X
শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪
১৪ চৈত্র ১৪৩০

বাঁধের ওপর জীবন

বাংলা ট্রিবিউন রিপোর্ট
১৮ আগস্ট ২০১৭, ২২:২৬আপডেট : ১৯ আগস্ট ২০১৭, ১৭:৩৮

 

লালমনিরহাটের কুলাঘাট পাকার মাথা বাঁধ (ছবি-প্রতিনিধি) পানির ওপর মাথা উঁচু করে আছে বাঁধ, বাঁধের দু’ধারে ছুঁই ছুঁই বানের পানি। বন্যার কড়াল গ্রাস থেকে বাঁচতে সেই বাঁধের ওপরে ঠাঁই নিয়েছে দুর্গত মানুষেরা। কিন্তু তারা বলছেন, এই বেঁচে থাকা স্বস্তি দেয় না। প্রতিটি মুহূর্ত যেন প্রচণ্ড যন্ত্রণা। গবাদি পশুর সঙ্গে গাদাগাদি করে বেঁচে থাকা জীবনে এখন আর কারো করুণা চান না তারা, খাদ্যেরও আগে চাচ্ছেন সম্ভ্রম রক্ষার নিশ্চয়তা। পরিবারের নারী ও মেয়েরা শৌচাগার পেলেই যেন আপাত বর্তে যাবেন বাঁধগুলোতে আশ্রয় নেওয়া পুরুষেরা। খাদ্য সংকটে এমনিতেও নাকাল হয়ে পড়েছেন তারা।

চলমান বন্যার সংবাদ সংগ্রহের জন্য সরেজমিনে দেশের ২২টি জেলা থেকে সংবাদ পাঠিয়েছেন বাংলা ট্রিবিউনের প্রতিনিধিরা। এসব প্রতিবেদনজুড়ে শুধুই না থাকার বেদনা। দেশের উত্তর ও উত্তর-পূর্বাঞ্চলের অধিকাংশ জেলার বন্যাদুর্গতরা বাংলা ট্রিবিউনকে জানান, তাদের কাছে এখন শুধু ‘নেই, নেই আর নেই’ ছাড়া আর কিছু নেই। বিভিন্ন বাঁধের ওপর আশ্রয় নিয়ে কোনমতে বেঁচে আছেন তারা।

লালমনিরহাটের কুলাঘাট পাকার মাথা বাঁধে আশ্রয়প্রার্থীদের পরিচ্ছন্নতা কর্ম (ছবি-প্রতিনিধি)

সরেজমিনে লালমনিরহাটের বিভিন্ন অঞ্চল ঘুরে আমাদের লালমনিরহাট প্রতিনিধি জানান, সদর উপজেলার ধরলা নদী বেষ্টিত কুলাঘাট ইউনিয়নের কুলাঘাট পাকার মাথা ওয়াপদা বাঁধের ওপর মানবেতর জীবনযাপন করছেন বানভাসি মানুষেরা। সেখানে শতাধিক মানুষের আশ্রয় হলেও নেই বিশুদ্ধ পানি ও পয়নিষ্কাশন ব্যবস্থা। বিভিন্ন বাঁধের ওপর অস্থায়ী একচালা ঘর তুলে আছেন জেলার ৩৫টি ইউনিয়নের বন্যাদুর্গতরা। কিন্তু এখন পর্যন্ত সরকারি কোনও সাহায্য পাননি বলে অভিযোগ করেছেন তারা।

বাঁধে আশ্রিতরা জানান, কুলাঘাট পাকার মাথা বাঁধের উপর ৫০টির বেশি গৃহহীন পরিবার বসবাস করছেন। এই বাঁধসহ জেলার বিভিন্ন দুর্গম এলাকায় বাঁধ ও রাস্তার উপর অবস্থানকারী গৃহহীন বন্যাদুর্গতদের মাঝে সরকারি কোনো ত্রাণ সামগ্রীই পৌঁছাচ্ছে না। ফলে এসব বন্যা দুর্গত লোকজনের মাঝে চরম খাদ্য সংকট দেখা দিয়েছে। ওয়াপদা বাঁধে আশ্রয় নেওয়া রমজান আলী (৬৫) বলেন, ‘আমার ৮ সদস্যের পরিবার। তাদের নিয়ে কয়েক দিন থেকে ওয়াপদা বাঁধটির উপর একটি খোলা ঘরে আছি। কোথাও যাওয়ার কোনও জায়গা নেই।’

