X
মঙ্গলবার, ১৬ এপ্রিল ২০২৪
৩ বৈশাখ ১৪৩১

বিষধর সাপেও হতে পারে অর্থনৈতিক লাভ!

উদিসা ইসলাম
১৪ জুলাই ২০১৭, ০৮:০৯আপডেট : ১৪ জুলাই ২০১৭, ১৬:৩০

পটুয়াখালীতে ব্যক্তি উদ্যোগে গড়ে তোলা একটি সাপের খামারের ছবি বর্ষাকালে আশ্রয়ের খোঁজে ইঁদুরের গর্ত দিয়ে মানুষের বাড়ি-ঘরে ঢুকে পড়ছে বিষধর গোখরা সাপ। বাড়ির লোকজনের চোখে পড়লেই ছড়াচ্ছে ভীষণ আতঙ্ক। আত্মরক্ষার্থে এগুলোকে পিটিয়েও মারা হচ্ছে হরদম। এবছরও রাজশাহী, সাতক্ষীরা, কুষ্টিয়াসহ বেশ কিছু জেলায় এমন ঘটনা ঘটেছে। বিষধর গোখরা থেকে যেমন মুক্তি চায় মানুষ, তেমনই ওয়াইল্ড লাইফ বিশেষজ্ঞরা চান, বর্ষা শুরুর আগেই গোখরার আশ্রয় ও বিচরণস্থল সংরক্ষণ করে এগুলোর নির্বিচারে হত্যা বন্ধ করা। তারা বলেন, খামার গড়ে এই সাপের বিষ সংগ্রহ করে রফতানির উদ্যোগ নেওয়া উচিৎ যাতে বিষাক্ত গোখরাও হতে পারে বৈদেশিক মুদ্রা উপার্জনের মাধ্যম।
তবে চাইলেই সাপের খামার করা সম্ভব নয়। এ বিষয়ে রাষ্ট্রের আছে সরাসরি নিষেধাজ্ঞা। ওয়াল্ডলাইফ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশে গোখরাসহ বৈচিত্র্যময় অনেক প্রজাতির সাপ থাকার পরেও এগুলোর বিষ সংগ্রহ, সংরক্ষণ ও বাজারজাতকরণে রাষ্ট্রীয়ভাবে বৈধতা না থাকায় এ বিষয়ে বাণিজ্যিক কোনও উদ্যোগ নিতে পারছেন না আগ্রহীরা। এমনকি সাপের খামার করার ক্ষেত্রেও রাষ্ট্রীয় নিষেধাজ্ঞা থাকায় চাইলেই কারো পক্ষে এমন উদ্যোগ নেওয়া সম্ভব হচ্ছে না।

অন্যদিকে, ওষুধ প্রশাসনের কর্মকর্তারা বলছেন, চাহিদা থাকায় সীমিত পরিসরে এদেশেও সাপের বিষ দিয়ে কিছু ওষুধ তৈরি হচ্ছে, যদিও এর কাঁচামাল বা বিষ আসছে দেশের বাইরে থেকে।

আর অধ্যাপকরা বলছেন, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতেই বিষ সংগ্রহ ও সংরক্ষণের নানা যন্ত্রপাতি রয়েছে। বিষ সংগ্রহের পদ্ধতি জানা থাকার পরও কেবল উদ্যোগের অভাবে কাজটি শুরু হয়নি।

ওষুধ প্রশাসন অধিদফতরের ওষুধ তত্ত্বাবধায়ক সৈকত কুমার ধর বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘ওষুধ তৈরি সংস্থা ইনসেপ্টা অ্যান্টি ভেনাম তৈরি করে। তবে কাঁচামাল বাইরে থেকে আসে।’ তিনি আরও বলেন, ‘সব সাপ সব দেশে থাকে না, ফলে আমদানির বিকল্প নেই।’ দেশে যেসব প্রজাতির সাপ পাওয়া যায় সেগুলো থেকে বিষ কিভাবে সংগ্রহ করা যায় সে নিয়ে কোনও উদ্যোগ নেওয়া হয়নি বলেও তিনি জানান।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের তথ্য মতে, বাংলাদেশে ৭০ প্রজাতির সাপ আছে যার মধ্যে বিষধর প্রজাতি ২৭টি। এই বিষধর প্রজাতির মধ্যে ১২ প্রজাতি থাকে বঙ্গোপসাগরে। বাকি ১৫ প্রজাতি দেশের সবখানে কম বেশি মেলে। বিষধর গোখরা সাপের বিষ অতি মূল্যবান। যার মধ্যে পটাসিয়াম সায়ানাইডের পরিমাণ সবচেয়ে বেশি। সাপের বিষ দিয়ে তৈরি জীবন রক্ষাকারী নানা ওষুধ বিদেশ থেকে আনা হচ্ছে।

