X
বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪
১৪ চৈত্র ১৪৩০

ভাসানচরে রোহিঙ্গা পুনর্বাসন: শঙ্কিত স্থানীয়রা

শাহেদ শফিক, ভাসানচর থেকে ফিরে
২১ অক্টোবর ২০১৭, ১০:০১আপডেট : ২২ অক্টোবর ২০১৭, ১৪:৫০

মিয়ানমারের রাখাইন থেকে নির্যাতনের মুখে বাংলাদেশে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের নোয়াখালীর দ্বীপ উপজেলা হাতিয়ার বিচ্ছিন্ন ভাসানচরে পুনর্বাসনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। এ ঘোষণার পর এ চরকে ঘিরে নানামুখী তথ্যে বিভ্রান্তির পাশাপাশি কৌতূহলও দেখা দিয়েছে। সম্প্রতি চরটি ঘুরে এসেছেন বাংলা ট্রিবিউনের স্টাফ রিপোর্টার শাহেদ শফিক। ভাসানচর নিয়ে তার ধারাবাহিক ৬ পর্বের প্রতিবেদনের আজ  থাকছে পঞ্চম পর্ব।

মেঘনা-বঙ্গোপসাগরের মোহনায় জেগে ওঠা ভাসানচর

মিয়ানমার থেকে নির্যাতনের শিকার হয়ে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের ভাসানচরে পুনর্বাসনের সরকারি সিদ্ধান্তের খবরে হাতিয়ার স্থানীয়দের মধ্যে নানা শঙ্কা দেখা দিয়েছে। হাতিয়াবাসীর কেউ কেউ একে মানবতার শ্রেষ্ঠ উদাহরণ হিসেবে বিবেচনা করলেও অনেকেই মনে করছেন ভাসানচরে পুনর্বাসিত হয়ে রোহিঙ্গারা জলদস্যুতাসহ নানা অপরাধ কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়বে। চর ছেড়ে তারা আশপাশের চরাঞ্চল ও মূল ভূখণ্ডেও ছড়িয়ে যেতে পারে। রোহিঙ্গাদের মধ্যে এইডসসহ ঝুঁকিপূর্ণ বিভিন্ন রোগ-ব্যাধি শনাক্তের খবরও উদ্বিগ্ন করে তুলেছে হাতিয়াবাসীকে। পাশাপাশি কর্মসংস্থানের সুযোগ কমে যাওয়ার আশঙ্কা করছেন স্থানীয়রা।

মিয়ানমার থেকে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের জন্য এরইমধ্যে নোয়াখালীর হাতিয়া উপজেলা থেকে প্রায় ২৫ কিলোমিটার পূর্বের বিচ্ছিন্ন ভাসানচরকে নির্বাচন করা হয়েছে। এ জন্য চরটি বাসযোগ্য করে তুলতে নৌবাহিনীকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। নৌবাহিনী প্রাথমিক কাজও শুরু করেছে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও প্রধানমন্ত্রীর সামরিক সচিবসহ সরকারের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা চরটি পরিদর্শনও করেছেন।

ভাসানচরে রোহিঙ্গা পুনর্বাসন: শঙ্কিত স্থানীয়রা

ভাসানচরে রোহিঙ্গা পুনর্বাসনের ঘোষণা আসার পর স্থানীয় বাসিন্দাদের মধ্যে নানা শঙ্কা ও উদ্বেগ বিরাজ করছে। তারা মনে করছেন, রোহিঙ্গারা ঝুঁকিপূর্ণ ও অপরাধপ্রবণ জাতি। ইয়াবা ব্যবসাসহ নানা অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে তারা জড়িত। নদীবেষ্টিত হাতিয়ার নির্জন ভাসানচরে তাদের পুনর্বাসন করা হলে সাগরকেন্দ্রিক দস্যুতায়ও তারা জড়িয়ে যেতে পারে। এসব কাজে একবার জড়িয়ে গেলে তাদের ফেরানো অসম্ভব হবে বলে মনে করছেন স্থানীয় বাসিন্দারা। তাছাড়া সাগরকেন্দ্রিক ভূ-রাজনীতির জন্যও তারা ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠতে পারে বলেও মনে করছেন কেউ কেউ।

বর্তমানে ছোট আয়তনের হাতিয়া দ্বীপে প্রায় সাড়ে ছয় লাখ মানুষ বসবাস করছে। এর মধ্যে যদি দ্বীপের ওই চরে আরও কয়েক লাখ রোহিঙ্গাকে রাখা হয় তাহলে দ্বীপের ভারসাম্য বিনষ্ট হবে। স্থানীয়রা মনে করছেন যেভাবে বলা হচ্ছে, বাস্তবে রোহিঙ্গাদের ভাসানচরে আটকে রাখা সম্ভব হবে না। তারা যেকোনও কায়দায় আশপাশের চরাঞ্চল ও মূল ভূখণ্ডে ছড়িয়ে পড়বে।

