X
শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪
৭ বৈশাখ ১৪৩১

‘জেনে বুঝেই গ্রেনেড হামলা মামলার আলামত নষ্ট করা হয়’

নুরুজ্জামান লাবু
২১ আগস্ট ২০১৭, ১০:০৮আপডেট : ২১ আগস্ট ২০১৭, ১৮:৩৪







আব্দুল কাহার আকন্দ (ছবি সংগৃহীত) ‘জেনে বুঝেই তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেত্রী ও বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে হত্যাচেষ্টা মামলার আলামত নষ্ট করা হয়। একই সঙ্গে তদন্তটিকেও নেওয়া হয় ভিন্ন পথে। অথচ মামলার তদন্ত কর্মকর্তারা জানতেন হরকাতুল জিহাদ আল ইসলামী-বাংলাদেশ (হুজিবি) সদস্যরা শেখ হাসিনাকে বারবার হত্যার চেষ্টা করেছেন। কিন্তু প্রথম দফা তদন্তের সময় সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা এসব নিয়ে কোনও আগ্রহ দেখাননি।’ আলোচিত ২১ শে আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলার অধিকতর তদন্তের দায়িত্ব পালনকারী কর্মকর্তা পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) অতিরিক্ত উপ-মহাপরিদর্শক আব্দুল কাহার আকন্দ বাংলা ট্রিবিউনের সঙ্গে এক সাক্ষাতকারে এসব কথা জানিয়েছেন।






আব্দুল কাহার আকন্দ বলেন, ‘ষড়যন্ত্রকারীদের লক্ষ্য ছিল শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগকে ধ্বংস করা। এজন্য তারা বারবার শেখ হাসিনাকে হত্যার চেষ্টা করেছে। তাদের উদ্দেশ্য ছিল শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগকে ধ্বংস করতে পারলে দেশকে জঙ্গি রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা যাবে। তাদের এই ষড়যন্ত্রের সঙ্গে তৎকালীন ক্ষমতাসীন দলের অনেকেই জড়িত ছিলেন।’

২০০৪ সালের ২১ আগস্ট রাজধানীর বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ে তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেত্রী শেখ হাসিনাকে হত্যার উদ্দেশ্যে জনসভায় গ্রেনেড নিক্ষেপ করে দুর্বৃত্তরা। এতে মরহুম রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমানের স্ত্রী আইভি রহমানসহ ২৪ জন নিহত হন। আহত হন প্রায় চারশ’ মানুষ। অল্পের জন্য প্রাণে বেঁচে যান বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

এ ঘটনায় পরদিন মতিঝিল থানার এসআই শরীফ ফারুক আহমেদ বাদী হয়ে একটি মামলা দায়ের করেন। মামলার তদন্তভার নিয়োজিত করা হয় সিআইডির তৎকালীন এএসপি আব্দুর রশিদ। সিআইডির তৎকালীন বিশেষ পুলিশ সুপার রুহুল আমিনের নেতৃত্বে মামলাটি ভিন্নখাতে প্রবাহিত করার চেষ্টা করা হয়। প্রথমে শৈবাল সাহা পার্থ নামে এক তরুণকে এই মামলায় ফাঁসানোর চেষ্টা করা হয়। পরবর্তীতে ২০০৫ সালের ৯ জুন নোয়াখালীর সেনবাগ থেকে জজ মিয়া নামে এক ব্যক্তিকে গ্রেফতারের পর তাকে দফায় দফায় রিমান্ডে নিয়ে তার কাছ থেকে স্বীকারোক্তি আদায় করা হয়। সেসময় বিষয়টি নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা শুরু হলে মামলার তদন্ত কর্মকর্তা বদল করা হয়। নতুন তদন্ত কর্মকর্তা সিআইডির সেসময়ের এএসপি মুন্সি আতিকুর রহমানও হাঁটেন একই পথে। মূল ঘটনা আড়াল করে জজ মিয়া নাটকের মাধ্যমে এই হামলার সঙ্গে জড়িতদের বাঁচানোর চেষ্টা করা হয়।

কিন্তু এক-এগার পরবর্তী তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় মামলার নতুন তদন্ত কর্মকর্তা এএসপি ফজলুল কবির তার তদন্তে বিএনপি নেতা আব্দুস সালাম পিন্টুর যোগসাজসে হরকাতুল জিহাদের নেতাকর্মীদের এই হামলার সঙ্গে সম্পৃক্ততা পান। ২০০৮ সালের ১১ জুন তিনি আব্দুস সালাম পিন্টুসহ ২২ জনকে আসামি করে আদালতে অভিযোগপত্র দেন। তবে ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে রাষ্ট্রপক্ষের আবেদনের প্রেক্ষিতে ওই বছরের ৩ আগস্ট মামলাটির অধিকতর তদন্তের আদেশ দেন। তখন মামলাটির তদন্ত কর্মকর্তা নিযুক্ত করা হয় আব্দুল কাহার আকন্দকে।