দেশে বিষ ব্যবহার করে কিছু ওষুধ প্রস্তুত করা হলেও কাঁচামাল বিদেশ থেকে আনা প্রসঙ্গে বিভাগের অধ্যাপক ফিরোজ জামান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, বনবিভাগে বন্যপ্রাণী শাখা আছে। কিন্তু, জাতীয়ভাবে সাপের সংরক্ষণ ও প্রজনন খামার নেই। এরকম খামার করা জরুরি। তিনি বলেন, খামার তৈরি করে বিষ সংগ্রহ ও সংরক্ষণের বৈধতা দিলে এর মাধ্যমে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা আয় সম্ভব। বাংলাদেশে আবহাওয়া সাপের উপযোগী হওয়ায় এত প্রজাতির সাপ পাওয়া যায় যে এগুলোর কালচার করা গেলে সাপের বিষ দেশে-বিদেশে কাজে লাগানো সম্ভব।

তিনি আরও বলেন, আমরা সাপ ধরার ও বিষ সংরক্ষণের কৌশল জানি। আমাদের বিভাগে সব ব্যবস্থা থাকার পরেও কেবল বৈধতা না থাকায় আমরা এই কাজটি করতে পারছি না।

কেন এখনও এটি সম্ভব হচ্ছে না জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমাদের রিসোর্স আমরা সঠিকভাবে ব্যবহার করতে পারি না, সেই দুর্বলতা আছেই। কিন্তু  যারা ব্যক্তিগতভাবে খামার করছেন তাদের উদ্দেশ্য নিয়েও সন্দেহ থেকে যাওয়ায় পুরো প্রক্রিয়াটাই শুরু করা যাচ্ছে না।

রাজশাহীর তিন এলাকায় গত এক সপ্তাহে বসতবাড়ির ভেতর থেকে বেরিয়ে এসেছে ১৮৩টি গোখরা সাপ। দেশের আরও কয়েকটি জেলাতেও পাওয়া গেছে এমন খবর। এসব সাপকে এলাকাবাসী পিটিয়ে মেরে ফেলার ঘটনাকে ‘অনাকাঙ্ক্ষিত’ উল্লেখ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের শিক্ষক ফিরোজ জামান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘সাপ মেরে ফেললে বাস্তু সংস্থানে সমস্যা দেখা দিবে। দেশে সাপ না থাকলে ইঁদুরের দৌরাত্ম্যে বাঁচা যাবে না।

গোখরা সাপ পাশাপাশি সাপের বিষ সংরক্ষণের ওপর গুরুত্বারোপ করে তিনি বলেন, সাপে কাটা রোগীর চিকিৎসার জন্য যে ওষুধ লাগে সেটা কিন্তু সাপের বিষ থেকেই তৈরি হয়। তাই ওষুধ তৈরির প্রয়োজনেও হলেও সাপের বিষ সংরক্ষণের ব্যবস্থা থাকা দরকার।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ওষুধ প্রযুক্তি বিভাগের অধ্যাপক আ ব ম ফারুক বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘সাপের বিষ ভীষণ দামি। আমার জানা মতে, বাংলাদেশে সাপের বিষ ব্যবহার করে কোনও ওষুধ তৈরি হয় না। কারণ, এর টেকনোলজি ভীষণ দামি, প্রচুর বিনিয়োগ দরকার। আর এটাও মনে রাখতে হবে সাপের বিষের তৈরি ওষুধ লাগে এমন রোগীর সংখ্যা যে অনেক বেশি তাও নয়। ফলে যারা বিনিয়োগ করবেন, তারা আসলে প্রস্তুত নন।’ তবে এই পুরো প্রক্রিয়াটা যদি বৈধভাবে করার ব্যবস্থা করা হয় সেটি বড় ধরনের অগ্রগতি হবে বলেও তিনি উল্লেখ করেন। আমাদের দেশে বিষ সংরক্ষণের কোনও ব্যবস্থা নেই উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘বর্তমানে চীন ও থাইল্যাণ্ড থেকে চোরাই পথে সাপের বিষ আসে, বাংলাদেশকে রুট হিসেবে ব্যবহার করে ‘

