X
শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪
৬ বৈশাখ ১৪৩১

মহাসড়ক যখন মহানরক

শাহেদ শফিক
২২ অক্টোবর ২০১৭, ১২:৩৪আপডেট : ২২ অক্টোবর ২০১৭, ২০:২৪

ঢাকা-রংপুর মহাসড়কের শাজাহানপুর উপজেলা অংশের চিত্র (ফাইল ছবি: প্রতিনিধি) রাজধানী ঢাকাসহ সারাদেশের সড়ক-মহাসড়কগুলো এখন যেন মহানরকে পরিণত হয়েছে বলে মনে করছেন পরিবহন সংশ্লিষ্টরা। তারা বলছেন, এসব সড়ক এখনও নিরাপদ হয়ে ওঠেনি। সড়ক-মহাসড়কে প্রতিদিনই দুর্ঘটনায় ঝরছে তাজা প্রাণ। যেসব দুর্ঘটনা ঘটছে, তার অর্ধেকই মহাসড়কে। এদিকে, রাজধানী ঢাকায়ও বাড়ছে দুর্ঘটনা। 

সড়ক দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউট (এআরআই) বলেছে, সড়ক দুর্ঘটনার ৪৩ শতাংশ ঘটে মহাসড়কে। ১৯৯৮ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত সড়ক দুর্ঘটনা নিয়ে পুলিশের দেওয়া তথ্য বিশ্লেষণ করে প্রতিষ্ঠানটি এ তথ্য পেয়েছে। সংস্থাটির তথ্য মতে, নিহতদের ৫৪ শতাংশের বয়স ১৬ বছর থেকে ৪০ বছরের মধ্যে। যারা কোনও কোনও পরিবারের কর্মক্ষম ব্যক্তি।




পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, বাংলাদেশে সড়ক দুর্ঘটনার হার অন্যান্য দেশের তুলনায় অনেক বেশি। পশ্চিমা দেশগুলোতে যেখানে প্রতি ১০ হাজার যানবাহনের মধ্যে মাত্র ৩টি দুঘর্টনার কবলে পড়ে, সেখানে বাংলাদেশের হার ৮৫ দশমিক ৫ ভাগ। এসব দুর্ঘটনায় প্রতিবছর কত মানুষ নিহত হচ্ছে, তার কোনও সঠিক তথ্য নেই। পুলিশের পক্ষ থেকে এ সংখ্যা দুই থেকে আড়াই হাজারের বেশি নয় বলে দাবি করা হলেও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, এই সংখ্যা ২০ থেকে ২১ হাজারের বেশি।

মহাসড়কগুলোতে দুর্ঘটনা বেড়ে যাওয়ার পর সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয় থেকে ১৪৪টি ব্ল্যাক স্পট চিহ্নিত করা হয়েছে। ১৫টি ব্ল্যাক স্পটের কাজ ২০১৬ সালের সেপ্টেম্বরের মধ্যে শেষ হয়েছে। বর্তমানে সব মিলিয়ে এক তৃতীয়াংশ সমাধান করা হয়েছে বলে দাবি করছে মন্ত্রণালয়। বাকিগুলোর কাজ চলমান রয়েছে।

তবে বিষয়টি মানতে নারাজ বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মো. মোজাম্মেল হক চৌধুরী। তিনি বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘সরকার মহাসড়কের যেসব ব্ল্যাক স্পট চিহ্নিত করেছে, সেগুলো ১৯৮০ থেকে ১৯৯০ সালের করা। এগুলো বর্তমান সময়ের সঙ্গে মিলিয়ে করতে হবে। তখনকার পরিস্থিতি আর বর্তমান পরিস্থিতি এক নয়। তাছাড়া,ঢাকা ও চট্টগ্রাম ছাড়া দেশের অন্য মহাসড়কগুলোর অবস্থাও ভালো নয়। দিনদিন এসব মহাসড়কে মৃত্যুর হার বাড়ছে।’

জানতে চাইলে নিরাপদ সড়ক চাই আন্দোলনের চেয়ারম্যান ইলিয়াস কাঞ্চন বলেন, ‘আমাদের মহাসড়কগুলো আসলে মহাসড়কের মধ্যে পড়ে না। মহাসড়কের মানে হচ্ছে এর আশেপাশে কোনওকিছুই থাকতে পারবে না। শুধু গাড়ি চলবে। কিন্তু আমাদের সড়কগুলোর আশেপাশে বিভিন্ন ধরনের প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠে। এর পরেও আমরা এগুলোকে মহাসড়ক বলছি। সড়কগুলোর পাশাপাশি যানবাহনের অবস্থাও ভালো নয়। তবে এসব মেনে নিয়েই আমাদের পরিবর্তনের চেষ্টা করতে হবে।’

মহাসড়ক যখন মহানরক

তিনি বলেন, ‘জাতিসংঘ থেকে প্রতিটি সদস্য দেশকে সড়ক দুর্ঘটনা অর্ধেকে নামিয়ে আনার টার্গেট দেওয়া হয়েছে। আমাদের সেদিকেই নজর রাখতে হবে। দুর্ঘটনার জন্য শুধু চালকদের দায়ী করলে চলবে না। দেশে  যত চালক রয়েছে, তাদের প্রশিক্ষণের জন্য কোনও প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠেনি। তাদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা বাড়াতে হবে।’

গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবরের ওপর ভিত্তি করে  যাত্রীকল্যাণ সমিতি জানায়, ২০১৬ সালে সারাদেশে ৪ হাজার ৩১২টি সড়ক দুর্ঘটনায় ৬ হাজার ৫৫ জন নিহত ও ১৫ হাজার ৯১৪ জন আহত হন। ২০১৫ সালে দুর্ঘটনার সংখ্যা ছিল ৬ হাজার ৫৮১টি। এতে ৮ হাজার ৬৪২ জনের প্রাণহানী হয়েছে। আহত হয়েছেন ২১ হাজার ৮৫৫ জন। তবে পুলিশের হিসেবে ওই বছরে সড়ক দুর্ঘটনায় মারা গেছে ২ হাজার ৩৭৬ জন। আর বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসাবে এই সংখ্যা ২১ হাজারের বেশি।

যাত্রীকল্যাণ সমিতি আরও জানায়, ২০১৬ সালে ১ হাজার ৬৩টি বাস, ১ হাজার ১৮৭টি ট্রাক ও কাভার্ড ভ্যান, ৫৯৭টি হিউম্যান হলার, ৬৪৯টি কার, জিপ, মাইক্রোবাস, ৯৭৩টি অটোরিক্সা, ১ হাজার ৪৪৯টি মোটরসাইকেল, ১ হাজার ১৯০টি ব্যাটারি চালিত রিকশা, ৮৬৩টি নছিমন ও করিমন দুর্ঘটনার কবলে পড়ে। এতে ৮০৩ জন ছাত্র-ছাত্রী, ২৩৩ জন শিক্ষক, ৬১ জন সংবাদিক, ৬৩ জন ডাক্তার, ৫২ জন আইনজীবী, ৭৫ জন প্রকৌশলী, ৪৩৮ জন শ্রমিক, ২৯৪ জন চালক, ২৩৫ জন আইনশৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য (পুলিশ, সেনা সদস্য, বিজিবি ও আনসার সদস্য), ৪৩৩ জন বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মী, ১ হাজার ৫৯৮ জন পথচারী, ১৮২ জন সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী, ৮৪৩ জন নারী ও ৬৯৭টি শিশু সড়ক দুর্ঘটনার শিকার হয়েছে।

ব্রাহ্মণবাড়িয়ার রাস্তা (ফাইল ছবি: প্রতিনিধি)

সংগঠনটির এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, দেশে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহতদের প্রায় ৪৭ শতাংশ পথচারী। ৫৩ শতাংশ দুর্ঘটনার জন্য দায়ী বেপরোয়া গতি। অবকাঠামোর দুর্বলতা, মহাসড়কে ছোট যানবাহনের চলাচল, ভাঙা ও খানাখন্দে ভরা রাস্তা, অতিরিক্ত গতিতে গাড়ি চালানো, যাত্রীদের অসতর্কতা, ট্রাফিক আইন না মানা, বিপদজনক ওভারটেকিং, নছিমন-করিমন, ভটভটি, ইজিবাইক, রিকশা, অটোরিকশা, মূল সড়কে চলাচল, ফুটপাত দখল হয়ে যাওয়া দুর্ঘটনার জন্য দায়ী। এক্ষেত্রে চালকদের প্রশিক্ষণ, যানবাহনের গতি নিয়ন্ত্রণ, দুর্ঘটনা প্রতিরোধ সেল গঠন, মহাসড়কে দ্রুত ও ধীর গতির যানবাহনের জন্য পৃথক লেন করা, মানসম্মত সড়ক নির্মাণ ও রোড সেফটি অডিট করা, সড়ক মহাসড়কে রোড ডিভাইডার স্থাপন করা, চালকদের প্রশিক্ষিত করে তোলা, সড়ক-মহাসড়কের, জেব্রা ক্রসিং, ওভারপাস, আন্ডারপাস গড়ে তোলা, ওভারলোড নিয়ন্ত্রণ করা, মহাসড়কে নছিমন-করিমন ও রিকশা জাতীয় পরিবহন বন্ধ করা গেলে প্রাণহানী অর্ধেকে নামিয়ে আনা যাবে।

বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মো. মোজাম্মেল হক চৌধুরী বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘উন্নত দেশগুলোতে সড়ক দুর্ঘটনা প্রতিরোধে যেসব পরিকল্পনা ও সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়, সেগুলো খুবই সুনির্দিষ্ট। কিন্তু বাংলাদেশে পরিকল্পনা ও বাস্তবায়ন হয় দায়সারা গোছের। কত বছরে কী পরিমান দুর্ঘটনা ও প্রাণহানী কমানো হবে, কিভাবে তা অর্জিত হবে, কারা তা সফল করবে, সেটা স্পষ্ট করা জরুরি। পরিকল্পনা করে রেখে দিলে বা প্রতিদিন নতুন নতুন কথার ফুলঝুড়ি দিলে দুর্ঘটনা কমবে, এইটা আশা করা ঠিক নয়।’