 ম্যাপ

স্থানীয়দের এমন আশঙ্কার পরিপ্রেক্ষিতে গত ২৮ সেপ্টেম্বর ভাসানচর পরিদর্শনে গিয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল বলেন, ‘রোহিঙ্গা নিয়ে নোয়াখালীবাসীর আতঙ্কিত হওয়ার কোনও কারণ নেই। রোহিঙ্গারা কী করবে না করবে, সবকিছুই প্রশাসনের নজরদারিতে থাকবে। সবকিছু মাথায় রেখে পরিকল্পনা অনুযায়ী তাদের এখানে আনা হবে। ভাসানচরকে দ্রুত সময়ের মধ্যে সুন্দর আবাসিক এলাকা হিসেবে গড়ে তোলা হবে। রোহিঙ্গাদের জন্য এখানে শিক্ষা, চিকিৎসাসহ সব সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করা হবে।’

স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর এমন আশ্বাসেও আশ্বস্ত হতে পারছেন না স্থানীয়রা। এ নিয়ে কথা হয় উদয়ন মৎস্যজীবী সমবায় সমিতির সাধারণ সম্পাদক ও হাতিয়া দ্বীপ সরকারি কলেজ ছাত্র সংসদের সাবেক সাধারণ সম্পাদক মহিউদ্দিন মিঠুর সঙ্গে। তিনি বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন,  ‘রোহিঙ্গাদের পুনর্বাসন করা মানবিক বিষয়। কিন্তু আমরা আশঙ্কা করছি তাদের সঠিক নজরদারিতে রাখা যাবে কিনা। যদি তারা সুযোগ পায় তাহলে আমাদের মূল ভূখণ্ডেও চলে আসতে পারে। তাছাড়া, সাগরকেন্দ্রিক দস্যুপনায়ও জড়িয়ে যেতে পারে। ইয়াবা ব্যবসাসহ আরও নানা অপরাধে জড়িয়ে যেতে পারে। তারা যাতে সেসব কাজে আবার জড়িয়ে যেতে না পারে মৎস্যজীবী সমিতির পক্ষ থেকে আমরা সে দাবি জানাচ্ছি।’

তিনি আরও বলেন,‘আমরা যতদূর জেনেছি, রোহিঙ্গাদের অন্যতম পেশা মাছ ধরা। ভাসানচরে তাদের পুনর্বাসন করা হলে আশপাশের নদীতে তারা জেলে সেজে জলদস্যুতাসহ বিভিন্ন অপরাধে জড়িয়ে যেতে পারে।’ মহিউদ্দিন বলেন, ‘কক্সবাজার ও টেকনাফসহ ওই এলাকাগুলোয় যেসব অপরাধ ঘটছে তার অধিকাংশের সঙ্গেই রোহিঙ্গাদের জড়িত থাকার প্রমাণ রয়েছে।’

বিভিন্ন সময়ে মিয়ানমার সেনাবাহিনী ও স্থানীয় উগ্র মগদের দমন-পীড়নের শিকার হয়ে প্রায় ৯ লাখের মতো রোহিঙ্গা এখন শরণার্থী হিসেবে বাংলাদেশে অবস্থান করছে। এরমধ্যে গত ২৫ আগস্ট থেকে এ পর্যন্ত পাঁচ লাখ ৩৬ হাজারের বেশি রোহিঙ্গা বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করেছে। সরকারের কাছে আগে থেকে অবস্থান করা রোহিঙ্গাদের নানা অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ার তথ্য রয়েছে। ফলে তাদের সামাজিক সমস্যা ও পর্যটন শিল্পের জন্য অন্তরায় হিসেবে দেখছিল সরকার।

স্থানীদের অনেকেই মাছ ধরেন এ নদীতে

হাতিয়ার একটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী প্রধান শিক্ষক আবুল কাশেম বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘হাতিয়ার সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ধ্বংস করতে এটাই (ভাসানচরে রোহিঙ্গাদের পুনর্বাসন) যথেষ্ট। যদি ভাসানচরে রোহিঙ্গাদের আবদ্ধ করে রাখা না যায়, তাহলে তারা আমাদের আশপাশের চরাঞ্চল ও মূল ভূখণ্ডে মিশে গিয়ে অর্থনীতি, সংস্কৃতিসহ সব ধরনের কাজে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করতে পারে। তাছাড়া, রোহিঙ্গাদের ব্যবহার করে এক শ্রেণির লোক অপরাধপ্রবণতা বাড়াবে।’