লালমনিরহাটের কুলাঘাট পাকার মাথা বাঁধে আশ্রয় নিয়েছেন কয়েক’শ পরিবার  (ছবি-প্রতিনিধি)

রমজান আলীর পরিবারের পাশে থাকা আজিজুল ইসলাম ও রুবিয়া খাতুন বলেন, ‘এ পর্যন্ত ধরলার ভাঙনে ৪ বার নদী গর্ভে বিলীন হয়েছে বাড়ি। এবারের বন্যায় কিছুই বাঁচাতে পারিনি। কোথাও যাওয়ার জায়গা নেই। তাই বাঁধের উপর আপাদত আছি। কোনও ত্রাণ পাইনি। ঘরে বয়স্ক ও অসুস্থ্য শ্বাশুড়ী এবং ১২ বছরের একটি ছেলে আছে। মাছ ধরে বাজারে বিক্রি করে যা পাই তা দিয়ে কোনো রকম সংসার চালানোর চেষ্টা করছি।’ আজিজুল ইসলাম আরও বলেন, ‘আমার বাবার ৩৫-৩৬ বিঘা জমি ছিল সবই নদীতে বিলীন হয়ে গেছে। এখন আমরা ভাইয়েরা সবাই নিঃস্ব হয়ে গেছি, ভিটে-মাটিও নাই।’

বগুড়া ধুনটের বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধে আশ্রয় নিচ্ছেন দুর্গতরা (ছবি-প্রতিনিধি)

ত্রাণ স্বল্পতার কথা স্বীকার করে লালমনিরহাট সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা শফিকুল ইসলাম বলেন, ‘১৫ মেট্রিকটন জিআর চাল কুলাঘাট ইউনিয়নে বরাদ্দ প্রদান করা হয়েছে। কিন্তু বানভাসি লোকজনের সংখ্যা অনেক বেশি। এজন্য সকলকে একযোগে ত্রাণসামগ্রী প্রদান করা সম্ভব হচ্ছে না। যেহেতু ত্রাণ বিতরণ চলমান রয়েছে সেহেতু তারাও পাবেন।’

এ ব্যাপারে লালমনিরহাট জেলা (ভারপ্রাপ্ত) ত্রাণ কর্মকর্তা সুজাদ্দৌলা বলেন, ‘ ১ লাখ ২ হাজার ৭৫০টি বন্যা দুর্গত পরিবারের জন্য ইতোমধ্যে ৩৮২ মেট্রিকটন জিআর চাল ও ১২ লাখ ৯৫ হাজার জিআর টাকা ও ১৭শ শুকনা খাবার প্যাকেট বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে।

বগুড়া সারিয়াকান্দির কুড়িপাড়া আশ্রয়কেন্দ্রে প্রায় ছয়’শ গবাদি পশু নিয়ে আশ্রয় নিয়েছেন ছয় শতাধিক পরিবার (ছবি-প্রতিনিধি)

বগুড়া জেলার বন্যা পরিস্থিতিও একই রকম। সারিয়াকান্দি ও ধুনট থেকে ঘুরে এসে বাংলা ট্রিবিউনের বগুড়া প্রতিনিধি জানান, বগুড়ার সারিয়াকান্দিতে বিভিন্ন স্কুলের আশ্রয়কেন্দ্রে ও বাঁধে আশ্রয় নেওয়া জনগণের দুর্ভোগ বেড়েছে। গত কয়েকদিনে তাদের মধ্যে সরকারি বা বেসরকারিভাবে পর্যাপ্ত ত্রাণ বিতরণ করা হয়নি। খাবার ছাড়াও বিশুদ্ধ পানি ও গবাদি পশুর খাবার সংকট এবং পয়নিষ্কাষণ ব্যবস্থার সংকট দেখা দিয়েছে।

