X
বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪
১০ বৈশাখ ১৪৩১

আলোচনায় প্লেজারিজম: আইনি প্রতিকার কী?

রশিদ আল রুহানী
০৬ অক্টোবর ২০১৭, ১৪:১৩আপডেট : ০৬ অক্টোবর ২০১৭, ১৯:২৯

ছবি ইন্টারনেট থেকে সংগৃহীত কোনও অনুমতি ছাড়াই একজন লেখকের লেখা হুবহু আরেকজনের প্রবন্ধে বা নিবন্ধে তুলে ধরার বিষয়টি আজকাল প্রায়ই নজরে আসছে। কোনও কোনও ক্ষেত্রে মূল লেখক বা তার পক্ষে অন্য কেউ বিষয়টি জেনে অভিযোগ তুলেও  প্রায় ক্ষেত্রেই বিষয়টি অগোচরেই থেকে যায়। তবে আন্তর্জাতিক নীতি অনুযায়ী এই ধরনের কর্মকাণ্ড রীতিমত গুরুতর অপরাধ। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে প্লেজারিজমের অপরাধ প্রমাণিত হলে আইনি প্রক্রিয়ায় অপরাধীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার সুযোগ রয়েছে। অপরাধ প্রমাণিত হলে সাজা ও জরিমানার ব্যবস্থা রয়েছে। জানা গেছে, বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত প্লেজারিজমের সুনির্দিষ্টকোনও আইনি কাঠামো নেই। তবে কেউ চাইলে সিভিল কোর্টে অভিযুক্ত ব্যক্তির বিরুদ্ধে ক্ষতিপূরণ মামলা করতে পারেন। তাতে সাক্ষ্য প্রমাণ পাওয়া গেলে অবশ্যই মামলাকারী বিচার পাবেন। তবে এ ধরনের অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের জন্য অবশ্যই শক্ত নীতিমালা ও আইনের প্রয়োজন রয়েছে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।

উল্লেখ্য, গত ২৭ সেপ্টেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের দুই শিক্ষক সামিয়া রহমান ও মাহফুজুল হক মারজান এবং ট্যুরিজম অ্যান্ড হসপিটালিটি ম্যানেজমেন্ট বিভাগের তিন শিক্ষকের বিরুদ্ধে প্লেজারিজমের অভিযোগে পৃথক দুটি তদন্ত কমিটি গঠিত হয়। এরপরই প্লেজারিজমের বিষয়টি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমসহ বিভিন্ন পরিসরে আলোচনার শীর্ষে চলে আসে।

বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, এর আগেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন শিক্ষকের বিরুদ্ধে অন্যের লেখা চুরির অভিযোগ উঠেছে৷ নিবন্ধে চৌর্যবৃত্তির দায়ে ২০১৫ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আরবি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. আ জ ম কুতুবুল ইসলাম নোমানীকে পদাবনতি দিয়ে সহকারী অধ্যাপক করা হয়। পিএইচডি থিসিসে জালিয়াতির অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় ২০১৪ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক নূর উদ্দিন আলোকে চাকরিচ্যুত করে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। গবেষণা জালিয়াতি করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আরবি বিভাগের আরেকজন শিক্ষক অধ্যাপক ড. আবু বকর সিদ্দিকের বিরুদ্ধে সংখ্যাতিরিক্ত শিক্ষক হওয়ার অভিযোগ আছে। এছাড়া সমাজবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক সালমা বেগমের বিরুদ্ধে চৌর্যবৃত্তির অভিযোগ ওঠে এক বছর আগে। এছাড়া জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়েও এ ধরনের বেশ কয়েকটি অভিযোগে শিক্ষরা শাস্তি পেয়েছেন।

জানা যায়, বিশ্বের বিভিন্ন দেশে নামি দামি বিশ্ববিদ্যালয়সহ সে দেশের প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানে লেখাচুরি ঠেকাতে কঠোর নীতিমালা রয়েছে। এছাড়া বেশ কয়েকটি দেশে কপিরাইট আইনসহ প্লেজারিজম আইনও রয়েছে। তবে এখন পর্যন্ত বাংলাদেশে কপিরাইট আইন থাকলেও প্লেজারিজম আইন নেই। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে নির্দিষ্টভাবে প্লেজারিজমের কোনও নিজস্ব নীতিমালা বা বিধিবিধান নেই।

