X
বুধবার, ০৮ মে ২০২৪
২৫ বৈশাখ ১৪৩১

‘বঙ্গবন্ধু বললেন, এত দেরি হলো কেন?’

সালমান তারেক শাকিল
১৫ আগস্ট ২০১৭, ১৯:২৯আপডেট : ১৬ আগস্ট ২০১৭, ১০:৩৮

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যার রাতে রাষ্ট্রীয় কাজে যুগোস্লাভিয়ায় ছিলেন তদানীন্তন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও বর্তমানে গণফোরাম  সভাপতি ড. কামাল হোসেন। সেখানে এ খবর শোনার পর তিনি জার্মানিতে যান বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার সঙ্গে দেখা করতে। এরও আগে মুক্তিযুদ্ধের সময় জাতির পিতা আর তিনি আটক ছিলেন পাকিস্তানের পৃথক দুটি কারাগারে। শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে অত্যন্ত হৃদ্যতাপূর্ণ সম্পর্ক ছিল তার। দেশ স্বাধীন হওয়ার খবরে ইসলামাবাদের অদূরে একটি বাড়িতে তাকে বঙ্গবন্ধুর কাছে পৌঁছে দেয় পাকিস্তান সরকার। এরপর বঙ্গবন্ধুর সহচর হয়ে একই বিমানে স্বাধীন বাংলাদেশে ফেরেন তিনি। বাংলা ট্রিবিউনের কাছে ড. কামাল হোসেন উজাড় করেছেন সেই স্মৃতিময় অতীত।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান (ছবি-সংগৃহীত)

 

‘বিকাল ৪টায় আমাকে একটা গাড়িতে নিলো, ইসলামাবাদের দিকে নিলো। আমি ভাবলাম, ঠিক আছে রাজধানীর দিকে গেলে হয়ত কিছুটা পরিবর্তন হবে। কিন্তু ওখান থেকে পার হয়ে চলে গেল একটা কাঁচা রাস্তায়। চারদিকে মেশিনগান নিয়ে ঘুরে দাঁড়ানো জওয়ান। তখন আমি একটু ভয় পেয়েছিলাম। বললাম, কী করতে চাইছো? তো মিলিটারি অফিসার হেসে বলছে ‘‘না, না, তুমি চিন্তা করো না। ভালোই হবে তোমার জন্য।’’ তো ওইখানে একটা একতলা বাড়ি ছিল ডাক বাংলোর মতো। তো বললো যে ওইখানে তোমাকে নিয়ে যাওয়া হবে। গেছি, ঢুকেছি। তখন একজন বলল, ‘‘এক নাম্বার ঘরে ঢুকো।’’ ঢুকে দেখলাম বঙ্গবন্ধু দাঁড়িয়ে আছেন। আমাকে দেখে বললেন, এত দেরি হলো কেন?’ বলছিলেন ড. কামাল হোসেন; ১৬ ডিসেম্বর বিজয় দিবসের দিনে ভিন্ন এক গল্প, যা রচিত হয়েছিল ঘাতকদের দেশ পাকিস্তানে।

মুক্তিযুদ্ধের সময় আপনি কোথায় ছিলেন? পরিস্থিতি তখন কেমন ছিল?

ড. কামাল হোসেনের চোখের সামনে তখন জ্বলজ্বল করে ওঠে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি। বলেন, ‘জেল-এ ছিলাম। পাকিস্তানের হরিপুর জেলে। যেখানে আমাকে বন্ধ করে রাখা হয়েছিল, যে সেলে আমি ছিলাম সেখান থেকে বের হওয়ার পারমিশন ছিল না আমার। জেলে সাধারণত বন্দিকে ছেড়ে দেওয়া হয়, তিনি জেলের মধ্যে ঘোরাফেরা করতে পারেন, অন্য বন্দিদের সঙ্গে কথা বলতে পারেন। কিন্তু, আমাকে তা করতে দেওয়া হয়নি। একদম কোনও পত্রিকা, রেডিও কিছুই দেওয়া হয়নি।’

কতদিন ছিলেন কারাগারে? আর বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা হয় কিভাবে?