এদিকে ধুনট উপজেলায় যমুনা নদীতে পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধের পূর্ব পাশে ১২টি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন অন্তত দুই হাজার পরিবার। অনেক পরিবার বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধে আশ্রয় নিয়েছেন। পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধের ভুতবাড়িতে ৩টি, রঘুনাথপুরে ১টি, বানিয়াজানে ২টি ও চুনিয়াপাড়ায় ২টিসহ মোট ১০ পয়েন্ট ফাঁটল দেখা দিয়েছে।

বগুড়া সারিয়াকান্দির কুড়িপাড়া আশ্রয়কেন্দ্রের মানবেতর জীবন (ছবি-প্রতিনিধি)

আমাদের সিরাজগঞ্জ প্রতিনিধি জানান, সিরাজগঞ্জের বন্যা কবলিত সদর, কাজিপুর, চৌহালী, বেলকুচি ও শাহজাদপুর উপজেলার প্রায় ৪ লাখ পানিবন্দি মানুষের বেশির ভাগের আশ্রয়স্থল এখন উচুঁ রাস্তাঘাটসহ পানি উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (পাউবো)-এর বাঁধ। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের আশ্রয়কেন্দ্রগুলোতে গাঁদাগাঁদি করে থাকার চেয়ে বন্যাদুর্গরা বাঁধে থাকতেই বেশি পছন্দ করছেন। নিজ নিজ বসতবাড়িতে বন্যার পানি ওঠায় বাধ্য হয়ে বাড়ির পাশের বাঁধেই উঠেছেন অনেকে। খোলা আকাশের নিচে বাঁধের ওপর পলিথিন ও বাঁশ দিয়ে ঝুপড়ি তুলে গবাদি পশু ও স্বজনদের নিয়ে আছেন তারা। বৃষ্টির কারণে প্রতিকূল পরিস্থিতির মধ্যে পড়লেও বিকল্প কোনও ব্যবস্থা নেই।

সিরাজগঞ্জের ছোনগাছা ইউনিয়নের পার পাচিল এলাকার বাঁধের দৃশ্য (ছবি-প্রতিনিধি)

গবাদি পশুর জন্য খড় কেনার টাকা-পয়সা নেই। তাই অন্যের বাঁশঝাড় থেকে পাতা কেটে এনে খাওয়াচ্ছিলেন জহুরুল নামের একজন। তিনি বলেন, ‘পানি কমার আশায় দিন কাটাচ্ছি। এছাড়া আর কিই বা করার!’ এ ব্যাপারে সিরাজগঞ্জ পাউবোর নির্বাহী প্রকৌশলী সৈয়দ হাসান ইমাম বলেন, ‘সদরের রানীগ্রাম থেকে কাজিপুর উপজেলার মাইজবাড়ি ইউনিয়ন পর্যন্ত প্রায় ২৭ কি.মি. বাঁধের বিভিন্ন স্থানে ক্ষতিগ্রস্ত হলেও তা মেরামত করা হয়েছে। বাঁধের সাথে স্থানীয়রা ঘরবাড়ি তোলায় অসংখ্য ইঁদুরের গর্তের কারণে বাঁধের ক্ষতি হয়েছে। পানি কমতে শুরু করেছে।’ পানি কমার সময়ও বাঁধে ধস নামতে পারে বলে সতর্ক করে দেন তিনি।

সিরাজগঞ্জের পার পাঁচিল এলাকার বাঁধের মানুষ ও পশুর সহাবস্থান (ছবি-প্রতিনিধি)


