আনন্দের বারতা নিয়ে আসে ঈদ। ঈদ সবার খুশীর। কথাগুলো চিরন্তন সত্য হলেও অনেক সময় এর ব্যত্যয় ঘটে। তখন এই ঈদ হয় কষ্টের ও বেদনার। ব্যক্তি পর্যায় ছাড়াও কথাগুলোর ব্যত্যয় অনেক সময় অঞ্চলভিত্তিকও হয়। এ বছর যেমন— দেশের হাওর অধ্যুষিত হয়েছে ছয় জেলার মানুষের মুখে হাসি নেই। কারণ অপ্রত্যাশিতভাবে অতিবৃষ্টি ও হাওরের বাঁধ ভেঙ্গে পানিতে তলিয়ে গেছে জমির ফসল। মার্চে জমির ফসল হারিয়ে ওই অঞ্চলের মানুষ নিঃস্ব হয়ে গেছেন।
যেখানে একজন কৃষক একশ মন ধান পেতেন, এ বছর সেই কৃষক এক মন ধানও পাননি। এখনও এ অঞ্চলের অনেক মানুষকে সরকারের ত্রাণের ওপর নির্ভর করেই দিন পার করতে হচ্ছে। যারা ইজ্জতের দিকে তাকিয়ে সরকারি ত্রাণ আনতে যাননি, তাদেরতো দুরবস্থা আরও ভয়াবহ। যে পরিবার বছরে তিন থেকে চারশ মন ধান পেতো সেই পরিবারও ধার করে বা অন্যের সহযোগিতা নিয়ে সংসার চালাচ্ছে। এসব পরিবার ঈদের বাড়তি খরচ যোগাবে কোত্থেকে?
অন্যদিকে, গত ১২ জুন রাতে প্রবল বর্ষণে রাঙামাটি, বান্দরবান, খাগড়াছড়ি ও চট্টগ্রামসহ দেশের ছয় জেলায় দেড় শতাধিক মানুষের প্রাণহানি ঘটেছে। পাহাড়ের ভুমি ধসে ১৬৬ জন মানুষের প্রাণ চলে গেছে বলে জানিয়েছে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয়। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে রাঙামাটি জেলা। এই জেলায় মারা গেছেন ১২০ জন সাধারণ মানুষ। জেলা প্রশাসনের হিসাবে শুধু রাঙামাটি পাহাড় ধসে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের সংখ্যা প্রায় দুই হজারের মতো। এর বাইরে রয়েছে বান্দরবান, খাগড়াছড়ি, চট্টগ্রামের একটি অংশ ও কক্সবাজার জেলা। এই দুর্যোগের যারা কাছের মানুষ হারিয়েছেন, তাদের মুখে হাসি নেই এই ঈদে। আর যারা বেঁচে আছেন, তাদের অনেকেই আহত হয়েছেন। কেউ পঙ্গু হয়েছেন। কেউ বাড়ি-ঘর হারিয়েছেন। কেউ হারিয়েছেন সহায়-সম্বল। অনেকে এখনও আশ্রয় কেন্দ্রে অবস্থান করছেন। এখনও বৃষ্টি থামেনি। ঈদের মধ্যে যদি আবার বৃষ্টি হয় এবং আবারও এমন ঘটনা ঘটে— এই আশঙ্কায় সরকার আগামী ১৫ জুলাই পর্যন্ত সরকারি আশ্রয়কেন্দ্রগুলো চালু রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। আশ্রয় কেন্দ্রে অবস্থান নেওয়া এসব মানুষকে খাবার, ওষুধসহ চিকিৎসা সেবা দেওয়া হচ্ছে। এ অবস্থায় এবারের ঈদে এসব মানুষের মুখে হাসি নেই।
জানা গেছে, দেশের হাওর অঞ্চল নামে খ্যাত কিশোরগঞ্জ, হবিগঞ্জ, সুনামগঞ্জ, নেত্রকোনা, মৌলবীবাজার ও সিলেটের বিভিন্ন উপজেলায় অকাল বন্যায় ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে, নেত্রকোনা, কিশোরগঞ্জ ও সুনামগঞ্জ। এ সব জেলার অধিকাংশ ফসল তলিয়ে গেছে। আর ১০ থেকে ১২টা দিন সময় পেলে এই বন্যা ফসলের তেমন ক্ষতি করতে পারতো না। কিন্তু তা আর হয়নি। পানিতে তলিয়ে যাওয়া আধা পাকা ধানই তারা তুলে এনেছেন, কিন্তু তাতে শ্রমটাই গেছে। কাজের কাজ কিছু হয়নি বলে জানিয়েছেন স্থানীয় বাসিন্দারা।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে সুনামগঞ্জের জেলা প্রশাসক সাবিরুল ইসলাম বাংলা ট্রিবিউনকে জানিয়েছেন, হওর এলাকায় সরকারি ত্রাণ দেওয়া অব্যাহত রয়েছে। প্রতি পরিবারকে মাসে ৩০ কেজি চাল ও ৫০০ টাকা দেওয়া হচ্ছে। জেলা প্রশাসন থেকে জেলার দুঃস্থ পরিবারকে ঈদের জন্য সেমাই চিনিসহ প্রয়োজনীয় সুবিধা দেওয়া হচ্ছে। বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারও এ সুবিধা পাচ্ছে।
অন্যদিকে, কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক আলী হোসেন বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘জেলার যে সব এলাকায় পাহাড় ধসের ঘটনা ঘটেছে সেই সব এলাকার মানুষদের জন্য সরকারি সহায়তা অব্যাহত রয়েছে এবং তা থাকবে। বিষয়টি বিচেনায় নিয়েই সরকার আগামী ১৫ জুলাই পর্যন্ত আশ্রয়কেন্দ্রগুলো খোলা রাখা হয়েছে। যেখানে খাবারসহ চিকিৎসা সেবা দেওয়া হচ্ছে। তবে এলাকায় এই ঈদের সময় মানুষের মনে তো চাপা কান্না আছে। কেউ স্বজন হারিয়েছেন। কেউ সহায়-সম্বল হারিয়েছেন। কেউ নিজের সক্ষমতা হারিয়েছেন। এমন অবস্থায় ঈদের আনন্দ করা তো অসম্ভব।’
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, পার্বত্য তিন জেলায় ক্ষতিগ্রস্ত উপজেলাগুলোতে প্রতিদিনই নানা সামাজিক সংগঠন, বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ত্রাণ সহযোগিতা দিয়ে যাচ্ছে। পাহাড় ধসের পর তাৎক্ষণিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোর মধ্যে ২০ কেজি চাল, শুকনো খাবার দেওয়া হচ্ছে।
/এসএমএ/আপ-এআর/