X
বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪
১১ বৈশাখ ১৪৩১

মাটি আঁকড়েও থাকতে পারছে না রোহিঙ্গারা

আমানুর রহমান রনি, শাহপরীর দ্বীপ, টেকনাফ থেকে
১৬ সেপ্টেম্বর ২০১৭, ২৩:০১আপডেট : ১৭ সেপ্টেম্বর ২০১৭, ২১:০৫

রাখাইন থেকে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গারা নতুন করে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে দেশটির সেনাবাহিনী জাতিগত সহিংসতা শুরু করার পর গত দুই মাস ধরেই অনেক রোহিঙ্গা পরিবারের সদস্যদের নিয়ে নিজের ভিটেমাটি আঁকড়ে থাকার চেষ্টা করেছে। তারা প্রত্যাশা করেছিল, পরিস্থিতি একদিন শান্ত হবে। তাহলে তাদের আর অজানার ‍উদ্দেশে পাড়ি দিতে হবে না। কিন্তু রোহিঙ্গাদের সেই আশায় গুড়েবালি। দেশটির সেনাবাহিনীর অব্যাহত নির্যাতন ও রোহিঙ্গা হত্যার ফলে তারা আর বাপ-দাদার ভিটেমাটি আঁকড়েও থাকতে পারেনি। বাধ্য হয়েই তারা বাংলাদেশে পালিয়ে এসেছে। পালিয়ে আসা রোহিঙ্গারা জানিয়েছে, তাদের ফেলে আসা গ্রামগুলোয় যতদূর চোখ যায়, কেবলই ধ্বংস্তূপ আর হাহাকার। কোথাও কোনও মানুষ নেই আর।  

সেলিম উল্লাহ (৪৫)। মংডুর নাইক্যংপাড়া এলাকায় থাকতেন। তার স্ত্রীর নাম তাসমিনা খাতুন। দুই মেয়ে ও ছয় ছেলে নিয়ে গ্রামের সবার আসার পর তিনি এসেছেন। শাহপরীর দ্বীপ থেকে নৌকায় পার হয়ে টেকনাফের ভাঙ্গায় এসে স্ত্রী সন্তান নিয়ে গাড়ির জন্য অপেক্ষা করছেন। বাংলাদেশে আসতে দেরির কারণ হিসেবে তিনি জানান, স্ত্রী তাসমিনা খাতুন পক্ষঘাতগ্রস্ত (প্যারালাইসড)। স্ত্রী একমাস ধরে বিছানায় থাকায় তিনি তার পরিবার নিয়ে ঘরের মধ্যে কোনোভাবে ছিলেন। রাখাইনে রোহিঙ্গা যুবকদের হত্যা করা হয়, তাই আগেই ছেলেরা বাড়ি থেকে পালিয়ে এসেছেন।

সেলিম উল্লাহ বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আমি ভাবছিলাম আমাদের গ্রাম পোড়াবে না। তাও পাঁচদিন আগে পোড়ালো। আমাদের পাড়ায় কম ঘরবাড়ি, তার মধ্যে অনেকেই আগে চলে এসেছেন। ভাবছি আমাদের ঘর রক্ষা পাবে। তা আর হলো না। আমার স্ত্রী একমাস ধরে শরীরের বামপাশ নাড়াতে পারে না। তাকে চেয়ারে বসিয়ে পাহাড়, জঙ্গল বাপ-পুতে পার করে এসেছি। অনেক কষ্ট হয়েছে।’

রাখাইন থেকে পালিয়ে আসা সেলিম উল্লাহ কথা বলার সময় বার বার দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছাড়ছেন। কোথায় যাবেন, জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘বালুখালী ক্যাম্পে, সেখানে ছেলেরা আগেই আছে। এখন আমরা যাব। ক্যাম্পে ভালো থাকব না জানি, কিন্তু বেঁচে তো থাকবো।’