কয়েকদিন ধরে বন্যার পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে কুড়িগ্রাম প্রতিনিধি জানান, শহরের শুলকুর বাজারের উত্তর প্রান্তে ‘স্লুইচ গেটের রাস্তা’ নামে পরিচিত সড়কে গবাদি পশুর সঙ্গে পাশাপাশি রাত কাটাচ্ছেন আশ্রয় নেওয়া বানভাসিরা। কোনও মতে প্রাণে বাঁচলেও, সম্ভ্রম যেন আর বাঁচাতেই পারছেন না তারা। পুরুষরা নিজেদের দুর্ভোগ মেনে নিয়ে নির্ঘুম রাত কাটাচ্ছেন, কিন্তু তাদের স্ত্রী-কন্যাদের এ পরিস্থিতি থেকে উদ্ধার করার আকুতি জানান তারা। সেখানে আশ্রয় নেওয়া নারীরা জানান, চারপাশে অথৈ পানি। মাঝখানে এটাই উঁচু জায়গা। কয়েকদিন ধরে এখানেই থাকছেন তারা। কিন্তু টয়লেটের অভাবে বিপাকে পড়েছেন নারী ও মেয়েরা। এমনকি ক্ষুধা ও পিপাসা মেটাতে পানি ও খাবার খেতেও ভয় পাচ্ছেন তারা। 

কুড়িগ্রামের ‘স্লুইচ গেটের রাস্তা’ নামক সড়কে বানভাসিদের অস্থায়ী অবাস (ছবি-প্রতিনিধি)

সরেজমিনে দেখা যায়, রাস্তার দুই পাশে ছুঁই ছুঁই পানি। প্লাবিত পাথারের মধ্যে মাথা জাগিয়ে রাখা রাস্তাটির প্রায় তিন কিলোমিটার জায়গাজুড়ে আশ্রয় নিয়েছেন বন্যায় সব হারানো প্রায় দুই শতাধিক পরিবারের সদস্যরা। বাঁধের দুই পাশে গবাদি পশু আর মানুষের দিন কাটছে একসঙ্গে। পলিথিন বা কাপড়ের ছাউনি বানিয়ে সেখানে বাস করছেন তারা। একই চালের নিচে সন্তান-সন্তনি ও গবাদিপশুকে রাখতেও বিন্দুমাত্র দ্বিধা হচ্ছে না বলেও জানান বানভাসি মানুষেরা। 

কুড়িগ্রাম শহরের শুলকুর বাজারের উত্তর প্রান্তে বানভাসিদের নির্ঘুম রাত (ছবি-প্রতিনিধি)

যাত্রাপুর ইউনিয়নের ওয়াপদা বেড়ি বাঁধে আশ্রয় নেওয়া গবাদি পশুর মালিকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এক সপ্তাহ পার হয়ে গেলেও তারা কোনও গো-খাদ্য সহায়তা পাননি। বেশি দামে খড় কিনে এক বেলা, কোনও দিন দুবেলা খাবার দিচ্ছেন পশুকে। কিন্তু যে খড় কয়েকদিন আগে ২৫০ থেকে ৩০০ টাকা দিয়ে কিনতে পারতেন, বন্যার কারণে সেই খড় এখন কিনতে হচ্ছে ১২০০ থেকে ১৫০০ টাকায়। তাও পাওয়া যাচ্ছে না। ফলে স্বাস্থ্যহানি ঘটছে গবাদি পশুর। চারপাশ পানিতে নিমজ্জিত থাকায় প্রাকৃতিক কোনও খাবার জোগাড় করাও সম্ভব হচ্ছে না।

কুড়িগ্রামের বাঁধে আশ্রয় নেওয়া অসহায় পরিবারের আহারের প্রচেষ্টা (ছবি-প্রতিনিধি)

গাইবান্ধা জেলার অবস্থাও খুব একটা ভাল না। সাঘাটা, ফুলছড়ি, গোবিন্দগঞ্চ, পলাশবাড়ী ও সদরের বন্যা পরিস্থিতি দেখে এসে আমাদের গাইবান্ধা প্রতিনিধি জানিয়েছেন, ফুলছড়ি উপজেলার বানভাসিদের অনেকে উঁচু বাঁধে সাময়িকভাবে আশ্রয় নিলেও সেখান থেকেও সরে যেতে হয়েছে। কারণ, ফুলছড়ির ব্রহ্মপুত্র নদের সিংড়িয়া-রতনপুর বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধের বেশ কিছু পয়েন্ট মারাত্মক ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়েছে। ফলে লোকজনকে সরিয়ে দিয়েছে প্রশাসন।

