X
শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪
১৫ চৈত্র ১৪৩০

‘পাঞ্জাবিটা ট্রাংকে পইড়া আছে, পইরাও দেখতে পারলাম না’

নুরুজ্জামান লাবু
২৭ জুন ২০১৭, ০২:২৫আপডেট : ২৮ জুন ২০১৭, ১৪:৫১

‘পাঞ্জাবিটা ট্রাংকে পইড়া আছে, পইরাও দেখতে পারলাম না’ ‘ঈদের জন্য একটা পাঞ্জাবি কিনছিলাম। পাঞ্জাবিটা ট্রাংকেই পইড়া আছে। ছুটি চাইছিলাম, কিন্তু পাই নাই। উল্টা ঈদের জন্য দুই ঘণ্টা আগে থিকা ডিউটি শুরু হইছে। আমাদের ঈদ নাইরে ভাই! স্ত্রী-ছেলেমেয়েরা বাড়িতে রাগ কইরা বইসা আছে। ২৩ বছরের চাকরি জীবনে আইজকার মতো মনটা এত বেশি খারাপ হয়নি আমার’— বিষণ্ন মনে বাংলা ট্রিবিউনকে বলছিলেন কনস্টেবল মনিরুজ্জামান। ঈদের সারাদিন রাস্তায় দায়িত্ব পালন করতেই কেটে গেছে তার।

এমন পুলিশ সদস্য আরও অনেক। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর এই বিভাগের বেশিরভাগ সদস্যকেই পরিবার-পরিজন ছেড়ে দেশ ও জনগণের কল্যাণে ঈদে দায়িত্ব পালন করেছেন। বিশেষ করে থানা পুলিশ ও ট্রাফিক বিভাগের সদস্যরা ঈদের নামাজ পড়া কিংবা সেমাই-পায়েস খাওয়ার ফুরসতও পাননি।

‘পাঞ্জাবিটা ট্রাংকে পইড়া আছে, পইরাও দেখতে পারলাম না’ ঈদের দিন সকালে দেখা গেলো, কনস্টেবল মনিরুজ্জামান চুপচাপ বসেছিলেন গাড়িতে। বোঝা যাচ্ছিল তার মন ভালো নেই। এর কারণ কী তা নিয়ে শুরুতে কথাই বলতে চাইলেন না। পরে অবশ্য নিজ থেকেই মন খারাপের কারণ বর্ণনা করলেন।

মনিরুজ্জামান বাংলা ট্রিবিউনকে জানালেন, তার গ্রামের বাড়ি মানিকগঞ্জে। স্ত্রী ও তিন মেয়ে থাকে গ্রামে। ঈদের ছুটির জন্য আবেদন করেছিলেন। ঈদের জন্য পাঞ্জাবি কিনে রেখেছেন। ৫ কেজি আম কিনে রেখেছেন বাড়িতে নিয়ে যাওয়ার জন্য। স্ত্রী-সন্তানদের জন্য অবশ্য আগেই কেনাকাটা করে পাঠিয়ে দিয়েছেন। কিন্তু শেষ মুহূর্তে ছুটি পাননি তিনি। স্ত্রী-সন্তানেরা অভিমান করেছে। বাড়িতে বিশেষ কোনও রান্নাও করেনি। এ কারণে তিনি নিজেও রাগ করে থানা থেকে আয়োজন করা সেমাই এবং পোলাও মাংস খাননি। সকালে মুড়ি আর আম খেয়ে বেরিয়েছেন চাকরি করতে।

মনিরুজ্জামান বাংলা ট্রিবিউনকে বলছিলেন, ‘এবারের মতো এতটা মন খারাপ আর কখনও হয় নাই। বাড়িতে সবাই কষ্ট পাওয়ায় ঈদটাই মাটি হয়ে গেছে! ঈদের জন্য একটা পাঞ্জাবি কিনছিলাম, সেইটা ব্যারাকের ট্রাংকেই পইড়া আছে, পইরাও দেখতে পারলাম না। চাকরি যেহেতু করি কিচ্ছু করার নাই। মানুষের নিরাপত্তার জন্য আমাদের তো দায়িত্ব পালন করতেই হবে, তাই করছি।’

ঈদের দিন ভোর ৬টা থেকে দায়িত্ব শুরু করা কলাবাগান থানার উপ-পরিদর্শক (এসআই) কুতুব উদ্দিন বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘পুলিশের চাকরিতে ঈদ বা পূজা-পার্বণ বলে কিছু নেই। সরকারি দায়িত্ব পালন করতে হবে। তাছাড়া সবাইকে তো ছুটি দেওয়াও সম্ভব নয়। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সবাই ছুটি কাটালে নিরাপত্তা দেবে কে?’