হাতিয়া উপজেলার প্রবীণ শিক্ষাবিদ ও রাজনীতিক অধ্যক্ষ এনামুল হক বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘রোহিঙ্গাদের কিছু কিছু সদস্যের মধ্যে অপরাধ প্রবণতার খবর আমরা বিভিন্ন সময়ে গণমাধ্যমসহ বিভিন্ন মাধ্যমে শুনে আসছি। তবে মানবিক কারণে তাদের আশ্রয় দেওয়া প্রয়োজন।কিন্তু, তাদের আশ্রয় দেওয়ার পর তারা যাতে কোনও অপরাধকাজে জড়িত হতে না পারে, সেদিকে সরকার বা আইন-শৃঙ্খলাবাহিনীর কঠোর নজরদারি রাখতে হবে।’

ভাসানচরের একটি অংশ

স্থানীয় বাসিন্দা ও উপকূল বাঁচাও আন্দোলনের (উবা) সাধারণ সম্পাদক সারোয়ার হোসেন হৃদয় বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘বর্তমানে হাতিয়া উপজেলায় প্রায় সাড়ে ছয় লাখ লোক বসবাস করছে। তারা মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করে। রোহিঙ্গাদেরও অনেকের পেশা মাছ ধরা। আমাদের স্থানীয় জেলেদের সঙ্গে যদি তারা নতুন করে যুক্ত হয় তাহলে পরিস্থিতি আরও খারাপের দিকে যাবে।’

তিনি আরও বলেন, ‘এরইমধ্যে রোহিঙ্গাদের অনেকের শরীরে এইডসসহ বিভিন্ন রোগ ধরা পড়েছে। এরা অপরাধ ও রোগ-ব্যাধি ছড়ানোর ক্ষেত্রে ঝুঁকিপূর্ণ। তাছাড়া, তারা যদি জেলে সেজে নদীতে গিয়ে জলদস্যুদের সঙ্গে মিশে যায় তাহলে তো আমাদেরই ক্ষতি।’

আরও পড়ুন: 

ভাসানচরে যেভাবে রোহিঙ্গাদের পুনর্বাসন

 

ভাঙা-গড়ায় নড়বড়ে ভাসানচর (ভিডিও)
কতটা বাসযোগ্য ভাসানচর? (ভিডিও)
জোয়ারে ডোবে ভাটায় ভাসে

 

/এএম/টিএন/আপ-এসটি
সম্পর্কিত
জাতিসংঘের রোহিঙ্গা ডাটাবেজ ব্যবহার করতে চায় সরকার
ইন্দোনেশিয়ার উপকূল থেকে তিন রোহিঙ্গা শরণার্থীর লাশ উদ্ধার
ইন্দোনেশীয় উপকূলে নৌকাডুবি: ৭০ রোহিঙ্গা নিহতের আশঙ্কা
সর্বশেষ খবর
সরকারি চাকরির আশ্বাস ও ভুয়া নিয়োগপত্র দিয়ে কোটি টাকা আত্মসাৎ
সরকারি চাকরির আশ্বাস ও ভুয়া নিয়োগপত্র দিয়ে কোটি টাকা আত্মসাৎ
আইসিসি এলিট প্যানেলে প্রথম বাংলাদেশি আম্পায়ার সৈকত
আইসিসি এলিট প্যানেলে প্রথম বাংলাদেশি আম্পায়ার সৈকত
অর্থনৈতিক অঞ্চলের স্থান পরিদর্শন করে ভুটানের রাজার সন্তোষ প্রকাশ
অর্থনৈতিক অঞ্চলের স্থান পরিদর্শন করে ভুটানের রাজার সন্তোষ প্রকাশ
ট্যুর অপারেশনে ব্যাংকে থাকতে হবে ১০ লাখ টাকা
ট্যুর অপারেশনে ব্যাংকে থাকতে হবে ১০ লাখ টাকা
সর্বাধিক পঠিত
যেভাবে মুদ্রা পাচারে জড়িত ব্যাংকাররা
যেভাবে মুদ্রা পাচারে জড়িত ব্যাংকাররা
এবার চীনে আগ্রহ বিএনপির
এবার চীনে আগ্রহ বিএনপির
আয়বহির্ভূত সম্পদ: সাবেক এমপির পিএস ও স্ত্রীর বিরুদ্ধে দুদকের মামলা
আয়বহির্ভূত সম্পদ: সাবেক এমপির পিএস ও স্ত্রীর বিরুদ্ধে দুদকের মামলা
কুড়িগ্রাম আসছেন ভুটানের রাজা, সমৃদ্ধির হাতছানি
কুড়িগ্রাম আসছেন ভুটানের রাজা, সমৃদ্ধির হাতছানি
রাজধানীর ৫ জায়গায় তরমুজ বিক্রি হবে কৃষকের দামে
রাজধানীর ৫ জায়গায় তরমুজ বিক্রি হবে কৃষকের দামে