X
মঙ্গলবার, ২৩ এপ্রিল ২০২৪
১০ বৈশাখ ১৪৩১

নিরাপত্তার অজুহাতে তারা মালয়েশিয়ায় সেকেন্ড হোমের বাসিন্দা

গোলাম মওলা
২৬ জুলাই ২০১৭, ১৪:২৫আপডেট : ২৬ জুলাই ২০১৭, ১৯:৫৫

 

টুইন টাওয়ার, মালয়েশিয়া বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলে তার জন্ম। তিনি জাতীয় সংসদের একজন নির্বাচিত সদস্য। আবার মালয়েশিয়ায় সেকেন্ড হোমেরও বাসিন্দা। শুধু তাই নয়, তিনি সেদেশে ফ্ল্যাট কিনে ভাড়াও দিয়েছেন। একটি বা দুটি নয়, অর্ধ শতাধিক ফ্ল্যাটের মালিক তিনি। মালয়েশিয়ার সেকেন্ড হোমে বসবাসকারী অনেকের কাছেই এটি ওপেন সিক্রেট। বিষয়টি জানে বাংলাদেশ ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটও। কেবল উত্তরাঞ্চলের ওই এমপিই নয়, দেশের বাঘা বাঘা রাজনীতিবিদ, ব্যবসায়ী ও আমলারা মালয়েশিয়ার সেকেন্ড হোমের বাসিন্দা হয়েছেন।

মালয়েশিয়ার সরকারি হিসাবেই বলা আছে, সেদেশে সেকেন্ড হোম গড়েছেন ৩ হাজার ৫৪৬ বাংলাদেশি। অবশ্য  সেকেন্ড হোমের বাসিন্দারা জানিয়েছেন, মালয়েশিয়ায় সেকেন্ড হোম গড়েছেন এমন বাংলাদেশির সংখ্যা ১০ হাজারেরও বেশি।

এ প্রসঙ্গে মালয়েশিয়ার সেকেন্ড হোমের একজন বাসিন্দা বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘সরকারিভাবে ৩ হাজার ৫৪৬ বাংলাদেশির সেকেন্ড হোমের কথা বলা হলেও বাস্তবে এই সংখ্যা আরও বেশি।’

তিনি বলেন, ‘বর্তমানে মালয়েশিয়ার বিভিন্ন অঞ্চলে ১০ থেকে ১৫ হাজার বাংলাদেশি বসবাস করছেন। আরও প্রায় ৫ হাজার ব্যক্তি সেকেন্ড হোমের আবেদন করে অপেক্ষায় রয়েছেন। অনেকেই বলছেন, মালয়েশিয়া টাকার উৎস নিয়ে প্রশ্ন না করায় অনেক বাংলাদেশি এই সুযোগ নিচ্ছেন।’

জানা গেছে, মালয়েশিয়াতে কয়েক হাজার বাংলাদেশি রেস্টুরেন্টের ব্যবসা গড়েছেন। ওই দেশে বাংলাদেশি ব্যবসায়ীদের পাঁচতারা হোটেল ব্যবসা, গার্মেন্ট কারখানা, ওষুধ শিল্পসহ নানা খাতে বিপুল বিনিয়োগ রয়েছে। অনেকে রাজধানী কুয়ালালামপুরসহ বড় বড় শপিংমলে দোকানও কিনেছেন। অনেকে স্বর্ণ, খেলনা, তৈরি পোশাকের ব্যবসা করছেন। এদের কেউই বৈধভাবে অর্থ স্থানান্তর করেননি। বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমোদন ছাড়াই তারা মালয়েশিয়াতে টাকা নিয়ে গেছেন। অনেকে বিপুল পরিমাণ অর্থ বিনিয়োগ করেছেন কৃষি খাতসহ বিভিন্ন খাতে। 

এ প্রসঙ্গে মালয়েশিয়া-বাংলাদেশ ফোরাম অ্যাসোসিয়েশনের সহ-সভাপতি ডা. শংকর পোদ্দার বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘যারা মালয়েশিয়ার সেকেন্ড হোমে যুক্ত হয়েছেন, তাদের প্রত্যেকেই নিজের নিরাপত্তা ও বিনিয়োগের নিরাপত্তার কথা চিন্তা করে যুক্ত হয়েছেন।’

তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশের সরকারকে এই বিষয়টি অনুধাবন করতে হবে। কেন নিজের দেশ ছেড়ে অন্য দেশে বসবাস করতে যাচ্ছে মানুষ। আর মালয়েশিয়া আমাদের জন্য যা করতে পারছে, আমরা কেন তা পারছি না।’ তিনি উল্লেখ করেন, ‘বাংলাদেশে কবে অন্য দেশের মানুষের সেকেন্ড হোম হবে, সেদিকে নজর দেওয়া উচিত।’

দেশে রাজনৈতিক পট পরিবর্তন হলে নানা সমস্যার মুখে পড়তে পারেন, এমন আশঙ্কায় অনেকে সেকেন্ড হোম সুবিধা নিয়ে থাকেন। এ কারণে সরকার পরিবর্তনের সময়গুলোতে সেকেন্ড হোম প্রোগ্রামে আবেদনের হিড়িক পড়ে যায়।

এখন বিভিন্ন অনলাইনে ও সামাজিক মাধ্যমে এ নিয়ে বিজ্ঞাপন দেওয়া হচ্ছে। অনেক বাংলাদেশিও ব্যক্তিগতভাবে এই কাজের সঙ্গে যুক্ত। এরা বাংলাদেশের ব্যবসায়ী, দুর্নীতিবাজ আমলা ও রাজনীতিবিদদের টার্গেট করে সেকেন্ড হোমে বিনিয়োগে উৎসাহিত করছেন।

সেকেন্ড হোমের বিষয়ে বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল একুশে টিভির সাংবাদিক (হেড অব ইনপুট)  অখিল পোদ্দার তিন বছর আগে সরেজমিনে মালয়েশিয়া গিয়েছিলেন। তিনি তার অভিজ্ঞতা থেকে বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘জীবনের নিরাপত্তা ও বিনিয়োগের নিরাপত্তা ছাড়াও মালয়েশিয়ার শিক্ষা এবং যোগাযোগ ব্যবস্থাও বাংলাদেশিদের সেকেন্ড হোম বনানোর অন্যতম কারণ। ওই দেশে বাংলাদেশি রাজনীতিবিদরাই বেশি সেকেন্ড হোম বানিয়েছেন। এর পরেই আছেন ব্যবসায়ীরা। আমি সেখানে নানা মহলের সঙ্গে কথা বলে নিশ্চিত হয়েছি যে, সেকেন্ড হোম করতে যে টাকার প্রয়োজন হয়, তা বাংলাদেশ থেকে কেউই বৈধ পথে নেননি।’

তিনি বলেন, ‘‘মালয়েশিয়া সরকার সেদেশের সেকেন্ড হোমের জন্য ব্যবসায়ীদের অনেক সুবিধা দিয়ে থাকে। এই সুযোগে অনেকেই  ‘আনরেস্ট’ থেকে বাঁচতে, আবার কেউ তার সম্পদ সরাতে সেকেন্ড হোমের আশ্রয় নিয়েছেন।’’

তিনি বলেন, ‘মালয়েশিয়াতে  বাংলাদেশি অধ্যুষিত বেশ কয়েকটি এলাকা গড়ে উঠেছে। বাংলা মার্কেট এবং শাহআলু এলাকায় এখন সবচেয়ে বেশি বাংলাদেশিদের বসবাস। তারা কেউ কেউ বাড়ি কিনেছেন, আবার কেউ ফ্ল্যাট কিনে থাকছেন। আর ফ্ল্যাটের দাম কোনও কোনও ক্ষেত্রে বাংলাদেশের চেয়েও কম।’

এদিকে ফরেন এক্সচেঞ্জ রেগুলেশন অ্যাক্ট, ১৯৪৭-এর ৫(১) ধারা অনুযায়ী, বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমোদন ছাড়া কেউই দেশ থেকে টাকা বিদেশে পাঠাতে পারেন না। অর্থাৎ বাংলাদেশ থেকে কোনও অর্থ বিদেশে নিয়ে বিনিয়োগ করার আইনগত বৈধতা নেই। কিন্তু শুধু মালয়েশিয়া নয়, লন্ডন, সিঙ্গাপুর, কানাডা, যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়া ও দুবাইয়ে বাংলাদেশের কয়েক হাজার লোক বাড়ি ও ফ্ল্যাট কেনা থেকে শুরু করে ব্যবসা-বাণিজ্যে হাজার হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ করেছেন।