বাড়ির গুরুত্বপূর্ণ জমিজমার দলিলসহ প্রয়োজনীয় কাগজপত্র ঘরের সঙ্গে পুড়ে গেছে উল্লেখ করে সেলিম উল্লাহ বলেন, ‘আমার অল্প কিছু জায়গা ছিল, সে জমির দলিল ছিল ঘরেই। সব পুড়ে গেছে। সেনাবাহিনী এসেই গুলি করে, বিকট শব্দে কান ফেটে যায়। তারা  আমাদের ঘর থেকে বের হতে বলে, দ্রুত যে যা পেরেছি, তা নিয়ে বের হয়ে এসেছি।’

মংডুর হইজ্যারবিল এলাকা থেকে শনিবার সকালে এসেছেন নূর আমিন (৩৫)। তার স্ত্রী ও ছয় সন্তানসহ  নাফ নদী পার হয়ে শাহপরীর দ্বীপে এসে পৌঁছেছেন। আমিন মিয়ানমারে হালচাষ করতেন। স্ত্রীর কোলে ২৫দিন বয়সী সন্তান। স্ত্রী অন্তঃস্বত্তা থাকায় তিনি আগে আসতে পারেনিনি। সন্তান প্রসবের পর স্ত্রীকে নিয়ে এখন এসেছেন। একসপ্তাহ তারা নাক্যনডিয়া চরে ছিলেন। সেখান থেকে শনিবার নৌকায় পার হয়ে এসেছেন।

নূর আমিন বলেন, ‘আমার স্ত্রী অসুস্থ ছিল, টাকা ছিল না, তাই আসতে পারিনি। এতদিন ঘরের পেছনে পালিয়ে ছিলাম। এরপর চরে তাঁবু খাটিয়ে ছিলাম এক সপ্তাহ। এ সময় কোনও রকম শুকনো খাবার খেয়েছি।’

মিয়ানমার থেকে পালিয়ে আসা রোঙিঙ্গা নারী

 

নাফ নদী পার হয়ে মূলত দু’টি চরে রোহিঙ্গারা এসে নামে। একটি গুলার চর, অন্যটি জেলে পাড়া। শাহপরীর দ্বীপের জেটি থেকে ট্রলার অথবা বিজিবির চেকপোস্ট হয়ে গুলার চরে যেতে হয়। সাধারণ মানুষ সচরাচর সেখানে যায় না।

শনিবার দুপুরে গুলার চরে গিয়ে দেখা গেছে, নাফ নদী পার হয়ে কয়েকটি পরিবার এসে নামছে। তাদের একজন জোবায়দা (৩২)। তিনি নৌকা থেকে নেমে গুলার চরে তিন সন্তান নিয়ে বসে আছেন।  তার স্বামীর নাম মো. আলম। তাদের পাঁচ সন্তান। মংডুর হাসুরতায় তাদের বাড়ি। হাসুরতা বাজারে তার স্বামী সাইকেল, ভ্যান ও রিকশা মেরামতের দোকান করতেন। সেই বাজারটিতে গত মাসে আগুন দেয় সেনাবাহিনী। এরপর তাদের গ্রামেও আগুন। ২৩দিন আগে বাড়ি থেকে তারা রওয়ানা দিয়েছেন। এতদিন পাহাড়ে ও জঙ্গলে তাঁবু খাটিয়ে ছিলেন। জীবন বাঁচাতে জোবায়দার এমন দুঃসাহসিক যাত্রার কথা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমরা জঙ্গলে কখনও ভাত রান্না করেছি, কখনও লতা-পাতা রান্না করেছি। এসব খেয়েই বেঁচে ছিলাম। যেসব এলাকা দিয়ে আমরা এসেছি, এসব এলাকায় মগদের দেখেছি। আগুনে পোড়া দেখেছি। মানুষ কেটে কেটে টুকরো টুকরো করে তারা।’

এক প্রশ্নের জবাবে জোবায়দা বলেন, ‘আমাদের বাড়ি অনেক দূরে। সেখান থেকে আসতে সময় লাগে। এছাড়া টাকা ছিল না। তাই আসতে পারিনি। নদী পার হতে আমাদের প্রত্যেকের চার হাজার করে টাকা লাগছে। এত টাকা কোথায় পাবো? তাই আসিনি।’

