X
মঙ্গলবার, ১৯ মার্চ ২০২৪
৫ চৈত্র ১৪৩০

ভাঙা-গড়ায় নড়বড়ে ভাসানচর (ভিডিও)

শাহেদ শফিক, ভাসানচর থেকে ফিরে
১৯ অক্টোবর ২০১৭, ১০:১৪আপডেট : ২২ অক্টোবর ২০১৭, ১৫:০৭

মিয়ানমারের রাখাইন থেকে নির্যাতনের মুখে বাংলাদেশে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের নোয়াখালীর দ্বীপ উপজেলা হাতিয়ার বিচ্ছিন্ন ভাসানচরে পুনর্বাসনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। এ ঘোষণার পর এ চরকে ঘিরে নানামুখী তথ্যে বিভ্রান্তির পাশাপাশি কৌতূহলও দেখা দিয়েছে। সম্প্রতি চরটি ঘুরে এসেছেন বাংলা ট্রিবিউনের স্টাফ রিপোর্টার শাহেদ শফিক। ভাসানচর নিয়ে তার ধারাবাহিক ৬ পর্বের প্রতিবেদনের আজ থাকছে তৃতীয় পর্ব।

ভাঙা-গড়ায় নড়বড়ে ভাসানচর (ভিডিও) বয়স প্রায় ২৫ বছর হলেও এখনও থিতু হয়নি ভাসানচর। দীর্ঘ সময় ধরে এ চরের জায়গা যেমন মেঘনা ও বঙ্গোপসাগরের মোহনায় জেগে উঠেছে, তেমনই ভাঙনও দেখা দিয়েছে এর বিভিন্ন প্রান্তে। মেঘনা হয়ে বঙ্গোপসাগরে যাওয়া বিভিন্ন বাণিজ্যিক নৌযানের মাঝি বা সারেং―যারা অনেক বছর ধরেই ভাসানচরকে দেখছেন, তারা বলছেন বেশ কয়েক বছর ধরে বিভিন্ন প্রান্তের অব্যাহত ভাঙনে এ চরের অন্তত, কয়েক কিলোমিটার এলাকা নদী ও সাগর গর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। বলা যায়,ভাঙা-গড়ার মধ্যেই রয়েছে ভাসানচর।

বনবিভাগের তথ্যেও রয়েছে এর মিল। সরকারি এ প্রতিষ্ঠানটি উপাত্ত দিয়ে জানিয়েছে, এ পর্যন্ত চরের অন্তত ৫-৭ হাজার একর বনভূমি নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। এখনও ভাঙছে বনায়ন করা জমি। তাই ভাঙা-গড়ার এ খেলায় চরটির স্থায়ীত্ব নিয়ে কিছুটা শঙ্কাও রয়েছে স্থানীয় প্রশাসনের।

ঘাস গজালেও থেমে নেই ভাঙন বনবিভাগ জানিয়েছে, ভাটার সময় ভাসানচরের আশপাশে প্রায় ৫০ হাজার একর জায়গা ভেসে ওঠে। অথচ এ চরের দৃশ্যমান আয়তন মাত্র ১৩ হাজার একর। এর মধ্যে মোটে ৫ হাজার একর জায়গা এখন বসবাসযোগ্য। অর্থাৎ এখনও জেগে ওঠার অপেক্ষায় রয়েছে আরও প্রায় ৩৫ হাজার একর এলাকা। কিন্তু, সাগর মোহনার এই বিপুল পরিমাণ জায়গা আদৌ জাগবে কিনা, জাগলে কত সময় লাগতে পারে, নাকি বর্তমান দ্বীপচরের আরও বিশাল অংশ ভবিষ্যতে তলিয়ে যাবে তা নিয়ে বিশেষ গবেষণার সুযোগ আছে বলে মনে করে বনবিভাগ।  

সরকারি এই প্রতিষ্ঠানটি জানিয়েছে, এ চরে ২০০০ সাল থেকে গত অর্থবছর পর্যন্ত ১৬ হাজার ১১১ একর ম্যানগ্রোভ ও ৩৯ একর মাউন্ট (উঁচু স্থানে) বনায়ন করা হয়েছে। বর্তমানে ভাঙনের কবলে পড়ে ১৩ হাজার একরের মতো বনায়ন বিদ্যমান রয়েছে।

