X
শনিবার, ১৮ মে ২০২৪
৪ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১

কানে না ‘শোনা’ এখন অতীত

জাকিয়া আহমেদ
০৬ জুন ২০১৭, ০৯:৫০আপডেট : ০৬ জুন ২০১৭, ১৮:০১

কানে না ‘শোনা’ এখন অতীত

ছেলের বয়স যখন ৯ মাস তখনই বুঝতে পারছিলাম, ছেলে আমার আর দশটা বাচ্চার মতো না। কান্না করে না, ডাকলে তাকায় না, কোনও কিছুতেই তার রেসপন্স নেই। তখন থেকেই ছেলেকে নিয়ে যুদ্ধ শুরু হয় আমার। চিকিৎসার জন্য নিয়ে আসি এখানে। কিন্তু পরিবারের সহযোগিতা পাইনি। এধরনের অপারেশন দেশে এখনও প্রচার পায়নি, তাই পরিবারের সদস্যরা বাধা দিয়েছে অপারেশন করতে দেবে না। আমি চুপ ছিলাম, কিন্তু আমি আমার কাজ করে গেছি। পরিবারের অন্য সবার বিরুদ্ধে গিয়ে স্বামী আমাকে এ যুদ্ধে সাহস দেন। তারপরও অনেকটা সময় পেরিয়ে এসে গত দুই মাস আগে ছেলের অপারেশন হয়। এই দুই  মাসেই ওর অনেক পরিবর্তন আমি দেখতে পাচ্ছি। ছেলে আমার এখন ডাকলে সাড়া দেয়। আমি বুঝতে পারি সে আমার কথা শুনতে পাচ্ছে। ডাক দিলে পেছনে ফিরে তাকাচ্ছে, নানা শব্দ করছে। আমি শুধু এই দিনগুলোর অপেক্ষাতেই ছিলাম।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের সি ব্লকের নাক, কান গলা বিভাগের একটি কক্ষে বসে কথাগুলো বলছিলেন সুমাইয়া মাহজুবা। সাড়ে পাঁচ বছরের একমাত্র ছেলে মাধুর্যকে নিয়ে এই সংগ্রামের কথা বলতে গিয়ে বারবার তিনি চোখ মুছছিলেন। সুমাইয়া বলেন, পরিবারের অমতে যাওয়ার সিদ্ধান্ত যে আমার ভুল ছিল না, সেটি এখন আমার ছেলে প্রমাণ করে দিচ্ছে।

জানা গেল, মাধুর্য ছিল জন্ম থেকে বধির, যাকে বলা হয় শ্রবণ প্রতিবন্ধী। আর মাধুর্যর মতো এমন দেড় শতাধিক শিশুকে শ্রবণ প্রতিবন্ধকতা থেকে মুক্তি দিয়েছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের কক্লিয়ার ইমপ্লান্ট কর্মসূচি। এই কর্মসূচির আওতায় দেড় শতাধিক শ্রবণ প্রতিবন্ধী শিশু কক্লিয়ার ইমপ্লান্ট সার্জারি করে স্বাভাবিক জীবন ফিরে পেয়েছে। কক্লিয়ার ইমপ্লান্ট-জীবন বদলে দেওয়া এক অসাধারণ আধুনিক চিকিৎসা ব্যবস্থা। মাধুর্যর মতো হুমায়রা, অনিকসহ শিশুরা এখন শব্দের জগতে ফিরে এসেছে, মূলধারার স্কুলগুলোতে তারা পড়ছে, নাচ আর গান শিখছে। আর চিকিৎসকরা বলছেন, কক্লিয়ার ইমপ্লান্ট কর্মসূচির আওতায় চিকিৎসা নেওয়া শিশুরা শব্দের জগতে বিচরণ করছে, এ যেন তাদের নতুন জীবন।

