X
মঙ্গলবার, ১৯ মার্চ ২০২৪
৫ চৈত্র ১৪৩০

জোয়ারে ডোবে ভাটায় ভাসে

শাহেদ শফিক, ভাসানচর থেকে ফিরে
১৮ অক্টোবর ২০১৭, ০৯:৫১আপডেট : ২২ অক্টোবর ২০১৭, ১৫:০১
image

মিয়ানমারের রাখাইন থেকে নির্যাতনের মুখে বাংলাদেশে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের নোয়াখালীর দ্বীপ উপজেলা হাতিয়ার বিচ্ছিন্ন ভাসানচরে পুনর্বাসনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। এ ঘোষণার পর চরটি ঘিরে নানামুখী তথ্যগত বিভ্রান্তির পাশাপাশি কৌতূহলও দেখা দিয়েছে। সম্প্রতি চরটি ঘুরে এসেছেন বাংলা ট্রিবিউনের স্টাফ রিপোর্টার শাহেদ শফিক। ভাসানচর নিয়ে তার ধারাবাহিক ৬ পর্বের প্রতিবেদনের আজ  থাকছে দ্বিতীয় পর্ব।

রোহিঙ্গা পুনর্বাসনের নির্ধারিত স্থান নোয়াখালীর হাতিয়া উপজেলার বিচ্ছিন্ন চর ভাসানচর। জেলা সদর নোয়াখালী থেকে ৭২ কিলোমিটার এবং উপজেলার মূল ভূখণ্ড থেকে প্রায় ২০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত চরটি জোয়ারে ডুবে, ভাটায় ভাসে। সাধারণ জোয়ারে চরের অধিকাংশ এলাকা থাকে তিন থেকে চার ফুট পানির নিচে। ভরা পূর্ণিমায় চার থেকে আট ফুট পানিতে তলিয়ে যায়। ওই সময় দূর থেকে চরটিকে সাগরের বুকে ভাসমান ভেলার মতো দেখায়।

এ কারণে বর্তমানে চরটি বাস উপযোগী নয় বলে মনে করা হচ্ছে। এ অবস্থায় আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে চরটি বসবাস উপযোগী করা সম্ভব বলে বাংলা ট্রিবিউনকে জানিয়েছেন স্থানীয় উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা খোন্দকার মোহাম্মদ রিজাউল করিম ও জেলা প্রশাসক মো. মাহবুব আলম তালুকদার।

স্থানীয় জেলেরা জানান, স্বাভাবিক জোয়ারে চরের দুই-তৃতীয়াংশ ডুবে যায়। ভরা পূর্ণিমায় চরে ৪ থেকে ৮ ফুট পর্যন্ত পানি ওঠে। এ কারণে এখনও এই চরে জনবসতি শুরু হয়নি। চরটিতে বর্তমানে অনেক মহিষ রয়েছে। এসব মহিষ দেখাশোনার জন্য ৬-৭ জন বাথান (রাখাল) রয়েছেন। তবে তারাও চরে থাকতে পারেন না। স্বাভাবিক জোয়ারে অবস্থান করলেও ভরা পূর্ণিমায় তারা মূল ভূখণ্ডে ফিরে যান। ওই সময় দূর থেকে চরটিকে সাগরের বুকে ভাসমান ভেলার মতো দেখায়।

জোয়ারে ডোবে ভাটায় ভাসে

গত ৪ অক্টোবর হাতিয়ার নলচিরা ঘাট থেকে ভাড়া করা ট্রলারে আড়াই ঘণ্টা পথ পাড়ি দিয়ে পৌঁছাই ভাসানচর। সঙ্গে ট্রলারের ক’জন মাঝি-মাল্লা। উদ্দেশ্য চরটিকে ঘিরে নানা কৌতূহল ও প্রশ্নের জবাব মেলানো। রোহিঙ্গাদের এ চরে পুনর্বাসনের সরকারি ঘোষণার পর থেকেই চরটিকে ঘিরে নানা রকম তথ্য শোনা যাচ্ছে।

চরে নামতে হলো নৌবাহিনীর পন্টুনের মাধ্যমে। নৌবাহিনীর সদস্যদের বিশ্রামের জন্য কাছেই টিনের শেড বানানো হচ্ছে। তৈরি করা হয়েছে বড় একটি ঘরও। হেলিপ্যাড থেকে সেই ঘরে যাওয়ার জন্য চার ফুট উঁচু একটি রাস্তাও বানানো হয়েছে। সেখানে দেখা হয় দায়িত্বরত নৌবাহিনীর একজন কর্মকর্তার সঙ্গে। তবে অনুমতি না থাকায় তিনি চর ও পুনর্বাসন বিষয়ে কোনও কথা বলতে রাজি হননি।