যাত্রীকল্যাণ সমিতি তাদের প্রতিবেদনে বলছে, দেশের সড়ক মহাসড়কগুলোতে ১০ লাখ নছিমন-করিমন-ইজিবাইক চলাচল করছে। অবাধে আমদানি হচ্ছে অটোরিকশা, ব্যাটারি চালিত রিকশা, ইজিবাইক। দেশব্যাপী ৫ লাখ ফিটনেসবিহীন বাস, ট্রাক, কাভার্ড ভ্যান, হিউম্যান হলার অবাধে চলছে। নিবন্ধনহীন ৪ লাখ অটোরিকশা ও মোটরসাইকেল চলাচল করছে সড়ক-মহাসড়কে। এসব যানবাহন সড়ক দুর্ঘটনার প্রধান উৎস।

ব্রাহ্মণবাড়িয়ার রাস্তা। (ফাইল ছবি: প্রতিনিধি) এছাড়া আইন প্রয়োগেও রয়েছে দুর্বলতা। চালক ও মালিকদের বেপরোয়া মনোভাব এই সেক্টরকে দিন দিন অনিরাপদ করে তুলছে বলেও সংগঠনটির পক্ষ থেকে দাবি করা হয়।

এ বিষয়ে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির মহাসচিব খোন্দকার এনায়েত উল্লাহ বলেন, ‘দুর্ঘটনার জন্য সড়কের অব্যবস্থাপনাই দায়ী। মহাসড়কে বিভিন্ন ধরনের ছোট আকারের গাড়ি চলে। সেগুলো দুর্ঘটনা ঘটায়। তাছাড়া, মহাসড়কে কমগতির গাড়ি বন্ধ করা গেলে দুর্ঘটনা কমে আসবে।’

গত ঈদুল আজহায় সংগঠনটি ঈদ যাত্রায় সড়ক দুর্ঘটনা নিয়ে আরও একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে। এতে দেখা গেছে, দেশের সড়ক-মহাসড়কে ২১৪টি সড়ক দুর্ঘটনায় ২৫৪ জন নিহত ও ৬৯৬ জন আহত হয়েছেন।  দুর্ঘটনার ৩৯ দশমিক ১০ শতাংশ পথচারীকে গাড়ি চাপা, ১২ দশমিক ৬০ শতাংশ নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে, ৩২ দশমিক ৬০ শতাংশ মুখোমুখি সংঘর্ষ,  ১ দশমিক ৪০ শতাংশ চাকায় ওড়না পেছিয়ে, ৩ দশমিক ২০ শতাংশ গাড়ির ছাদ থেকে পড়ে ও ১১ দশমিক ২০ শতাংশ অন্যান্য কারণে ঘটেছে। যানবাহনের ৩৭ ভাগ বাস, ৩৫ ভাগ ট্রাক ও পিকআপ, ২৩ ভাগ নছিমন-করিমন, ভটভটি-ইজিবাইক, অটোরিকশা ও মোটরসাইকেল, ৫ ভাগ অন্যান্য যানবাহন এসব দুর্ঘটনার সঙ্গে জড়িত ছিল।

আরও পড়ুন:
রাত ৮টায় খালেদা-সুষমা বৈঠক

/এপিএইচ/আপ-এসএনএইচ/
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
শেষ ম্যাচে জিতে সুপার লিগে গাজী গ্রুপ
শেষ ম্যাচে জিতে সুপার লিগে গাজী গ্রুপ
কারাগার এখন বিএনপি নেতাকর্মীদের স্থায়ী ঠিকানা: রিজভী
কারাগার এখন বিএনপি নেতাকর্মীদের স্থায়ী ঠিকানা: রিজভী
তিন নম্বরে থেকে সুপার লিগে মোহামেডান
তিন নম্বরে থেকে সুপার লিগে মোহামেডান
মুখ থুবড়ে পড়েছে ইউক্রেনের অস্ত্র খাত
মুখ থুবড়ে পড়েছে ইউক্রেনের অস্ত্র খাত
সর্বাধিক পঠিত
নিজ বাহিনীতে ফিরে গেলেন র‍্যাবের মুখপাত্র কমান্ডার মঈন
নিজ বাহিনীতে ফিরে গেলেন র‍্যাবের মুখপাত্র কমান্ডার মঈন
ডিএমপির ৬ কর্মকর্তার বদলি
ডিএমপির ৬ কর্মকর্তার বদলি
আমানত এখন ব্যাংকমুখী
আমানত এখন ব্যাংকমুখী
বৈধ পথে রেমিট্যান্স কম আসার ১০ কারণ
বৈধ পথে রেমিট্যান্স কম আসার ১০ কারণ
ইসরায়েলি হামলা কি প্রতিহত করতে পারবে ইরান?
ইসরায়েলি হামলা কি প্রতিহত করতে পারবে ইরান?