চরের ভেতরের একটি খাল সরেজমিন দেখা গেছে, ভাসানচরের দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব পাশ এখনও ভাঙছে। খুব প্রকটভাবে তা দেখা না গেলেও বনবিভাগেরই তথ্য, বছরে অন্তত আধা কিলোমিটার এলাকা ভাঙনের কবলে পড়ে বিলীন হয়ে যাচ্ছে।

৯০ দশকের মাঝামাঝি জেগে ওঠা এ চরে ১০ বছর আগেও মাছ ধরতে যেতেন হাতিয়া উপজেলার নলচিরা ইউনিয়নের পাঞ্চায়েত গ্রামের ৫৮ বছর বয়সী জেলে আলম। তিনি বাংলা ট্রিবিউনকে জানান, ১০ বছর আগেও তিনি জালিয়ারচর ও ডুবারচরের মাঝখানের খালে মাছ ধরতে যেতেন। ভাটার সময় খালটি হেঁটে ও জোয়ারে সাঁতরে পারাপার হওয়া যেত। ধীরে ধীরে খালটিতে ভাঙন শুরু হয়। খালটি ভাঙতে ভাঙতে বড় নদীতে পরিণত হওয়ায় গত ১০ বছর ধরে এই খালে আর মাছ ধরা যায় না। এ কারণে এই চরের বনায়ন করা এলাকাও দিন দিন ছোট হয়ে আসছে।

ভাঙন কবলিত একটি অংশ সরেজমিন দেখা গেছে, ভাঙনের কারণে ভাসানচরের পুরনো অংশটি ছোট হয়ে আসছে। বনবিভাগের সৃজিত বনভূমি নদীগর্ভে বিলীন হয়ে যাচ্ছে। চরের দক্ষিণ-পূর্ব দিকে ভাঙলেও উত্তর ও পশ্চিম দিকে আবার নতুন করে চর জেগে উঠছে। ফলে এ চরটি কবে স্থায়ী রূপ পাবে তা নিয়ে এখনও সংশয়ে রয়েছে স্থানীয় প্রশাসন।

সম্প্রতি ভাসানচর নিয়ে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশে সরেজমিন একটি প্রতিবেদন তৈরি করেন নলচিরা রেঞ্চের ওছখালী বিট কর্মকর্তা মো. নাহিদ হাসান। ওই প্রতিবেদনে তিনি ভাসানচরের গঠন ও প্রকৃতি সম্পর্কে উল্লেখ করেন। এতে তিনি বলেন, ভাসানচর গোলাকৃতির বালি ও কাদাযুক্ত নরম প্রকৃতির মাটি দিয়ে মেঘনার বুকে জেগে ওঠা এমন একটি চর― যার মাঝের অংশ উঁচু ও চারপাশ নিচু। এ কারণে এ চরের নিম্নাঞ্চল স্বাভাবিক জোয়ারে তলিয়ে যায় ও ভাটায় ভেসে ওঠে। চরটির দক্ষিণ ও পশ্চিম পাশে ব্যাপক ভাঙন অব্যাহত রয়েছে। তাছাড়া, চরটির উত্তর ও পূর্ব পাশ এখনও জেগে ওঠার পর্যায়ে থাকায় অতিরিক্ত কাদাময়। তবে চরের মধ্যস্থানে বেশ উঁচু ও শক্ত মাটি রয়েছে। চরটির মাটি নরম প্রকৃতির, কাদাযুক্ত এবং জোয়ারে তলিয়ে যাওয়া ও লোনা পানির অনুপ্রবেশের কারণে সেখানে ফসলের চাষাবাদ অত্যন্ত দুরূহ। তবে চরটির মধ্যস্থানে উঁচু ও বড় বড় কেওড়া গাছ রয়েছে।

কোথাও ভাঙছে, কোথাও পলি জমে বাড়ছে চরের ভুমি ভাসানচর ভাঙনের কথা স্বীকার করেন হাতিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) খোন্দকার মোহাম্মদ রিজাউল করিম, জেলা প্রশাসক মো. মাহবুব আলম তালুকদার ও নোয়াখালী বিভাগীয় বন কর্মকর্তা মো. তহিদুল ইসলাম।

জানতে চাইলে খোন্দকার মোহাম্মদ রিজাউল করিম বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘ভাসানচর ব্যাপক ভাঙছে। এখন সেই চিন্তা করে লাভ নেই। এই চর স্থায়ী হতে আরও সময় লাগবে। এখন সরকার যদি এ চরে রোহিঙ্গা পুনর্বাসন করে তাহলে নিশ্চয় ভাঙন রোধ করেই পুনর্বাসন করবে।’ তার মতে, চরটি এখনও অনেক কাঁচা। চরের আয়তন ১৩ হাজার একর হলেও এই মুহূর্তে পাঁচ হাজার একর মোটামুটি বাসযোগ্য বলে ধরা যেতে পারে।

