ভারি বর্ষণের সঙ্গে উজান থেকে নেমে আসা ঢলে পাঁচ জেলায় বন্যা পরিস্থিতির অবনতি ঘটেছে। এসব জেলার বেশির ভাগ নদ-নদীর পানি বাড়তে থাকায় নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হচ্ছে। এতে বাড়ছে পানিবন্দি মানুষের সংখ্যা। জেলাগুলো হলো- কুড়িগ্রাম, গাইবান্ধা, সিরাজগঞ্জ, জামালপুর ও বগুড়া। তবে লালমনিরহাট ও নীলফামারীর বন্যা পরিস্থিতি স্থিতিশীল রয়েছে।
বাংলা ট্রিবিউনের প্রতিনিধিদের পাঠানো খবর:
কুড়িগ্রাম
কয়েকদিনের বৃষ্টি ও উজান থেকে নেমে আসা ঢলে ব্রহ্মপুত্র, দুধকুমার, ধরলা ও তিস্তা নদীসহ কুড়িগ্রামের সবক’টি নদ-নদীর পানি বৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে। এতে জেলার সার্বিক বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে। মঙ্গলবার (১১ জুলাই) সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত ব্রহ্মপুত্রের পানি চিলমারী পয়েন্টে ঘণ্টায় ৩১ সেন্টিমিটার বেড়ে বিপদসীমার ২৯ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে এবং ধরলার পানি ফেরিঘাট পয়েন্টে ঘণ্টায় ১৯ সেন্টিমিটার করে বৃদ্ধি পেয়ে বিপদসীমার ২২ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এদিকে, পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকায় জেলার সদর উপজেলাসহ উলিপুর, চিলমারী, রৌমারী ও রাজিবপুর উপজেলার নদী তীরবর্তী ইউনিয়নগুলো বন্যার কবলে পড়েছে।
সদর উপজেলার যাত্রাপুর ইউনিয়নের প্রায় ৩০টি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। এসব গ্রামের সবক’টি পরিবার পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। শুকনো খাবার ও পানীয় জলের সংকট তৈরি হওয়ায় বিপাকে পড়েছেন বন্যাকবলিতরা। একই অবস্থা বিরাজ করছে বন্যা কবলিত অন্যান্য উপজেলার মানুষের মাঝে।
গাইবান্ধা
নদ-নদীতে পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকায় গাইবান্ধার সার্বিক বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে। মঙ্গলবার (১১ জুলাই) সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত ব্রহ্মপুত্র-যমুনা নদের পানি ফুলছড়ি পয়েন্টে বিপদসীমার ৪৭ সেন্টিমিটার ও ঘাঘট নদীর শহরের ব্রিজ এলাকার পানি বিপদসীমার ২৪ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। জেলা সদর, ফুলছড়ি, সাঘাটা ও সুন্দরগঞ্জসহ চার উপজেলার নিম্নাঞ্চল ও চরাঞ্চলের আরও নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হয়েছে। এতে করে চার উপজেলার ৬০ গ্রামের লক্ষাধিক মানুষ পানিবন্দি হয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছেন। এসব এলাকায় শুকনো খাবার, বিশুদ্ধ পানি ও গবাদি পশুর গো-খাদ্যের তীব্র সংকট দেখা দিয়েছে। এছাড়া তলিয়ে গেছে শত শত বিঘার পাটের জমি ও আমন বীজতলা। বাধ্য হয়ে অনেকে পরিবার নিয়ে বালাসী ঘাটের রেলের জায়গা, উঁচু বাঁধ ও বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে আশ্রয় নিয়েছেন। পানির প্রবল চাপে সিংড়া-রতনপুরসহ বেশ কয়েকটি পয়েন্টের বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ হুমকির মুখে পড়েছে।
জামালপুর
একদিন স্থিতিশীল থাকার পর জামালপুরে বন্যা পরিস্থিতি ফের অবনতি হয়েছে বলে পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী নব কুমার চৌধুরীর বরাতে জানিয়েছেন বাংলা ট্রিবিউনের প্রতিনিধি। নব কুমার চৌধুরী জানান, রবি ও সোমবার বাহাদুরাবাদ পয়েন্টে যমুনার পানি বিপদসীমার ৩৭ সেন্টিমিটার ওপরে ছিল। মঙ্গলবার সন্ধ্যায় একই পয়েন্টে যমুনার পানি বেড়ে বিপদসীমার ৭২ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। যমুনার সঙ্গে একইভাবে ব্রহ্মপুত্র, ঝিনাইসহ শাখা নদীগুলোর পানিও বাড়ছে এবং যমুনার পানি বৃদ্ধি আগামী দুই-তিনদিন অব্যাহত থাকতে পারে বলেও জানান তিনি।