ঘর থেকে সোল্যার প্যানেল, টর্চ লাইটসহ বেশকিছু জিনিস তারা নিয়ে এসেছেন। এগুলো আগেই বস্তায় ভরে ঘরের পেছনে রেখেছিলেন। তাই আগুন দেওয়ার পর তারা এসব নিয়ে চলে আসেন।

শনিবার দিনব্যাপী রাখাইন রাজ্যের বিভিন্ন এলাকা থেকে এমন অসংখ্য রোহিঙ্গাকে আসতে দেখা গেছে। যাদের গ্রাম দূরে তারাই এখন হেঁটে হেঁটে নাফ নদীর কাছে এসে নৌকায় উঠছেন। তাদের অনেকে ভেবেছিলেন তাদের ঘরে হয়তো আগুন দেওয়া হবে না।  কিন্তু শেষ মুহূর্তে আগুন দেওয়ায় আর থাকতে পারেননি।

গত ২৪ আগস্ট মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের নিরাপত্তা বাহিনীর অন্তত ২৯টি তল্লাশি চৌকিতে হামলার ঘটনা ঘটে। এরপর সেনাবাহিনী রাখাইন রাজ্যে তথাকথিত ক্লিয়ারেন্স অপারেশন শুরু করে। ২৫ আগস্ট থেকে লাখ লাখ রোহিঙ্গা টেকনাফ, উখিয়া ও বান্দরবানের বিভিন্ন পয়েন্ট থেকে বাংলাদেশে প্রবেশ করা শুরু করে। আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর দাবি, এখন পর্যন্তা তিন লাখ ৮৯ হাজার রোহিঙ্গা বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। মিয়ানমার সেনাবাহিনীর এমন অভিযান অব্যাহত থাকলে এই সংখ্যা দশলাখ হতে পারে বলে ধারণা। বাংলাদেশে আগে থেকেই চার লাখ রোহিঙ্গা বসবাস করছে। তাই বর্তমানে প্রায় আটলাখের বেশি রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে। মিয়ানমার তাদের ফেরত নিতে সবসময় অস্বীকার করে আসছে।

 

/এমএনএইচ/
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
দলের সিদ্ধান্ত না মেনে ভোটে আছেন মন্ত্রী-এমপির যেসব স্বজন
উপজেলা নির্বাচনদলের সিদ্ধান্ত না মেনে ভোটে আছেন মন্ত্রী-এমপির যেসব স্বজন
টিভিতে আজকের খেলা (২৪ এপ্রিল, ২০২৪)
টিভিতে আজকের খেলা (২৪ এপ্রিল, ২০২৪)
চেলসিকে গুঁড়িয়ে দিলো আর্সেনাল
চেলসিকে গুঁড়িয়ে দিলো আর্সেনাল
আদালতে সাক্ষ্য দিতে এসে কাঁদলেন মিতুর মা
আদালতে সাক্ষ্য দিতে এসে কাঁদলেন মিতুর মা
সর্বাধিক পঠিত
মিশা-ডিপজলদের শপথ শেষে রচিত হলো ‘কলঙ্কিত’ অধ্যায়!
চলচ্চিত্র শিল্পী সমিতিমিশা-ডিপজলদের শপথ শেষে রচিত হলো ‘কলঙ্কিত’ অধ্যায়!
আজকের আবহাওয়া: তাপমাত্রা আরও বাড়ার আভাস
আজকের আবহাওয়া: তাপমাত্রা আরও বাড়ার আভাস
জরিপ চলাকালীন জমির মালিকদের জানাতে হবে: ভূমিমন্ত্রী
জরিপ চলাকালীন জমির মালিকদের জানাতে হবে: ভূমিমন্ত্রী
ডিবির জিজ্ঞাসাবাদে যা জানালেন কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান
ডিবির জিজ্ঞাসাবাদে যা জানালেন কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান
ব্যাংক একীভূতকরণ নিয়ে নতুন যা জানালো বাংলাদেশ ব্যাংক
ব্যাংক একীভূতকরণ নিয়ে নতুন যা জানালো বাংলাদেশ ব্যাংক