খ্যাতনামা এই আইনজীবী বলেন, ‘নয়মাস পাকিস্তানের হরিপুর জেলে ছিলাম। আর বঙ্গবন্ধু ছিলেন মিয়াওয়ালি জেলে। দুইটাই কিন্তু একদম শেষ প্রান্তে। জেলের ভেতরে কোনও পত্রিকা দিতো না, কোনও কথা বলতে দেওয়া হতো না। জেলের যে অঙ্গন ওর বাইরে কোনও চলাফেরা ছিল না আমার।’

ড. কামাল হোসেন বলেন, ‘‘আমি তো অনেক বন্দির ব্যাপারে মামলা লড়েছি। এটাতো জেনারেল রুলে আছে যে একজন বন্দি পত্রিকা পাবে, সকাল থেকে মাগরিব পর্যন্ত ঘোরাফেরা করার সুযোগ পাবে। কিন্তু আমাকে কোনও সুযোগ দেওয়া হতে না। আমি ওদের বলেছি যে দেখো আমার পেটে ব্যথা আছে, আমাকে একটু হাসপাতালে যেতে দাও। তারা বলেছে ‘না না ডাক্তার এসে দেখে যাবে।’ ওই যে একটু বেরুবার সুযোগ তখন সেটাও পাইনি।’’

বাংলা ট্রিবিউনের সঙ্গে আলাপচারিতায় ড. কামাল হোসেন

তিনি বলেন, ‘‘মজার বিষয় হলো ১৬ই ডিসেম্বর আমার জন্য মুক্তি দিবস। যেদিন রাতে ওরা আত্মসমর্পন করলো সেদিন জেলের সুপার এসে বললো যে, ‘আরে আপনার এখানে চেয়ার নেই জেলের ভেতরে। হেই দেখো দেখো একটা চেয়ার এনে দাও।’ তারপর ওরা দেখে বলে, ‘আপনার এই শীতের দিনে কোনও কার্পেট নেই? এই এখানে একটা কার্পেট নিয়ে আসো।’ তো তখন আমি বুঝে ফেলেছি যে কী ঘটেছে। তাদের চেহারা খারাপ আর আমার চেহারার উন্নতি। খাওয়া যখন নিয়ে এলো দেখি ট্রেতে তিনটা প্লেটে তিনরকম পদ। আমি বললাম ‘ব্যাপারটা কি? কেননা আগে একটা টিনের বাটিতে একটু ডাল আর একটা রুটি দিয়ে যেত এই নয় মাস। ১৬ই ডিসেম্বর থেকে তিন পদ খাওয়া।’ ওরা বললো ‘না না, ডাক্তার বলেছে তোমাকে ভালোমতো ডায়েট দিতে।’ তখন আমি বুঝতে পেরেছি যে বাইরে কী ঘটেছে। তো তারপরে আমাকে বললো যে আপনি একটু পরিদর্শন করেন জেলে। সুপারিন্টেন্ডেন্ট এসে জেলের তালা খুলে আমাকে সারা জেলে ঘোরাচ্ছে। এই আমাদের কারখানা, এই আমাদের অমুক ইত্যাদি। তো আমিও হাসতে হাসতে বলেছি যে নয়মাস পরে এটা ভালোই লাগছে। তারা বললো ‘হ্যাঁ হ্যাঁ তোমরা তো এখানে আসো। আর বাইরে গিয়ে তোমরা ভিআইপি হয়ে যাও।’ আমিতো বুঝতেই পেরেছি যে ভিআইপি হওয়ার মানেটা কী। ‘ জেল সুপার বললো,  ‘তুমি তো আর বেশি দিন থাকবে না। যাওয়ার আগে একটা গাছ লাগিয়ে যাও।’ আমি বললাম যে আমি ওরকম ভিআইপি না। আমার পার্টিতে আমি জুনিয়র মানুষ। আমাকে বলেছো ভালো, কিন্তু গাছ-টাছ লাগানোর লোক আমি না। ব্যবহার মানে ডেইলি ইমপ্রুভ হচ্ছে এইভাবে। তো ২৮ তারিখে সকালে জেল সুপার আমাকে বললো যে তুমি প্যাক আপ। দুটা কাপড় ছিল, আমি ব্যাগে নিলাম।  সন্ধ্যা ৬টায় আমাকে একটা গাড়িতে নিলো। ইসলামাবাদের দিকে নিলো। আমি ভাবলাম ঠিক আছে রাজধানীর দিকে গেলে হয়ত কিছুটা পরিবর্তন হবে। কিন্তু ওখান থেকে পার হয়ে চলে গেল একটা কাঁচা রাস্তায়। চারিদিকে মেশিনগান নিয়ে  ঘুরে দাঁড়ানো সেনারা রাস্তায়। তখন আমি একটু ভয় পেয়েছিলাম। বললাম, ‘কি করতে চাইছো?’ মিলিটারি অফিসার হেসে বলছে ‘না না তুমি চিন্তা করো না। ভালোই হবে তোমার জন্য।’ ওইখানে একটা একতলা বাড়ি ছিল ডাক বাংলোর মতো। বললো যে ওইখানে তোমাকে নিয়ে যাওয়া হবে। গেছি, ঢুকেছি। তখন বললো, এক নম্বর ঘরে ঢুকো।  সেখানে ঢুকে দেখি বঙ্গবন্ধু আছেন।’