এ ব্যাপারে গাইবান্ধার জেলা প্রশাসক গৌতম চন্দ্র পাল বলেন, ‘বাঁধের ভাঙন ঠেকাতে সেনাবাহিনী কাজ শুরু করেছে। বিভিন্ন পয়েন্ট ঝুঁকিপূর্ণ ও ধসের আশঙ্কা থাকায় বাঁধ সংলগ্ন লোকজনকে তাদের সম্পদ নিয়ে নিরাপদ আশ্রয় চলে যাওয়ার আহ্বান জানিয়ে মাইকিং করা হয়েছে। পাশাপাশি এসব এলাকায় বিশৃঙ্খলা এড়াতে বাঁধে অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে।’

গাইবান্ধার ফুলছড়ির ব্রহ্মপুত্র নদের সিংড়িয়া-রতনপুর বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ (ছবি-প্রতিনিধি)

রাজশাহী প্রতিনিধির রিপোর্ট থেকে জানা যায়, গত ১৩ আগস্ট বিকালে রাজশাহীর মোহনপুর উপজেলার ধূরইল ঘাসিগ্রাম ইউনিয়নের তানোর সীমানা এলাকার শীব ও বারনই নদীর বেড়িবাঁধ ভেঙে পানি ঢুকে হাজার হাজার বিঘা জমির ধান, সবজি ক্ষেত, পুকুর ও পানের বরজ তলিয়ে গেছে। বেড়িবাঁধ ভেঙে ভীমনগর, মেলান্দি, বেলনা, ঘাসিগ্রাম, বাজে দেওপুর, দেওপুর, মহিষকুন্ডি, ডাঙ্গা পাড়া, পালশা, গোয়ালপাড়া, আমরাইল ও শিবপুর গ্রামের শতাধিক পরিবার পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। বাঁধে আশ্রয় নেওয়া অসহায় মানুষরা আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছেন। পাঁচ দিনেও বাঁধ মেরামত সম্ভব হয়নি কেন জানতে চাইলে রাজশাহী পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মোখলেসুর রহমান বলেন, ‘বাঁধ মেরামতের পাইলিং কাজ চলছে। স্রোতের কারণে মেরামত কাজ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। তবে প্রযুক্তিসহ সব রকম প্রক্রিয়া নিয়ে আমরা বাঁধ মেরামতের কাজ করে যাচ্ছি।’ 

রাজশাহীতে বাঁধ বাঁচাতে পানির স্রোত কমানোর চেষ্টা স্থানীয়দের (ছবি-প্রতিনিধি)

জয়পুরহাট প্রতিনিধি জানান, তুলশীগঙ্গা নদীর বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধের বেশ কয়েকটি জায়গায় ফাটল দেখা দেওয়ায় হুমকির মুখে পড়েছে পুরো বাঁধ। ফলে অস্থিরতা দেখা দিয়েছে স্থানীয়দের মধ্যে।  এ ব্যাপারে জেলা পানি উন্নয়ন বিভাগের সহকারী বিভাগীয় প্রকৌশলী একেএম নজমুল হাসান জানান, তুলশীগঙ্গা নদীর পানি এখনও বিপদসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। তুলশীগঙ্গা বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধের আক্কেলপুর এলাকার মাদারতলী ঘাটে ২০ ফুট অংশ ভেঙে গেছে।  বাঁধটি মেরামত করা না গেলে আক্কেলপুর উপজেলার অন্তত ১০টি গ্রাম ক্ষতিগ্রস্ত হবে বলে দাবি করেন তিনি। স্বেচ্ছাশ্রমের ভিত্তিতে বৃহস্পতিবার (১৭ আগস্ট) সকাল থেকে বাঁধটি মেরামত শুরু করেন এলাকাবাসী। 

ভেঙে গেছে জয়পুরহাটের তুলশীগঙ্গা নদীর বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ (ছবি-প্রতিনিধি)

