X
বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪
১২ বৈশাখ ১৪৩১

‘রুদ্ধ করা যাবে না শিশুর কল্পনার ক্যানভাসকে’

জাকিয়া আহমেদ
২১ জুলাই ২০১৭, ০৮:২৪আপডেট : ২১ জুলাই ২০১৭, ১৭:০০

শিশুর হাতে আঁকা মূল ছবি

শিশুদের নিজেদের মতো করে ভাবতে, গাইতে দিতে হবে। শিশু আর শিল্পীর কল্পনার কোনও সীমারেখা নেই, সেখানে কোনও সীমারেখা টেনে দেওয়াও বোকামি। তাদের সৃজনশীলতাকে বাধাগ্রস্ত করতে গেলেই দেশপ্রেমের ঘাটতি দেখা দেবে, যেটা সমাজে নানা অসামাজিক তথা সমাজবিরুদ্ধ কাজের জন্ম দেবে। বঙ্গবন্ধুর ছবি আঁকা নিয়ে মামলা হওয়াতে শিশু মনে সেটা কেমন প্রভাব ফেলবে জানতে চাইলে শিশুদের নিয়ে কাজ করা একাধিক ব্যক্তি এবং শিশুমনোরোগ বিশেষজ্ঞরা এভাবেই বলেন বাংলা ট্রিবিউনকে।

তারা বলেন, একটি শিশুর আঁকা ছবি নিয়ে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার বিপাকে পড়া নিয়ে যেমন সমালোচনা হচ্ছে, তেমনই যে শিশুর আঁকা ছবি নিয়ে এ কাণ্ড সেই শিশুসহ সব শিশুর মনেও এর প্রভাব পড়বে। শিশু বিশেষজ্ঞরা আরও বলছেন, এ ঘটনায় অভিভাবকরাও শিশুদের এই সুকুমারবৃত্তি নিয়ে ভাববেন। স্পর্শকাতর বিষয়ে শিশু কী করছে তা নিয়ে সতর্ক হবেন। কোনও ছবি আঁকতে গিয়ে, কোনও গান গাইতে গিয়ে শিশুটি হেনস্তার শিকার হোক-কেউ সেটা চাইবেন না।

প্রসঙ্গত, শিশুর আঁকা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ছবি দিয়ে কার্ড প্রকাশ করায় ছবি বিকৃতির অভিযোগে মামলা হয় বরিশালের আগৈলঝাড়ার ভূতপূর্ব উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) গাজী তারেক সালমানের বিরুদ্ধে।  বর্তমানে বরগুনায় দায়িত্বরত এই ইউএনও বরিশালের চিফ মেট্রোপলিটন আদালতে স্বেচ্ছায় হাজির হলে তাকে জামিন না দিয়ে প্রথমে টেনে হিঁচড়ে কারাগারে নেওয়া হয়। অবশ্য সমালোচনার মুখে পরে তাকে জামিন দেওয়া হয়। স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে আয়োজিত অনুষ্ঠানের আমন্ত্রণপত্রের পেছনের দিকে বঙ্গবন্ধুর ছবি যুক্ত করায় জাতির মানহানি হয়েছে এমন অভিযোগে গত ৭ জুন একটি মামলায় সমনের মুখোমুখি হতে হয় তাকে।

শিশুর আঁকা ছবিটি কার্ডে প্রকাশিত যেমন

শিশুদের সুকুমার বৃত্তির বিকাশ বাধাগ্রস্ত হবে এবং কোনও অভিভাবকও আর চাইবে না তার সন্তান কোনও ঝামেলায় পড়ুক- এ ঘটনায় এটাই এখন ভাবার বিষয় বলে মন্তব্য করেন জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিটিউট ও হাসপাতালের শিশু কিশোর ও পারিবারিক মনোরোগবিদ্যা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডা. হেলাল উদ্দিন আহমেদ। তিনি বলেন, ‘অভিভাবকরা কনজারভেটিভ মানসিকতার ভেতরে চলে যাবেন আর কোনও শিশু যখন জানবে তার ছবির কারণে কেউ পুলিশি ঝামেলায় পড়ছে, সমালোচনা হচ্ছে তখন সে এরকম সুকুমার বৃত্তি চর্চায় আগ্রহ হারাবে,নিরুৎসাহিত হয়ে যাবে।’

