X
বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪
১১ বৈশাখ ১৪৩১

মেডিক্যাল কলেজ বেড়েছে, বাড়েনি শিক্ষার মান

জাকিয়া আহমেদ
০৫ অক্টোবর ২০১৭, ১২:১৭আপডেট : ০৫ অক্টোবর ২০১৭, ২০:৫৯

চিকিৎসা সেবা (ছবি: সংগৃহীত) রাজধানীর মালিবাগে বেসরকারি সাফেনা উইমেন্স ডেন্টাল কলেজে চলতি শিক্ষাবর্ষে (২০১৭-১৮)  ভর্তি স্থগিত করেছে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, এই কলেজের প্রতিটি বিভাগে রয়েছে প্রয়োজনীয় শিক্ষক সংকট। এছাড়া হাসপাতালে নির্ধারিত শয্যা সংখ্যার অভাব ও নীতিমালা অনুযায়ী কলেজের নামে রেজিস্ট্রি করা জমি না থাকায় শিক্ষার্থী ভর্তির বিষয়ে স্থগিতাদেশ দেওয়া হয়েছে।

প্রসঙ্গত, দেশে বর্তমানে মেডিক্যাল কলেজ রয়েছে ১০০টি। এর মধ্যে সরকারি ৩১টি এবং বেসরকারি মেডিক্যাল কলেজের সংখ্যা ৬৯টি। অভিযোগ রয়েছে, বেসরকারি মেডিক্যাল কলেজগুলোর বেশিরভাগই সরকারের দেওয়া শর্ত মানছে না। এসব কলেজের ব্যবস্থাপনা ও পরিচালনায়ও রয়েছে ব্যাপক অনিয়ম। ফলে দেখা যাচ্ছে, দেশে মেডিক্যাল কলেজের সংখ্যা বাড়লেও, বাড়েনি মেডিক্যাল শিক্ষার মান।

এদিকে বেসরকারি মেডিক্যাল কলেজ স্থাপন ও পরিচালনা আইন দ্রুত মন্ত্রিসভায় উপস্থাপনের জন্য সংশ্লিষ্টদের নির্দেশ দিয়েছেন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম। মঙ্গলবার (৩ অক্টোবর) বাংলাদেশ মেডিক্যাল ও ডেন্টাল কাউন্সিল (বিএমডিসি)-এর কর্মকর্তাদের সঙ্গে এক মতবিনিময় সভায় তিনি এই নির্দেশ দেন। ওই সভায় স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেন, ‘বেসরকারি মেডিক্যাল কলেজ নীতিমালা অনুসরণে প্রায় ক্ষেত্রেই বিচ্যুতি দেখা যাচ্ছে। শুধু নীতিমালা প্রয়োগ করে কলেজ পরিচালনায় সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা কঠিন হয়ে পড়ে বলে আইন প্রণয়ন প্রয়োজন।’

কেবল সাফেনা উইমেন্স ডেন্টাল কলেজই নয়, নির্ধারিত শর্ত পূরণ না করায় চলতি শিক্ষাবর্ষে আরও পাঁচটি বেসরকারি মেডিক্যাল ও একটি ডেন্টাল কলেজের ভর্তি কার্যক্রম স্থগিত রেখেছে মন্ত্রণালয়। এগুলো হচ্ছে- ঢাকায় নর্দান ইন্টারন্যাশনাল মেডিক্যাল কলেজ, আইচ মেডিক্যাল কলেজ, সাহাবউদ্দিন মেডিক্যাল কলেজ, কেয়ার মেডিক্যাল কলেজ এবং কেরানীগঞ্জে অবস্থিত আদদ্বীন বসুন্ধরা মেডিক্যাল কলেজ।