আপনাদের প্রথম কি কথাবার্তা হলো? আপনারা কি করলেন?

ড. কামাল হোসেন বলেন, ‘‘বঙ্গবন্ধু বললেন, এত দেরি হলো কেন?’ আমি বললাম যে এই ব্যাগে তো কিছু ছিল না। আমাকে বলার সঙ্গে সঙ্গে আমি ১৫ মিনিটের মধ্যে রেডি হয়ে গেছি। যখনই ওরা গাড়িতে নিয়েছে আমি গাড়িতে উঠেছি। কিন্তু ওখান থেকে আসতে অবশ্য দু/আড়াই ঘণ্টা লেগেছে। তখন উনিই বলতে লাগলেন যে ২৬ তারিখ (২৬ ডিসেম্বর ১৯৭১) থেকে তো আমি এখানে। ২৬ তারিখ বা তার কাছাকাছি সময়ে উনি এসেছেন ওখানে। মিয়াওয়ালি জেল থেকে। ওই জায়গাটার নাম ছিল শিহালা গেস্ট হাউজ। এটা পুলিশ একাডেমির একটা অতিথি ভবন আর কি। বঙ্গবন্ধু বললেন যে ‘আমাকে এখানে নিয়ে এসেছে দুদিন আগে। আমাকে আনার পরেই দেখি ঢুকছে ভুট্টো। তো আমি ভুট্টোকে বলেছি যে তুমিও কি বন্দি হিসেবে এসেছো? তো বললো যে ‘না না, আমি তো প্রেসিডেন্ট।’ তো বঙ্গবন্ধু বললেন যে, ‘তুমি কি করে প্রেসিডেন্ট হলে? আমি তো ১৬৭ সিট পেলাম আর তুমি তো তার অর্ধেকের চেয়ে কম পেলে। তখন ভুট্টো বললেন যে ‘হ্যাঁ হ্যাঁ আপনিই প্রেসিডেন্ট হয়ে যান।’ তো উনি বললেন যে, রাখো এসব আমি তো রসিকতা করছিলাম। আমি যত দ্রুত বাংলাদেশ যেতে পারি সেটার ব্যবস্থা করো।’ তো ভুট্টো বললেন যে, ‘দু/চারদিন আমাকে সময় দেন আমি অবশ্যই এটা করবো।’ তখন বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন ‘আমার ধারণা, কামাল হোসেনও এখানে কোথাও বন্দি আছে। কামাল হোসেন তো আছে, ওকে আমার কাছে পাঠিয়ে দাও।’ বঙ্গবন্ধু আমাকে বললেন যে, ‘উনি কথা রেখেছেন। পরশু ভুট্টো আমাকে বললেন আর আজ তোমাকে এখানে আনলেন।’