তবে সরেজমিনে দেখা গেছে, পুরো চরটি কয়েকটি খালের মাধ্যমে বিভক্ত রয়েছে। একেক এলাকার অবস্থান একেক রকম। চরের যে অংশে নৌবাহিনীর সদস্যদের থাকার জন্য বিশ্রামাগার নির্মাণ করা হচ্ছে সেটি চরের অন্যান্য অংশের তুলনায় কয়েক ফুট উঁচু। কিন্তু এরপরও তাতে রাতের স্বাভাবিক জোয়ারে এক ফুটের মতো পানি ওঠে। ভরা পূর্ণিমা বা অমাবস্যার জোয়ারে তাদের থাকার এলাকাসহ পুরো চরে ৪-৮ ফুট পর্যন্ত পানি জমে যায়। আর মরা কাটালে চরের নিচু এলাকা তলিয়ে যায়।

 জোয়ারে জলমগ্ন চর, দূরে হেলিপ্যাডে যাওয়ার রাস্তা

এরপর আমরা হেঁটে আশপাশের এলাকা ঘুরে দেখি। তখন ভাটা, তবু এখানে-সেখানে রাতের জোয়ারের পানির চিহ্ন। হেলিপ্যাডের আশপাশেও জোয়ারের পানির চিহ্ন দৃশ্যমান। নৌকা নিয়ে একটু দক্ষিণ-পূর্ব দিক হয়ে অপেক্ষাকৃত বড় একটি খাল বেয়ে আমরা চরের মাঝ অংশে ঢুকি। ততক্ষণে জোয়ার লেগেছে সাগরে। চরের বিশাল অংশ জোয়ারের পানিতে থই থই করছে। গাছগুলোর নিচের অংশ পানিতে ডুবে গেছে। ভাসানচরের যতদূর দেখা যায়,সমতল ভূমির দেখা মেলে না। প্রায় ২৫ মিনিট ধরে চরের মাঝের খাল দিয়ে নৌকা বেয়ে চলতে চলতে হঠাৎ আমাদের নৌকাটি মাটিতে আটকে গেলো। এরপর মাঝি-মাল্লাসহ আমরা চরে নেমে পড়ি। পুরো চরের কোথাও হাঁটু পানি, আবার কোথাও কোমর পানি। ততক্ষণে মরা কাটাল শুরু হয়।চরের উঁচু স্থানগুলোতে অবশ্য তখন পানি দেখা যায়নি।

রোহিঙ্গাদের স্থানান্তরের সরকারি ঘোষণার পর চলতি বছরের ৮ ফেব্রুয়ারি প্রধানমন্ত্রীর সামরিক সচিব মেজর জেনারেল আবেদীন ভাসানচর পরিদর্শনে যান। এরপর গত মাসের ২৮ তারিখ যান স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল। মন্ত্রী যেদিন চর পরিদর্শনে যান, সেদিনও পুরো চর পানিতে তলিয়ে ছিল।

স্থানীয় জেলে রিয়াজ উদ্দিন বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আমরা গত ৪-৫ বছর ধরে এই চরে মাছ ধরি। প্রায়ই দেখি জোয়ারের সময় চরের সব এলাকা ডুবে যায়। এই চরটি আশপাশের অন্যান্য চরের তুলনায় অনেক নিচু। আগামী কয়েকদিন পর অমাবস্যার জোয়ারে আবারও পুরো চর ডুবে যাবে। কোনও মানুষ এখানে বসবাস করতে পারে না।’

 ভাটার সময় ভাসানচর

ভাসানচরে রোহিঙ্গা পুনর্বাসনের সিদ্ধান্ত নেওয়ার পর গত ৬ ফেব্রুয়ারি সরেজমিন পরিদর্শন করে সরকারকে প্রতিবেদন দিয়েছে নোয়াখালী উপকূলীয় বন বিভাগ। তাতে বলা হয়ছে, চরটি প্রতিনিয়ত জোয়ার-ভাটায় নিমজ্জিত হয়। শুষ্ক মৌসুমে কিছু অংশ উঁচু দেখা গেলেও অমাবস্যা-পূর্ণিমার অতি জোয়ারে এবং ভরা বর্ষা মৌসুমে পুরোপুরি ডুবে যায়। ঝড়-জলোচ্ছ্বাসেও ভাসানচর আক্রান্ত হয়। এতে কোনও ফসল হয় না। বিশুদ্ধ পানির ব্যবস্থাও নেই। উত্তর ও পশ্চিম তীরে ভীষণ ভাঙন চলছে। মোট কথা, চরটি মানব বসবাসের উপযোগী নয়।

ভাসানচর প্রসঙ্গে নোয়াখালী বিভাগীয় বন কর্মকর্তা মো. তহিদুল ইসলাম বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘এখনও ভরা জোয়ারের সময় ভাসানচরের বিভিন্ন এলাকা পানিতে তলিয়ে যায়। জোয়ারের সময় পূর্বাংশ দেখা যায় না।’

সরেজমিন একটি অভিজ্ঞতার কথা বর্ণনা করে তিনি বলেন, ‘কয়েকদিন আগে আমরা ভাসানচর গিয়েছিলাম। সেখানে উঁচু জায়গায় একটি সাইনবোর্ড লাগানো ছিল। সেখানে দাঁড়িয়ে ছবি তুলেছি। কিন্তু যখন জোয়ার শুরু হয় তখন ১২-১৪ ফুট পানি উঠে যায়।’

