X
শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪
৬ বৈশাখ ১৪৩১

আন্তর্জাতিক গণ-আদালত থেকে ফিরে যা বললেন সি আর আবরার

উদিসা ইসলাম
২৫ সেপ্টেম্বর ২০১৭, ২০:২৯আপডেট : ২৫ সেপ্টেম্বর ২০১৭, ২০:৩৬

 

অধ্যাপক সিআর আবরার রাখাইনে গণহত্যা চালানোর দায়ে রাষ্ট্র হিসেবে মিয়ানমারকে দোষী সাব্যস্ত করেছেন মালয়েশিয়ার কুয়ালালামপুরে অবস্থিত আন্তর্জাতিক গণ-আদালত। গত ১৮ থেকে ২১ সেপ্টেম্বর প্রত্যক্ষদর্শীর জবানবন্দি, বিভিন্ন প্রামাণ্য দলিল ও সাক্ষ্য গ্রহণের ভিত্তিতে ২২ সেপ্টেম্বর (শুক্রবার) মালয় বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন অনুষদের মিলনায়তনে এ রায় ঘোষণা করা হয়। এর আগে গণ-আদালতে শুনানির শেষ দিনে অং সান সু চি ও তার সামরিক সহযোগীদের গণহত্যার দায়ে ‘যুদ্ধাপরাধী’ হিসেবে ইন্টরন্যাশনাল ক্রিমিন্যার কোর্টের  (আইসিসি) কাঠগড়ায় দাঁড় করানোর সুপারিশ করেছেন সাক্ষী ও বাদীপক্ষের আইনজীবীরা। তাদেরই একজন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক সিআর আবরার। দীর্ঘদিন ধরে রোহিঙ্গাদের নিয়ে কাজ করার প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার আলোকে তিনি সাক্ষ্য দিয়ে এসেছেন এই এই গণআদালতে। সোমবার (২৫ সেপ্টম্বর) বাংলা ট্রিবিউনের মুখোমুখি হয়ে তিনি পুরো বিচারপ্রক্রিয়া সম্পর্কে তার বক্তব্য তুলে ধরেছেন।

কিভাবে এই বিচার সম্ভব হলো?

সি আর আবরার: মিয়ানমারে গণহত্যা নিয়ে এই গণআদালতে চলতি বছরের মার্চে প্রথম শুনানির আয়োজন করা হয়। এবার চূড়ান্ত শুনানি শেষে রায় ঘোষণা করা হয়েছে। এখনও  পূর্ণাঙ্গ রায় পাওয়া যায়নি। রোমভিত্তিক পারমানেন্ট পিপলস ট্রাইব্যুনাল (পিপিটি) নামের একটি সংগঠন এই আদালত গঠন করে। পিপিটি ষাটের দশকে ভিয়েতনাম যুদ্ধের পটভূমিতে প্রখ্যাত ব্রিটিশ দার্শনিক বার্ট্রান্ড রাসেল ও জ্যঁ পল সার্ত্রের আন্তর্জাতিক যুদ্ধাপরাধের ধারণায় প্রতিষ্ঠিত।

এ আদালতে ৯ সদস্যের বিচারকের একটি প্যানেল শুনানি গ্রহণ করেন। এরমধ্যে ছিলেন আর্জেন্টিনায় সেন্টার ফর জেনোসাইডের প্রতিষ্ঠাতা দানিয়েল ফিয়েরেস্তেইন, আয়ারল্যান্ডের ডেনিস হেলিডে, ইসরায়েলের যুদ্ধাপরাধ তদন্ত-প্রক্রিয়ায় যুক্ত জুলাইহা ইসমাইল, কম্বোডীয় আইনবিদ হেলেন জার্ভিস, ইন্দোনেশিয়ার মানবাধিকার-বিষয়ক আইনজীবী নুরসিয়াবানি, ভারতের মুম্বাই দাঙ্গার তদন্তকারী সাবেক বিচারপতি বেলুর নারায়ণ স্বামী শ্রীকৃষ্ণ, অস্ট্রেলিয়ার মেকুইয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের সাবেক প্রধান গিল এইচ বোয়েরিঙ্গার, ইরানের মানবাধিকার বিষয়ক আইনজীবী সাদি সদর ও ইতালির সলিসিটর জেনারেল নিলও রেসি।

আপনি সেখানে কিভাবে যুক্ত হলেন?

