X
শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪
১৩ বৈশাখ ১৪৩১
ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী সাংবাদিক নাজমুলের জবানি

রানা প্লাজার পিলার ভাঙতে শুরু করে দুর্ঘটনার আগের দিনই

এস এম নূরুজ্জামান
২৩ এপ্রিল ২০১৭, ২৩:০০আপডেট : ২৪ এপ্রিল ২০১৭, ০৯:৪৫

রানা প্লাজা ধসের আগের দিন নাজমুলকে ওই ভবন থেকে বের হওয়ার জন্য শাসাচ্ছেন রানা প্লাজার মালিক সোহেল রানা (ছবি সৌজন্য একুশে টিভি) ২০১৩ সালের ২৪ এপ্রিল রানা প্লাজা দুর্ঘটনা ঘটে। কিন্তু, ওই দুর্ঘটনার আগের দিন ২৩ এপ্রিল সেখানে যা ঘটেছিল তা যদি গণমাধ্যমে সময়মতো প্রচার করা হতো তাহলে হয়তো এমন মৃত্যুর মিছিল ঠেকানো যেতো। সেদিন কেন গণমাধ্যমে সেই চিত্র তুলে ধরা যায়নি এবং স্থানীয় সাংবাদিকরা কেন ও কিভাবে বাধাগ্রস্ত হয়েছিলেন—এসব বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য উঠে এসেছে সাভারের সাংবাদিক নাজমুল হুদার জবানিতে। এ ঘটনার চার বছর পর আজ শনিবার ধসে বিলীন হওয়া সেই রানা প্লাজার সামনে দাঁড়িয়ে সেইদিনের ঘটনা বর্ণনা করেন বাংলা ট্রিবিউনের কাছে।
নাজমুল হুদা বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, রানা প্লাজার তিন তলায় নিউ ওয়েভ বটমস লিমিটেড। এই কারখানাটিতে তখন তৈরি হচ্ছিল ইউরোপীয় ক্রেতাদের কার্যাদেশ দেওয়া শিশুদের প্যান্ট। ঘটনার শুরু এই তিন তলা থেকেই। ২০১৩ সালের ২৩ এপ্রিল আর সবার মতোই এই ফ্লোরের কাটিং সেকশনে এসে কাজ শুরু করেছিলেন সুপারভাইজার নুরুল ইসলাম খান। এ ঘটনা শুরুর বর্ণনা তার কাছ থেকেই প্রথম পাই।
নুরুল ইসলাম খান আমাকে জানান, ‘২৩ এপ্রিল সকাল পৌনে দশটা।তিন তলার একটি পিলারে হঠাৎ চড়চড় করে শব্দ হলো। একটি সেলাই মেশিনের ওপর সশব্দে খসে পড়লো দেয়ালের প্লাস্টার। আতঙ্কে ছোটাছুটি শুরু করলেন শ্রমিকরা। তখন আমরা কাউকে কিছু না বলে চেয়ারম্যানকে ফোন করি। তিনি আমাদের কারখানা ছুটি দিয়ে দিতে বলেন এবং তার সঙ্গে দেখা করতে বলেন’।
তিনি জানান, কিন্তু, চেয়ারম্যানের এই নির্দেশ তোয়াক্কা করেননি নিউ ওয়েভ বটমস লিমিটেডের ম্যানেজার। তিনি এসে শ্রমিকদের বলেন, ‘এরকম দু-একটা পিলার না থাকলে কিছু হবে না। এখন কাজের যা চাপ। আমরা নাইট করে কুলাতে পারছি না। শ্রমিকদের কাজ করতে হবে।’
ধসে পড়ার পর রানা প্লাজা নুরুল ইসলাম খান সেসময় জানিয়েছিলেন, ‘ম্যানেজারের সঙ্গে যখন কথা বলছিলাম তখনও আমি পিলারের ভেতর চড়চড় শব্দ শুনতে পাচ্ছিলাম’।
এরপরের বর্ণনা একুশে টেলিভিশন ও বাংলাদেশ প্রতিদিনের সাভার প্রতিনিধি নাজমুল হুদার নিজের। তিনি বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘নিউ ওয়েভ বটমস লিমিটেডের সুপারভাইজার নুরূল ইসলামের কাছ থেকে এমন তথ্য পেয়ে কিছুক্ষণের মধ্যেই ক্যামেরা নিয়ে পৌঁছে যাই রানা প্লাজায়। কিন্তু, রানা প্লাজার ফাটলের সংবাদ সংগ্রহ ও চিত্রধারণ করতে গিয়ে বাধাগ্রস্ত হই। রানা প্লাজার মালিক ও সাভার যুবলীগের নেতা সোহেল রানার সঙ্গী-সাথীরা চিত্র ধারণে বাধা দিতে থাকেন। এক পর্যায়ে ৪র্থ তলা থেকে সোহেল রানার পালিত ক্যাডার বিদ্যুৎসহ ১০/১২ জন আমাকে কলার ধরে কারখানা থেকে বের করে আনার চেষ্টা করে। কিন্তু জোর করে আমি ভেতরে থেকে যাই। এরপর আমি নিজেকে বাঁচাতে ঢাকার জেলা প্রশাসককে ফোন করে রানা প্লাজার ফাটলের ঘটনা বলি। এর জবাবে তিনি আমাকে বলেন, সাভার উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তার সঙ্গে যোগাযোগ করার জন্য। এ সময় সন্ত্রাসীরা আমাকে জোর করে ভেতর থেকে বের করে দিয়ে ভবনের গেটে তালা ঝুলিয়ে দেয়।
এরপর সোহেল রানা জোর করে আমাকে তার অন্ধকার রুমে নিয়ে যায়। তখন একুশে টেলিভিশনের প্রোগ্রামের কাজ করতেন আলভিদ রাজ। তাকে ফোনে বিষয়টা বললে তিনি আমাকে নিউজ না করার পরামর্শ দেন। কিন্তু, আমি এরপর ইটিভির তদানীন্তন ন্যাশনাল ইনচার্জ মুশফিকা নাজনীনের সঙ্গে যোগাযোগ করি। তিনি আমাকে নিউজ ও ফুটেজ পাঠাতে বলেন ।