বন বিভাগের উপ-বন সংরক্ষক শাহাব উদ্দিন বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ২০১২ সালের বন্যপ্রাণি সংরক্ষণ আইন অনুযায়ী কেউ ব্যক্তিগতভাবে খামার করতে চাইলেও পারবে না, বনবিভাগ অনুমতি দেবে না। অবশ্য, ছোট পরিসরে কেউ কেউ কাজ করছেন, তাদেরকে কিছু কাজ করার অনুমতি দেওয়া হয়েছে। তবে বিষ রফতানি করার অনুমতি তারাও পাননি। তিনি আরও বলেন, ‘সাপ গৃহপালিত কোনও প্রাণী নয়, কেউ খামার করতে চাইলে নিশ্চয় সেটির বাণিজ্যিক কোনও উদ্দেশ্য থাকবে এবং সেটির জন্য বনবিভাগের অনুমতি অবশ্যই নিতে হবে।’

বনসংরক্ষক জাহিদুল কবীর বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘বাংলাদেশে সাপের বৈচিত্র্য অনেক। চাইলে অর্থনৈতিকভাবে এটাকে ব্যবহার করা যায়। কিন্তু এখন পর্যন্ত তেমন কোনও উদ্যোগ নেওয়া সম্ভব হয়নি। প্রয়োজনীয় আইন না থাকায় সাপের বিষ সংরক্ষণের লাইসেন্স দিতে পারিনি। এ বিষয়ে আইন প্রণয়ন বর্তমানে প্রক্রিয়াধীন রয়েছে উল্লেখ করে তিনি আরও বলেন, আইনটি হয়ে গেলে আমরা ব্যক্তিগত উদ্যোগের যে কয়েকটি খামার হয়েছে সেগুলোকে বৈধতা দিতে পারবো।’

/ইউআই/টিএন/

সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
মাদারীপুরে বজ্রাঘাতে ২ জনের মৃত্যু
মাদারীপুরে বজ্রাঘাতে ২ জনের মৃত্যু
শিগগিরই অনলাইন নিউজ পোর্টালের বিজ্ঞাপন নীতিমালা: তথ্য প্রতিমন্ত্রী
শিগগিরই অনলাইন নিউজ পোর্টালের বিজ্ঞাপন নীতিমালা: তথ্য প্রতিমন্ত্রী
ইরান ইস্যুতে তৃতীয় বৈঠকে বসছে ইসরায়েলের মন্ত্রিসভা
ইরান ইস্যুতে তৃতীয় বৈঠকে বসছে ইসরায়েলের মন্ত্রিসভা
নেপাল ও ভুটান সফরে গেলেন পররাষ্ট্র সচিব
নেপাল ও ভুটান সফরে গেলেন পররাষ্ট্র সচিব
সর্বাধিক পঠিত
শেখ হাসিনাকে নরেন্দ্র মোদির ‘ঈদের চিঠি’ ও ভারতে রেকর্ড পর্যটক
শেখ হাসিনাকে নরেন্দ্র মোদির ‘ঈদের চিঠি’ ও ভারতে রেকর্ড পর্যটক
বিসিএস পরীক্ষা দেবেন বলে ক্যাম্পাসে করলেন ঈদ, অবশেষে লাশ হয়ে ফিরলেন বাড়ি
বিসিএস পরীক্ষা দেবেন বলে ক্যাম্পাসে করলেন ঈদ, অবশেষে লাশ হয়ে ফিরলেন বাড়ি
ঘরে বসে আয়ের প্রলোভন: সবাই সব জেনেও ‘চুপ’
ঘরে বসে আয়ের প্রলোভন: সবাই সব জেনেও ‘চুপ’
ডাবের পানি খাওয়ার ১৫ উপকারিতা
ডাবের পানি খাওয়ার ১৫ উপকারিতা
ফরিদপুরে সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ গেলো ১৩ জনের
ফরিদপুরে সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ গেলো ১৩ জনের