X
শনিবার, ০৪ মে ২০২৪
২০ বৈশাখ ১৪৩১

ওয়াটার বাস চালাতে আগ্রহ নেই ইজারাদারের

শফিকুল ইসলাম
২৩ নভেম্বর ২০১৭, ০৭:৫৩আপডেট : ২৩ নভেম্বর ২০১৭, ১৬:১১

 

ওয়াটার বাস (ফাইল ছবি: সংগৃহীত) প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিশেষ অগ্রাধিকার ভিত্তিক প্রকল্প ওয়াটার বাস চালানোর ব্যাপারে আগ্রহ নেই সংশ্লিষ্ট ইজারাদার কোম্পানি ইমরান ট্রেডার্সের। বরং ওয়াটার বাস চালালে প্রতিদিনই লোকসান গুনতে হয় বলে দাবি করেছে কোম্পানিটি। তবে, বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহন করপোরেশনের (বিআইডব্লিউটিসি) কর্মকর্তারা বলছেন, এটি প্রধানমন্ত্রীর অগ্রাধিকারভিত্তিক প্রকল্প হওয়ায় এই সার্ভিস বন্ধ হবে না। বাংলাদেশে সার্ভিসটি এই প্রথম। তাই কিছুটা সমস্যা হচ্ছে। শিগগিরই এই সমস্যা কেটে যাবে।

নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয় ও বিআইডব্লিউটিএ-এর অর্থায়নে, নিজস্ব প্রযুক্তিতে ২০০৪ সালে একটি ওয়াটার ট্যাক্সি দিয়ে সদরঘাট থেকে আমিনবাজারে নৌপথে প্রথম যাত্রী চলাচল শুরু হয়। জনগণের মধ্যে তখন বিপুল উৎসাহ-উদ্দীপনা দেখা দেয়। কিন্তু অচিরেই কর্তৃপক্ষের অব্যবস্থাপনার কারণে ওয়াটার ট্যাক্সি একসময় বন্ধ হয়ে যায়।

এরপর নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয় ও বিআইডব্লিউটিএ ২০১০ সালের ২৮ আগস্ট ‘তুরাগ’ ও ‘বুড়িগঙ্গা’ নামে দু’টি ওয়াটারবাসের মাধ্যমে সদরঘাট থেকে গাবতলী পর্যন্ত নৌপথে সার্ভিস চালু করে। ওয়াটার বাস দু’টি নির্মাণে সরকারের খরচ হয় প্রায় ১ কোটি টাকা। কিন্তু মাত্র ১১ মাস যেতে না যেতেই ওই ওয়াটারবাসগুলো মুখ থুবড়ে পড়ে ২০১১ সালের ১০ জুন। এরপর সাড়ে ৩ কোটি টাকা ব্যয়ে আরও ৪টি ওয়াটার বাস চালু করা হয় ২০১৩ সালের ৪ জুলাই। ওই বাসগুলোও বছর না যেতেই বিকল হয়ে পড়ে। এরপর দৈনিক ৪০ হাজার টাকা লোকসান দেখিয়ে ওয়াটার বাস সার্ভিসটি ছেড়ে দেওয়া হয় বেসরকারি মালিকানায়। কিন্তু তারাও লোকসানের কারণে বেশিদিন টিকে থাকতে পারেনি। বেশ কয়েকমাস বন্ধ থাকার পর আবারও সার্ভিসটি চালু করে বিআইডব্লিউটিসি। সর্বশেষ অব্যাহত লোকসানের ঝুঁকি মাথায় নিয়ে ২০১৪ সালের ১৬ নভেম্বর ৬টি ওয়াটার বাস নামায় সংস্থাটি। ৫ কোটি টাকার বেশি ব্যয়ে এ নৌযানগুলো তৈরি করে হাইস্পিড শিপ বিল্ডার্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানি। বর্তমানে সার্ভিসটি আবার ছেড়ে দেওয়া হয়েছে বেসরকারি মালিকানায়।