ড. কামাল হোসেন জানালেন, শিহালা গেস্ট হাউজে বঙ্গবন্ধু এবং তিনি ১০ দিন থাকেন।

আপনার কি মনে আছে আপনারা যেদিন বাংলাদেশে প্রথম পা রাখেন কি ঘটেছিল সেদিন? আপনার নিজের অনুভূতিটা কি?

ড. কামাল হোসেন বলেন, আমরা আকাশ থেকে নিচে দেখি শুধু মানুষ, মানুষ আর মানুষ। গাছের ওপরে মানুষ, ছাদের ওপরে মানুষ। ৬/৭ জানুয়ারিতে আমাদের প্লেনে তুললো। ওটার একটা ব্যাপার আছে যে কোথায় নেবে? আমরা বলেছি যে ডাইরেক্ট ঢাকা নিয়ে চলো। তারা বললো যে যুদ্ধ হয়েছে তারপরে তো এয়ার স্পেস বন্ধ। আমরা ইন্ডিয়ার ওপরে ফ্লাই করতে পারবো না। তো আমরা বললাম যে আমাদেরকে জাতিসংঘের প্লেন অথবা রেডক্রসের প্লেনে দিয়ে দাও। ওরা বললো ইরান, টার্কি। বঙ্গবন্ধু বললো ওইসব দেশে না কোনও নিউট্রাল দেশে। জেনেভায় নিয়ে যেতে পারো, সুইজারল্যান্ড। তো তারা হঠাৎ করে বলে ফেলেছে যে লন্ডনে আমরা নিতে পারি। তো বঙ্গবন্ধু বললেন যে আর তো কোনও কথাই নেই। লন্ডনে আমরা সবচেয়ে বেশি বাংলাদেশের লোক পাবো। তুমি ইমিডিয়েটলি বলো যে লন্ডনে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করুক। তো এইভাবে লন্ডনে যাওয়ার ব্যবস্থা হলো। বললো যে ৬/৭ তারিখে আমাদেরকে নেবে। লন্ডনে এসে পৌঁছেছি ৮ তারিখ।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান (ছবি: সংগৃহীত)

ওই সময় বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে থাকার অভিজ্ঞতা কেমন ছিলো?

ড. কামাল হোসেন বলেন, তার ব্যাপারে আর কি, তিনি তো জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ওই জায়গায় এসেছেন। দেশ স্বাধীন হয়েছে তার জীবনটা তিনি ফিরে পেয়েছেন।