গত ১৭ আগস্ট বেসরকারি মেডিক্যাল কলেজ ও ডেন্টাল কলেজ নীতিমালা বিষয়ক এক সভায় এই কলেজগুলোতে ভর্তি কার্যক্রম স্থগিত রাখার সিদ্ধান্ত নেয় স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়। বেসরকারি মেডিক্যাল কলেজগুলো পরিদর্শন শেষে স্বাস্থ্য অধিদফতরের দেওয়া সুপারিশ সাপেক্ষে মন্ত্রণালয় এই সিদ্ধান্ত নেয়। ওইদিন স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম বলেছেন, ‘যেসব মেডিক্যাল কলেজ সরকার নির্ধারিত নীতিমালা পূরণ করতে পারছে না, সেগুলোর ভর্তি কার্যক্রম স্থগিত থাকবে এবং মানহীন কলেজ বন্ধে মন্ত্রণালয় ও অধিদফতরের নিয়মিত পরির্দশন অব্যাহত থাকবে। এমনকি, কার্যক্রম স্থগিত হওয়া মেডিক্যাল কলেজগুলো যদি তাদের শিক্ষার মান উন্নীত না করে, তাহলে তাদের পুরো কার্যক্রম বন্ধ করে দেওয়া হবে।’

স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম আরও বলেন, ‘চিকিৎসকরা যে প্রতিষ্ঠানে লেখাপড়া শিখে চিকিৎসক হবেন, মানুষের চিকিৎসা ও সেবা করবেন, সেসব মেডিক্যাল কলেজের ঘাটতি কোনোভাবেই সরকার মেনে নেবে না।’ মেডিক্যাল ভর্তি পরীক্ষা

সরকারের নীতিমালা অনুযায়ী বেসরকারি মেডিক্যাল কলেজ ও ডেন্টাল কলেজগুলোকে শিক্ষা কার্যক্রম শুরুর অন্তত দুই বছর আগে একটি পরিপূর্ণ হাসপাতাল চালু করতে হবে, অ্যাকাডেমিক ভবন এবং হাসপাতাল ভবন পৃথক হতে হবে। কোনও ভাড়া বাড়িতে হাসপাতাল এবং কলেজ স্থাপন করা যাবে না।

দেশের বেশিরভাগ বেসরকারি মেডিক্যাল কলেজে নেই প্রয়োজনীয় শিক্ষক ও  যন্ত্রপাতি। এরপরও একের পর এক বেসরকারি মেডিক্যাল কলেজ অনুমোদন পাচ্ছে। অনুমোদন দেওয়ার ক্ষেত্রেও সরকারি নীতিমালা মানা হচ্ছে না। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, একদিকে নীতিমালা না মানা বেসরকারি মেডিক্যাল কলেজগুলোর কার্যক্রম স্থগিত করা হচ্ছে, অন্যদিকে রাজনৈতিক প্রভাবে নতুন নতুন মেডিক্যাল কলেজ অনুমোদন পাচ্ছে। জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সংশ্লিষ্টদের সঠিক নজরদারির অভাব এবং রাজনৈতিক প্রভাবেই  মানহীন মেডিক্যাল কলেজের অনুমোদন বাড়লেও বাড়ছে না শিক্ষার মান। স্বাস্থ্যমন্ত্রী নিজেও একাধিকবার রাজনৈতিক প্রভাবে মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার কথা স্বীকার করেছেন।

স্বাস্থ্য অধিদফতরের একটি সূত্র জানায়, মেডিক্যাল কলেজগুলোতে এখন প্রায় ৪০ ভাগের মতো শিক্ষক সংকট রয়েছে। শিক্ষকদের ঢাকামুখী হবার প্রবণতা, কর্মস্থলে উপস্থিত না থাকা এবং উচ্চশিক্ষার জন্য দেশের বাইরে যাওয়ার প্রবণতাই  শিক্ষক সংকটের অন্যতম কারণ।

মেডিক্যাল কলেজগুলোতে শিক্ষার মান না থাকলে সেসব কলেজ একেবারে বন্ধ করে দেওয়া উচিত মন্তব্য করে স্বাস্থ্য অধিকার আন্দোলনের আহ্বায়ক ও বাংলাদেশ মেডিক্যাল অ্যাসোসিয়েশন (বিএমএ)-এর সাবেক সভাপতি অধ্যাপক ডা. রশীদ-ই মাহবুব বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘এতগুলো মেডিক্যাল কলেজ করতে গেলেতো মিনিয়াম কিছু ক্রাইটেরিয়া থাকা উচিত, কিন্তু সেটা কি আদৌ হচ্ছে? মনিটরিং করছি ঠিকমতো ?’

