X
শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪
১২ বৈশাখ ১৪৩১

জেনে-বুঝেই আরসাকে হামলা চালাতে দিয়েছিল মিয়ানমার সেনাবাহিনী?

আদিল শাখাওয়াত
১৯ অক্টোবর ২০১৭, ২৩:৫৭আপডেট : ২০ অক্টোবর ২০১৭, ০০:২৪

২৫ আগস্ট নিরাপত্তা চৌকিগুলোতে নিরাপত্তা শিথিল ছিল বলে উল্লেখ করেছেন রোহিঙ্গারা (ছবি- সৈয়দ জাকির হোসেন/ঢাকা ট্রিবিউন) মিয়ানমারের রোহিঙ্গাদের সংগঠন আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মির (আরসা) শীর্ষ কয়েকজন নেতাসহ সংগঠনটির ২০ জন সদস্যের সঙ্গে কথা বলেছেন ঢাকা ট্রিবিউনের সাংবাদিক আদিল শাখাওয়াত। এসব সাক্ষাৎকারে উঠে এসেছে আরসার ইতিহাস, সাংগঠনিক কাঠামো, নেতৃত্ব, অর্থায়ন ও এর সঙ্গে সম্পর্কিত বিভিন্ন বিষয়ের বিস্তারিত তথ্য। ২৪ আগস্ট রাখাইনে সেনাচৌকিতে হামলার ঘটনাও উঠে এসেছে এতে। পাঁচ পর্বের ধারাবাহিক প্রতিবেদনে আজ থাকছে প্রথম পর্ব

রোহিঙ্গাদের বিভিন্ন সূত্র বলছে, এ বছরের আগস্টের ২৫ তারিখে মিয়ানমার সীমান্তে নিরাপত্তা চৌকিতে যে হামলার তথ্য হয়তো আগে থেকেই ছিল মিয়ানমার সেনাবাহিনীর কাছে। তবে তারা ইচ্ছাকৃতভাবেই এই হামলা ঘটতে দিয়েছে, যেন হামলাকারী রোহিঙ্গাদের সন্ত্রাসী হিসেবে প্রচার চালানো যায়। রোহিঙ্গারা আরও দাবি করছেন, ২৫ আগস্টের হামলার পর নয়, বরং জুলাইয়ের শেষ সপ্তাহ থেকেই সন্ত্রাসীদের সন্ধানের উছিলায় রোহিঙ্গাদের হয়রানি করতে শুরু করে।

রোহিঙ্গাদের এক ধর্মীয় নেতা বলেন, ‘সাধারণত আমাদের এলাকায় রোহিঙ্গাদের সব চেক পোস্টেই থামতে হয়। তবে কোনও এক অজানা কারণে ২৪ আগস্ট চেক পোস্টগুলোতে তেমন কোনও তৎপরতা দেখা যায়নি। ওইদিন আরসার সদস্যরা ওই এলাকা দিয়ে অবাধেই চলাচল করেছে, তাদের কেউ বাধা দেয়নি।’ রোহিঙ্গাদের এই ধর্মীয় নেতার অনেক শিক্ষার্থীই আরসার সদস্য।

ওই ধর্মীয় নেতা দাবি করেন, ‘ইতিহাস বলে, মিয়ানমারের সেনাবাহিনী সবই জানে। কোনও ঘরে যদি একটি বুলেটও থেকে থাকে, সেটার নিখুঁত অবস্থানও তারা বলে দিতে পারবে। এই সেনাবাহিনীর যেহেতু রোহিঙ্গাদের নির্মূল করার পরিকল্পনা রয়েছে এবং রোহিঙ্গাদের মধ্যেও তাদের গুপ্তচর রয়েছে, তাই এটা মনে করার কোনও কারণ নেই যে তারা হামলার ঘটনা আগে থেকে আঁচ করতে পারেনি। তারা ঠিক জানত। শুধু তাই নয়, তারা আরসার প্রধান নেতা আতা উল্লাহকে ২৫ আগস্টের হামলা চালানোর সুযোগও করে দেয়। কারণ তারা জানত, এই হামলা হলে তারা আরসাকে সন্ত্রাসী সংগঠন ও সব রোহিঙ্গাকে সন্ত্রাসী বলে চিহ্নিত করার সুযোগ পাবে।’