সি আর আবরার: আমাকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল। দীর্ঘদিন কাজের অভিজ্ঞতা থেকে করণীয় ও বাংলাদেশের পরিস্থিতিগুলো তুলে ধরতে চেয়েছি। কাজ করতে গিয়ে দেখা গেল, ১৯৭৮ কিংবা ১৯৯১ সালে যারা ঢুকেছিল, তাদের বিষয়ে কোনও ‘ইনস্টিটিউশনাল মেমরি’ নেই। আমাদের দেশে বিভিন্ন সরকারের আমলে রোহিঙ্গা ইস্যুটা যতটা গুরত্ব পাওয়ার কথা ছিল, তত পায়নি।সেখানে যারা সাক্ষ্য দিচ্ছেন, তারা ভিকটিম ও ভিকটিম পরিবারের সদস্য, যারা মিয়ানমারের ভেতরের কথা বলতে চেয়েছেন। তাদের অবস্থা যে দেশ ছাড়ার পরও ‘নিরাপদ’ হয়নি, সেই জায়গাটা বোঝা দরকার। অনর্দিষ্টকালের জন্য প্রজন্ম ধরে রোহিঙ্গারা অনেক কিছু থেকে বঞ্চিত, সেটা হাইলাইট করা প্রয়োজন ছিল। আমি আমার কাজ ও অভিজ্ঞতার আলোকে এই বিষয়ে করণীয় নিয়ে  কথা বলেছি।

আপনি ছাড়া আর কারা সাক্ষী ছিলেন?

সি আর আবরার: এখানে দুই ধরনের সাক্ষী ছিলেন,  ভিকটিম সাক্ষী ও বিশেষজ্ঞ সাক্ষী। বার্মিজ ভিন্নমতাবলম্বী একজন ছিলেন, যিনি ইংল্যান্ডে বসবাসকারী, ইন্টারন্যাশনাল জেনোসাইড ওয়াচ বিষয়ে বিশেষজ্ঞ সাক্ষী। এছাড়া ২৫ আগস্টের পরে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে প্রচারিত ভিডিও ফুটেজ, রাখাইনে ধারণ করা ভিডিও ক্লিপ দালিলিক প্রমাণ হিসেবে হাজির করা হয়েছে।

ভিকটিমরা জানিয়েছেন, কিভাবে চোখের সামনে দুই শ থেকে আড়াই শ নারীকে হত্যা করা হয়, সে তথ্য। ভিডিও ফুটেজে ধারণ করা হয়েছে, যেখানে প্লাস্টিকের ব্যাগে লাশ ভাসছে, নারীরা বলছেন ধর্ষণের ঘটনা। ওই সময় রোহিঙ্গারা নিজেরাই ভিডিও করতে করতে এলাকা ছেড়েছেন, এমনটা এবারই প্রথম দেখা যাবে।

অধ্যাপক সি আর আবরারের সঙ্গে উদিসা ইসলাম

ডিফেন্সে? কেউ ছিলেন?

সি আর আবরার: ট্রাইব্যুনালের আইন অনুযায়ীমিয়ানমার থেকে ছয়জনকে আহ্বান জানানো হয়েছিল। তারা যে আসবেন না, সেটা সবাই বুঝেছিল। ফলে দরকার ছিল একটি স্বাধীন ডিফেন্স বিশেষজ্ঞ নিয়োগ করা, কিন্তু তা হয়নি। আবার যখন শুনানি চলছিল,  সু চি তখন তার শেষ বক্তৃতাটি দিচ্ছিলেন দেশে বসে। সেটি সেখানে তাদের অবস্থান হিসেবে বিবেচনায় নেওয়া হয়েছে। বিবাদী পক্ষের আইনজীবী হিসেবে রোহিঙ্গা, কাচিন ও অন্য সংখ্যালঘুদের বিষয়ে মিয়ানমারের নেতাদের দেওয়া সাম্প্রতিক বছরগুলোর বিবৃতি বিবেচিত হয়েছে।

নারীরা তাদের ওপর নিপীড়নের বর্ণনা ‘ক্যামেরা ট্রায়ালের’ মাধ্যম তুলে ধরেছেন। আমাদের মানবাধিকার চেয়ারম্যান রিয়াজুল হক গিয়েছিলেন, সরকার কী করছে, তা তিনি জানিয়েছেন। তার উপস্থিতি গুরুত্বপূর্ণ ছিল।

আদালতের কার্যক্রম চলার সময় লাখ লাখ রোহিঙ্গা আবারও বাংলাদেশে প্রবেশ করার ঘটনা বিচারপ্রক্রিয়ায় বিশেষ গুরুত্ব পেয়েছে বলে মনে করেন?

