X
বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪
১১ বৈশাখ ১৪৩১
উখিয়া টু বালুখালি

ত্রাণের জন্য অন্তহীন অপেক্ষা

নুরুজ্জামান লাবু, কক্সবাজার (উখিয়া) থেকে
২৬ সেপ্টেম্বর ২০১৭, ১১:৫৮আপডেট : ২৬ সেপ্টেম্বর ২০১৭, ২৩:৪৩

ত্রাণের অপেক্ষায় থাকা রোহিঙ্গারা রাত ৮টা, চারিদিকে অন্ধকার। দূরে স্থানীয় বাসিন্দা আর রোহিঙ্গাদের নতুন-পুরনো ক্যাম্পগুলোয় মিটি মিটি আলো জ্বলছে। মাঝে মধ্যেই দেখা যাচ্ছে ছোটবড় গাড়ি ছুটে যেতে। এর মধ্যে চোখে পড়লো রাস্তার পাশে নারী, পুরুষ ও শিশুদের ছোট ছোট জটলা। কেউ দাঁড়িয়ে, আবার কেউ বসে আছে। সবাই বসে আছে ত্রাণের অপেক্ষায়। ট্রাক দেখলেই ছুটে যায়, যদি ত্রাণ মেলে। সোমবার বিকাল থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত দেখা গেলো এই চিত্র।

কুতুপালং আর বালুখালি মাঝামাঝি রাস্তায় একটা জটলার দিকে এগিয়ে যেতেই দেখা মিললো কয়েকজন নারীর। এদের একজন রাশিদা।বয়স পঞ্চাশের কাছাকাছি। স্বামী নজির আহমেদের কোনও খোঁজ জানেন না। তিন দিন আগে তমব্রু সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশে এসেছেন। কিন্তু থাকার কোনও জায়গা পাচ্ছেন না। খাবারের ব্যবস্থাও নেই। স্থানীয় এক ব্যক্তির বাড়িতে প্রথম তিন দিন থেকেছেন। সোমবার খাবারের সন্ধানে বেরিয়েছেন, রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছেন যদি কেউ কিছু দিয়ে সহযোগিতা করে।

রাশিদা জানান, তাদের বাড়ি রাখাইনের বালি বাজার এলাকায়। বাড়িতে গরু ছিল, জমি-জমাও ছিল। ছেলে-মেয়েদের নিয়ে সুখের সংসারও ছিল। কিন্তু এক নিমিষেই সব তছনছ হয়ে গেল। স্বামী-সন্তানদের কোনও খোঁজ নেই।প্রতিবেশীদের সঙ্গে জীবন নিয়ে কোনও রকমে পালিয়ে এসেছেন।তার আশা,স্বামী-সন্তানরা কোথাও না কোথাও আশ্রয় নিয়ে আছেন।

ত্রাণের জন্য অন্তহীন অপেক্ষা

রাশিদার মতো ত্রাণের অপেক্ষায় ছিল কিশোরী ইয়ারুন্নেছা। স্বামীকে হারিয়ে ফেলেছে সে। চার দিন আগে তমব্রু দিয়ে এসেছিল তারা। কিন্তু স্বামী আজিজের কোনও খোঁজ পাচ্ছেন না। ছোটবেলায় বাবা-মা হারানো ইয়ারুন্নেছা বড় হয়েছেন চাচাদের কাছে। বাংলাদেশে পালিয়ে আসার সময় সেই চাচাদের কাছেও যেতে পারেননি।

ইয়ারুন্নেছা বলেন, ‘সকালে গুড়-মুড়ি পেয়েছিলাম। দুপুরে চিড়া।তাই খেয়েছি। রাতের খাবারের কোনও ব্যবস্থা হয়নি। রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছি, যদি কোনও সহযোগিতা পাই। তবেই রাতের খাবার জুটবে।’

বিকালে একজন ৪০টা টাকা দিয়েছে।তা সংগ্রহ করতে গিয়ে রীতিমতো যুদ্ধ করতে হয়েছে তাকে।এতে হাত কেটে রক্তও বেরিয়েছে। হাতের সেই জমাটবাধা রক্ত দেখিয়ে ইয়ারুন্নেছা বলেন,‘কোনও ত্রাণ না পেলে এই ৪০ টাকা দিয়ে রাতের খাবার কিনে সবাই ভাগ করে খাবো।’

