ করতে হয়। সেখানে অনেক টাকা। পানি উন্নয়ন বোর্ড এসব তত্ত্বাবধান করে। তবে তারা বারবারই দুর্নীতির অভিযোগে পড়েছে।’
/ইউআই/এফএস/
আরও পড়ুন-