ওই ধর্মীয় নেতা আরও বলেন, আতা উল্লাহ কোথায় থাকেন এবং কোথা থেকে আরসা পরিচালনা করেন, এসব তথ্য সম্ভবত মিয়ানমার সেনাবাহিনীর কাছে আছে।

আরসা যেভাবে নিরাপত্তা চৌকিতে হামলা চালিয়েছে, তা মিয়ানমারের সেনাবাহিনী সঙ্গে লড়াইয়ের ভালো উপায় বলে মনে করছেন না রোহিঙ্গাদের এই ধর্মীয় নেতা। এই সময়ে এসে এই বিদ্রোহী সংগঠনটির প্রতি ব্যাপক সমর্থন লক্ষ্য করা এরা সেনাবাহিনীর এজেন্ডাই বাস্তবায়ন করেছে বলে মনে করেন তিনি।

তিনি বলেন, ‘আমাদের অবশ্যই মিয়ানমারের শোষক সরকারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে হবে। তবে একই সময়ে আমাদের এটাও মাথায় রাখতে হবে, গোটা বিশ্বেএখন কিভাবে মুসলিমদের দেখছে এবং এখন এসে আমাদের সন্ত্রাসী বলে চিহ্নিত করার চেষ্টা চালাচ্ছে। রোহিঙ্গারাও মুসলিম এবং মিয়ানমারের সেনাবাহিনীও আমাদের ধ্বংস করতে প্রস্তুত ছিল। এমন একটি পরিস্থিতিতে আরসা যেটা করেছে, সেটাকে আমার দৃষ্টিতে সঠিক বলে মনে হয়নি।

বয়স্ক রোহিঙ্গাদের অনেকেই আরসার এমন হামলার কার্যকারিতা নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন। তবে এতে করে তরুণদের মধ্যে আরসার জনপ্রিয়তায় কোনও ভাটা পড়েনি। আরসার দুই তরুণ সদস্য বলেন, ‘আমিরের (আতা উল্লাহ) নির্দেশ পাওয়ামাত্রই আমরা যেকোনও স্থানে যেতে ও লড়াই করতে প্রস্তুত।’ তাদের মতো আরও অনেক আরসা সদস্যই মিয়ানমার থেকে আতা উল্লাহর নির্দেশনা পাওয়ার জন্য অপেক্ষ করছেন বলে জানান তারা।

এদিকে, আরসা সূত্রগুলো বলছে, হামলার পরিকল্পনা ছিল ২৬ আগস্ট। তবে ২৪ আগস্ট আচমকা একটি বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটলে হামলার সময় এগিয়ে নিতে আসতে বাধ্য হয় তারা। এক আরসা সদস্য বলেন, ‘আমাদের কয়েকজনের নেতৃত্বে ছিলেন সিনিয়র কমান্ডার মুফতি জিয়াবুর রহমান। আগের পরিকল্পনা অনুযায়ী, আমরা ২৪ আগস্ট গো জন দিয়াতে বিস্ফোরক রেখে আসার দায়িত্বে ছিলাম আমরা। তবে নির্দিষ্ট সময়ের আগেই একটি বোমার বিস্ফোরণ হয় এবং এ ঘটনায় আমাদের সাত সদস্য নিহত হয়। মুফতি জিয়াবুর রহমানও আহত হন ওই ঘটনায়।’

