X
শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪
৭ বৈশাখ ১৪৩১

বন্যাদুর্গত এলাকায় এখনও খাদ্য সংকট

শফিকুল ইসলাম
১৬ অক্টোবর ২০১৭, ২১:৫৩আপডেট : ১৯ অক্টোবর ২০১৭, ১৬:৫৫

প্রলয়ঙ্করী বন্যায় দেশের ৩২ জেলায় নষ্ট হয়ে যায় মাঠের ফসল

‘কোনও বছর বানে আবাদ খায়া যায় না। এবার ছয় বিঘা জমির ধান বানে খায়া গেইছে। ফির (আবার) যদি ধান না লাগাই, তাইলে খামো কী, গরু-বাছুর কী খায়া থাকপে (থাকবে)?’

বাংলা ট্রিবিউনের কুড়িগ্রাম প্রতিনিধি আরিফুল ইসলামের সঙ্গে আলাপকালে এভাবেই এ বছরের বন্যাপরবর্তী সময়ের দুর্দশার কথা তুলে ধরেন কুড়িগ্রাম সদর উপজেলার ঘোগাদহ ইউনিয়নের চৈতের খামার এলাকার মহুবর রহমান। তিনি জানান, বন্যায় শুধু মাঠের ফসলই নয়, আগামী ফসল না ওঠা পর্যন্ত চলার জন্য ঘরের গোলায় যে চাল জমিয়ে রেখেছিলেন তাও নষ্ট হয়ে গেছে। মরে গেছে হাঁস-মুরগি,পঁচে গেছে ক্ষেতের সবজি,ভেসে গেছে পুকুরের মাছ। পুরোপুরি হাত খালি হয়ে যাওয়ায় কিভাবে আমন ওঠার আগ পর্যন্ত সংসার চালাবেন তা ভেবেই এখন দিশেহারা মহুবার রহমান।

কেবল কুড়িগ্রামের মহুবারই নন,বন্যাকবলিত জেলাগুলোর সব কৃষকেরই এই অবস্থা। ক্ষেত আর ঘরে জমানো ফসল হারিয়ে তারা সবাই রয়েছেন চরম অনিশ্চয়তায়। কিন্তু, পেটের খাবার জোটাতে পারেন আর নাই পারেন,থেমে নেই তাদের জীবন। আগামীর ভাবনাও ভাবতে হচ্ছে তাদের। এ কারণে ফের জমিতে ফিরেছেন কৃষকরা,নতুন আশায় বুক বেঁধেছেন আমন ধানের জন্য।

বন্যায় ফসলের ক্ষতির তথ্য

মহুবার রহমান জানান,বন্যার পর সামান্য সরকারি ত্রাণ পেয়েছেন।দিনে দু’বেলা আধাপেট খেয়ে চলছে তার চার জনের সংসার। নতুন করে চাষের জন্য ধার করেছেন ১০ হাজার টাকা। তাই দিয়ে প্রায় ১৫ কিলোমিটার দূর থেকে কিনে এনেছেন ধানের চারা। পরিবহন ব্যয় বাঁচাতে দুই ছেলেকে নিয়ে বাইসাইকেলে করে নিয়ে এসেছেন ধানের চারা। মজুরি দিয়ে শ্রমিক নেওয়ার সামর্থ্য নেই বলে ছেলেদের স্কুলে যাওয়া বন্ধ রেখে তাদের দিয়েই কাজ করাচ্ছেন। নতুন ফসলকে ঘিরেই এখন নতুন আশা মহুবার রহমানের মনে। প্রকৃতি বাধ না সাধলে নতুন আবাদের আমন ঘরে তুলে খানিকটা ক্ষতি কাটিয়ে উঠবেন― সেই অপেক্ষায় আছেন তিনি।

নওগাঁর তোবারক হোসেন, সিরাজগঞ্জের মজিবুর রহমান, কিশোরগঞ্জের আলতাফ হোসেন, দিনাজপুরের সোহরাব হোসেন, গাইবান্ধার কেরামত আলী, জামালপুরের মিলন মিয়া, মৌলভীবাজারের সুজন হওলাদার, সুনামগঞ্জের আফজাল মিয়া, জয়পুরহাটের দুলাল শেখ, টাঙ্গাইলের আনন্দ কুমার দাসও জানিয়েছেন একই কথা। বন্যার পানিতে তারাও হারিয়েছেন ক্ষেতের ফসল। তাদেরও ঘরের খাবার পচে গেছে, পুকুরের মাছ ভেসে গেছে, নষ্ট হয়েছে ক্ষেতের সবজিও। তারাও মহুবার রহমানের মতোই ক্ষেতে লাগিয়েছেন আমনের বীজ। সেই ফসলের দিকেই এখন তাকিয়ে আছেন তারা।

