X
বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪
১২ বৈশাখ ১৪৩১

‘আমরা এহন কী খাইয়্যাম? কীবায়ে বাঁচবাম?’

শফিকুল ইসলাম, হাওর থেকে ফিরে
২৮ এপ্রিল ২০১৭, ১৮:২১আপডেট : ২৯ এপ্রিল ২০১৭, ০৮:৩১

হাওরে তলিয়ে যাওয়া কাঁচাপাকা ধান হাতে দুই শিশু নেত্রকোনার আটপাড়া উপজেলার বানিয়াজান ইউনিয়নের সোনাইখালী গ্রামের বাসিন্দা গোলাবজান বিবির বয়স ৮০ বছর। বার্ধক্যজনিত কারণে শারীরিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়ায় সোজা হয়ে দাঁড়াতেও কষ্ট হয় তার। গত ২৫ এপ্রিল দুপুরে (১২টা-সাড়ে ১২টা) নীলপাড়ের সাদা সুতি কাপড় পরে খালি পায়ে অনেক লোকের মাঝে তিনিও দাঁড়িয়েছিলেন সোনাইখালী সেতুর ওপর।

সামনে টেংরাম হাওর। এই পথ দিয়ে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণমন্ত্রী মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মদন উপজেলার উচিৎপুর গ্রামের কয়রা হাওরের দিকে যাবেন। মাঝে এখানে থামবেন। খবরটি পেয়েই এসেছেন গোলাবজান বিবি। কেমন আছেন জানতে চাইলে তিনি আঞ্চলিক ভাষায় কথা বললেন বাংলা ট্রিবিউনের এই প্রতিনিধির সঙ্গে।

৮০ বছর বয়সী এই বৃদ্ধার স্বামী নেই, বেঁচে আছেন তিন ছেলেকে নিয়ে। ছেলেরা হাওরে মাছ ধরে। অন্যের জমিতে ধান চাষ করে। যা পায় তা দিয়েই পাঁচ নাতি-নাতনিকে নিয়ে বছর কেটে যায়। এবারের বন্যায় হাওরে চাষ করা ধান তলিয়ে গেছে। মাছ ভেসে গেছে। মন্ত্রীকে কাছে পেয়ে তার প্রশ্ন, ‘আমরা এহন কী খাইয়্যাম? (কী খাবো) কীবায়ে বাঁচবাম? (কীভাবে বাঁচবো)’

গোলাবজান বিবি বললেন, ‘১৫-২০ দিন আগের সেদিনের ঘটনা মৃত্যুর আগ মুহূর্ত পর্যন্ত মনে থাকবে। সেদিন ছিল মঙ্গলবার। দিনভর প্রচুর বৃষ্টি হচ্ছে। রাতে শুনলাম আশপাশের মানুষরা বৃষ্টি উপেক্ষা করে বাঁধের দিকে ছুটছে। আমার ছেলেদের ঘুম থেকে তুলে খবর নিতে বললাম, বাইরে কি হচ্ছে। তারা খবর নিয়ে এলো, বৃষ্টি আর পাহাড়ি ঢলের পানিতে বাঁধ ডুবে যাচ্ছে। গ্রামবাসীরা একত্রিত হয়ে বাঁধ রক্ষার চেষ্টা করছে। আমার তিন ছেলেও গেলো সেখানে। রাতভর চেষ্টা করেও শেষ রক্ষা হয়নি। ভোরের দিকে সবকিছু মুহূর্তে শেষ হয়ে গেলো। মলিন মুখে বাড়ি ফিরলো সবাই। আমার তিন ছেলেও ফিরলো। তাদের কাছে জানলাম সবই। পূবের আকাশ কিছুটা পরিষ্কার হয়ে এলে গুঁড়িগুঁড়ি বৃষ্টি উপেক্ষা করে আমিও হাওরের পাড়ে গিয়ে দেখি পানি আর পানি। কিচ্ছু নাই। সব ডুবে গেছে। কোথায় ধান? কোথায় বাদাম? সেসবের কোনও চিহ্ন পর্যন্ত নেই। মরার এতো পানি কোথা থেকে এলো কিছুই বুঝলাম না। জীবনে এত পানি দেখিনি।’