গো জন দিয়ার আশপাশের নুরুল্লাহ ফারা, বাগুনা ও সফরাদ্দিবিল এলাকার স্থানীয় রোহিঙ্গারাও ২৪ আগস্ট রাত ১১টার দিকে বোমা বিস্ফোরণের শব্দ শুনতে পাওয়ার কথা জানিয়েছেন।

আরসা সদস্যরা বলেন, মিয়ানমারের সেনাবাহিনীও এই বিস্ফোরণের শব্দ শুনতে পেয়েছে বলে আতা উল্লাহ নিজেদের হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপের মাধ্যমে একদিন আগে, ২৫ আগস্ট ওই হামলা চালানোর নির্দেশ দেন। আরসা’র একটি সূত্র বলেন, ‘রাত ১২টার দিকে কিছু এলাকায় ও রাত ৩টার দিকে কিছু এলাকায় হামলার নির্দেশ আসে।’ তারা আরও বলেন, আনুষ্ঠানিক ঘোষণার আগে থেকেই ওই হামলার কাজ চলছিল বলেও ইঙ্গিত পেয়েছিলেন তারা। কারণ ওই সময়ে তারা সংগঠনের সবচেয়ে সেরা কর্মীগুলোর মধ্যে বাড়তি তৎপরতা দেখতে পান।

জুলাইয়ের শেষ সপ্তাহে রাথেডং টাউনশিপের (জেলা) রাজার বিল ও শোয়াপ প্র্যাং এলাকা থেকে বেশ কয়েকজন রোহিঙ্গাকে ধরে নিয়ে যায় মিয়ানমারের নিরাপত্তা বাহিনী। তাদের বেশিরভাগই তরুণ। এরপর থেকে গোটা আগস্ট মাসেই আরসা নিজেদের টুইটার অ্যাকাউন্ট থেকে বারবার রোহিঙ্গাদের ওপর সেনাবাহিনীর নির্যাতন বন্ধের আহ্বান জানাতে থাকে। রোহিঙ্গারা বলছেন, জুলাইয়ে ধরে নিয়ে রোহিঙ্গাদের কোনও খোঁজ আর পাওয়া যায়নি।

রাখাইনের চুত পিইন এলাকার তরুণ নেয়ামতউল্লাহ একজন হাফেজ। বালুখালী ক্যাম্পে থাকা এই তরুণ বলেন, ‘নিরাপত্তা বাহিনী হঠাৎ করেই আমাদের গ্রামে আরসা সদস্যদের খুঁজতে শুরু করে। ওই সময় কেনাকাটার জন্য বাজারে যেতেও আমাদের বাধা দেওয়া হয়। বলা হয়, আমরা নাকি সবাই সন্ত্রাসী।’

পরে, গত ৪ আগস্ট বৌদ্ধ ম্রো সম্প্রদায়ের ছয় জনের লাশ পাওয়া যায় মংডুর মেয়ু পাহাড়ি এলাকায়। তাদের সবার শরীরে গুলি ও চাপাতির দাগ ছিল। এ ঘটনার পর সেনাবাহিনী আবারও ফিরে আসে চুত পিইন এলাকায়। এবারে তারা রোহিঙ্গা আটক করতে গেলে গ্রামবাসী তাদের বাধা দেয়। ওই গ্রামের আরেক সাবেক বাসিন্দা জলিল জানান, গ্রামবাসী বাধা দিলে সেনবাহিনী কাউকে আটক না করেই চলে যায়। যদিও পরে তারা আবার ফিরে এসে ঘরবাড়িতে আগুন লাগিয়ে দেয় বলে জানান জলিল। ওই সময় থেকেই ওই এলাকায় সেনাবাহিনীর উপস্থিতি উল্লেখযোগ্য পরিমাণে বেড়ে যায়।