আব্দুল কাহার আকন্দ জানান, আগের অভিযোগপত্রে ২১ শে আগস্টের হামলায় ব্যবহৃত গ্রেনেডের উৎস এবং এই হামলার নেপথ্য ইন্ধনদাতা ও পরিকল্পনাকারীদের বিষয়ে কোনও তথ্য ছিল না। আদালতের আদেশে তিনি এই বিষয়টির তদন্ত শুরু করেন। তদন্ত করতে গিয়ে তিনি দেখেন মামলার শুরুতেই এই ঘটনা ভিন্নখাতে প্রবাহিত করতে এর আলামত নষ্ট করা হয়েছে। ঘটনাস্থল থেকে আলামত হিসেবে যেসব গ্রেনেড উদ্ধার করা হয়েছিল তা ধ্বংস করা হয়েছে। এছাড়া আরও অনেক আলামত নষ্ট করা হয়।

তিনি বলেন, ‘তদন্ত করতে গিয়ে আমরা সোর্সের মাধ্যমে জানতে পারি এসব গ্রেনেড পাকিস্তান থেকে আনা হয়েছিল। সাবেক উপমন্ত্রী আব্দুস সালাম পিন্টু ও তার ভাই তাজউদ্দিন মিলে আব্দুল মাজেদ ভাট নামে এক ব্যক্তির মাধ্যমে এসব গ্রেনেড সংগ্রহ করে। মাজেদ ভাটকে গ্রেফতারের পর সে আদালতে এ বিষয়ে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিও দিয়েছে। একই সঙ্গে এই ঘটনায় জড়িত মুফতি আব্দুল হান্নানের সঙ্গে তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবরের ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ছিল। বাবরের মাধ্যমে হাওয়া ভবনে যোগাযোগ ঘটে মুফতি হান্নান ও তার সহযোগীদের।’ যদিও মামলাটি এখনও বিচারধীন বলে বিস্তারিত তথ্য প্রকাশ করাটা সমীচিন নয় বলে মন্তব্য করেন তিনি।

আব্দুল কাহার আকন্দ বলেন, ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার আগেও শেখ হাসিনাকে হত্যার উদ্দেশ্যে গোপালগঞ্জের কোটালিপাড়ায় বোমা পুঁতে রাখা হয়। সেই ঘটনার পাশাপাশি ফরিদপুরের একটি পীরের আস্তানায় হত্যাকাণ্ডের তদন্ত করতে গিয়ে মুফতি কামাল সাকের নামে একজনকে গ্রেফতার করা হয়। জিজ্ঞাসাবাদে সে কোটালিপাড়ার ঘটনার কথাও স্বীকার করে। তার কাছ থেকে হুজিবির সদস্যদের একটি তালিকা পাওয়া যায়। সেই তালিকায় মুফতি হান্নানের নাম ছিল। মুন্সি আতিক সেই ঘটনার তদন্ত করেছেন। হুজিবির সদস্যরা আদালতে দেওয়া স্বীকারোক্তিতে বলেছে, শেখ হাসিনাকে হত্যা ও আওয়ামী লীগকে ধ্বংসের উদ্দেশ্যেই তারা হামলার চেষ্টা করেছে। মুন্সি আতিক পরবর্তীতে ২১ আগস্ট হামলার তদন্ত করতে গিয়ে এই বিষয়গুলি আমলে নেয়নি। এটাতে স্পষ্ট যে উদ্দেশ্য প্রণোদিতভাবে তদন্তটি করা হয়েছিল।

আব্দুল কাহার আকন্দ বলেন, ‘পরবর্তীতে মুফতি হান্নান র‌্যাবের হাতে গ্রেফতার হওয়ার পর ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার কথা স্বীকার করে। কিন্তু, তখনও সেই বিষয়টি আমলে আনা হয়নি। মুফতি হান্নানকে তখনও এই মামলায় নেওয়া হয়নি। তারা অপরাধ স্বীকার করলেও তা রেকর্ড করা হয়নি।’ আগের তদন্ত কর্মকর্তারাই মামলাটিতে সমস্যা করেছে বলে মনে করেন তিনি।

তিনি বলেন, ‘মুফতি কামাল শাকের ফরিদপুরের সেই হত্যা মামলা থেকে নিজেকে বাঁচাতে মুফতি হান্নানসহ অন্যদের নিয়ে সেসময়ের স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবরের কাছে গিয়েছেন। তাদের সঙ্গে যোগাযোগ ছিল। বাবর সকাল-বিকাল হাওয়া ভবনে যেতেন। তার মাধ্যমে পলিটিক্যাল ইনফ্লুয়েন্স বা তৎকালীন সরকারের একটি অংশ হুজির সঙ্গে ষড়যন্ত্র করে ২১ আগস্ট হামলার পরিকল্পনা করে।’