এটা কেবল বঙ্গবন্ধুর ছবির ক্ষেত্রেই যে হবে তা নয়, যে কোনও ক্ষেত্রেই সেটা হবে-মানসিক চাপে কেউ যেতে চাইবে না। শিশুরা মনে করবে, যে কোনও ধরনের সৃজনশীলতা অপরাধ। এ কারণে ভবিষ্যতে হয়তো এক ধরনের ‘টাইপড শিল্পচর্চার’ ভেতরে চলে যাবে ভবিষ্যত প্রজন্ম। সবাই একই ধরনের গান গাইবে, একই ছবি আঁকবে, একই কবিতা আবৃত্তি করবে। ফুল, পাখি, লতাপাতা ছাড়া ক্রিয়েটিভ কিছু আর আমরা শিশুদের আঁকার খাতায় পাবো না। ইউনিফর্মেটিক পরিস্থিতিতে চলে যাবে—যেটা কিনা তার স্বাভাবিক বিকাশকে চরমভাবে বাধাগ্রস্ত করবে।

কোনও শিশু যদি একটি বটগাছ আঁকতে গিয়ে বটগাছের ওপরের দিকে বঙ্গবন্ধুকে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় মহীরূহ ভেবে গাছের একেবারে ওপরে বঙ্গবন্ধুর মুখ এঁকে দেয় তাহলে কি সে ভুল করবে—প্রশ্ন রেখে বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের প্রোগ্রাম কো-অর্ডিনেটর আবদুল্লাহ আল মামুন বলেন, ‘এটা তো শিশুমনের কল্পনা, সেটাকে তো কিছু দিয়ে আটকানো যাবে না। রুদ্ধ করা যাবে না শিশুর কল্পনার ক্যানভাসকে। তাতে বাধা দেওয়া ঠিকও নয়। বাঙালি জাতির শ্রেষ্ঠ মানুষ বঙ্গবন্ধু। একটি শিশুতো বড়দের মতো করে ভাববে না, সে তার মতো করে কাজ করবে, ভাববে, আঁকবে, গাইবে।’

তিনি বলেন, ‘শিশু এবং শিল্প এই দুই বিষয়ের সমন্বয় যেমন এখানে রয়েছে, তেমনি রয়েছেন বঙ্গবন্ধু। অপরদিকে, এখন থেকে শিশুদের আঁকা বঙ্গবন্ধুর ছবি ঝামেলার মনে করে তারা সন্তানকে বঙ্গবন্ধু থেকে দূরে রাখবে। আর বঙ্গবন্ধু থেকে দূরে রাখা মানে বাংলাদেশ থেকে দূরে রাখা। কাজেই মামলা করার কাজটি যারা করেছেন, আমি মনে করি এটা শিল্পের বিপক্ষে, শিশু মনের বিপক্ষে, শিশুদের সৃষ্টিশীলতা-তাকে বাধাগ্রস্ত করেছে। আর সার্বিকভাবে জঙ্গিবাদ-উগ্রবাদ তথা সমাজবিরোধী কর্মকাণ্ডের মূল কারণ হচ্ছে দেশপ্রেমের অভাব। এখন দেশপ্রেমের প্রথম ধাপটাই গড়ে ওঠে বঙ্গবন্ধুকে কেন্দ্র করে। যিনি বঙ্গবন্ধুর ছবি আঁকাকে কেন্দ্র করে এতোবড় কাজ করেছেন তিনি খুবই অবিবেচকের মতো কাজ করেছেন, যিনি মামলা করেছেন তিনি শিল্প বোঝেন না।’

আবদুল্লাহ আল মামুন বলেন, ‘শিল্পী আর শিশুর কল্পনার কোনও সীমারেখা নেই। বঙ্গবন্ধুকে শিশুদের থেকে দূরে রাখবে এই ঘটনা, তারা বঙ্গবন্ধুর কাছে যাবে না, তাকে আঁকবে না। শিশুদের তার মতো করে বঙ্গবন্ধু বা বাংলাদেশকে ভাবতে দিতে হবে।’ এক্ষেত্রে কোনও আইনি বাধা থাকলে সেগুলো সরিয়ে দিতে হবে বলেও মন্তব্য করেন তিনি।

