X
শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪
১৫ চৈত্র ১৪৩০

মৃত ভেবে শিশুটিকে ফেলে গিয়েছিল মগরা

নুরুজ্জামান লাবু, তমব্রু সীমান্ত থেকে
২৬ সেপ্টেম্বর ২০১৭, ২২:৫২আপডেট : ২৭ সেপ্টেম্বর ২০১৭, ০০:৪৬

দাদির কোলে রোহিঙ্গা শিশু রেদোয়ান

বাবা-মাকে হত্যার পর মৃত ভেবে শিশুটিকে ফেলে গিয়েছিল মগরা। তারা ভেবেছিল শিশুটি মরে গেছে। খবর পেয়ে শিশুটির স্বজনেরা যখন তাদের বাসায় যায় তখন বাবা-মায়ের রক্তে ভেসে যাওয়ায় মেঝেতে বসে কাঁদছিল। প্রথমে শিশুটিকে দ্রুত উদ্ধার করে আনা হয়। পরে গিয়ে আনা হয় তার বাবা-মায়ের লাশ। গেল ঈদ-উল-আযহার দিন এই নির্মম ঘটনাটি ঘটে নাইক্ষ্যংছড়ির তমব্রু সীমান্তের ওপারে মিয়ানমারের তমব্রুর ডেকোবনিয়া ৪ নম্বর ওয়ার্ডের উত্তরপাড়ায়। শিশুটি এখন তমব্রুর নোম্যান্ডস ল্যান্ডের তমব্রু পশ্চিমকূল স্কুলের পাহাড় এলাকার একটি রোহিঙ্গা ক্যাম্পে দাদা-দাদি ও চাচা-চাচিদের আশ্রয়ে রয়েছে।

রেদোয়ান নামে দুই বছরের উচ্ছ্ল শিশুটি প্রায় প্রতিদিনই বাবা-মায়ের জন্য কাঁদে। স্বজনরা তাকে নানা খেলনা হাতে দিয়ে শান্ত রাখার চেষ্টা করছে। শিশুটির বাবা জাহার উল্লাহ (২৫) ও মা আয়েশা খাতুন (২১) কে সেদিনই তমব্রুর বাংলাদেশ অংশের স্থানীয় কবরাস্থানে দাফন করা হয়েছে।

মৃত ভেবে ফেলা রাখা শিশু রেদোয়ানকে উদ্ধার করে এক নিকটাত্মীয়। তখনও রেদোয়ানের গায়ে লেগে আছে রক্ত।

আসলে কি ঘটেছিল সেদিন? গত মাসের ২৫ আগস্ট অশান্ত হয়ে ওঠা রাখাইন রাজ্যের তমব্রু মিয়ানমারের অংশ থেকে এই পাড়ে চলে আসা জাহার উল্লাহ ও আয়েশা তাদের একমাত্র সন্তানকে নিয়ে কেন গিয়েছিলেন আবার ওপারে? নোম্যান্স ল্যান্ডের সেই রোহিঙ্গা ক্যাম্পে বসে কথা হয় জাহার উল্লাহর বড় ভাই কেফায়েত উল্লাহর সঙ্গে। সচ্ছ্ল পরিবারের সন্তান কেফায়েত জানান, তার বাড়ি-জমিজমা, হালের জন্য একাধিক ট্রাক্টর, চিংড়ির ব্যবসা, নিজের দোকান সবই ছিল তার। ২৫ আগস্টের উত্তেজনার পর তারা ২৯ আগস্ট ভয়ে পরিবারের সবাই মিলে চলে আসেন নোম্যান্স ল্যান্ডে। সীমান্তের কাঁটাতারের বেড়া থেকে তার বাড়ি দেখা যায়। সম্পদের ক্ষতি হলেও পরিবারের কেউ যে আক্রান্ত হবেন এমনটা ভাবেননি কখনোই।