দুপুর সাড়ে ১২টার সময় নিজ কার্যালয়ে বসেই রানা একুশে টেলিভিশনকে সাক্ষাৎকার দেন। তখন সোহেল রানা বলেছিলেন, ‘পিলারের ওখান থেকে চুল পরিমাণ প্লাস্টার খুলে পড়েছে। মানুষ তিলকে তাল বানাচ্ছে। আমরা ইঞ্জিনিয়ারকে সঙ্গে নিয়ে দেখে এসেছি। ইঞ্জিনিয়ার বলেছে এটা ঝুঁকিপূর্ণ নয়। দু'একদিনের মধ্যেই প্লাস্টার ঠিক করে ফেলা হবে’। এরপর আমাকে নিউজ না করতে বলেন ভবনটির মালিক সোহেল রানা। আমাকে ২ হাজার টাকা ঘুষ দেওয়ারও চেষ্টা করেন তিনি। এ সময় আরও ১৫/২০ জন সাংবাদিক ছিলেন সেখানে। তারা কিন্তু, রানার হুমকিতে ফাটলের খবরটি তাদের মিডিয়ায় পাঠাননি।
ওই সাক্ষাৎকারে যে প্রকৌশলীর কথা উল্লেখ করেন সোহেল রানা, সেই প্রকৌশলী ছিলেন রানার নিয়োগ করা একজন বেসরকারি প্রকৌশলী। তার নাম আবদুর রাজ্জাক। ওইদিন বিকাল পৌনে তিনটার দিকে রানা প্লাজা পরিদর্শন করেন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা কবির হোসেন সরদার। তিনি প্রকৌশলী আব্দুর রাজ্জাকের বরাত দিয়ে তিনি বলেন, ‘অস্বাভাবিক কিছু না। একটা পিলারে কিছুটা ফাটল দেখা দিয়েছে। বড় ধরনের আশঙ্কার কোনও সম্ভাবনা নেই’।
রানা প্লাজার ধ্বংসস্তূপের মধ্য থেকে আহতদের উদ্ধার তৎপরতা (ছবি- সংগৃহীত) এরপর এলো সেই ভয়াবহ দিন। ২০১৩ সালের ২৪ এপ্রিল বুধবার ঘড়িতে সকাল আটটা। ওইদিন দ্বিতীয় দিনের মতো বিএনপি জোটের হরতাল চলছে। রানা প্লাজার শপিং মলের সব দোকান বন্ধ। বন্ধ ব্র্যাক ব্যাংকের শাখাটিও। শুধু ৫টি পোশাক কারখানার শ্রমিক-কর্মচারীরা ভবনের সামনে উপস্থিত হয়ে ঘোরাঘুরি করছে। আশপাশে মাইকে ঘোষণা দিয়ে বলা হচ্ছে শ্রমিকদের কাজে যোগ দিতে। মালিকপক্ষের হুমকিতে কাজ হারানোর ভয়ে সকাল সাড়ে আটটার দিকে শ্রমিকরা ঢুকতে শুরু করেন রানা প্লাজায়। তিন তলা থেকে নয়-তলা, সবগুলো ফ্লোরেই কাজ শুরু হয়ে যায়। তিনতলায় কাজ শুরু করেছেন নিউ ওয়েভ বটমসের কাটিং সুপারভাইজার নুরুল ইসলাম খান। আবার তার জবানিতে জানতে পারি ওই মুহূর্তের ঘটনার বিবরণ। তিনি জানান, ‘ফ্লোরে মাইকিং করে বলা হচ্ছে, ভবনটি তের তলা ফাউন্ডেশন। কেবল নয় তলা হয়েছে। আতঙ্কিত হবার কারণ নাই কোনও। আর যদি কোনও দুর্ঘটনা দেখা দেয়, আমাদের কমপ্লায়েন্সের লোক আছে চারিদিকে, তোমাদের দ্রুত বের হয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করা হবে’।
নুরুল ইসলাম আমাকে জানান, ‘সকাল ৮টা ৪৫ মিনিটের সময় দেখি হঠাৎ চারদিকে কিছু লোক আতঙ্কিতভাবে দৌড়াতে শুরু করেছে। পনেরো বিশ-জন দৌড়ে বাইরে চলে গেল। লাইনের মেয়েগুলো সব দেখলাম দাঁড়িয়ে গেল। আমিও দাঁড়িয়ে আছি। তখন অন্যরা আবার বলল, কিছু হয়নি, বসো বসো। তখন সব মেয়েরা আবার বসে পড়লো। এরপর দু’মিনিট পর ভেতরে থাকা কয়েক হাজার শ্রমিক নিয়ে ধসে পড়লো সাভারের রানা প্লাজা নামের নয় তলা ভবনটি।’
সাংবাদিক নাজমুল বাংলা ট্রিবিউনকে জানান, রানা প্লাজা ধসে পড়ার মুহূর্তে সামনের মহাসড়ক পুরোটাই ধুলোয় ঢাকা পড়ে যায়। শুরু হয় ভেতর থেকে প্রাণ নিয়ে বেরিয়ে আসা শ্রমিকদের আর্ত চিৎকার। ওই সময় মোবাইল ফোনের ক্যামেরায় সেই চিত্র ধারণ করেন একজন পথচারী। তারপরে ছুটে আসি আমরা...।
সাংবাদিক নাজমুল হুদা আরও বলেন, ‘রানা প্লাজা ভেঙে পড়ার আগের দিন অবিবেচকের মতো যে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা এটিকে ঝুঁকিপূর্ণ নয় বলে ঘোষণা দিয়েছিলেন, চার বছর পর সেই কবির হোসেন সরদার এখন বরখাস্ত। এখন শুধু ভবন মালিক সোহেল রানা কারাগারে আছেন। আর তার নিয়োগ করা প্রকৌশলী আব্দুর রাজ্জাকসহ সবাই কারাগারে বাইরে জামিনে রয়েছেন। ৫টি কারখানার চারটির মালিকও কারাগারের বাইরে। পঞ্চম কারখানাটির মালিক বিদেশে ‘
রানা প্লাজা যে জায়গাটিতে ছিল, সেই মূল ভবনটি এখন একটি জলমগ্ন ডোবা। বর্তমান অবস্থা দেখে মনে হয় না এখানে রানা প্লাজা নামের কোনও ভবন কখনও ছিল। ৩ বছর আগে এর চারপাশ টিন দিয়ে ঘেরাও করে রাখা হয়েছিল। সামনের অংশে গড়া হয়েছে ছোট্ট একটি স্মৃতির মিনার। এর সামনেও গড়ে উঠেছে বেশ কিছু দোকানপাট। এসব খুঁটিনাটি ভালোভাবে লক্ষ্য না করলে কেউ ভাবতেই পারবেন না, চার বছর আগে কত বড় একটা ধ্বংসযজ্ঞ এখানে ঘটে গেছে।

