X
শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪
৬ বৈশাখ ১৪৩১

ধর্ষণের শিকার নারী ও শিশুদের নিয়তি 'স্থানচ্যুতি'

উদিসা ইসলাম
০৬ আগস্ট ২০১৭, ১০:০৩আপডেট : ০৬ আগস্ট ২০১৭, ১৮:০৪

ধর্ষণ ১১ বছর আগের কথা। সিরাজগঞ্জের সিতারার (ছদ্মনাম) বয়স তখন ১০ বছর। গ্রামের তিন যুবকের ধর্ষণ করে তাকে। কিন্তু সিতারার অভিভাবকরা মামলা করেননি। সমাজের সবাই মিলে সালিশ করে তিন যুবককে বেত্রাঘাতের শাস্তি দেন। পরের বছর ১১ বছরের মেয়েকে নিয়ে বাবার বাড়ি পাবনায় চলে যান সিতারার মা। আর ফেরা হয়নি।

সিতারা এখন ২১ বছরের। তার নিজের ঘর হয়েছে। কিন্তু এখনও ছোটবেলায় তার সঙ্গে ঘটে যাওয়া ঘটনার রেশ কাটেনি, তাই কারণে-অকারণে শুনতে হয় ‘কটুকথা’।

কেন গ্রাম ছেড়ে চলে আসতে হয়েছিল জানতে চাইলে সিতারার মা বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘মেয়েকে কত লোক যে যন্ত্রণা দিয়েছে যদি জানতেন। ওই ঘটনার জন্য আমার মেয়ে দায়ী না, ও তো কিছু বুঝতোও না। কিন্তু ধর্ষণের কথা জানাজানির পর বিপদ যেন আরও বেড়ে গেলো। এ ডাক দেয়, ও ডাক দেয়। শেষে এলাকা ছেড়ে আসায় সেইসব সমস্যা থেকে পরিত্রাণ পেয়েছি। কিন্তু জানাজানির যে ভয়টা ছিল, সেটা আর আড়াল করা সম্ভব হয়নি।’

দিনাজপুরের চার বছরের মনি (ছদ্মনাম)। শরীরে ক্ষত আর ধর্ষণের কারণে বিপর্যস্ত শিশুটির খবর গণমাধ্যমে উঠে আসায় তার সুচিকিৎসা হয়েছে বটে, কিন্তু আশেপাশের গ্রামগুলোরও সবাই থাকে ধর্ষণের শিকার হিসেবে চিহ্নিত করে দিয়েছে। প্রায় এক বছরে তার পরিবারের জীবন বদলে গেছে। এখন শরীরের ক্ষত শুকিয়ে এলেও মেয়েটির জন্য সমাজের বাঁকা কথা যেন আরও বড় ক্ষত হয়ে দাঁড়িয়েছে। মনিকে এ পরিস্থিতি থেকে বাঁচানোর চেষ্টায় ব্যস্ত থাকেন মা। সংখ্যালঘু হওয়ায় লড়াইটা আরও কঠিন উল্লেখ করেছেন তিনি। চোখের পানি ফেলে অস্ফুটে বাংলা ট্রিবিউনকে মনির মা বললেন, ‘ওকে ওপারে (ভারত) পাঠিয়ে দেবো।’

কেবল সিতারা বা মনি নয়, ধর্ষণের শিকার নারী ও শিশুকে জীবনের বেশিরভাগ ক্ষেত্রে শৈশব কিংবা দীর্ঘদিনের এলাকা ছেড়ে বেঁচে থাকার লড়াই করতে হয়। কখনও কখনও সমাজে থেকেও সামাজিকতা থেকে দূরে থাকতে বাধ্য হতে হয় তাদের।

দোষ না করেও দোষী হিসেবে অবহেলিত হওয়ায় ও নেতিবাচক আচরণের কারণে ধর্ষণের শিকার অনেকে বেছে নেন আত্মহননের পথ। শিশুদের ক্ষেত্রে ট্রমা থেকে বের হলেও জীবনের এই অভিজ্ঞতা বারবারই মনে করিয়ে দেওয়া হয়।

সমাজবিজ্ঞানী ও মনোবিজ্ঞানীরা বলছেন, ‘এ ধরনের অদৃশ্যমানতার জন্য ক্ষতিগ্রস্তরা দায়ী নয়, কিন্তু আজীবন তাকে সেই অনুভূতির মধ্যে রাখা হয়। অভিযুক্ত ও ধর্ষণের শিকার ব্যক্তির সম্পর্ক সবসময়ই অসম ক্ষমতার। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে দোষীদের বিচার না হওয়ায় মেয়েটিকে ছেড়ে দিতে হয় পুরনো এলাকা।’