এ বছরের মার্চে হাওরাঞ্চল ও জুন-জুলাইয়ে দেশের মধ্যাঞ্চলসহ মোট ৩২ জেলায় শুরু হওয়া দু’দফা বন্যার ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে ফের মাঠে কাজ করছেন কৃষকরা। তাদের প্রত্যাশা, বোরোর ক্ষতি কাটাতে সহায়তা করবে আমন। এ বছর বোরো মৌসুমে সরকারের উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ছিল ১ কোটি ৯১ লাখ মেট্রিক টন। তবে বন্যার সঙ্গে সঙ্গে এ মৌসুমে যুক্ত হয়েছিল ব্লাস্ট রোগ। বেসরকারি হিসাবে এই দুই কারণে এ বছর বোরো উৎপাদনে ক্ষতির পরিমাণ ২৫ লাখ মেট্রিক টন,যদিও কৃষি মন্ত্রণালয়ের হিসাবে এর পরিমাণ ২০ থেকে ২১ লাখ মেট্রিক টন। তবে সরকারের সব পরিকল্পনা ঠিক থাকলে এ বছর বাম্পার ফলন হবে আমনের।

  বন্যার্তদের মাঝে ত্রাণ বিতরণ করছেন সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী এবং আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের

সরকারের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী,এ বছর হাওর ও মধ্যাঞ্চলের বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের সংখ্যা ১৭ লাখ ৩৬ হাজার ২৬৩টি, ক্ষতিগ্রস্ত মোট মানুষের সংখ্যা ৮২ লাখ ১৭ হাজার ৪৩২ জন। এসব মানুষের জন্য ৩১ আগস্ট পর্যন্ত বন্যাকবলিত ৩২ জেলায় সরকারি ত্রাণের (জিআর) চাল বরাদ্দ করা হয়েছে ২৭ হাজার ২০৭ মেট্রিক টন। এর মধ্যে বিতরণ করা হয়েছে ১৭ হাজার ৩৯৪ মেট্রিক টন চাল, মজুত রয়েছে ৯ হাজার ৮শ ১৩ মেট্রিক টন। জিআরের আওতায় বরাদ্দ করা হয়েছে ৮ কোটি ৮৬ লাখ ৫৫ হজার নগদ টাকা। এর মধ্যে বিতরণ করা হয়েছে ৫ কোটি ৫৭ লাখ ৫৯ হাজার ২২৭ টাকা, মজুত রয়েছে ৩ কোটি ১৩ লাখ ৬৫ হাজার ৭৭৩ টাকা।

ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, বন্যাকবলিত ৩২ জেলায় দুর্গত মানুষের জন্য শুকনো খাবার বরাদ্দ করা হয়েছে ৭১ হাজার ২৬০ প্যাকেট। এর মধ্য থেকে বিতরণ করা হয়েছে ৬৯ হাজার ১২০ প্যাকেট, মজুত রয়েছে ২ হাজার ১৪০ প্যাকেট। ঢেউটিন বরাদ্দ করা হয়েছে ৩১ হাজার ৯৮০ বান্ডিল।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে খাদ্যমন্ত্রী অ্যাডভোকেট কামরুল ইসলাম বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন,‘দেশের কোথাও খাদ্য সংকট নেই। বোরো ফসলের ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে সরকার কৃষকদেরকে সব ধরনের সহায়তা দিচ্ছে। এখনও বন্যাকবলিত জেলাগুলোতে ত্রাণ বিতরণ করছে জেলা প্রশাসন। এছাড়া,উপজেলা পর্যায় পর্যন্ত খোলা বাজারে চাল বিক্রি (ওএমএস) কার্যক্রম চলছে। খাদ্যবান্ধব কর্মসূচির আওতায় ১০ টাকা কেজি দরে চাল বিক্রির কার্যক্রমও চলছে। বাজারে চালের দামও প্রতিদিনই কমছে।’

তবে বন্যায় ক্ষতিগ্রস্তদের অভিযোগ, রোহিঙ্গা সংকট শুরুর পর থেকে বন্যাকবলিত জেলায় দুর্গত মানুষদের জন্য সরকারি সহায়তা বন্ধ হয়ে গেছে। বন্যাদুর্গতদের দিকে সরকারের আর কোনও নজর নেই।