নেত্রকোনার হাওর অঞ্চলে পথে পথে কাঁচাপাকা ধানের স্তুপ মন্ত্রী আসবেন জেনে একই উপজেলার আটিকান্দা গ্রামের বাসিন্দা ষাটোর্ধ্ব কৃষক রমজান আলী ফকিরও মলিন মুখে এসেছিলেন সোনাইখালী ব্রিজের ধারে। কিছু দেবে কিনা কিংবা কী চান জানতে চাইলে উত্তরে তিনি আঞ্চলিক ভাষায় বলেন, ‘ঘরে খাবার নাই। না ডুবলে এতদিনে নতুন ধান ঘরে উঠে যেতো। কিন্তু বৃষ্টি আর পাহাড়ি ঢলে তলিয়ে গেছে ধান। সেই ধান যা পেরেছি কেটে এনেছি। কিন্তু তাতে চাল পাওয়া যায়নি। সব চিটা হয়ে গেছে। কারণ পরিপক্ক হয়নি।’

রমজান আলী ফকির আরও জানান, টেংরাম হাওরে ১৮ কাঠা জমিতে ইরি ২৯ লাগিয়েছিলেন তিনি। হাওরের পাশের উঁচু জমিতে লাগিয়েছিলেম বাদাম। সবই তলিয়ে গেছে পানিতে। তার কথায়, ‘মাসখানেক আগে থেকেই পানি বাড়ছিলো। কারণ বৃষ্টি হয়েছে অনেক। প্রথম ভাবলাম এটা হয়তো বৃষ্টির পানি, বৃষ্টি থেমে গেলেই সব ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু তা আর হলো না। কারণ এতে বৃষ্টির পানির সঙ্গে যোগ হয়েছে উজান থেকে আসা পাহাড়ি ঢল। ক্রমশ পানি বৃদ্ধির কারণে একের পর এক বাঁধ ভেঙে যাচ্ছে। ফলে চাষ করা ধান একটু একটু করে ডুবে যাচ্ছে।’

কুল কিনারা না পেয়ে ছেলেমেয়ে আর স্ত্রীকে নিয়ে হাওরে চাষ করা ধান কেটে আনতে নেমে যান রমজান আলী ফকির। কেটে আনলেনও। কিন্তু তাতে কাজ হলো না। কারণ ধানই যে পাকেনি! তিনি বলেছেন, ‘পাকার আগেই পানিতে ডুবে যাওয়া ধান কেটে এনেছি। আর মাত্র ১০-১২ দিন সময় পেলেই ধান পেকে যেতো। তখন ডুবে যাওয়া ধান থেকেও কিছু চাল পেতাম। এখন তো আমরা নিঃস্ব। এতদিন হলো কোনও সাহায্য পেলাম না। কেউ দেখতেও এলো না। আজ মন্ত্রী আসবে বলে কত লোকজনই না দেখলাম।’

একই দিন সকাল সোয়া ১০টায় নেত্রকোনার বারহাট্টা উপজেলার তাহেরা-মান্নান স্মৃতি উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে কথা হয় একই উপজেলার চিরাম ইউনিয়নের ৬ নং ওয়ার্ডের বাসিন্দা আনোয়ার হোসেনের সঙ্গে। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনামন্ত্রী মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া ও স্থানীয় সংসদ সদস্য যুব ও ক্রীড়া উপ-মন্ত্রী আরিফ খান জয় এসেছিলেন বন্যাদুর্গত হাওরবাসীকে ত্রাণ দিতে। সেই ত্রাণের আশায় স্কুল মাঠে টাঙানো সামিয়ানার নিচে পাতা বেঞ্চে বসেছিলেন বারহাট্টা উপজেলার চিরাম ইউনিয়নের ৬ নং ওয়ার্ডের বাসিন্দা আনোয়ার হোসেন। বয়স আনুমানিক ৫০-৫৫ বছর। কিন্তু স্থানীয় চেয়ারম্যানের দেওয়া স্লিপ না থাকায় ত্রাণ না পেয়ে হতাশা নিয়ে গালে হাত রেখে বিষণ্ন মনে বসেছিলেন তিনি।

পানিতে নেমে ধানা কাটার চেষ্টা করে ৩৫ কেজি ধান তুলতে পেরেছেন বলে জানান আনোয়ার হোসেন। এর মাধ্যমে সর্বোচ্চ ২০-২২ কেজি চাল পাওয়া যেতে পারে বলে মনে হচ্ছে তার। কিন্তু এই চাল দিয়ে বছর যাবে কীভাবে? তাই স্থানীয় প্রশাসনের মাইকিং শুনে তাহেরা-মান্নান স্মৃতি উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে এসেছেন ত্রাণের আশায়।