নারীনেত্রী খুশি কবির বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘নারী ধর্ষণের শিকার হয়, এতে তার কোনও অ্যাক্ট নেই। কিন্তু সামাজিক পুরো নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া তার ওপর দিয়েই যায়। সে একদিকে বিচার পায় না, অন্যদিকে সমাজে তার জন্য স্বস্তির কোনও জায়গা অবশিষ্ট থাকে না। শুরুতে যারা ক্ষতিগ্রস্তর পাশে দাঁড়ান, তারাও বিষয়টি ফলোআপের মধ্যে না রাখায় ওই নারীর জীবনের লড়াইয়ের পথ তাকেই নির্ধারণ করতে হয়।’

এই নারীনেত্রী আরও বলেন, ‘যেহেতুধর্ষণের শিকার ব্যক্তির চেয়ে অভিযুক্তরা সামাজিকভাবে ক্ষমতাশালী হয়ে থাকে, সেক্ষেত্রে মেয়েটির সমাজে টিকে থাকা সহজ হবে না, এটাই স্বাভাবিক। আমরাও সমাজে তার জন্য তেমন পরিস্থিতি তৈরিতে সহায়ক ভূমিকা পালন করতে পারিনি।’

বাংলাদেশ নারী প্রগতি সংঘের প্রধান রোকেয়া কবীর মনে করেন, ধর্ষণের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত নারীর স্থানচ্যুতির জন্য তার সুরক্ষা ব্যবস্থা না থাকাই দায়ী। তার ভাষ্য, ‘রাষ্ট্র যদি তাকে নিরাপত্তা না দিতে পারে তাহলে সে নিজের মতো করেই সমাধান বের করতে চাইবে। সমাজের বাস্তবতা এখনও এরকমই যে অভিযুক্তকে নয়, ধর্ষণের শিকার নারীকেই আমরা অবহেলার চোখে দেখি।’

এ ধরনের পরিস্থিতির পরিবর্তনে কথা বলা শুরু হওয়াকে ইতিবাচক উল্লেখ করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষিকা সাদেকা হালিম। তিনি বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘তাদের জন্য আলাদাভাবে কিছু করলে আরও বেশি চিহ্নিত হয়ে যাবে ফলে সেটিও করা যাচ্ছে না। আমাদের চেষ্টা করতে হবে কিভাবে সামাজিক পরিসরে মানসিকতা পরিবর্তনের কাজগুলো করা যায়। বিচার নিশ্চিত করা গেলে দোষী নির্দোষ এর ধারণায় পরিবর্তন আসবে। সেটাও জরুরি।’

মনোবিশ্লেষক মেখলা সরকার মনে করেন, এ ধরনের শারীরিক ও মানসিক ক্ষতির সম্মুখীন যারা হয়, তাদের ক্ষেত্রে যে সামাজিক যত্ন প্রয়োজন আমাদের সমাজ তা দিতে প্রস্তুত নয়। তিনি বলেন, ‘দীর্ঘদিন ট্রমার মধ্যে থাকা মানুষ আশেপাশের পরিস্থিতির কারণে স্বাভাবিক জীবনে আসতে পারে না। আবার সমাজের কারণেই অদৃশ্য হয়ে যেতে পারে। সমাজে থেকেও সামাজিক কাজে অংশগ্রহণের কোনও অধিকারই যেন তাদের নেই, এমন বোধ নিয়ে বেঁচে থাকতে হয়। এ অবস্থা কখনও স্বাভাবিক জীবন হতে পারে না।’

 /ইউআই/জেএইচ/ আপ-এসটি

সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
থার্ড টার্মিনালের বাউন্ডারি ভেঙে বিমানবন্দরে বাস, প্রকৌশলী নিহত
থার্ড টার্মিনালের বাউন্ডারি ভেঙে বিমানবন্দরে বাস, প্রকৌশলী নিহত
ভারত-পাকিস্তান টেস্ট হবে দারুণ: রোহিত
ভারত-পাকিস্তান টেস্ট হবে দারুণ: রোহিত
জাতীয় পতাকার নকশাকার শিব নারায়ণ দাস আর নেই
জাতীয় পতাকার নকশাকার শিব নারায়ণ দাস আর নেই
পথের পাশের বাহারি শরবতে স্বাস্থ্যঝুঁকি কতটা?
পথের পাশের বাহারি শরবতে স্বাস্থ্যঝুঁকি কতটা?
সর্বাধিক পঠিত
সয়াবিন তেলের দাম পুনর্নির্ধারণ করলো সরকার
সয়াবিন তেলের দাম পুনর্নির্ধারণ করলো সরকার
নিজ বাহিনীতে ফিরে গেলেন র‍্যাবের মুখপাত্র কমান্ডার মঈন
নিজ বাহিনীতে ফিরে গেলেন র‍্যাবের মুখপাত্র কমান্ডার মঈন
ডিএমপির ৬ কর্মকর্তার বদলি
ডিএমপির ৬ কর্মকর্তার বদলি
আমানত এখন ব্যাংকমুখী
আমানত এখন ব্যাংকমুখী
বৈধ পথে রেমিট্যান্স কম আসার ১০ কারণ
বৈধ পথে রেমিট্যান্স কম আসার ১০ কারণ