কেফায়েত উল্লাহ বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘ঈদের দিন তার ভাই স্থানীয় মসজিদে নামাজ আদায় করেন। এপারে জলপাইতলায় এক বন্ধুর বাসায় গিয়ে কোরবানির মাংস নিয়ে আসেন ক্যাম্পের বাসায়। গোসলের সমস্যা বলে আয়েশা তার স্বামীকে বলেন সীমান্তের ওপারেই নিজেদের বাড়িতে যাওয়ার জন্য। গোসল করে এবং বাড়িতে রেখে আসা মালামাল দেখে আসা দুটোই হবে। দুপুরে জাহার উল্লাহ আর আয়েশা তাদের একমাত্র শিশু সন্তানকে নিয়ে রওয়ানা দেন নিজের বাড়ির উদ্দেশ্যে। সঙ্গে ছিল ফুফাতো ভাই একরাম উল্লাহ। জাহারদের বাড়ির পাশেই একরামদের বাড়ি।’

রেদোয়ানের বাবা জাহারউল্লাহকে মগরা হত্যা করার পর তার মরদেহ বয়ে নিয়ে যাচ্ছেন ছোট ভাই শরীয়ত উল্লাহ।

কাছ থেকে এই নৃশংসতা দেখা একরাম উল্লাহ জানান, তারা বাড়িতে যাওয়ার আধ ঘণ্টা পরই দেখেন হাতে আগ্নেয়াস্ত্র, বড় বড় কিরিচ আর ছুরি নিয়ে ১০-১২ জনের একটি মগের দল তাদের বাড়ির দিকে আসছে। একরাম নিজে বাড়ি থেকে বেরিয়ে পেছনের জঙ্গলে গিয়ে আত্মগোপন করেন। এর আগে জাহার উল্লাহ আর তার স্ত্রী আয়েশাকে মগের দল আসার খবর দেন। শিশু সন্তান রেদোয়ান ঘুমিয়েছে বলে জাহার-আয়েশা দম্পতি বাইরের দরজা বন্ধ করে ভেতরে চুপ করে বসেছিলেন। যেন মগরা ভাবে বাড়িতে কেউ নেই। কিন্তু বাড়িতে যাওয়াই যেন কাল হলো তাদের।

একরাম উল্লাহ বলছিলেন, ‘মগরা বাড়িতে এসেই দুমদাম হামলা করে দরজা ভেঙে ফেলে। তারা প্রথমে গুলি করে, পরে কুপিয়ে ও ছুরিকাঘাতে হত্যা করে জাহার-আয়েশা দম্পতিকে। আমি বিষয়টি সঙ্গে সঙ্গে জাহারের বড় ভাই কেফায়েতকে জানাই।’  তিনি আরও বলেন, ‘মগরা বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পর প্রথম জাহারের বাড়িতে ঢুকি। দেখতে পাই মেঝেতে পড়ে আছে রক্তাক্ত জাহারের লাশ। খাট আর আলমারির পাশে লুকিয়ে থাকা আয়েশার শরীরও রক্তাক্ত। আয়েশা দাঁড়ানো অবস্থাতেই ছিলেন। তাদের একমাত্র শিশু সন্তান রেদোয়ান মেঝেতে বাবা-মায়ের রক্তে গড়াগড়ি খাচ্ছে আর কাঁদছে। তিনি রেদোয়ানকে কোলে নিয়ে বাইরে বেরিয়ে আসেন। এদিকে ভাই ও ভাইয়ের স্ত্রীর মৃত্যুর খবরে সীমান্তের এপার থেকে কেফায়েত তার বাবা-ভাইদের নিয়ে যাচ্ছিলেন নিজ বাড়িতে।’

এরপরের অংশের বর্ণনা দেন কেফায়েত উল্লাহ। তিনি বলেন, ‘যখন নিজেদের বাড়িতে যাই ততক্ষণে আমার ভাই ও তার স্ত্রী দুজনেই মারা গেছেন। আমি নিজে আয়েশার লাশ কাঁধে নেই। আর আমার ছোট ভাই শরিয়ত উল্লাহ এবং আরেকজন কাঁধে নেয় জাহারের লাশ। আমাদের নিজেদেরও তখন প্রাণের ভয়। বাড়িতে গিয়ে বেশি সময় থাকিনি। লাশ দুটো নিয়ে দ্রুত চলে আসি সীমান্তের এপারে, নোম্যান্স ল্যান্ডে। এদিকে স্বজনরা অপেক্ষা করছিল কান্নাজড়িত কন্ঠে। লাশ নিয়ে আসার পর কান্নার রোল পড়ে যায় সবার মধ্যে ‘ বাস্তুহীন পরিবারটিতে ঈদের যৎসামান্য আনন্দও উবে যায় মুহূর্তেই।