কামাল হোসেন বলেন, আমাকে যখন অ্যারেস্ট করেছে তখন আমার ওয়াইফ করাচিতে চলে গেছেন তার বাবার বাসায়। বাচ্চাদেরকে নিয়ে। তার বাবা রিটায়ার্ড ডিস্ট্রিক্ট জাজ, করাচিতে থাকতেন। আমাদেরকে প্লেনে তোলার সময় একটা ইন্টারেস্টিং ঘটনা যে, প্লেন আসবে করাচি থেকে। আমাদেরকে নিয়ে লন্ডনে যাবে। তো আমি বঙ্গবন্ধুকে বললাম যে ‘আপনি বললে তো কাজ হবে। আমার বাচ্চাদেরকে তুলে দিতে বলেন করাচি থেকে।’ তো ভুট্টোতো বঙ্গবন্ধুকে খুব খুশি করতে চাইছিলেন। তখন বঙ্গবন্ধু ভুট্টোকে বললেন যে প্লেন যেহেতু করাচি থেকে আসছে সেহেতু ওর বাচ্চাদেরকে তুলে দিতে বলেন। আমি তো অবশ্যই চাইবো যে আমি কিভাবে ওদেরকে ফিরে পাবো। কিন্তু এইভাবে যে হয়ে যাবে সেটা কল্পনাও করিনি। আমি বঙ্গবন্ধুকে বললাম যে এয়ারপোর্টের পাশেই ওদের বাসা। খুব সহজেই ওদেরকে তুলে দিতে পারে। আমার ওয়াইফকে বলেছে যে আপনি এক ঘণ্টার মধ্যে রেডি হয়ে যান। আপনাকে প্লেনে রাওয়ালপিন্ডি নিয়ে যাবে। লন্ডন নিয়ে আসবে সেটা বলেও নাই। তো বলেছে যে কিছু গরম কাপড় নেন। রাওয়ালপিন্ডিতে তো খুব শীত। তো এইভাবে ওদেরকে তুলে দিয়েছে। তো এইভাবে ওদেরকে প্লেনে পেলাম।

এ বিষয়ে কামাল হোসেন আরও যুক্ত করেন, আমাদের সঙ্গে লন্ডন থেকে আরও উঠলেন গোলাম মওলা। লন্ডন থেকে আমরা যারা উঠলাম তাদের ছবি আছে। উনি বঙ্গবন্ধুর ভক্ত ছিলেন। ইন্সুরেন্স কোম্পানির ম্যানেজিং ডাইরেক্টর ছিলেন। সাইপ্রাসে আমাদের প্লেন তেল নিতে নেমেছিল। ৯ই জানুয়ারি। সেখান থেকে দিল্লি। অসাধারণ সংবর্ধনা দিলেন মিসেস গান্ধী। ওখানে পাশের মাঠে বাংলায় একটা ভাষণও দিলেন বঙ্গবন্ধু।

বঙ্গবন্ধুর প্রতি ভারত সরকারের দৃষ্টিভঙ্গি কেমন ছিল? উত্তরে ড. কামাল হোসেন বলেন, প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী তো তার পুরো কেবিনেটসহ উপস্থিত হলেন। এবং পাবলিকলি একটি সভাও অনুষ্ঠিত হয়। কিন্তু অবাক করা বিষয় হচ্ছে, রাষ্ট্রীয় একটি অনুষ্ঠানকে পারিবারিক মনে হয়েছে। সেখানে একে অপরকে জড়িয়ে ধরে, কোলাকুলি করা হচ্ছে। মনে হচ্ছে পরিবারের পুনর্মিলনী। তো, বঙ্গবন্ধুকে অনুরোধ করা হল, যে তিনি যেন সমবেত জনগণের উদ্দেশে কিছু বলেন।

১৫ আগস্টে আপনি কোথায় ছিলেন?