কুতুব উদ্দিনের স্ত্রী-সন্তানরা থাকে নওগাঁর তিলকপুরে। ঈদুল আজহায় ছুটি নেবেন বলে এবার ঈদে দায়িত্ব পালন করছেন তিনি। কিন্ত কোরবানির ঈদেও ছুটি পাবেন কিনা তা নিয়ে সংশয় কাটেনি তার।

পুলিশের এই কর্মকর্তা বাংলা ট্রিবিউনকে বলছিলেন, ‘থানার ব্যারাকে থাকি। সকালে পোশাক পরা অবস্থায় একফাঁকে ঈদের নামাজ পড়েছি। ঈদ উপলক্ষে থানা থেকে আয়োজিত সেমাই ও পোলাও-মাংস খেয়েছি। তবুও স্ত্রী-সন্তানের জন্য মনটা পুড়ছে! যদিও সকালে ফোনে কথা হয়েছে আমাদের। ছোট ছেলেটার খুব মন খারাপ। কিন্তু কিছুই করার নেই। দেশসেবায় নিয়োজিত থাকতে হবেই।’

ঢাকা মহানগর পুলিশের পশ্চিম বিভাগে কর্মরত ট্রাফিক কনস্টেবল গোলাম মোস্তফার স্ত্রী-সন্তান থাকে নাটোরে। তার ঠিকানা রাজারবাগ ব্যারাক। তিনি খাওয়া-দাওয়া করেন রাজারবাগের ক্যান্টিনে খান তিনি। কিন্তু ঈদের দিন সেটি বন্ধ। সকালের খাবারের জন্য আশেপাশের হোটেলও খোলা পাননি। যারা মেসে খায় তাদের বিশেষ ব্যবস্থা ছিল। কিন্তু যারা ক্যান্টিনে খায় তাদের রুটি-কলা খেয়ে থাকতে হচ্ছে। তিনি বলেন, ‘আমাদের তো ঈদ বলে কিছু নাই। কারণ আমাদের রাস্তায় থাকতে হয়। সকালে পরিবারের সবার সঙ্গে কথা বলছি। তাদের মন বিষণ্ন। কিন্তু মন খারাপ করে কী হবে! কোরবানির ঈদ বাড়িতে উদযাপন করবো বলে এবার তাদের সান্ত্বনা দিয়েছি।’ ‘পাঞ্জাবিটা ট্রাংকে পইড়া আছে, পইরাও দেখতে পারলাম না’

জীবিকার জন্যও রাস্তায়
নিরাপত্তার জন্য পুলিশ সদস্যরা যেমন ঈদের দিনও দায়িত্ব পালন করেন, আবার জীবিকার প্রয়োজনেও ঈদের পুরো দিন রাস্তায় কাটিয়ে দেন অন্য অনেক পেশার লোকজন। বিশেষ করে রিকশা চালক, সিএনজি চালক, বাস চালক, বেসরকারি নিরাপত্তাকর্মী, পরিচ্ছন্নতাকর্মীসহ অনেকেই জীবিকার তাগিদে ঈদের দিনেও থাকেন রাস্তায়। ঈদ তাদের জন্য তেমন কোনও আনন্দ বয়ে আনতে পারে না। বরং পরিবার থেকে দূরে থাকার কারণে তাদের কাছে ঈদ হয়ে থাকে কষ্টের।

ঈদের দিন বাস-সিএনজি-রিকশাচালকদের বেশি দেখা যায় ঢাকার অলিগলিতে। কেউ কেউ সকালে পরিবারের সঙ্গে ঈদ করে তারপর ভাড়ায় খাটার জন্য গাড়ি নিয়ে বের হন। কিন্তু বেশিরভাগ রিকশাচালক ঈদের দিন একটু বাড়তি আয়ের জন্য পরিবারের সঙ্গে ঈদ না করে থেকে যান ঢাকায়। তাদেরই একজন শামীম হোসেন। পাবনায় গ্রামের বাড়ি তার।