অধিকতর তদন্ত শেষে তদন্ত কর্মকর্তা আব্দুল কাহার আকন্দ ২০১১ সালের ৩ জুলাই আদালতে সম্পূরক অভিযোগপত্র জমা দেন। যেখানে আগের ২২ আসামির সঙ্গে নতুন করে আরও ৩০ জনকে অভিযুক্ত করা হয়। ঘটনার পরিকল্পনকারী ও সরাসরি জড়িত হিসেবে নাম আসে বিএনপির সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট তারেক রহমান, তৎকালীন স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর, বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক সচিব হারিস চৌধুরী, জামায়াত নেতা আলী আহসান মুজাহিদ, সাবেক সংসদ সদস্য শাহ মোহাম্মদ কায়কোবাদ, বিশেষ গোয়েন্দা সংস্থা ডিজিএফআই, এনএসআইয়ের সেসময়ের  একাধিক কর্মকর্তা, পুলিশের তিন মহাপরিদর্শক, তদন্ত ভিন্ন পথে নেওয়া তিন তদন্ত কর্মকর্তাসহ আরও ১০ জন হুজিবি সদস্য।

আব্দুল কাহার আকন্দ বলেন, বঙ্গবন্ধু হত্যা, জাতীয় চার নেতা হত্যার ধারাবাহিকতায় শেখ হাসিনাকে হত্যা চেষ্টা করা হয়। এসব আসলে একই সূত্রে গাঁথা। তারা আসলে আওয়ামী লীগকে ধ্বংস করতে চেয়েছে। তাদের উদ্দেশ্য ছিল ইসলামী রাষ্ট্র কায়েম করা। ২১ শে আগস্ট হুজিবিকে ব্যবহার করা হয়েছে।

এই ঘটনার অভিযুক্ত আসামিরা সবাই যাতে সাজা পায় সেই আশা ব্যক্ত করে অতিরিক্ত এই ডিআইজি বলেন, এই ঘটনায় এখনও ১৯ জন আসামি পলাতক রয়েছে। পলাতক আসামিদের মধ্যে যারা দেশের বাইরে রয়েছে তাদের ধরতে রেড নোটিশ ইস্যু করা হয়েছে। আর যারা দেশের ভেতরে রয়েছে তাদের গ্রেফতারের চেষ্টা চলছে।

/টিএন/আপ-এসএনএইচ/
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
প্রাথমিক বিদ্যালয়ে অ্যাসেম্বলি বন্ধ
প্রাথমিক বিদ্যালয়ে অ্যাসেম্বলি বন্ধ
দ্বিতীয় বিয়ের চার দিন পর বৃদ্ধকে হত্যা, দুই ছেলে পলাতক
দ্বিতীয় বিয়ের চার দিন পর বৃদ্ধকে হত্যা, দুই ছেলে পলাতক
লখনউ ও চেন্নাইয়ের অধিনায়ককে ১২ লাখ রুপি জরিমানা 
লখনউ ও চেন্নাইয়ের অধিনায়ককে ১২ লাখ রুপি জরিমানা 
বিদ্যুৎস্পৃষ্টে প্রাণ গেলো ইউপি সদস্যের
বিদ্যুৎস্পৃষ্টে প্রাণ গেলো ইউপি সদস্যের
সর্বাধিক পঠিত
বাড়ছে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মানি, নতুন যোগ হচ্ছে স্বাধীনতা দিবসের ভাতা
বাড়ছে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মানি, নতুন যোগ হচ্ছে স্বাধীনতা দিবসের ভাতা
ইরান ও ইসরায়েলের বক্তব্য অযৌক্তিক: এরদোয়ান
ইস্পাহানে হামলাইরান ও ইসরায়েলের বক্তব্য অযৌক্তিক: এরদোয়ান
উপজেলা চেয়ারম্যান প্রার্থীকে অপহরণের ঘটনায় ক্ষমা চাইলেন প্রতিমন্ত্রী
উপজেলা চেয়ারম্যান প্রার্থীকে অপহরণের ঘটনায় ক্ষমা চাইলেন প্রতিমন্ত্রী
সংঘাত বাড়াতে চায় না ইরান, ইসরায়েলকে জানিয়েছে রাশিয়া
সংঘাত বাড়াতে চায় না ইরান, ইসরায়েলকে জানিয়েছে রাশিয়া
দেয়ালের দেশ: মন খারাপ করা সিনেমা
সিনেমা সমালোচনাদেয়ালের দেশ: মন খারাপ করা সিনেমা