ওই সময়ে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. কামাল হোসেন বলেন, আমি যুগোস্লাভিয়ায় ছিলাম। টিটোর দেশ। (যুগোস্লাভিয়ার প্রধানমন্ত্রী ও রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব পালন করেছেন জোসিপ ব্রজ টিটো)। বঙ্গবন্ধুর আদেশে তার একটি কাজেই আমি যুগোস্লাভিয়ায় গিয়েছিলাম। কারণ, টিটো বলেছিলেন, পেরুতে জোট নিরপেক্ষ শীর্ষ সম্মেলন হতে যাচ্ছে পরের সেপ্টেম্বরে। তো, তাদের ফরেন মিনিস্টার আমাকে বললেন, ‘টিটো তোমার লিডারকে (বঙ্গবন্ধুকে) এত সম্মান করেন, যে সম্মেলনে মৌলিক রেজ্যুলেশন দেবে, যৌথভাবে। তো এ কারণে খসড়া তৈরি করতে হবে।’ সেজন্য আমাকে যুগোস্লাভিয়ার ফরেন মিনিস্টার বললেন, ‘তুমি তিনদিনের জন্য আসো, কিছু কাজ করি। তুমি ড্রাফট নিয়ে বঙ্গবন্ধুর সম্মতি নেবে আর আমি টিটোর সম্মতি নেবো।’ তারপরই যৌথভাবে পেরুতে অনুষ্ঠিত সম্মেলনে সেটি পাশ করবেন। তো আমি বললাম যে দেখো, আমার জন্য তিনদিনের জন্য আসা কঠিন। বঙ্গবন্ধুকেও বললাম, যে অনেকগুলো কাজ আছে। এরপর যুগোস্লাভিয়ার ফরেন মিনিস্টার আবার বঙ্গবন্ধুকে চিঠি দিল, ‘ঠিক আছে, তুমি তিনদিনের জন্য আসো। চতুর্থ দিনে তুমি ঢাকা থাকবে। ইত্যাদি, ইত্যাদি।’

জাতির পিতা শেখ মুজিবুর রহমান (ছবি: সংগৃহীত)

ড. কামাল হোসেন এ প্রসঙ্গে আরও বলেন, পরে বঙ্গবন্ধু বললেন, ‘তাদের এত আগ্রহ, তুমি তিনদিন হয়ে আসো।’ তো, বঙ্গবন্ধুর কাজে গিয়েছিলাম।

বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর?

ড. কামাল হোসেন যোগ করেন, খবর পেয়ে আমি বেলজিয়াম থেকে ছুটে জার্মানির বনে যাই। ওখানে আমাদের হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী অ্যাম্বাসেডর (সাবেক স্পিকার) আছে। হাসিনা ও রেহানা সেখানে ছিল। (প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তার বোন শেখ রেহানা) কারণ, হাসিনার স্বামী প্রফেসর ওয়াজেদ একটি ফেলোশিপ পেয়ে তখন জার্মানিতে ছিলেন। হুমায়ূন রশীদ আমাকে জানালেন, ‘তারা জার্মানিতে আছে। ব্রাসেলসে গেছে সানাউল হক সাহেবের ওখানে বেড়াতে।’ আমি বললাম, না, এ খবর পাওয়ার পর (বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড) কিভাবে ওরা গেল? হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী জবাবে বললেন, ‘না না, সে ব্যবস্থা করা হয়েছে। তারা বাই রোডে জার্মানিতে রওয়ানা হয়েছেন।’

এরপর আমি সোজা জার্মানিতে চলে আসি। আমি বনে আসার কিছুদিন পর হাসিনা সেখানে পৌঁছালেন । এরপর রেডিওতে, বিভিন্ন মাধ্যমে খবর নিচ্ছি দেশের। সেখানে হাসিনা (প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা) আমাকে বললেন, ‘আপনি আমাকে ছেড়ে চলে যাবেন না।’ আমি বললাম, নিশ্চিন্ত থাকুন, এখন আমার দেশে যাওয়ার প্রশ্নই উঠে না। আমি লন্ডনে যাব, তথ্যগুলো সংগ্রহ করবো।’