এদিকে, বন্যায় জেলার ইসলামপুর, দেওয়ানগঞ্জ, মেলান্দহ, সরিষাবাড়ি, মাদারগঞ্জ ও জামালপুর সদরের ২৫টি ইউনিয়নের শতাধিক গ্রামের লক্ষাধিক মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। অনেকেই বাড়িঘর ছেড়ে আশ্রয় নিয়েছেন উচু বাঁধে। ডাইভারশনে পানি ওঠায় ব্যাহত হচ্ছে মেলান্দহ-মাহমুদপুর সড়ক যোগাযোগ। বন্যার পানি ওঠায় বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে জেলার ১৩১টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান।
বগুড়া
বগুড়ায় সার্বিক বন্যা পরিস্থিতির আরও অবনতি হয়েছে। প্রবল বর্ষণ ও উজান থেকে নেমে আসা ঢলে সরিয়াকান্দিতে যমুনা নদীর পানি আরও বেড়েছে। মঙ্গলবার (১১ জুলাই) সন্ধ্যা পর্যন্ত বিপদসীমার ৪৭ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে পানি প্রবাহিত হচ্ছিল। বাঙালি নদীতে পানি বাড়লেও বিপদসীমার নিচে রয়েছে। সারিয়াকান্দি, সোনাতলা ও ধুনট উপজেলার অন্তত ৭৫ গ্রাম বন্যার কবলে পড়েছে। পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকায় মানুষের দুর্ভোগ বেড়েই চলেছে। মঙ্গলবার সারিয়াকান্দির হাটশেরপুর ইউনিয়নের চকরতিনাথ এবং করমজাপাড়া গ্রামের ১৩৩টি পরিবারের বাড়িঘর স্থানান্তর করতে হয়েছে।
এছাড়া ১২টি বাড়িঘর নগদ, টাকাসহ সব মালামাল নদীতে ভেসে গেছে। বগুড়া ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তার অফিস সূত্র জানায়, সারিয়াকান্দি, সোনাতলা ও ধুনট উপজেলার যমুনা তীরবর্তী ১৪ ইউনিয়নের ১৩ হাজারেরও বেশি পরিবারের প্রায় ৫০ হাজার মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধের ওপর আশ্রয় নিয়েছে প্রায় সাড়ে তিন হাজার পরিবার। যমুনায় পানি বাড়ায় বাঁধ সংলগ্ন নিম্নাঞ্চল ও চরাঞ্চলের নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হচ্ছে। দুর্গতরা বাঁধসহ উঁচু স্থানে আশ্রয় নিয়েছেন। প্রতিদিন বাঁধে আশ্রয়গ্রহণকারীর সংখ্যা বাড়ছে। বাঁধের ওপর বেড়া দিয়ে তৈরি করা ঘরে মানুষ ও গবাদিপশু গাদাগাদি করে বাস করছে। দুর্গত এলাকাগুলো খাবার বিশুদ্ধ পানির সংকট ও পয়ঃনিষ্কাষনের সমস্যা দেখা দিয়েছে।
সিরাজগঞ্জ
উজানের পানি বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে সিরাজগঞ্জে বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হচ্ছে। যমুনার পানি সিরাজগঞ্জ হার্ড পয়েন্টে ঘণ্টায় ১৮ সেন্টিমিটার করে বেড়ে বিপদসীমার ৫২ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। যমুনার পানি বাড়ায় জেলার সদর, কাজিপুর, বেলকুচি, চৌহালী ও শাহজাদপুর উপজেলার নদী তীরবর্তী গ্রামগুলো নতুন করে প্লাবিত হচ্ছে। তবে সংশ্লিষ্ট জানিয়েছেন, যমুনার পানি বাড়লেও জেলার সার্বিক বন্যা পরিস্থিতি এখনও আশঙ্কাজনক রূপ নেয়নি।
বন্যার প্রকোপ সেভাবে না বাড়লেও জেলা সদরের বাহুকা ও মেছড়া, কাজিপুর উপজেলার শুভগাছা ও মাছুয়াকান্দি এবং চৌহালী উপজেলা সদরের অদূরে খাস কাউলিয়া যমুনার পাড়ে থেমে থেমে ভাঙ্গন অব্যাহত রয়েছে। যমুনার পশ্চিম পাড়ের তীর রক্ষা ক্রমশই অরক্ষিত হয়ে পড়ছে। এদিকে বাঁধ-পাড় ভাঙন অব্যাহত থাকলেও বরাদ্দ না থাকায় হিমশিম খাচ্ছেন স্থানীয় পাউবোর লোকজন।
লালমনিরহাট ও নীলফামারী
লালমনিরহাট ও নীলফামারীতে বন্যা পরিস্থিতি অপরিবর্তিত রয়েছে। তিস্তা নদীর পানি ডালিয়া পয়েন্টে ঘণ্টায় ৩ সেন্টিমিটার করে বেড়ে বিপদসীমার ১০ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। অপরদিকে, ধরলা নদীতে ঘণ্টায় ৭ সেন্টিমিটার করে বেড়ে পানি বিপদসীমার ২৬ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। ধরলা কাছ ঘেঁষে বয়ে যাওয়া রত্নাই নদীর পানিও বৃদ্ধি পেয়েছে। ফলে এসব নদীর দুই পাড়ে বসবাসকারী শত শত পরিবার পানিবন্দি হয়ে মানবেতর জীবন যাপন করছে। তিস্তার পানির তোড়ে হাতীবান্ধার সিঙ্গিমারী ইউনিয়নের ধুবনী এলাকায় বাঁধ ভেঙে পানি ঢুকে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। এদিকে, নীলফামারীতে বন্যায় চরাঞ্চলের প্রায় ১৫ হাজার পরিবার এখনও পানিবন্দি অবস্থায় রয়েছে। স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা জানিয়েছেন, তিস্তার বন্যার কারণে চর ও চর গ্রামের অনেক পরিবার বিশুদ্ধ পানি ও খাদ্যের অভাবে পড়েছে। তারা মনে করেন, জরুরিভাবে শুকনো খাবার বিতরণ করা প্রয়োজন।
/এমএ/টিএন/