কেফায়েত বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, তিনি যখন আয়েশার লাশ কাঁধে তোলেন, তখন আয়েশার কানে সোনার দুল, হাতে আংটি আর নাকফুলগুলো ছিলই। কোমরেও পাওয়া যায় বাংলাদেশি ৯ হাজার আর মিয়ানমারের ৬০ হাজার টাকা। কেফায়েতের ভাষ্য, ‘সীমান্তের কাছাকাছি বাসা হওয়ায় মগরা হত্যার পর মালামাল লুট করতে পারেনি। অন্যদের যেমন হত্যার পর ধনসম্পদ লুট করা হয় জাহার-আয়েশার বেলায় তা হয়নি। কারণ মগরাও ভেবেছিল তাদের ওপর আক্রমণ হতে পারে। এ কারণে ওই দিন চলে গিয়ে পরদিন ধন-সম্পদ লুট করে বাড়ি-ঘর আগুনে পুড়িয়ে দেয় তারা।’

কেফায়েত বলেন, তাদের পরিবারটি মোটামুটি সচ্ছল ছিল। বাড়িতে খাবারের অভাব ছিল না। সাত ভাই চার বোনের মধ্যে জাহার ছিল তৃতীয়। বছর তিনেক আগে তাকে কুয়াংছিবন এলাকার মেদিতে বিয়ে করিয়েছিলেন। পরিবারের সবাই একসঙ্গেই থাকতো। বছর খানেক আগে আলাদা বাড়ি করেছিলেন কেফায়েত। বলেন, বাবা-মা হারা শিশু রেদোয়ানকে এখন তারা নিজেদের কাছেই রাখছেন। শিশুটি বাবা-মায়ের জন্য কাঁদে। কিন্তু কি আর করার? নানারকম খেলনা কিনে দিয়ে, হাতে বিস্কুট দিয়ে তার কান্না সামাল দেওয়ার চেষ্টা করেন তারা।

কাঁটাতারের বেড়ার ওপাশে সীমান্তের খুব কাছে নিজেদের পুড়ে যাওয়া বাড়ি দেখান কেফায়েতউল্লাহ।

নোম্যান্স ল্যান্ডের ওই ক্যাম্পে বসে কেফায়েত উল্লাহর সঙ্গে কথা বলতে বলতেই এ প্রতিবেদককে তিনি নিয়ে যান কাঁটাতারের বেড়ার কাছে। পাহাড়ের টিলায় দাঁড়িয়ে হাত দিয়ে দেখান তার বাড়ি। বলেন, ভাই ও ভাইয়ের স্ত্রীকে হত্যার পরদিন মগরা আবার এসে তাদের বাড়ি আগুনে দিয়ে পুড়িয়ে দেয়। আর গেলো রবিবার আগুন দেয় তার নিজের বাড়িতে। কাঁটাতারের এপার থেকে সেই আগুন দেখেছেন আর চোখের পানি ফেলেছেন, কিন্তু কিছুই করার ছিল না তার।

কেফায়েতের ক্যাম্পের ঘরে যাওয়ার আগে কথা হয় তমব্রু সীমান্তে আজগর আলী মৌলভী নামে এক বৃদ্ধের সঙ্গে। আয়েশার নানা আজগর আলী মৌলভী কান্নাজড়িত কণ্ঠে নাতনি আর তার নাত-জামাইয়ের মৃত্যুর খবর জানান। বলেন, আগে মৌলভী হিসেবে বিভিন্ন মাদ্রাসায় পাঠদান করতেন। কিন্তু বছর কয়েক আগে থেকেই একের পর এক মাদ্রাসাগুলো বন্ধ করে দেয় প্রশাসন। তাই শেষদিকে পান দোকান করতেন। সেই দোকান ফেলে প্রাণের ভয়ে পালিয়ে আসতে হয়েছে তাকেও।