সি আর আবরার: এ সময়ই চূড়ান্ত শুনানি হবে, তা ঠিক হয়েছিল মার্চে প্রাথমিক শুনানি শেষে মামলাটি আমলে নেওয়ার পর। সেপ্টেম্বরকে ধরে মামলাটি আগাচ্ছিল ওই  সময়েই। কিন্তু দু’টি ঘটনা একইসময়ে ঘটে যাওয়ায় স্বাভাবিকভাবেই বিশ্বের মনোযোগ বেশি পাওয়া গেছে। তবে আমি মনে করি, এই মুহূর্তে ২৫ আগস্টের পরে আসা রোহিঙ্গাদের দিকে মনোযোগ দিলেও আমাদের আসলে ১৯৯১-৯২ সালে আসা রোহিঙ্গাদের সুরক্ষা ও সমর্থন দেওয়ার কথা বিবেচনায় নিতে হবে। এ কথাগুলো শুনানিতেও বলেছি। আশ্বস্ত হওয়ার মতোও অনেক ঘটনা ঘটেছে। এমনকি লন্ডনভিত্তিক রোহিঙ্গা বিশেষজ্ঞ ও মিয়ানমারের মানবাধিকার নেতা মং জার্নি আমাদের ভাবতে সহায়তা করেন। তিনি সেনা আর্কাইভ থেকে তথ্য এনে সাহায্য করেন। তিনি বলেন, রোহিঙ্গা বাংলাদেশে থেকে যায়নি। তারা রাখাইনেই ছিল। ১৯৮২ সালের আইন এমনভাবে করা, যাতে মুসলমানরা মিয়ানমার ছাড়ে। সে দেশের নাগরিকত্ব পেতে হলে এটি প্রমাণ করতে হবে যে, সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির পূর্বপুরুষেরা ১৮২৪ সালের আগে মিয়ানমারে গিয়েছেন। কোনোটিই সম্ভব না।

রায়ে গণহত্যা ঘটছে বলা হলো, এরপর কী? এ বিচার বা রায়ের আসলে কোনও কার্যকারিতা আছে?

সি আর আবরার: এ রায় বা বিচারের আইনি কোনও ভিত্তি নেই। এটি কেবল নৈতিক চাপ সৃষ্টি করতে পারে। সমস্যার প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করার জন্যই এই আদালত প্রতিষ্ঠা। রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে অস্বীকারের প্রবণতা আছে, সেটি মানুষকে জানানো, এভিডেন্স সংগহ করা—এসবই এই আদালতর কাজ। আমাদের বলতে হবে ‘এথনিক ক্লিনজিং’ নয়, গণহত্যা চলছে। টপ জুরিরা যেভাবে জেরা করেছেন, প্রসিকিউশন যেভাবে উপস্থাপন করেছে, তাতে মামলাটির কোনও একদিন যখন বিচার হবে, তার ডকুমেন্টারি ইভিডেন্স হাজির থাকলো।

এই আদালতের মাধ্যমে কী কী করা গেলো বলে আপনি মনে করেন?

সি আর আবরার:  প্রথমত, নৃশংসতা যে হচ্ছে, তা প্রমাণিত। এই যে বলা হয় বাংলাদেশ থেকে রোহিঙ্গারা সেখানে গেছে, সেটি তো তাদের বিশেষজ্ঞই তথ্য দিয়ে ভুল প্রমাণ করলো। দ্বিতীয়ত, একটা দালিলিক প্রমাণ, আর্কাইভাল মেটেরিয়াল, ভিকটিমের সাক্ষ্য, বিশেষজ্ঞ সাক্ষী, ভিডিও ফুটেজ এসবের ঐতিহাসিক মূল্য আছে। তৃতীয়ত যেসব রাষ্ট্র বলার চেষ্টা করছে, গণহত্যা ঘটেনি, তাদের বুঝিয়ে দেওয়া জরুরি, গণহত্যা বলতে যা বোঝায়, তার সবই মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের সঙ্গে ঘটেছে।

কেন অস্বীকার করছে বলে মনে করেন?