কক্লিয়ার ইমপ্লান্ট কর্মসূচির পরিচালক অধ্যাপক ডা. আবুল হাসনাত জোয়ারদার বলেন, ২০১০ সালে তারই তত্ত্বাবধানে বিএসএমএমইউ’র নাক, কান ও গলা বিভাগে এই কার্যক্রম শুরু হয়। আর এখন এখানে তারই নেতৃত্বে একটি সার্জিক্যাল টিম কক্লিয়ার ইমপ্লান্ট সার্জারি করছেন। তিনি বলেন,এই কার্যক্রম শুরু হওয়ার আগে বিদেশে গিয়ে কোটি টাকা ব্যয়ে এই সার্জারি করতে হতো। কিন্তু এখন আর বিদেশে যাওয়ার প্রয়োজন হয় না, বিএসএমএমইউতে ইমপ্লান্ট কিনে ২৫ হাজার টাকা দিয়ে এই সেবা পাওয়া যায়। যারা এই টাকা দিতে অপারগ, তাদেরকে বিনামূল্যে এই সেবা দেওয়া হয়ে থাকে।

এই প্রকল্পের আওতায় এ পর্যন্ত ১৩১ জন রোগীর অস্ত্রোপচার হয়েছে এবং ২০১৬-১৭ অর্থবছরে আরও ৫০ জন শ্রবণ প্রতিবন্ধী শিশু বিনামূল্যে এই চিকিৎসা পাবে বলেও জানা গেছে। এছাড়াও, বিএসএমএমইউ’র এই বিভাগ থেকে ২১ জন নিজ খরচে ইমপ্লান্ট বসিয়ে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে এসেছেন।

কক্লিয়ার ইমপ্লান্ট কার্যক্রমের কর্মসূচি পরিচালক অধ্যাপক ডা. আবুল হাসনাত জোয়ারদার বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘কক্লিয়ার ইমপ্লান্ট এক ধরনের ইলেকট্রনিক্স ডিভাইস যা কিনা মারাত্মক বা সম্পূর্ণ বধির ব্যক্তিকে শব্দ শুনতে সহায়তা করে। এটাকে বায়োনিক ইয়ারও বলা হয়।তবে উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন হিয়ারিং এইড ব্যবহার করেও যারা শুনতে পারেন না তাদের জন্যই এই কক্লিয়ার ইমপ্ল্যান্ট। দুইভাগে বিভক্ত এই ডিভাইসের একটি অংশ অপারেশনের মাধ্যমে অন্তঃকর্ণের কক্লিয়াতে স্থাপন করা হয়, যার ভেতরের অংশে থাকে রিসিভার স্টিমুলেটর আর কানের বাইরে থাকা আরেকটি অংশে থাকে মাইক্রোফোন, স্পিচ প্রসেসর এবং ট্রান্সমিটার।’

কানে না ‘শোনা’ এখন অতীত

ডা.আবুল হাসনাত জোয়ারদার আরও বলেন, ‘কক্লিয়ার ইমপ্লান্টের কাজ হলো বাইরের শব্দ মাইক্রোফোনের মাধ্যমে নিয়ে এনালগ ইলেকট্রিক সিগনালে পরিবর্তন করা। তারপর স্পিচ প্রসেসরের মাধ্যমে সে সিগনাল প্রসেসিং করে কোডেড ডিজিটাল সিগনালে রূপান্তর করা। অপারেশনের তিন থেকে ৪ দিন পর যখন কানের বাইরে থাকা মেশিন লাগিয়ে সুইচ অন করা হয় সেদিন থেকেই শিশুটি শব্দের জগতে আসে, সেদিন থেকেই সে শব্দ শুনতে পায়। এরপর ৩ থেকে ৬ মাস সময় দরকার হয় তার বিভিন্ন শব্দের সঙ্গে পরিচিত হতে।

সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, এই অপারেশনের জন্য তিন থেকে চার ঘন্টা সময় প্রয়োজন এবং এখানে সফলতার হার শতকরা একশভাগ। দুই থেকে তিনদিন পরই রোগী হাসপাতাল থেকে চলে যেতে পারে, তবে অপারেশনের পর দীর্ঘদিন নিতে হয় অডিটরি রিহেবিলিটেশন।

বিএসএমএমইউ’র অডিটরি রিহেবিলিটেশন থেরাপির দায়িত্বে থাকা নাক-কান-গলা বিভাগের অডিটরি রিহেবিলিটেশন থেরাপি অফিসার অনিতা রানী রায় বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘নানা ধরনের শব্দের মাধ্যমে শিশুদের পরিচিত করিয়ে তাদের শুনতে পাওয়ার অভ্যাস তৈরি করে দেই আমরা। শোনার অভ্যাস তৈরি হলেই একসময় সে কথা বলতে শুরু করে।’

অনিতা রায় হাসতে হাসতে বলেন, ‘যেসব শিশু একসময় শুনতে পেতো না, কথা বলতে পারতো না, তারা এখন ঝগড়াও করছে। বিষয়টি একটু অন্যরকম হলেও আমাদের জন্য আনন্দের।’

ইমপ্লান্ট সার্জারির উপযুক্ত বয়স ৩ বছর উল্লেখ করে অধ্যাপক ডা. আবুল হাসনাত জোয়ারদার বলেন, ‘প্রতিদিনই বাড়ছে ইমপ্লান্ট গ্রহীতার সংখ্যা। কিন্তু সরকারিভাবে সীমিত সংখ্যক ইমপ্লান্ট দেওয়ার সুযোগ থাকায় সবাইকে তা দিতে পারছি না। এটা কষ্টের।’

/টিএন/

সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
পুতিনের চীন সফর: শি’র মন জয়ের চেষ্টায় ব্যস্ত ছিলেন রুশ নেতা
পুতিনের চীন সফর: শি’র মন জয়ের চেষ্টায় ব্যস্ত ছিলেন রুশ নেতা
খেটে খাওয়া মানুষের ভাগ্যোন্নয়নের বাজেট দাবি
খেটে খাওয়া মানুষের ভাগ্যোন্নয়নের বাজেট দাবি
ন্যায়বিচার পাওয়া প্রত্যেকের মৌলিক অধিকার: প্রধান বিচারপতি
ন্যায়বিচার পাওয়া প্রত্যেকের মৌলিক অধিকার: প্রধান বিচারপতি
খারকিভে হামলা আরও তীব্র করবে রাশিয়া, আশঙ্কা ইউক্রেনের
খারকিভে হামলা আরও তীব্র করবে রাশিয়া, আশঙ্কা ইউক্রেনের
সর্বাধিক পঠিত
অতিরিক্ত ডিআইজি মনিরুজ্জামানের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ ইসির
অতিরিক্ত ডিআইজি মনিরুজ্জামানের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ ইসির
যাত্রীর জামাকাপড় পুড়িয়ে পাওয়া গেলো সাড়ে চার কোটি টাকার স্বর্ণ
যাত্রীর জামাকাপড় পুড়িয়ে পাওয়া গেলো সাড়ে চার কোটি টাকার স্বর্ণ
দাম কমেছে সবজি-মাংসের, তবু পরিস্থিতি অস্বাভাবিক
দাম কমেছে সবজি-মাংসের, তবু পরিস্থিতি অস্বাভাবিক
সুপ্রিম কোর্ট রিসার্চ ইনস্টিটিউটের স্থান পরিদর্শন প্রধান বিচারপতির
সুপ্রিম কোর্ট রিসার্চ ইনস্টিটিউটের স্থান পরিদর্শন প্রধান বিচারপতির
কোথায় কীভাবে কেএনএফ সদস্যদের প্রশিক্ষণ দেয়, জানালেন নারী শাখার প্রধান
কোথায় কীভাবে কেএনএফ সদস্যদের প্রশিক্ষণ দেয়, জানালেন নারী শাখার প্রধান