ড. কামাল হোসেন বলেন, বোধহয়, ১৬ বা ১৭ আগস্টে আমি লন্ডনে যাই। লাল পাসপোর্ট জমা দিয়ে সবুজ পাসপোর্ট নেব বলে। কেন গেলাম, তথ্য নিতে। ডিপ্লোম্যাট পাসপোর্ট জমা দিয়ে সবুজ পাসপোর্ট নেব। মারা গেছেন, ফারুক চৌধুরী, ও তখন ডেপুটি হাই কমিশনার লন্ডনে। ও এসে আমাকে রিসিভ করে নিয়ে গেল। ফারুক চৌধুরী বলল, ‘ঢাকা থেকে তো বলা হচ্ছে, আপনাকে কোনও প্লেনে তাড়াতাড়ি তুলে দিতে, আপনাকে মন্ত্রী ওরা করবে।’ উত্তরে আমি, মাথা খারাপ হইছে আমি মন্ত্রী হবো। আমি পাসপোর্ট পরিবর্তন করতে এলাম। দেশে যাওয়ার প্রশ্নই আসে না। তো এইভাবে আমি লন্ডনে থেকে গেলাম। অক্সফোর্ডে ফেলোশিপ পেয়ে গেলাম। পরিবারও সেখানে নিয়ে গেলাম।

সংবিধান প্রণেতা ড. কামাল হোসেন আরও বলেন,‘ ১৯৮০ সালে আমি দেশে আসি। আমি জার্মানিতে তাকে (প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা) কথা দিয়েছিলাম, সসম্মানে দেশে নেওয়ার ব্যবস্থা করবো। আমি দেশে ফেরার পর পার্টির যে গঠনতন্ত্র হল, সেখানে আমারও ভূমিকা ছিল। যৌথ নেতৃত্বের ব্যবস্থা করেছিলাম। বেগম তাজউদ্দীনকে (সাবেক প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমেদ এর স্ত্রী জোহরা তাজউদ্দীন) আমরা সভাপতি ও আবদুর রাজ্জাককে (প্রয়াত) সাধারণ সম্পাদক করি। কেউ এসে বললেন, ‘শেখ হাসিনাকে এখন সভাপতি করে আনলে কেমন হয়। বঙ্গবন্ধুকেও সম্মান জানানো হবে, ঐক্যের প্রতীক হিসেবে।’ তখন, বেগম তাজউদ্দীন প্রস্তাব দিয়েছিলেন, ‘করো, আমি সমর্থন করি।’

/টিএন/

ড. কামাল হোসেনের ছবি: সাজ্জাদ হোসাইন

সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
পিএসজিকে হারিয়ে ফাইনালে ডর্টমুন্ড
চ্যাম্পিয়নস লিগপিএসজিকে হারিয়ে ফাইনালে ডর্টমুন্ড
রাজস্থানকে হারিয়ে প্লে অফের আশা বাঁচিয়ে রাখলো দিল্লি
রাজস্থানকে হারিয়ে প্লে অফের আশা বাঁচিয়ে রাখলো দিল্লি
ঢাকা আসছেন মার্কিন অ্যাসিস্ট্যান্ট সেক্রেটারি ডোনাল্ড লু
ঢাকা আসছেন মার্কিন অ্যাসিস্ট্যান্ট সেক্রেটারি ডোনাল্ড লু
প্রথম ধাপের উপজেলা নির্বাচন আজ
প্রথম ধাপের উপজেলা নির্বাচন আজ
সর্বাধিক পঠিত
ব্যারিস্টার সুমনকে একহাত নিলেন চুন্নু
ব্যারিস্টার সুমনকে একহাত নিলেন চুন্নু
ছুড়ে দেওয়া সব তীর সাদরে গ্রহণ করলাম: ভাবনা
ছুড়ে দেওয়া সব তীর সাদরে গ্রহণ করলাম: ভাবনা
খালেদা জিয়ার শারীরিক অবস্থার দ্রুত অবনতি, বিএনপির প্রস্তুতি কী?
খালেদা জিয়ার শারীরিক অবস্থার দ্রুত অবনতি, বিএনপির প্রস্তুতি কী?
শনিবার স্কুল খোলা রাখার প্রতিবাদে শিক্ষকদের কর্মবিরতি ঘোষণা
শনিবার স্কুল খোলা রাখার প্রতিবাদে শিক্ষকদের কর্মবিরতি ঘোষণা
আসছে ব্যয় কমানোর বাজেট
আসছে ব্যয় কমানোর বাজেট