বাংলা ট্রিবিউনকে আনোয়ার হোসেন বলেন, ‘গত ৩০-৩৫ বছরে এ অঞ্চলের হাওরে এত পানি আসেনি। এ বছরই হঠাৎ পানি এসে আমাদের সবকিছু ডুবিয়ে দিলো। এক রাতের মধ্যে তলিয়ে গেলো স্ত্রী-সন্তান নিয়ে বেঁচে থাকার সারাবছরের সঞ্চয়। সিঙ্গুর হাওরের ৯ কাঠা জমিতে চাষ করেছিলাম ইরি ২৯। সকালে হাওরের পাড়ে গিয়ে দেখি সব পানির নিচে।’

এরপর চোখেমুখে অন্ধকার নেমে আসায় পানিতে নেমে ধানা কাটার চেষ্টা করে ৩৫ কেজি ধান তুলতে পেরেছেন বলে জানান আনোয়ার হোসেন। এর মাধ্যমে সর্বোচ্চ ১২-১৪ কেজি চাল পাওয়া যেতে পারে বলে মনে হচ্ছে তার। কিন্তু এই চাল দিয়ে বছর যাবে কীভাবে? তাই স্থানীয় প্রশাসনের মাইকিং শুনে তাহেরা-মান্নান স্মৃতি উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে এসেছেন ত্রাণের আশায়। কিন্তু স্থানীয় চেয়ারম্যানের দেওয়া স্লিপ না থাকায় ত্রাণ না পেয়ে হতাশা নিয়ে বসেছিলেন তিনি।

বাংলা ট্রিবিউনকে আনোয়ার হোসেন বলেন, ‘গত ৩০-৩৫ বছরে এ অঞ্চলের হাওরে এত পানি আসেনি। এ বছরই হঠাৎ পানি এসে আমাদের সবকিছু ডুবিয়ে দিলো। এক রাতের মধ্যে তলিয়ে গেলো সারাবছরের সঞ্চয়। সিঙ্গুর হাওরের ৬ বিঘা জমিতে চাষ করেছিলাম ইরি ২৯। সকালে হাওরের পাড়ে গিয়ে দেখি সব পানির নিচে।’

একই মাঠে কথা হয় বারহাট্টা উপজেলার চিরাম ইউনিয়নের কৃষক হাফিজ উদ্দিনের সঙ্গে। তিনি জানান, স্থানীয় ধামারুক হাওরের ৮ কাঠা জমিতে ধান চাষ করেছিলেন তিনি। পাননি এক কেজি ধানও। সবই ডুবে গেছে। ঘরের ১৩টি হাঁসও ভেসে গেছে বানের পানিতে। ৪টি ছাগল বিক্রি করে দিয়েছেন ঘাসের অভাবে।

একই ইউনিয়নের রহমত আলী ডাকায়া টেংরাম হাওরের ১৬ কাঠা জমিতে চাষ করেছিলেন ইরি। তারও জমি পুরোটাই তলিয়ে গেছে। সেই তলিয়ে যাওয়া ধান যতটুকু পেরেছেন কেটে এনে দেখেন অধিকাংশই কাঁচা। সব মিলিয়ে ২৬-২৭ কেজি হবে। সেগুলোই ছেটে শুকানোর চেষ্টা করছেন এখন। পথের ধারে শুকাতে দেওয়া এই ধান দুই দফায় বৃষ্টিতে ভিজেছে। তাই ওই ধানে যে কতো চাল পাওয়া যাবে আর তা দিয়ে কী হবে সেইসব ভেবে দিশেহারা তিনি।

মদন উপজেলার উচিতপুর গ্রামের বাসিন্দা ৬৭ বছরের বৃদ্ধ সেকেন্দার মিয়ার সঙ্গে এই প্রতিবেদকের কথা হলো বালুর ট্রলার ঘাটে। তিনি বলেন, ‘মদনের পাগলার হাওরে ১১ কাঠা জমিতে ধান লাগিয়েছিলাম। বন্যার পানিতে সব তলিয়ে গেছে। যতোদূর পেরেছি কেটে এনেছি।’