অপরদিকে, সাংবাদিক প্রভাষ আমিন ফেসবুকে লিখেছেন, ‘আমি অনেকবার স্কেচটি দেখেছি, বড় করে দেখেছি; আমার চোখে কোনও বিকৃতি ধরা পড়েনি। কারণ আমি জানি এটা কাইয়ুম চৌধুরীর আঁকা নয়, বঙ্গবন্ধুর ছবিটি এঁকেছে ক্লাশ ফাইভে পড়ুয়া একজন। আমি বরং মুগ্ধ হয়েছি, একটি শিশু বঙ্গবন্ধুকে হৃদয়ে ধারণ করে তা আবার রংতুলিতে ফুটিয়ে তুলেছে। বঙ্গবন্ধুর স্কেচের ব্যাকগ্রাউন্ডে জাতীয় পতাকার ব্যবহারও আমার চমৎকার লেগেছে। এই ছবিটি ব্যবহার করে গত ২৬ মার্চ মহান স্বাধীনতা ও জাতীয় দিবসে বরিশালের আগৈলঝাড়ার উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা গাজী সালমান তারেক আমন্ত্রণপত্র তৈরি করেন। আগে জানলে শিশুটিকে উৎসাহ দেওয়ায় আমি সালমান তারেককে ধন্যবাদ জানাতাম।’ তিনি আরও লিখেছেন, ‘দেরিতে হলেও এখন তাকে ধন্যবাদ জানাচ্ছি।’ 

চিকিৎসক ও শিল্পী গুলজার হোসেন উজ্জ্বল ফেসবুকে লিখেছেন, ‘বরগুনার ইউএনওকে অপমানিত হতে হলো। এই অপমান সে কোনদিন ভুলবে না। যে শিশুটির ছবি আমন্ত্রণপত্রে ব্যবহার করা হলো সেই শিশুটিও যখন জানবে তার ভালবাসা ও নিষ্পাপ আবেগকে বিকৃত চিত্রকর্ম বলে ঘোষণা দেওয়া হয়েছে, তখন তার মনের অবস্থা কি হবে?’

/জেএ/এএম/টিএন/

সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
সারা দেশে আরও ৭২ ঘণ্টার ‘হিট অ্যালার্ট’ জারি
সারা দেশে আরও ৭২ ঘণ্টার ‘হিট অ্যালার্ট’ জারি
প্রীতি উরাংয়ের অস্বাভাবিক মৃত্যু: ‘অপরাধ আড়ালের চেষ্টা হচ্ছে’
প্রীতি উরাংয়ের অস্বাভাবিক মৃত্যু: ‘অপরাধ আড়ালের চেষ্টা হচ্ছে’
মিয়ানমারে ফেরত পাঠানো হলো সেনাসহ ২৮৮ বিজিপি সদস্যকে
মিয়ানমারে ফেরত পাঠানো হলো সেনাসহ ২৮৮ বিজিপি সদস্যকে
বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে করারোপ: আইনের বিশ্লেষণ
বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে করারোপ: আইনের বিশ্লেষণ
সর্বাধিক পঠিত
সিয়াম-মেহজাবীনের পাল্টাপাল্টি পোস্টের নেপথ্যে…
সিয়াম-মেহজাবীনের পাল্টাপাল্টি পোস্টের নেপথ্যে…
বাংলাদেশ ব্যাংকের চাকরি ছাড়লেন ৫৭ কর্মকর্তা
বাংলাদেশ ব্যাংকের চাকরি ছাড়লেন ৫৭ কর্মকর্তা
কেন গলে যাচ্ছে রাস্তার বিটুমিন?
কেন গলে যাচ্ছে রাস্তার বিটুমিন?
‘বয়কট’ করা তরমুজের কেজি ফের ৬০ থেকে ১২০ টাকা
‘বয়কট’ করা তরমুজের কেজি ফের ৬০ থেকে ১২০ টাকা
২৪ ঘণ্টা পর আবার কমলো সোনার দাম
২৪ ঘণ্টা পর আবার কমলো সোনার দাম