তবে দেশের স্বাভাবিক আইন ব্যবস্থায় একজন লেখক অথবা কোনও প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান চাইলেই সিভিল কোর্টে অভিযোগ দিয়ে মামলা করতে পারেন বলে বাংলা ট্রিবিউনকে জানিয়েছেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার জ্যোতির্ময় বড়ুয়া। তিনি বলেন, ‘দেশে কপিরাইট আইন রয়েছে। তবে সেটা ছাড়াও ১৯০৮ সালের যে দেওয়ানি কার্যবিধি আছে সেই কার্যবিধি মৌলিক আইন হিসেবে কাজ করে। ফলে এই আইনের বিভিন্ন স্তরে যে বিধিবিধান আছে সেই বিধিতে এসব অভিযোগের ভিত্তিতে যে কেউ চাইলেই সুযোগ নিতে পারেন। অভিযোগ প্রমাণিত হলে অভিযোগকারী সুবিধা পাবেন।’

এদিকে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ, শিক্ষক, গবেষক ও লেখকদের দাবি অন্যের জিনিস নিজের বলে চালিয়ে দেওয়া বন্ধে নীতিমালা ও আইন থাকা প্রয়োজন। দেশে প্লেজারিজমের আইন থাকা প্রয়োজন হয়ে পড়েছে তবে সেটা থাকলেও বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে অন্তত একটি নীতিমালা ও আইন থাকা দরকার বলে মনে করছেন তারা।

ছবি সংগৃহীত

এ বিষয়ে সিলেটের শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ফরিদ উদ্দিন আহমেদ বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘প্লেজারিজম কঠোর অপরাধ। আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে থাকাকালীন সময়ে বেশ কয়েকজন শিক্ষকের বিরুদ্ধে অভিযোগ পেয়েছিলাম। পরে তা প্রমাণিত হওয়ায় তারা শাস্তিও পেয়েছেন। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়েও এমন হয়েছে।’

তিনি আরও বলেন, ‘অনেক লেখক রয়েছে যারা অন্যের লেখা চুরি করে পার পেয়ে যাচ্ছে, অনেকে ধরাও পড়ছে না। ফলে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে প্লেজারিজম বন্ধে কঠোর নীতিমালা হওয়া প্রয়োজন। যাতে অভিযোগ পেলেই ওই আইন অনুযায়ী যেন তাকে শাস্তি দেওয়া যায়। এমন কয়েকটি শাস্তি দেওয়া হলে এই অপরাধ করতে কেউ আর সাহস পাবে না।’

এখন প্লেজারিজমের অভিযোগ পেলে কিভাবে প্রমাণ ও শাস্তি দেওয়া হয় জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যেটা হয় সেটা হলো,  অভিযোগ পেলে সিন্ডিকেট সভা থেকে তদন্ত কমিটি করা হয়।  এরপর ওই কমিটি যদি সত্যতা পায় তাহলে সিন্ডিকেটই সিদ্ধান্ত নেয় কী সাজা হবে। সাজা হিসেবে কারও কারও ডিমোশন করে দেওয়া হয়, দীর্ঘসময় পদোন্নতি দেওয়া হয় না। অনেক সময় চাকরিও চলে যেতে পারে। অনেক সময় দলীয় কারণে একজন অন্যজনের বিরুদ্ধে অভিযোগ দিয়ে বসে। ইচ্ছাকৃতভাবে হেনস্থা করতে চায়। কিন্তু দলীয় রাজনীতির ঊর্ধ্বে গিয়ে যদি এই কাজটি নিরপেক্ষভাবে করা যায় তাহলে একটি ডিসিপ্লিনের মধ্যে চলে আসবে।’

যারা রিভিউ করবেন তাদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা আছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘একটি নিবন্ধ যখন রিভিউয়ে যায় তখন রিভিউয়ারদের খুবই সতর্ক থাকা উচিত কোথাও কোনও সমস্যা আছে কি না সে ব্যাপারে। লেখা কপি পেস্ট হলে টারনিটর নামে যে সফটওয়ার আছে সেটা দিয়ে ভালো করে চেক করতে হবে।’

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পুষ্টি ও খাদ্যবিজ্ঞান ইনস্টিটিউটের পরিচালক ও সিন্ডিকেট সদস্য অধ্যাপক নাজমা শাহীন বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘এখন যে পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে তাতে নীতিমালা খুবই প্রয়োজন। কঠোর আইন না হওয়ায় যেন নিয়ন্ত্রণহীন পরিস্থিতি তৈরি হয়ে পড়ছে।’

প্লেজারিজম নানান রকমে হয় উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘কিছু আছে আইডিয়া প্লেজারিজম, কিছু আছে হুবহু অন্য লেখকের লেখা কপি করা। আবার কিছু আছে সেল্ফ (নিজের লেখায় নিজে কপি করা) প্লেজারিজম। এই অপরাধগুলোর কোনটির ক্ষেত্রে কী ধরনের শাস্তি দেওয়া হবে এসব বিষয়ে নীতিমালা হলে প্লেজারিজম কমে যাবে।’

তিনি আরও বলেন, ‘প্লেজারিজমের জন্য যে লেখকই অপরাধী তা কিন্তু নয়। এর জন্য রিভিউয়ার, সম্পাদককেও দায় নিতে হয়। কারণ, রিভিউয়ার সঠিকভাবে রিভিউ করতে ব্যর্থ হলে এর দায় তো অন্য কেউ নেবে না।’