শামীম বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘গ্যারেজে থাকি। বাড়িতে যাই নাই। সকালে রুটি-কলা খাইছি। দুপুরে মহাজন বাসায় নিয়ে খাওয়াইছে। ঈদের কয়েকদিন রাস্তা ফাঁকা থাকবো। এ সময়টাতে একটু বেশি ইনকামের আশায় আছি।’

বাংলা ট্রিবিউনকে শামীম আরও বলেন, “সকালে মা-বাবার সঙ্গে মোবাইলে কথা হইছে। মা ফোন কইরাই কাইন্দা দিছে। বলতেছেন, ‘তুই বাড়িতে আইলি না ক্যান?’ এজন্য মনটা একটু খারাপ হইছে। কিন্তু কি করুম। কিছু টাকা-পয়সা নিয়া তো বাড়িতে যাইতে হইবো।”

মোহাম্মদপুর এলাকার রবিউল নামে এক সিএনজি চালক বাংলা ট্রিবিউনকে জানান, তার গ্রামের বাড়ি নীলফামারী। ঢাকায় মেসে থেকে সিএনজি চালান তিনি। ঈদের দিন সকালে সিএনজি নিয়ে বেরিয়েছেন রবিউল। কারণ ঈদের দিন লোকজন স্বজনদের বাড়িতে যাবেন অথবা ঘুরতে বের হবে। বকশিশসহ একটু বাড়তি ইনকাম করা যায় বলে ঈদের দিনও সিএনজি চালিয়েছেন তিনি।

রবিউল বলেন, ‘গরিব মানুষের কি আর ঈদ আছে! আমাগো ঈদের দিনও যা, অন্যদিনও তা। বিদেশ গেছিলাম। ফেরত আইছি। অনেক টাকা ঋণ আছে। এগুলা শোধ করতে হইবো। এই চিন্তায় ঈদের আনন্দের কথা আর মনেই করতে পারি না।’

/জেএইচ/আপ-এআর/

সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
ধারণার চেয়ে কম সেনা প্রয়োজন ইউক্রেনের: সিরস্কি
ধারণার চেয়ে কম সেনা প্রয়োজন ইউক্রেনের: সিরস্কি
ফিরেই ফর্টিসকে বিধ্বস্ত করলো মোহামেডান
ফিরেই ফর্টিসকে বিধ্বস্ত করলো মোহামেডান
লঞ্চঘাটের পন্টুন থেকে পদ্মা নদীতে পড়ে যুবকের মৃত্যু
লঞ্চঘাটের পন্টুন থেকে পদ্মা নদীতে পড়ে যুবকের মৃত্যু
রাশিয়ায় বন্ধ হলো জাতিসংঘের নজরদারি সংস্থার কার্যক্রম
রাশিয়ায় বন্ধ হলো জাতিসংঘের নজরদারি সংস্থার কার্যক্রম
সর্বাধিক পঠিত
অ্যাপের মাধ্যমে ৪০০ কোটি টাকার রেমিট্যান্স ব্লক করেছে এক প্রবাসী!
অ্যাপের মাধ্যমে ৪০০ কোটি টাকার রেমিট্যান্স ব্লক করেছে এক প্রবাসী!
প্রথম গানে ‘প্রিয়তমা’র পুনরাবৃত্তি, কেবল... (ভিডিও)
প্রথম গানে ‘প্রিয়তমা’র পুনরাবৃত্তি, কেবল... (ভিডিও)
নেচে-গেয়ে বিএসএমএমইউর নতুন উপাচার্যকে বরণে সমালোচনার ঝড়
নেচে-গেয়ে বিএসএমএমইউর নতুন উপাচার্যকে বরণে সমালোচনার ঝড়
চিয়া সিড খাওয়ার ৮ উপকারিতা
চিয়া সিড খাওয়ার ৮ উপকারিতা
‘ভারতের কঠোর অবস্থানের কারণেই পিটার হাস গা ঢাকা দিয়েছেন’
‘ভারতের কঠোর অবস্থানের কারণেই পিটার হাস গা ঢাকা দিয়েছেন’