ত্রাণের অপেক্ষায় থাকা ইয়াসমিন

১৫ বছরের ইয়াসমিনও ত্রাণের জন্য অপেক্ষা করছিল। তার কাছে বাবা-মায়ের কথা জিজ্ঞাসা করতেই ডুকরে কেঁদে ওঠে।  মা ও ভাই হারানোর সেই ঘটনার বর্ণনা দিয়ে সে বলে, ১০-১২ দিন আগের কথা। তাদের বাড়িতে মগরা যখন আক্রমণ করেছিল তখন বাবা কুইল্যা মিয়া, ছোট দুই বোন তাসমিন আরা ও সুমা আর ভাই সুমনকে নিয়ে বাড়ির পেছনের দিক দিয়ে বেরিয়ে এসেছিল সে। বাড়িতে ছিল তার মা জোহরা খাতুন আর বড় ভাই ফারুক। মগরা তাদের সামনেই বাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেয়। তার তার মা ও ভাইকে নির্মমভাবে হত্যা করে। মাথা কেটে কাটা মণ্ডু দূর থেকে তাদের দেখায়।এরপর তারা চলে আসে তমব্রু সীমান্তে। সেখানে কয়েকদিন থাকার পর সীমানা পেরিয়ে এসেছে কুতুপালং পুরনো ক্যাম্পের খালার বাসায়। বছরখানেক আগে খালা তার পরিবার নিয়ে চলে এসেছিল বাংলাদেশে। ইয়াসমিনের ভাষ্যমতে, তার বাবা চোখে দেখেন না। বড় ভাই ফারুক আর মা ছিল সংসারের উপার্জনক্ষম ব্যক্তি। জমিতে চাষ করে বড় ভাই আর মা তাদের সংসার চালাতো। মা আর ভাইয়ের মৃত্যু তাদের একেবারেই অবলম্বনহীন করেছে।

কাঁদতে কাঁদতে ইয়াসমিন বলছিল, ‘ছোট ভাইবোন আর অন্ধ বাবাকে খালার বাসায় রেখে বেরিয়েছি খাবারের সন্ধানে। কারণ খালাও যে আশ্রয়হীন, ক্যাম্পে কোনোরকমে খেয়ে না খেয়ে জীবন কাটায়। সে এতগুলো মুখের আহার যোগাবে কিভাবে?’

নতুনদের সঙ্গে ত্রাণের আশায় পুরনোরাও: নতুন করে আসা রোহিঙ্গাদের সঙ্গে কক্সবাজারে আগে থেকে থাকা রোহিঙ্গারা মিশে ত্রাণ নিচ্ছে। বিকালে এই প্রতিবেদক যখন উখিয়া থেকে বালুখালির দিকে যাচ্ছিলেন, তখন রাস্তায় মাঝে মধ্যেই রোহ্ঙ্গিাদের বসে থাকতে দেখে সিএনজি চালক আব্দুর রহিমের কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন,নতুন-পুরনো রোহিঙ্গরা ত্রাণের আশায় বসে আছে।

পুরনো রোহিঙ্গাদের বিষয়ে জানতে চাইলে স্থানীয় এই ব্যক্তি বলেন, ‘পুরনোদের মধ্যে যারা গরিব তারা নতুনদের সঙ্গে মিশেছে। রাস্তায় দাঁড়িয়ে কিছু সহযোগিতা পেলে খারাপ কি? মাঝে মধ্যে ত্রাণের ট্রাকগুলো থামিয়ে নানারকমের খাবার আর অন্যান্য জিনিসপত্র ছুঁড়ে দেয়,তাই কাড়াকাড়ি করে নিয়ে যায় ওরা।’

উখিয়া-বালুখালির রাস্তা

সোমবার বিকালে এই প্রতিবেদক কুতুপালং এলাকায় খবর সংগ্রহের সময় অনেক নারী ও শিশুদের মানুষের কাছে সহযোগিতা চাইতে দেখেছেন। যাদের বেশিরভাগই পুরানো ক্যাম্পের রোহিঙ্গা বলে বলছিলেন স্থানীয়রা।

রেজিস্ট্রেশনের জন্য সাড়া কম: রোহিঙ্গাদের নাম নিবন্ধন করে পদ্ধতি অনুসারে ত্রাণ বিতরণের কথা বলা হলেও অনেকেই বিষয়টি জানেনই না। আবার অনেকের নাম নিবন্ধনের ক্ষেত্রে আগ্রহও নেই।