এদিকে এ বিষয়ে মন্তব্য করেন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক মাঈন উদ্দিন জুয়েল। আন্তর্জাতিক অভিবাসন বিষয়ে পিএইচডি করতে বর্তমানে তিনি এস্তোনিয়া অবস্থান করছেন। প্লেজারিজম বন্ধে করণীয় বিষয়ে বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আমার মতে, বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান কাজ গবেষণার মাধ্যমে নতুন জ্ঞান সৃষ্টি করা, এই জ্ঞান শ্রেণিকক্ষে শিক্ষার্থীদের মধ্যে বিতরণ করা, নতুন গবেষক তৈরি করা। কিন্তু শিক্ষকরা নিজেরা গবেষণার পরিবর্তে রাজনীতি নিয়ে ব্যস্ত। শিক্ষার্থীদের সঠিকভাবে সুপারভাইজ করে প্লেজারিজম সম্পর্কে ধারণা দেওয়ার সময় পান না। ফলে নতুন শিক্ষকরা গবেষণা না শিখেই শিক্ষক হচ্ছেন।’

তিনি আরও বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণা খাতে প্রয়োজনীয় বরাদ্দ না থাকায় শিক্ষকরা দিন দিন গবেষণাবিমুখ হচ্ছেন। এ অবস্থায় প্রমোশন ও আপগ্রেডেশনের আগে যেনতেনভাবে প্রবন্ধ প্রকাশ করার চর্চা শুরু হয়েছে। ইদানিং অনেক সিনিয়র শিক্ষক পাবলিকেশনের সংখ্যা বাড়ানোর জন্য গবেষণা সম্পর্কে ভালো ধারণাহীন জুনিয়র শিক্ষকদের কিংবা তাদের সুপারভিশনের শিক্ষার্থীদের দিয়ে প্রবন্ধ লেখিয়ে নিজের নাম যোগ করেন। এই অবস্থার অবসান হওয়া জরুরি।’

আরও পড়ুন-

ঢাবির শিক্ষক সামিয়া ও মারজান দু’জনে নিবন্ধটি যেভাবে লিখেছেন
ফুকোর নিবন্ধ থেকে ৫ পৃষ্ঠা লেখা চুরির অভিযোগ, সামিয়ার অস্বীকার

ঢাবির সামিয়া ও মারজানের বিরুদ্ধে এডওয়ার্ড সাঈদের লেখাও কপির অভিযোগ

 

/আরএআর/ এফএস/এসটি/টিএন/
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
চেলসিকে গুঁড়িয়ে দিলো আর্সেনাল
চেলসিকে গুঁড়িয়ে দিলো আর্সেনাল
আদালতে সাক্ষ্য দিতে এসে কাঁদলেন মিতুর মা
আদালতে সাক্ষ্য দিতে এসে কাঁদলেন মিতুর মা
‘ভুঁইফোড় মানবাধিকার প্রতিষ্ঠানগুলো মানবাধিকার লঙ্ঘন করছে’
‘ভুঁইফোড় মানবাধিকার প্রতিষ্ঠানগুলো মানবাধিকার লঙ্ঘন করছে’
গরমে স্বস্তির খোঁজে লোকালয়ে ঢুকছে সাপ, সচেতনতার আহ্বান ডিএমপির
গরমে স্বস্তির খোঁজে লোকালয়ে ঢুকছে সাপ, সচেতনতার আহ্বান ডিএমপির
সর্বাধিক পঠিত
মিশা-ডিপজলদের শপথ শেষে রচিত হলো ‘কলঙ্কিত’ অধ্যায়!
চলচ্চিত্র শিল্পী সমিতিমিশা-ডিপজলদের শপথ শেষে রচিত হলো ‘কলঙ্কিত’ অধ্যায়!
আজকের আবহাওয়া: তাপমাত্রা আরও বাড়ার আভাস
আজকের আবহাওয়া: তাপমাত্রা আরও বাড়ার আভাস
ডিবির জিজ্ঞাসাবাদে যা জানালেন কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান
ডিবির জিজ্ঞাসাবাদে যা জানালেন কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান
সকাল থেকে চট্টগ্রামে চিকিৎসাসেবা দিচ্ছেন না ডাক্তাররা, রোগীদের দুর্ভোগ
সকাল থেকে চট্টগ্রামে চিকিৎসাসেবা দিচ্ছেন না ডাক্তাররা, রোগীদের দুর্ভোগ
ব্যাংক একীভূতকরণ নিয়ে নতুন যা জানালো বাংলাদেশ ব্যাংক
ব্যাংক একীভূতকরণ নিয়ে নতুন যা জানালো বাংলাদেশ ব্যাংক