অধ্যাপক ডা. রশীদ-ই মাহবুব বলেন, ‘যদিও তারা অনেক সময় বিভিন্ন চাপের কারণে অনুমোদন দিয়ে দেয়, কিন্তু সেটা মেডিক্যাল  এডুকেশনে অন্তত হওয়া উচিত না। মেডিক্যাল এডুকেশন কোনও চাপের কাছে মাথা নত করার বিষয় নয়। এটা কেবল বিদ্যা নয়, এটা টোটালি স্কিল এবং টেকনিক্যাল বিষয়। আর এই স্কিলকে উন্নত করতে হবে।’ যেখানে শিক্ষক নেই, প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি নেই এবং সরকারি নীতিমালা মানা হচ্ছে না, সেসব কলেজগুলোতে কী করে স্কিল ডেভেলপ হবে, প্রশ্ন এই চিকিৎসাবিদের।

তিনি আরও বলেন, ‘শুধু তাই নয়, এখনও যেগুলো রয়েছে, সেগুলো অ্যাপ্রোপ্রিয়েট কিনা, একটি মেডিক্যাল কলেজের যেসব সুযোগ সুবিধা থাকা উচিত, সেগুলো তাদের রয়েছে কিনা, সেসব বিষয়েও তদারকি করা উচিত। যদিও একটি পরীক্ষা প্রসিডিওর রয়েছে, কিন্তু সেটাই চিকিৎসক হবার একমাত্র যোগ্যতা নয়। এখানে আরও অনেক বিষয় জড়িত। ’

এসব মানহীন মেডিক্যাল কলেজ থেকে ভবিষ্যতে বের হওয়া চিকিৎসকদের মান নিয়েও প্রশ্ন তুলে অধ্যাপক ডা. রশীদ-ই মাহবুব বলেন, ‘অনেক দেশে মেডিক্যাল কলেজ থেকে পাস করার পরও প্র্যাকটিস করার অনুমতি দেওয়া হয় না। প্র্যাকটিস করার জন্য পৃথক পরীক্ষা নেওয়া হয়। এখন আমরা কোন কাজটা করবো সে বিষয়টা ফয়সালা করতে হবে।’আমরা কী করবো, মেডিক্যাল শিক্ষাকে কোথায় নিয়ে যাবো, সে বিষয়ে ভাবার সময় এসেছে, বললেন এই জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ।

ওয়ার্ল্ড ফেডারেশন ফর মেডিক্যাল এডুকেশনের জ্যেষ্ঠ উপদেষ্টা এবং বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার আঞ্চলিক উপদেষ্টা (দক্ষিণ পূর্ব এশিয়া) প্রফেসর এম মোজাহেরুল হক বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘চিকিৎসকদের প্রফেশনালিজম উন্নত করার জন্য এথিক্স, নলেজ এবং স্কিল- তিনটি উপাদান গুরুত্বপূর্ণ। একজন চিকিৎসককে এথিক্যাল প্রফেশনাল হতে হলে  প্রশিক্ষণ দিতে হবে মেডিক্যাল কলেজগুলোতে, সেখানে মানসম্পন্ন শিক্ষার সুযোগ থাকতে হবে। আর মানসম্মত শিক্ষার জন্য প্রয়োজন কলেজগুলোতে প্রশিক্ষিত শিক্ষক এবং আনুসঙ্গিক উপরকরণ। বিশেষ করে প্রশিক্ষণের জন্য হাসপাতালে রোগী থাকা প্রয়োজন। এছাড়া, প্রয়োজন রয়েছে উন্নত মানের লাইব্রেরি, গবেষণা ও প্রশিক্ষণের সুযোগের বিষয়টি। প্রয়োজনীয় অবকাঠামোও থাকা দরকার। কিন্তু বর্তমানে রাজনৈতিক বিবেচনায় যেসব কলেজকে অনুমতি দেওয়া হয়েছে, তার বেশির ভাগেরই এগুলো নাই। এছাড়া কলেজগুলোতে রয়েছে শিক্ষক স্বল্পতা। এমনকি সরকারি মেডিক্যাল কলেজগুলোতেও শিক্ষক সংকট প্রবল। এসব কিছু বিবেচনায় নিয়ে মেডিক্যাল কলেজগুলোকে ঢেলে সাজাতে হবে। অন্যথায় মেডিক্যাল কলেজের সংখ্যা বাড়তে থাকবে, কিন্তু শিক্ষার মান বাড়বে না।’