এ প্রসঙ্গে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক অর্থ উপদেষ্টা ড. এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘পণ্য আমদানির আড়ালে দেশের বাইরে অর্থ পাচার হয়। দেশে বিনিয়োগ না থাকলেও মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানি বাড়ছে। এর অর্থ হচ্ছে ওভার ইনভয়েসিংয়ের (আমদানি পণ্যে মূল্য বেশি দেখানো) মাধ্যমে টাকা পাচার হচ্ছে।’

এদিকে ওয়ার্ল্ডওয়াইড মাইগ্রেশন কনসালটেন্ট লিমিটেড নামে এক সাব-এজেন্টের ওয়েবসাইটে উল্লেখ আছে, ১০ বছরের নন-মালয়েশিয়ান ভিসার জন্য আবেদন করতে হলে বাংলাদেশি ৫০ বছরের কম বয়সীদের জন্য অ্যাকাউন্টে জমা থাকতে হয় পাঁচ লাখ রিঙ্গিত বা এক কোটি ছয় লাখ টাকা এবং মালয়েশিয়ার ব্যাংকে ফিক্সড ডিপোজিট করতে হয় ৬৫ লাখ টাকা। ৫০-এর বেশি বয়সীদের জন্য অ্যাকাউন্টে থাকতে হবে সাড়ে তিন লাখ রিঙ্গিত বা ৭৫ লাখ টাকা। মালয়েশিয়ায় ফিক্সড ডিপোজিট করতে হবে ৩২ লাখ টাকা। তবে উভয় ক্ষেত্রে মাসিক আয় হতে হবে কমপক্ষে দুই লাখ ১২ হাজার টাকা।

অর্থপাচারের মাধ্যমে মালয়েশিয়ায় সেকেন্ড হোম গড়ার বিষয়ে বাংলাদেশ ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের মহাব্যবস্থাপক দেব প্রসাদ দেবনাথ বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘মালয়েশিয়াতে যারা টাকা নিয়ে যাচ্ছেন তারা হুন্ডিকে বেছে নিচ্ছেন।’ তিনি বলেন, ‘বর্তমান সিস্টেমের  দুর্বলতার কারণে হুন্ডি বেড়ে যাচ্ছে। অর্থ পাচার ঠেকাতে প্রথম কাজ হচ্ছে সেই দুর্বলতাগুলো দূর করা। আমরা সেই দুর্বলতাগুলো নিয়ে কাজ শুরু করেছি।’

/এপিএইচ/

আরও পড়ুন: 

সাত খুন মামলার ডেথ রেফারেন্সের শুনানি শেষ, রায় ১৩ আগস্ট

সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
মাটি কাটার সময় বেরিয়ে এলো রাইফেল, গ্রেনেড ও মর্টারশেল
মাটি কাটার সময় বেরিয়ে এলো রাইফেল, গ্রেনেড ও মর্টারশেল
২৩ মিনিটে জামালকে তিন গোল দিয়ে সেমিফাইনালে পুলিশ
২৩ মিনিটে জামালকে তিন গোল দিয়ে সেমিফাইনালে পুলিশ
ডিবির জিজ্ঞাসাবাদে যা জানালেন কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান
ডিবির জিজ্ঞাসাবাদে যা জানালেন কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান
উত্তর গাজায় আবারও হামলা জোরদার করলো ইসরায়েল
উত্তর গাজায় আবারও হামলা জোরদার করলো ইসরায়েল
সর্বাধিক পঠিত
রাজকুমার: নাম নিয়ে নায়িকার ক্ষোভ!
রাজকুমার: নাম নিয়ে নায়িকার ক্ষোভ!
আজকের আবহাওয়া: তাপমাত্রা আরও বাড়ার আভাস
আজকের আবহাওয়া: তাপমাত্রা আরও বাড়ার আভাস
মাতারবাড়ি ঘিরে নতুন স্বপ্ন বুনছে বাংলাদেশ
মাতারবাড়ি ঘিরে নতুন স্বপ্ন বুনছে বাংলাদেশ
অতিরিক্ত সচিব হলেন ১২৭ কর্মকর্তা
অতিরিক্ত সচিব হলেন ১২৭ কর্মকর্তা
উৎপাদন খরচ হিসাব করেই ধানের দাম নির্ধারণ হয়েছে: কৃষিমন্ত্রী 
উৎপাদন খরচ হিসাব করেই ধানের দাম নির্ধারণ হয়েছে: কৃষিমন্ত্রী