প্রতিদিনই ভাঙছে ভাসানচরের বিভিন্ন অংশ একই কথা জানান নোয়াখালী বিভাগীয় বন কর্মকর্তা মো. তহিদুল ইসলাম। তিনি আরও বলেন, ‘ভাসানচরের দক্ষিণ-পূর্ব দিকে ভাঙছে। আবার পশ্চিম দিকে চর জাগছে। এটা আমি গিয়েও দেখে আসছি। আমাদের সৃজনকৃত অনেক বড় বড় গাছ ভেঙে নদীতে বিলীন হয়ে গেছে। একটি চর বা দ্বীপ স্থায়ী হতে ৪০ থেকে ৫০ বছর সময় লাগে। নতুনভাবে চর দেখা দেওয়ার পর আমরা প্রথমে সেই চরে গিয়ে সরেজমিন দেখে আসি। যখন দেখি চরটিতে উড়ি বা বিভিন্ন প্রজাতির ঘাস জন্মায়, তখন আমরা সেখানে বনায়ন করি। উপকূলীয় চরগুলোতে কেওড়া ও গেওয়া গাছই ভালো জন্মায়। এরপর ধীরে ধীরে গাছের শেকড়ের সঙ্গে পলি জমে চর ক্রমান্বয়ে উঁচু ও শক্ত হয়ে ওঠে। এরপর এক পর্যায়ে চরটি বসবাসের উযোগী হয়।’

প্রতিবেদকের বর্ণনায় ভাসানচর

এই কর্মকর্তা জানান, ২০০০ সাল থেকে এ পর্যন্ত তারা ভাসানচরে প্রায় ১৬ হাজার একর ম্যানগ্রোভ বনায়ন ও ৪০ একর মাউন্ট বনায়ন করেছেন। বর্তমানে চরটির আয়তন হচ্ছে ১৩ হাজার একর। এর মধ্যে বিশাল অংশ এখনও বনায়ন করা হয়নি। এই কর্মকর্তার কাছে প্রশ্ন ছিল আয়তন যদি ১৩ হাজার একর হয় তাহলে ১৬ হাজার একর বনায়ন কিভাবে করা হয়েছে? জবাবে তিনি বলেন, ‘আমাদের বনায়নসহ চরের বিশাল অংশ ভেঙে গেছে। কিছু এলাকা এখনও ভাঙছে।’ 

বঙ্গোপসাগরের মোহনায় মেঘনার বুকে জাগা ভাসানচর

সূত্রে জানা গেছে, গত ২৮ সেপ্টেম্বর চরটি সরেজমিন দেখতে যান স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল। ওইদিন চরটি নিয়ে মন্ত্রীকে একটি প্রেজেন্টেশন দেখায় নৌবাহিনী। এতে ভাঙনের চিত্রটিও উঠে আসে। প্রতিরোধ হিসেবে ভাঙন কবলিত স্থানে নৌবাহিনীর ভাসমান ডক বা পল্টুন বেঁধে দিয়ে সাগরের ঢেউ প্রতিরোধ করে ভাঙন থামানো সম্ভব বলে তাকে জানানো হয়েছে। তাছাড়া, আধুনিক প্রযুক্তির মাধ্যমেও চরের ভাঙন প্রতিরোধ করা সম্ভব বলে ওই প্রেজেন্টেশনে বলা হয়।

বঙ্গোপসাগরের মোহনায় মেঘনার বুকে জেগে ওঠা ভাসানচর

স্থানীয় প্রশাসনের তথ্যমতে, চরটির দৈর্ঘ্য ৮ কিলোমিটার ও প্রস্থ সাড়ে ৪ কিলোমিটার। এতে রোহিঙ্গাদের পুনর্বাসনের জন্য ৫০০ একর জমি প্রস্তাব করা হয়েছে। তবে বর্তমানে চরের পশ্চিম ও উত্তর পাশের নদীতে আরও বিশাল আকারে ডুবোচর দেখা যাচ্ছে। ভাটার সময় এই অংশে নৌকা চলাচলে বাধার সৃষ্টি হয়।