আরও পড়ুন-

রানা প্লাজার আহত শ্রমিকদের বয়ান জানবে বিশ্ব

রানা প্লাজার আহত শ্রমিকদের ৪২ শতাংশ বেকার

/জেইউ/টিএন/

সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
৩ মে ঢাকাসহ সারা দেশে বিক্ষোভ ডেকেছে ইসলামী আন্দোলন
৩ মে ঢাকাসহ সারা দেশে বিক্ষোভ ডেকেছে ইসলামী আন্দোলন
ইসলামী ব্যাংকের নোয়াখালী জোনের কর্মকর্তা সম্মেলন
ইসলামী ব্যাংকের নোয়াখালী জোনের কর্মকর্তা সম্মেলন
ওলামা দলের আংশিক কমিটি দিয়েছে বিএনপি
ওলামা দলের আংশিক কমিটি দিয়েছে বিএনপি
‘হিট ইমারজেন্সি’ জারির আহ্বান সাইফুল হকের
‘হিট ইমারজেন্সি’ জারির আহ্বান সাইফুল হকের
সর্বাধিক পঠিত
সরকারি না হলেও সলিমুল্লাহ কলেজে অধ্যাপক ১৪ জন
সরকারি না হলেও সলিমুল্লাহ কলেজে অধ্যাপক ১৪ জন
এগিয়েছে ‘ওমর’, চমকে দিলো ‘লিপস্টিক’!
ঈদের ছবিএগিয়েছে ‘ওমর’, চমকে দিলো ‘লিপস্টিক’!
মৈত্রী ট্রেনে তল্লাশি, মুদ্রা পাচারের অভিযোগে আটক দুই বাংলাদেশি
মৈত্রী ট্রেনে তল্লাশি, মুদ্রা পাচারের অভিযোগে আটক দুই বাংলাদেশি
মৌসুমের সব রেকর্ড ভেঙে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা চুয়াডাঙ্গায়
মৌসুমের সব রেকর্ড ভেঙে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা চুয়াডাঙ্গায়
আমরা সবাই ফেরেশতা, বাস করি বেহেশতে: রায়হান রাফী
আমরা সবাই ফেরেশতা, বাস করি বেহেশতে: রায়হান রাফী