তমব্রু নোম্যান্স ল্যান্ডের ক্যাম্পে থাকা মৌলভী আজগর আলী বলেন, ‘আরকানে তাদের চৌদ্দ পুরুষের বাস। তাদের নাগরিকত্ব কেড়ে নিয়ে এখন বাঙালি বলে তাড়িয়ে দিচ্ছে।’ বাংলাদেশে এসে আশ্রয় আর ত্রাণ সহযোগিতার কারণে কৃতজ্ঞতা জানান তিনি। বলেন, ‘একাত্তরের  সংগ্রামের সময় এই পারের অনেকেই তাদের বাড়িতে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছিল। কেউ কেউ তার মাকে মা ডাকতো। বাংলাদেশিরা এখন যেন সেই ঋণই শোধ করছে।’

বয়সের ভারে নুব্জ হয়ে আসা এই বৃদ্ধ মৌলভী বলেন, ‘যদি কপালে থাকে, যদি আল্লাহ চায়, যদি শান্তি ফিরে আসে, তবে আবারও ফিরে যেতে চাই নিজ বাড়িতে। পুড়িয়ে দেওয়া বাড়িতেই নতুন করে ঘর তুলে থাকতে চাই। যদিও এই পারে থেকে যাবে আমার আদরের নাতনি আয়েশা আর স্বামী জাহারের কবর।’

ছবি: প্রতিবেদক ও ক্ষতিগ্রস্ত পরিবার

/টিএন/
সম্পর্কিত
জাতিসংঘের রোহিঙ্গা ডাটাবেজ ব্যবহার করতে চায় সরকার
ইন্দোনেশিয়ার উপকূল থেকে তিন রোহিঙ্গা শরণার্থীর লাশ উদ্ধার
ইন্দোনেশীয় উপকূলে নৌকাডুবি: ৭০ রোহিঙ্গা নিহতের আশঙ্কা
সর্বশেষ খবর
ডিভোর্স দেওয়ায় স্ত্রীকে কুপিয়ে নিজেও আত্মহত্যার চেষ্টা করেন স্বামী
ডিভোর্স দেওয়ায় স্ত্রীকে কুপিয়ে নিজেও আত্মহত্যার চেষ্টা করেন স্বামী
এক সপ্তাহের মাথায় ছিনতাইকারীর ছুরিকাঘাতে আরেকজন নিহত
এক সপ্তাহের মাথায় ছিনতাইকারীর ছুরিকাঘাতে আরেকজন নিহত
‘উচিত শিক্ষা’ দিতে পঙ্গু বানাতে গিয়ে ভাইকে হত্যা
‘উচিত শিক্ষা’ দিতে পঙ্গু বানাতে গিয়ে ভাইকে হত্যা
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে মানবাধিকার উইং চালুর পরামর্শ সংসদীয় কমিটির
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে মানবাধিকার উইং চালুর পরামর্শ সংসদীয় কমিটির
সর্বাধিক পঠিত
অ্যাপের মাধ্যমে ৪০০ কোটি টাকার রেমিট্যান্স ব্লক করেছে এক প্রবাসী!
অ্যাপের মাধ্যমে ৪০০ কোটি টাকার রেমিট্যান্স ব্লক করেছে এক প্রবাসী!
নিউ ইয়র্কে পুলিশের গুলিতে বাংলাদেশি তরুণ নিহত, যা জানা গেলো
নিউ ইয়র্কে পুলিশের গুলিতে বাংলাদেশি তরুণ নিহত, যা জানা গেলো
বিএনপির ইফতারে সরকারবিরোধী ঐক্য নিয়ে ‘ইঙ্গিতময়’ বক্তব্য নেতাদের
বিএনপির ইফতারে সরকারবিরোধী ঐক্য নিয়ে ‘ইঙ্গিতময়’ বক্তব্য নেতাদের
প্রথম গানে ‘প্রিয়তমা’র পুনরাবৃত্তি, কেবল... (ভিডিও)
প্রথম গানে ‘প্রিয়তমা’র পুনরাবৃত্তি, কেবল... (ভিডিও)
সমুদ্রসৈকতে জোভান-সাফার ‘অনন্ত প্রেম’!
সমুদ্রসৈকতে জোভান-সাফার ‘অনন্ত প্রেম’!