সি আর আবরার: যখনই জেনোসাইড বলবেন, তখনই আপনাকে অ্যাক্ট করতে হবে। যখনই স্বীকার করে নেবেন, সক্রিয় হতে হবে। কিন্তু যারা অস্বীকার করছে, তারা তো অ্যাকশন নেবে না তাদের স্বার্থের কারণে। যারা এই গণহত্যার বিচার চায়, তাদের জন্য এই আদালতের বিচারটি গুরুত্বপর্ণ হাতিয়ার হবে। জেনোসাইড মানে কেবল হত্যা বা গণহত্যা না, জেনোসাইডের সংজ্ঞা ভিন্ন। যেকোনও জাতি ধ্বংস বা নির্মূল করার লক্ষ্যে এবং যাকে নির্মূল করা হচ্ছে তার আইডেন্টিটি ধ্বংস করার পাশাপাশি কোনও একটি  আইডেন্টিটিটি চাপিয়ে দেওয়াও জেনোসাইড। জিউদের যখন হত্যা করা হয়েছিল, তারা জিউ হিসেবেই মরেছে। অথচ রোহিঙ্গারা নিজ আইডেন্টিটি নিয়ে মরতে পারেনি। এ হত্যাকাণ্ড জিউদের হত্যা করার চেয়েও ভয়াবহ।

ছবি: সাজ্জাদ হোসেন

/এমএনএইচ/
সম্পর্কিত
মিয়ানমার ও রোহিঙ্গা সমস্যা: নিরাপত্তা পরিষদে নিজের অবস্থান তুলে ধরলো বাংলাদেশ
রোহিঙ্গাদের বাসা ভাড়া দিলে নেওয়া হবে আইনি ব্যবস্থা
ফেরত যাবেন মিয়ানমারের ১৮০ সেনা, ফিরবেন ১৭০ বাংলাদেশি
সর্বশেষ খবর
মার্কেসের 'আনটিল আগস্ট'
মার্কেসের 'আনটিল আগস্ট'
ভারতের লোকসভা নির্বাচনের ভোটগ্রহণ চলছে
ভারতের লোকসভা নির্বাচনের ভোটগ্রহণ চলছে
রেলক্রসিংয়ে রিকশায় ট্রেনের ধাক্কা, বাবার মৃত্যু মেয়ে হাসপাতালে
রেলক্রসিংয়ে রিকশায় ট্রেনের ধাক্কা, বাবার মৃত্যু মেয়ে হাসপাতালে
যুক্তরাষ্ট্র দূতাবাসের পুরস্কার পেলেন কুবির চার শিক্ষার্থী
যুক্তরাষ্ট্র দূতাবাসের পুরস্কার পেলেন কুবির চার শিক্ষার্থী
সর্বাধিক পঠিত
সয়াবিন তেলের দাম পুনর্নির্ধারণ করলো সরকার
সয়াবিন তেলের দাম পুনর্নির্ধারণ করলো সরকার
ডিএমপির ৬ কর্মকর্তার বদলি
ডিএমপির ৬ কর্মকর্তার বদলি
পিএসসির সদস্য ড. প্রদীপ কুমারকে শপথ করালেন প্রধান বিচারপতি
পিএসসির সদস্য ড. প্রদীপ কুমারকে শপথ করালেন প্রধান বিচারপতি
নিজ বাহিনীতে ফিরে গেলেন র‍্যাবের মুখপাত্র কমান্ডার মঈন
নিজ বাহিনীতে ফিরে গেলেন র‍্যাবের মুখপাত্র কমান্ডার মঈন
পরীমনির বিরুদ্ধে ‘অভিযোগ সত্য’, গ্রেফতারি পরোয়ানা জারির আবেদন
পরীমনির বিরুদ্ধে ‘অভিযোগ সত্য’, গ্রেফতারি পরোয়ানা জারির আবেদন