নোয়াখালীর জেলা প্রশাসক মো. মাহবুব আলম তালুকদার বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘চরটি ভাঙছে ঠিক। কিন্তু আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে এ ভাঙন প্রতিরোধ করা যেতে পারে। আমি যেহেতু কারিগরি বিশেষজ্ঞ নই, সেহেতু এ বিষয়ে এর বেশি বলতে পারবো না। বর্তমানে চরে ভূমি জরিপ চলছে। এরপর বিস্তারিত বলা যাবে।’

খাল থেকে দেখা ভাসানচর

জেলা প্রশাসনের এই শীর্ষ কর্মকর্তার মতে, কোনও চরই প্রাকৃতিকভাবে মানুষের জন্য বসবাসযোগ্য হয় না। চর জাগার পর ধীরে ধীরে সেটাকে বাস উপযোগী করে তোলা হয়। ভাসানচরে বসতি গড়তে হলে সেখানে বেড়িবাঁধ নির্মাণের পাশাপাশি রাস্তাঘাট, সাইক্লোন শেল্টার, আশ্রয়কেন্দ্র, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, বিশুদ্ধ পানির ব্যবস্থা ও নিরাপত্তা জোরদারসহ অনেক উন্নয়ন কাজ করতে হবে।

জেলা প্রশাসক আরও বলেন, ‘আগামী মাসের মধ্যে ভাসানচরে ১৩ কিলোমিটার লম্বা বেড়িবাঁধ নির্মাণের পরিকল্পনা রয়েছে। রোহিঙ্গাদের পুনর্বাসন করা হলে পুরো চর বেড়িবাঁধের আওতায় চলে আসবে।’

আরও পড়ুন:
কতটা বাসযোগ্য ভাসানচর? (ভিডিও)
জোয়ারে ডোবে ভাটায় ভাসে




/এএম/টিএন/আপ-এসএনএইচ/
সম্পর্কিত
রোহিঙ্গাদের জন্য এ বছর ৮৫ কোটি ডলার সহায়তা চেয়েছে জাতিসংঘ
রোহিঙ্গাদের সর্বোচ্চ সেবার জন্য অন্তর্ভুক্তিমূলক অংশগ্রহণের দাবি
অনুপ্রবেশকালে আরও ১৪ রোহিঙ্গাকে ফেরত পাঠিয়েছে বিজিবি
সর্বশেষ খবর
জরিমানার ৪৬৪ মিলিয়ন ডলার বন্ড জোগাড় করতে পারেননি ট্রাম্প
নিউইয়র্ক জালিয়াতি মামলাজরিমানার ৪৬৪ মিলিয়ন ডলার বন্ড জোগাড় করতে পারেননি ট্রাম্প
বাড়তি ভাড়া নিলে সেই গণপরিবহন চলাচল বন্ধ করে দেওয়া হবে
পরিবহন মালিক সমিতির হুঁশিয়ারিবাড়তি ভাড়া নিলে সেই গণপরিবহন চলাচল বন্ধ করে দেওয়া হবে
দুই পক্ষের সংঘর্ষে এক ব্যক্তি নিহত
দুই পক্ষের সংঘর্ষে এক ব্যক্তি নিহত
দেশে দেশে রমজানের বৈচিত্র্যময় সংস্কৃতি ও রকমারি উৎসব
দেশে দেশে রমজানের বৈচিত্র্যময় সংস্কৃতি ও রকমারি উৎসব
সর্বাধিক পঠিত
দিন দিন নাবিকদের সঙ্গে কঠোর আচরণ করছে দস্যুরা
দিন দিন নাবিকদের সঙ্গে কঠোর আচরণ করছে দস্যুরা
সুইডেনের রাজকন্যার জন্য দুটি হেলিপ্যাড নির্মাণ, ৫০০ স্থানে থাকবে পুলিশ
সুইডেনের রাজকন্যার জন্য দুটি হেলিপ্যাড নির্মাণ, ৫০০ স্থানে থাকবে পুলিশ
অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তারা সাকিবকে আমার বাসায় নিয়ে আসেন: মেজর হাফিজ
অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তারা সাকিবকে আমার বাসায় নিয়ে আসেন: মেজর হাফিজ
সঞ্চয়ী হিসাবের অর্ধকোটি টাকা লোপাট করে আত্মগোপনে পোস্ট মাস্টার
সঞ্চয়ী হিসাবের অর্ধকোটি টাকা লোপাট করে আত্মগোপনে পোস্ট মাস্টার
‘সরলতার প্রতিমা’ খ্যাত গায়ক খালিদ আর নেই
‘সরলতার প্রতিমা’ খ্যাত গায়ক খালিদ আর নেই