রহিমা খাতুন নামে পাঁচ সন্তানের জননী বলেন, তিনি দুদিন আগে এসেছেন। কোথায় নাম নিবন্ধন করে তার জানা নেই। যেখানে রাত হচ্ছে তিনি সেখানেই কাটাচ্ছেন। আর চেয়ে-চিন্তে কোনোরকমে দিন পার করছেন।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে,সোমবার রাত পর্যন্ত মাত্র ১৯ হাজারের কিছু বেশি রোহিঙ্গা তাদের নাম নিবন্ধন করেছেন।

পাসপোর্ট অধিদফতরের সহকারী পরিচালক আজিজ আহমেদ জানান, তারা সব রোহিঙ্গাদের নাম নিবন্ধনের বিষয়টিকে গুরুত্ব দিচ্ছেন। এজন্য প্রয়োজনীয় সব ব্যবস্থাও নেওয়া হচ্ছে।

আরও পড়ুন:

স্বজনদের লাশ শনাক্তে মিয়ানমারে ফিরতে চায় রোহিঙ্গা হিন্দুরা

বিধবা হিন্দু রোহিঙ্গা নারীরা বললেন নির্যাতনের কথা

মুসলিম নারীদের সঙ্গে বোরকা পরে পালিয়ে এসেছেন পূজা

/এনএল/এসটি/
সম্পর্কিত
কক্সবাজার জেলার রোহিঙ্গা ভোটারদের তালিকা চেয়েছেন হাইকোর্ট
মিয়ানমারের ২৮৫ জন সেনা ফেরত যাবে, ফিরবে ১৫০ জন বাংলাদেশি
মিয়ানমার ও রোহিঙ্গা সমস্যা: নিরাপত্তা পরিষদে নিজের অবস্থান তুলে ধরলো বাংলাদেশ
সর্বশেষ খবর
ট্রাকের সঙ্গে সংঘর্ষে বাস উঠে পড়লো রেললাইনে, ট্রেন থামিয়ে যাত্রীদের উদ্ধার
ট্রাকের সঙ্গে সংঘর্ষে বাস উঠে পড়লো রেললাইনে, ট্রেন থামিয়ে যাত্রীদের উদ্ধার
আপিল বিভাগে নিয়োগ পেলেন তিন বিচারপতি
আপিল বিভাগে নিয়োগ পেলেন তিন বিচারপতি
চুরি করা গরুসহ ট্রাক থামিয়ে পালিয়ে যায় চোরেরা, আগুন ধরিয়ে দিলো জনতা
চুরি করা গরুসহ ট্রাক থামিয়ে পালিয়ে যায় চোরেরা, আগুন ধরিয়ে দিলো জনতা
বাংলাদেশ সফরের জিম্বাবুয়ে দলে অ্যালিস্টার ক্যাম্পবেলের ছেলে
বাংলাদেশ সফরের জিম্বাবুয়ে দলে অ্যালিস্টার ক্যাম্পবেলের ছেলে
সর্বাধিক পঠিত
মিশা-ডিপজলদের শপথ শেষে রচিত হলো ‘কলঙ্কিত’ অধ্যায়!
চলচ্চিত্র শিল্পী সমিতিমিশা-ডিপজলদের শপথ শেষে রচিত হলো ‘কলঙ্কিত’ অধ্যায়!
জরিপ চলাকালীন জমির মালিকদের জানাতে হবে: ভূমিমন্ত্রী
জরিপ চলাকালীন জমির মালিকদের জানাতে হবে: ভূমিমন্ত্রী
ব্যাংক একীভূতকরণ নিয়ে নতুন যা জানালো বাংলাদেশ ব্যাংক
ব্যাংক একীভূতকরণ নিয়ে নতুন যা জানালো বাংলাদেশ ব্যাংক
ডিবির জিজ্ঞাসাবাদে যা জানালেন কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান
ডিবির জিজ্ঞাসাবাদে যা জানালেন কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান
সিয়াম-মেহজাবীনের পাল্টাপাল্টি পোস্টের নেপথ্যে…
সিয়াম-মেহজাবীনের পাল্টাপাল্টি পোস্টের নেপথ্যে…