রাস্তার ওপরে পলিথিন দিয়ে ঢেকে রাখা দূরের একটি স্তুপ হাত দিয়ে দেখিয়ে সেকেন্দার আলী এ প্রতিবেদককে বলেন, ‘ওই যে আমার ধান। ঢেকে রেখে দিয়েছি পলিথিন দিয়ে। মাড়াইও করতে পারিনি। বৃষ্টি হচ্ছে। কীভাবে মাড়াই করবো? গরু ছিল তিনটি। শুকনো জায়গা নেই। বাঁধের ওপর রেখেছিলাম। বাধ ভেঙে যাচ্ছে দেখে কোনোরকম গরুগুলোকে রাস্তায় তুলতে পেরেছিলাম। তা না হলে তো বাঁচাতে পারতাম না। গরুর খাবার ঘাস, খড় কিছুই নেই। সব ডুবে গেছে। তাই বিক্রি করে দিয়েছি। ভালো দাম পাই নাই। অর্ধেকের চেয়েও কম দামে বেচে দিয়েছি।’

কয়রা হাওর পড়ে নির্মিত মঞ্চে থেকে ত্রাণমন্ত্রীর বিতরণ করা ত্রাণসামগ্রী হিসেবে দেওয়া ১৫ কেজি চাল ও নগদ ৫০০ টাকা পেয়েছেন মদন উপজেলার কুলিয়াটি গ্রামের কৃষক তোরাব আলী। সকাল থেকে অপেক্ষা শেষে বেলা ২টা দিকে মাথায় চালের ব্যাগ নিয়ে বাড়ির দিকে রওনা দেন তিনি। সঙ্গে ৫ ও ৭ বছর বয়সী দুই মেয়ে। হাঁটতে হাঁটতেই কথা হয় তার সঙ্গে।

কয়রা হাওরে লাগানো ১৯ কাঠা জমির ধান কীভাবে পানির নিচে চলে গেলো তা জানিয়ে কৃষক তোরাব আলী বললেন, ‘হাওরের মধ্য দিয়ে গড়ে তোলা বাঁধ আমরা বিনা পারিশ্রমিকে ঠিকাদারের শ্রমিকদের নিয়ে একসঙ্গে নির্মাণ করেছিলাম। ভেবেছিলাম বাধ রক্ষা করা গেলে জমির ধান ও বাদাম উভয়ই রক্ষা করা যাবে। কিন্তু পারিনি।’

/এসআই/জেএইচ/

আরও পড়ুন-
কাঁচাপাকা ধানই এখন হাওরের কৃষকদের সম্বল

সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
ওসির বিরুদ্ধে চেয়ারম্যান প্রার্থীর পক্ষে কাজের অভিযোগ
ওসির বিরুদ্ধে চেয়ারম্যান প্রার্থীর পক্ষে কাজের অভিযোগ
মেলায় জাদু খেলার নামে ‘অশ্লীল নৃত্য’, নারীসহ ৫ জন কারাগারে
মেলায় জাদু খেলার নামে ‘অশ্লীল নৃত্য’, নারীসহ ৫ জন কারাগারে
বাংলাদেশ ব্যাংকের চাকরি ছাড়লেন ৫৭ কর্মকর্তা
বাংলাদেশ ব্যাংকের চাকরি ছাড়লেন ৫৭ কর্মকর্তা
কেন গলে যাচ্ছে রাস্তার বিটুমিন?
কেন গলে যাচ্ছে রাস্তার বিটুমিন?
সর্বাধিক পঠিত
সিয়াম-মেহজাবীনের পাল্টাপাল্টি পোস্টের নেপথ্যে…
সিয়াম-মেহজাবীনের পাল্টাপাল্টি পোস্টের নেপথ্যে…
‘মারামারি’র ঘটনায় মিশা-ডিপজলের দুঃখপ্রকাশ
‘মারামারি’র ঘটনায় মিশা-ডিপজলের দুঃখপ্রকাশ
মিয়াবতী থেকে পিছু হটলো মিয়ানমারের বিদ্রোহীরা?
মিয়াবতী থেকে পিছু হটলো মিয়ানমারের বিদ্রোহীরা?
আজকের আবহাওয়া: কোথায় কেমন গরম পড়বে
আজকের আবহাওয়া: কোথায় কেমন গরম পড়বে
‘বয়কট’ করা তরমুজের কেজি ফের ৬০ থেকে ১২০ টাকা
‘বয়কট’ করা তরমুজের কেজি ফের ৬০ থেকে ১২০ টাকা