বাংলাদেশ মেডিক্যাল অ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিলের (বিএমডিসি) সভাপতি  অধ্যাপক ডা. শহীদুল্লাহ বেসরকারি মেডিক্যাল কলেজের শিক্ষার মান প্রসঙ্গে বলেন, ‘আমরা মনে করি, সরকারি মেডিক্যাল কলেজের পাশাপাশি বেসরকারি মানসম্পন্ন মেডিক্যাল কলেজের প্রয়োজন রয়েছে। কারণ, আমাদের দেশে এখনও জনসংখ্যার তুলনায় চিকিৎসক কম। কাজেই আমাদের চিকিৎসক তৈরি করতে হবে। কিন্তু বেসরকারি মেডিক্যাল কলেজগুলোকে অবশ্যই মানসম্পন্ন হতে হবে। এখানে কোনও ছাড় নেই। তাদের সব ধরনের নিয়ম নীতি মেনে চলতে হবে।’ তিনি আরও বলেন, ‘নিয়ম নীতির তোয়াক্কা না করে যারা ব্যবসা করতে চায়, তাদের অধিকার নেই মেডিক্যাল কলেজ চালানোর।’ 

আরও পড়ুন- ফরেনসিক মেডিসিন শিক্ষার বেহাল দশা!

 

/এপিএইচ/আপ-এফএস/
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
ছাত্রলীগের ‘অনুরোধে’ গ্রীষ্মকালীন ছুটি পেছালো রাবি প্রশাসন
ছাত্রলীগের ‘অনুরোধে’ গ্রীষ্মকালীন ছুটি পেছালো রাবি প্রশাসন
সাজেকে ট্রাক খাদে পড়ে নিহত বেড়ে ৯
সাজেকে ট্রাক খাদে পড়ে নিহত বেড়ে ৯
বার্সেলোনার সঙ্গে থাকছেন জাভি!
বার্সেলোনার সঙ্গে থাকছেন জাভি!
চার বছরেও পাল্টায়নি ম্যালেরিয়া পরিস্থিতি, প্রশ্ন নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি নিয়ে
চার বছরেও পাল্টায়নি ম্যালেরিয়া পরিস্থিতি, প্রশ্ন নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি নিয়ে
সর্বাধিক পঠিত
সিয়াম-মেহজাবীনের পাল্টাপাল্টি পোস্টের নেপথ্যে…
সিয়াম-মেহজাবীনের পাল্টাপাল্টি পোস্টের নেপথ্যে…
‘মারামারি’র ঘটনায় মিশা-ডিপজলের দুঃখপ্রকাশ
‘মারামারি’র ঘটনায় মিশা-ডিপজলের দুঃখপ্রকাশ
মিয়াবতী থেকে পিছু হটলো মিয়ানমারের বিদ্রোহীরা?
মিয়াবতী থেকে পিছু হটলো মিয়ানমারের বিদ্রোহীরা?
আজকের আবহাওয়া: কোথায় কেমন গরম পড়বে
আজকের আবহাওয়া: কোথায় কেমন গরম পড়বে
ছয় দিনের সফরে ব্যাংকক গেলেন প্রধানমন্ত্রী
ছয় দিনের সফরে ব্যাংকক গেলেন প্রধানমন্ত্রী