নীলফামারি প্রতিনিধি রিপোর্টে জানা যায়, বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হওয়ায় বাড়ি ফিরেছে নীলফামারীর ডিমলার পাঁচ শতাধিক পরিবার। তবে কোমর সমান পানিতে বসতভিটা তলিয়ে থাকায় এখনও তিস্তা ব্যারেজের ডানতীর বাঁধ ছাড়তে পারেনি এ উপজেলার খালিশা চাপানি ইউনিয়নের আরও ৩৩টি পরিবার। তাদের অভিযোগ, বাঁধে আশ্রয় নেওয়া নারীরা স্বাস্থ্যসম্মত পায়খানা বা শৌচাগারের অভাবে বিপাকে পড়েছেন। বন্যার কারণে পিছিয়ে পড়ছে বানভাসি ছেলেমেয়েদের পড়ালেখাও। বন্যার পানিতে ভেসে গেছে অনেকের পাঠ্য বই। পূর্ব ছাতনাই খোকার চড়ের পঞ্চম শ্রেণির ছাত্রী তহমিনা আখতার বলেন, ‘দুই মাস পরে বাৎসরিক পরীক্ষা। বন্যার কারণে বাঁধে আছি। পড়াশোনা করার পরিবেশ নেই। ছোট একটু জায়গায় দুটি ছাগল, হাঁস মুরগী, আমরা পাঁচজন মিলে কোনও রকমে বেঁচে আছি।’

নীলফামারীতে বাঁধে ভাঙনের ফলে শঙ্কিত বানভাসিরা (ছবি-প্রতিনিধি)

বাঁধে আশ্রিত দুর্গতরা জানান, সরকারিভাবে তাদের যে পরিমাণ ত্রাণ দেওয়া হয়েছে, তা প্রয়োজনের তুলনায় খুবই কম। এতে তারা খাবার, বিশুদ্ধ পানি, শিশুদের খাবার নিয়ে সংকটে রয়েছেন। একইভাবে পাচ্ছেন না চিকিৎসাসেবাও। পানি উন্নয়ন বোর্ড ডালিয়া ডিভিশনের নির্বাহী প্রকৌশলী মোস্তাফিজুর রহমান বাংলা ট্রিবিউনকে জানান, এ পয়েন্টে তিস্তার পানি বিপদসীমার ৬০ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে পানি প্রবাহিত হচ্ছে। পানি কমতে থাকায় বন্যা পরিস্থিতি উন্নতির দিকে।

বাঁধে ও উঁচু স্থানে আশ্রয় নেওয়া বন্যাদুর্গত মানুষের চোখে-মুখে অসহায়ত্ব (ফাইল ছবি)

 

হাওড় ঘুরে সুনামগঞ্জ প্রতিনিধি জানান, হাওড়ের অবস্থা আরও শোচনীয়। একাকার হয়ে গেছে পাহাড়ি ঢল, টানা বৃষ্টি, হাওড় উছলানো পানি আর সুনামগঞ্জবাসীর কান্না। বারবার ফসলহানির ফলে তাদের ধানের মাচা এখন খালি। ঘরে ধান-চাল বলতে কিছু নেই। কিন্তু পড়ে আছে পুরোটা বছর। সামনে একটাই উপায়, মাধুকরী হতে পারেন তারা। ভিক্ষা ছাড়া আর কোনও বিকল্প উপায় দেখছেন না হাওরের বন্যাদুর্গত মানুষেরা। তবে ভিক্ষা দেওয়ার মতো অবস্থা কারো আছে কিনা তা নিয়েও সংশয় প্রকাশ করেছেন তারা। সবার অবস্থাই তো একই রকম, তাহলে ভিক্ষাটা দিবে কে? ঘরে ঘরে হাত পাতলেও দু’মুঠো চাল-ডালে অঞ্জলি ভরবে কিনা, সে ব্যাপারেও সংশয় প্রকাশ করেছেন হাওড়ের মানুষেরা।তারা জানান, ‘ঋণ কইরা বৈশাইখা লাগাছিলাম, বৈশাইখা ধানও কাঁচা থাকতে ডুবে গেছে। তোরা তোরা আমন লাগাইছিলাম, এই ধানও পানির তলে। আমরা খাইমু কী কইরা আর বাঁচমু কী কইরা। মাইগা খাওন ছাড়া তো আর কোনও উপায় নাই।’