৪ আগস্টের হামলার পর ১৬ আগস্ট আরসা এক বিবৃতি প্রকাশ করে টুইটার অ্যাকাউন্টে। ওই বিবৃতিতে ‘রথেডংয়ে রোহিঙ্গাদের আটকে রাখা’ থেকে মিয়ানমার সরকারকে বিরত থাকতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে চাপ দেওয়ার আহ্বান জানায় আরসা।

রোহিঙ্গাদের প্রতি নৃশংস হামলা আর থামেনি। আরসরা সদস্যরা বলছেন, এ কারণেই তাদের ২৫ আগস্ট হামলা চালাতে হয়েছে। ওই রাতে আরসা সদস্যরা ৩০টি নিরাপত্তা চৌকিতে হামলা চালায়। যদিও আরসা সদস্যদের দাবি, রোহিঙ্গাদের নির্মূল করতে মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর তৎপরতার বিরুদ্ধে তাদের এই হামলা রক্ষণাত্মক কৌশল। আরসার ওই রাতের হামলায় সাধারণ রোহিঙ্গারাও যথেষ্টই সহায়তা করেছেন বলে জানান তারা।

এর আগে, গত ২৪ আগস্ট রোহিঙ্গা অধিকারকর্মী নেয় স্যান লুইন তার ফেসবুক পেজে বেশ কয়েকটি ভিডিও শেয়ার করেন। ওই ভিডিওগুলোতে রথেডং থেকে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর হাতে আটক রোহিঙ্গাদের ওপর নির্যাতনের চিত্র তুলে ধরা হয়। ভিডিওতে অনেক রোহিঙ্গার শরীরেই দেখা গেছে গুলির চিহ্ন।
(ঢাকা ট্রিবিউনে প্রকাশিত)

/টিআর/
সম্পর্কিত
উখিয়া ক্যাম্পে রোহিঙ্গা যুবককে কুপিয়ে হত্যা
কক্সবাজার জেলার রোহিঙ্গা ভোটারদের তালিকা চেয়েছেন হাইকোর্ট
মিয়ানমারের ২৮৫ জন সেনা ফেরত যাবে, ফিরবে ১৫০ জন বাংলাদেশি
সর্বশেষ খবর
বাংলাদেশের উন্নয়ন দেখলে আমাদের লজ্জা হয়: শাহবাজ
বাংলাদেশের উন্নয়ন দেখলে আমাদের লজ্জা হয়: শাহবাজ
৬ ম্যাচ পর জয় দেখলো বেঙ্গালুরু 
৬ ম্যাচ পর জয় দেখলো বেঙ্গালুরু 
সাদি মহম্মদ স্মরণে ‘রবিরাগ’র বিশেষ আয়োজন
সাদি মহম্মদ স্মরণে ‘রবিরাগ’র বিশেষ আয়োজন
‘নীরব এলাকা’, তবু হর্নের শব্দে টেকা দায়
‘নীরব এলাকা’, তবু হর্নের শব্দে টেকা দায়
সর্বাধিক পঠিত
দুদকের চাকরি ছাড়লেন ১৫ কর্মকর্তা
দুদকের চাকরি ছাড়লেন ১৫ কর্মকর্তা
বাংলাদেশ ব্যাংকের চাকরি ছাড়লেন ৫৭ কর্মকর্তা
বাংলাদেশ ব্যাংকের চাকরি ছাড়লেন ৫৭ কর্মকর্তা
স্কুল-কলেজে ছুটি ‘বাড়ছে না’, ক্লাস শুরুর প্রস্তুতি
স্কুল-কলেজে ছুটি ‘বাড়ছে না’, ক্লাস শুরুর প্রস্তুতি
কেন গলে যাচ্ছে রাস্তার বিটুমিন?
কেন গলে যাচ্ছে রাস্তার বিটুমিন?
ধানের উৎপাদন বাড়াতে ‘কৃত্রিম বৃষ্টির’ পরিকল্পনা
ধানের উৎপাদন বাড়াতে ‘কৃত্রিম বৃষ্টির’ পরিকল্পনা