নীলফামারীতে বেসরকারি উদ্যোগে ত্রাণ বিতরণ

তবে এমন অভিযোগ অস্বীকার করে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয়ের সচিব শাহ কামাল বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘বন্যাদুর্গতদের জন্য ত্রাণ সহায়তা বন্ধ হয়নি,এখনও চলছে। বন্যায় আক্রান্ত প্রতিটি জেলার ডিসিদের কাছে সরকারি সহায়তার জন্য চাল, টাকা ঢেউটিন―সবকিছু দেওয়া আছে। তারা সেগুলো বিতরণ করছেন।’ কিছুদিন আগে প্রতিটি বন্যাকবলিত জেলার জন্য এক হাজার প্যাকেট শুকনো খাবার বরাদ্দ করা হয়েছে বলেও জানান তিনি।

অন্য এক প্রশ্নের জবাবে সচিব বলেন,‘বন্যাকবলিত এলাকার শতভাগ মানুষ সরকারি ত্রাণ সবাই পায় না। সরকারি ত্রাণ বিতরণের জন্য নীতিমালা আছে।সেই নীতিমালা অনুযায়ী স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের দেওয়া তালিকা অনুসরণ করে ত্রাণ বিতরণ করা হয়।’ তিনি বলেন, ‘যেকোনও এলাকার দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাসকারী জনগোষ্ঠীকেই এমন দুর্যোগে ত্রাণ সহায়তা দেওয়া হয়। বিষয়টি অনেকেই জানেন না বলে সরকারের সমালোচনা করছেন।’

এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) সাবেক মহাপরিচালক ড. এম আসাদুজ্জামান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘যেকোনও দুর্যোগে জেলা প্রশাসকরা তাৎক্ষণিকভাবে তার কাছে থাকা সম্পদ নিয়ে ত্রাণ বিতরণ করতে শুরু করেন। সময়মতো প্রয়োজনীয় জিনিসটি নিয়ে তার পাশে দাঁড়াতে পারাটা একটি চ্যালেঞ্জ। এছাড়া, সরকারি ত্রাণ বিতরণে অতীত অভিজ্ঞতাও প্রয়োজন। কারণ, সবসময় ত্রাণ হিসেবে খাদ্য বা কাপড় জরুরি নাও হতে পারে। যে কাউকে ত্রাণ বিতরণের দায়িত্ব দিলে তো চলবে না। এতে সমস্যা তৈরি হবে।’

অন্য এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন,‘এবারের বন্যায় মানুষের ব্যাপক সম্পদহানি হয়েছে। সেই ক্ষতি কাটিয়ে ওঠার ক্ষেত্রে সরকার শতভাগ সফল হয়েছে এমন বলা যাবে না। আবার সরকার শতভাগ ব্যর্থ হয়েছে, সেটাও বলা যাবে না। জনবল সংকট ও দক্ষতারও অভাব ছিল।’

/টিআর/টিএন/
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
বিমানবন্দরে বাউন্ডারি ভেঙে ঢুকে যাওয়া বাসের চালক গ্রেফতার 
বিমানবন্দরে বাউন্ডারি ভেঙে ঢুকে যাওয়া বাসের চালক গ্রেফতার 
মোংলার তাপমাত্রা ৪১ ডিগ্রি সেলসিয়াস, সহসা নামবে না বৃষ্টি
মোংলার তাপমাত্রা ৪১ ডিগ্রি সেলসিয়াস, সহসা নামবে না বৃষ্টি
‘আমি কোনও ছেলেকে বিশ্বাস করতে পারি না’
‘আমি কোনও ছেলেকে বিশ্বাস করতে পারি না’
তাপদাহে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবীদের গাউন পরিধানে শিথিলতা
তাপদাহে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবীদের গাউন পরিধানে শিথিলতা
সর্বাধিক পঠিত
বাড়ছে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মানি, নতুন যোগ হচ্ছে স্বাধীনতা দিবসের ভাতা
বাড়ছে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মানি, নতুন যোগ হচ্ছে স্বাধীনতা দিবসের ভাতা
দুর্নীতির অভিযোগ: সাবেক আইজিপি বেনজীরের পাল্টা চ্যালেঞ্জ
দুর্নীতির অভিযোগ: সাবেক আইজিপি বেনজীরের পাল্টা চ্যালেঞ্জ
ইরান ও ইসরায়েলের বক্তব্য অযৌক্তিক: এরদোয়ান
ইস্পাহানে হামলাইরান ও ইসরায়েলের বক্তব্য অযৌক্তিক: এরদোয়ান
উপজেলা চেয়ারম্যান প্রার্থীকে অপহরণের ঘটনায় ক্ষমা চাইলেন প্রতিমন্ত্রী
উপজেলা চেয়ারম্যান প্রার্থীকে অপহরণের ঘটনায় ক্ষমা চাইলেন প্রতিমন্ত্রী
সংঘাত বাড়াতে চায় না ইরান, ইসরায়েলকে জানিয়েছে রাশিয়া
সংঘাত বাড়াতে চায় না ইরান, ইসরায়েলকে জানিয়েছে রাশিয়া