নৌবাহিনীর সাইনবোর্ড

ভাসানচরের বয়স প্রায় ২৫ বছর হলেও অনুকূল পরিবেশ না থাকায় এতে এখনও জনবসতি গড়ে ওঠেনি। বেড়িবাঁধ না থাকায় জোয়ারের পানিতে পুরো চর প্লাবিত হয়। রোহিঙ্গাদের এই চরে এনে পুনর্বাসন করার আগে বেড়িবাঁধ, ঘূর্ণিঝড় আশ্রয়কেন্দ্র, বিশুদ্ধ পানীয় জলের ব্যবস্থা করার পাশাপাশি আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখার জন্য পুলিশ ক্যাম্প করা দরকার বলে মনে করেন স্থানীয় সংসদ সদস্য আয়েশা ফেরদৌস।

জানতে চাইলে নোয়াখালী জেলা প্রশাসক মো. মাহবুব আলম তালুকদার বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘চরে পানি ওঠে। সরকার নিশ্চয় চরটি উপযোগী করেই সেখানে রোহিঙ্গাদের পুনর্বাসন করবে। এখন সরকার যদি চায় আমরা পুনর্বাসন করবো। আর না চাইলে করবো না। সরকার সে সিদ্ধান্ত নেবে সেটাই আমরা বাস্তবায়ন করবো।’

তিনি আরও বলেন, ‘ভাসানচরে নৌবাহিনীর তত্ত্বাবধানে ৬ ফুট উঁচু ১৩ কিলোমিটার লম্বা বেড়িবাঁধ নির্মাণের পরিকল্পনা রয়েছে। বেড়িবাঁধ নির্মাণ হলে তখন আর পানি প্রবেশ করবে না।’ ১৩ কিলোমিটার যথেষ্ট কিনা- জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘সবই এখনও প্রাথমিক পর্যায়ে। সরকার চরটিকে উপযোগী করেই সেখানে বসতি গড়ে তুলবে।’

আরও পড়ুন:

কতটা বাসযোগ্য ভাসানচর? (ভিডিও)

 

/এএম/টিএন/আপ-এসটি
সম্পর্কিত
রোহিঙ্গাদের জন্য এ বছর ৮৫ কোটি ডলার সহায়তা চেয়েছে জাতিসংঘ
রোহিঙ্গাদের সর্বোচ্চ সেবার জন্য অন্তর্ভুক্তিমূলক অংশগ্রহণের দাবি
অনুপ্রবেশকালে আরও ১৪ রোহিঙ্গাকে ফেরত পাঠিয়েছে বিজিবি
সর্বশেষ খবর
ওয়ালটন ফ্রিজ কিনে মিলিয়নিয়ার হলেন কুমিল্লার হুমায়ুন
ওয়ালটন ফ্রিজ কিনে মিলিয়নিয়ার হলেন কুমিল্লার হুমায়ুন
কলেজ চত্বর থেকে অসুস্থ ভুবন চিল উদ্ধার
কলেজ চত্বর থেকে অসুস্থ ভুবন চিল উদ্ধার
নাহিদ সুলতানা যুথীসহ ৩ জনের জামিন আবেদন শুনতে হাইকোর্টের নতুন বেঞ্চ
নাহিদ সুলতানা যুথীসহ ৩ জনের জামিন আবেদন শুনতে হাইকোর্টের নতুন বেঞ্চ
অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তারা সাকিবকে আমার বাসায় নিয়ে আসেন: হাফিজ উদ্দীন
অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তারা সাকিবকে আমার বাসায় নিয়ে আসেন: হাফিজ উদ্দীন
সর্বাধিক পঠিত
সুইডেনের রাজকন্যার জন্য দুটি হেলিপ্যাড নির্মাণ, ৫০০ স্থানে থাকবে পুলিশ
সুইডেনের রাজকন্যার জন্য দুটি হেলিপ্যাড নির্মাণ, ৫০০ স্থানে থাকবে পুলিশ
পদ্মার গ্রাহকরা এক্সিম ব্যাংক থেকে আমানত তুলতে পারবেন
একীভূত হলো দুই ব্যাংকপদ্মার গ্রাহকরা এক্সিম ব্যাংক থেকে আমানত তুলতে পারবেন
দিন দিন নাবিকদের সঙ্গে কঠোর আচরণ করছে দস্যুরা
দিন দিন নাবিকদের সঙ্গে কঠোর আচরণ করছে দস্যুরা
সঞ্চয়ী হিসাবের অর্ধকোটি টাকা লোপাট করে আত্মগোপনে পোস্ট মাস্টার
সঞ্চয়ী হিসাবের অর্ধকোটি টাকা লোপাট করে আত্মগোপনে পোস্ট মাস্টার
‘সরলতার প্রতিমা’ খ্যাত গায়ক খালিদ আর নেই
‘সরলতার প্রতিমা’ খ্যাত গায়ক খালিদ আর নেই