সুনামগঞ্জে হাওড়ের উঁচু জায়গাগুলোই বানভাসিদের শেষ আশ্রয়ের জায়গা (ছবি-প্রতিনিধি)

এছাড়াও শেরপুর, জামালপুর, রাজবাড়ী, ফরিদপুর, ও মৌলভীবাজার প্রতিনিধিদের পাঠানো প্রতিবেদনেও একই রকমের চিত্র পাওয়া যায়। বানভাসিরা জানান, একসময় সবই ছিল, আজ আর কিছুই নেই। চারপাশে শুধু থৈ থৈ পানি। সেই স্রোতে বিলীন হয়ে গেছে তাদের অতীতের স্থিরতা আর অনাগত স্বপ্নময় দিনগুলি। আর বর্তমান বলতে বুক ভরা হাহাকার নিয়ে শুধুই বেঁচে থাকা। এলাকার বাঁধ ও উঁচু সড়কে আশ্রয় নিয়ে মরে যাওয়ার মতো করেই বেঁচে আছেন বানভাসি মানুষেরা।

রাজবাড়ী গোয়ালন্দ পয়েন্টে ঘটি-বাটি-সন্তান নিয়ে মায়ের হাহাকার (ছবি-প্রতিনিধি)

/এএইচ/

সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
ডিভোর্স দেওয়ায় স্ত্রীকে কুপিয়ে নিজেও আত্মহত্যার চেষ্টা করেন স্বামী
ডিভোর্স দেওয়ায় স্ত্রীকে কুপিয়ে নিজেও আত্মহত্যার চেষ্টা করেন স্বামী
এক সপ্তাহের মাথায় ছিনতাইকারীর ছুরিকাঘাতে আরেকজন নিহত
এক সপ্তাহের মাথায় ছিনতাইকারীর ছুরিকাঘাতে আরেকজন নিহত
‘উচিত শিক্ষা’ দিতে পঙ্গু বানাতে গিয়ে ভাইকে হত্যা
‘উচিত শিক্ষা’ দিতে পঙ্গু বানাতে গিয়ে ভাইকে হত্যা
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে মানবাধিকার উইং চালুর পরামর্শ সংসদীয় কমিটির
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে মানবাধিকার উইং চালুর পরামর্শ সংসদীয় কমিটির
সর্বাধিক পঠিত
অ্যাপের মাধ্যমে ৪০০ কোটি টাকার রেমিট্যান্স ব্লক করেছে এক প্রবাসী!
অ্যাপের মাধ্যমে ৪০০ কোটি টাকার রেমিট্যান্স ব্লক করেছে এক প্রবাসী!
নিউ ইয়র্কে পুলিশের গুলিতে বাংলাদেশি তরুণ নিহত, যা জানা গেলো
নিউ ইয়র্কে পুলিশের গুলিতে বাংলাদেশি তরুণ নিহত, যা জানা গেলো
বিএনপির ইফতারে সরকারবিরোধী ঐক্য নিয়ে ‘ইঙ্গিতময়’ বক্তব্য নেতাদের
বিএনপির ইফতারে সরকারবিরোধী ঐক্য নিয়ে ‘ইঙ্গিতময়’ বক্তব্য নেতাদের
প্রথম গানে ‘প্রিয়তমা’র পুনরাবৃত্তি, কেবল... (ভিডিও)
প্রথম গানে ‘প্রিয়তমা’র পুনরাবৃত্তি, কেবল... (ভিডিও)
সমুদ্রসৈকতে জোভান-সাফার ‘অনন্ত প্রেম’!
সমুদ্রসৈকতে জোভান-সাফার ‘অনন্ত প্রেম’!