বিআইডব্লিউটিসি পরীক্ষামূলকভাবে পরিচালনার জন্য একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কাছে লিজ দেয়। সরকারের এই ওয়াটার বাসগুলো ছিল প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অগ্রাধিকার প্রকল্পগুলোর অন্যতম। লক্ষ্য ছিল—এর মাধ্যমে একদিকে যানজট কমবে, অন্যদিকে রাজধানীবাসী কম খরচে কম সময়ে সদরঘাট থেকে টঙ্গী, গাবতলী, আশুলিয়া; এমনকী নারায়ণগঞ্জ বন্দর পর্যন্ত চলাচল করতে পারবেন। নৌযানগুলো জনপ্রিয়তাও পেতে থাকে। বাড়তে থাকে যাত্রী। কমতে থাকে সড়কপথে রাজধানীতে বাসে চলাচলকারী যাত্রীর সংখ্যা। তখন এই সার্ভিস বন্ধে তৎপর হয়ে ওঠে একটি সিন্ডিকেট। যারা এই নৌ রুট ও জাহাজগুলোকে ভোগান্তিতে পরিণত করার চক্রান্তে মেতে ওঠে। অভিযোগ রয়েছে, সড়কপথে পরিবহন ব্যবসায়ীদের পক্ষে গড়ে ওঠা ওই সিন্ডিকেটের সঙ্গে যুক্ত হয় সরকারের বেশি কয়েকজন অসৎ কর্মকর্তা-কর্মচারীও। ফলে দিনে দিনে এই সার্ভিসকে অকাযকর করে দেওয়ার অপচেষ্টা শুরু হয়। আদায় করা হয় সরকার নির্ধারিত ভাড়ার চেয়ে বেশি ভাড়া। ভেঙে ফেলা হয় টাইম সিডিউলও। ফলে অতিরিক্ত ভাড়া ও ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করতে করতে বিরক্ত হয়ে মুখ ফিরিয়ে নেন যাত্রীরা। এর ফলে অনিশ্চিত হয়ে পড়ে প্রধানমন্ত্রীর পছন্দের অগ্রাধিকারের প্রকল্পটি।   

একটি সূত্র জানায়, এই সার্ভিসটিকে অকার্যকর করে তুলতে বিভিন্ন অজুহাতে প্রথমে ওয়াটারবাসের গতি কমানো হয়েছে। যুক্তি হিসেবে বলা হয়েছিল, বেশি গতিতে ওয়াটারবাস চললে নদীর পাড় ভেঙে যায়। এছাড়া ছোট ছোট নৌকা ও ট্রলারেরও ক্ষতি হয়। তখন গতি কমিয়ে  চালানোর ওয়াটার বাসগুলো। এতে নির্দিষ্ট সময়ে গন্তব্যে পৌঁছাতে পারতেন না যাত্রীরা। এ কারণে ওয়াটার বাস সার্ভিসের ওপর ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন তারা। একসময় মুখ ফিরিয়ে নেন।

সূত্র জানায়, গাবতলী থেকে সদরঘাট পর্যন্ত সরকার নির্ধারিত ৩০ টাকা ভাড়ার জায়গায় ইজারাদার প্রতিষ্ঠান ৪০ টাকা আদায় করতো। এতেও ক্ষুব্ধ হয়েছেন যাত্রীরা।  এসব অভিযোগ পাওয়ার পরেও ইজারাদার প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে কোনও ব্যবস্থা নেয়নি বিআইডব্লিউটিসি কর্তৃপক্ষ। 

এদিকে ল্যান্ডিং স্টেশনগুলোয়ও চলছে চরম নৈরাজ্য।  মালামালের জন্য অতিরিক্ত ভাড়া আদায়, একবার টিকিট কেটে নিচে গেলে, আবারও টিকিট কাটতে বাধ্য করা, সন্ধ্যার পর মাদকসেবীদের আড্ডা, বাতি না জ্বলা, প্রয়োজনীয় নিরাপত্তা না থাকাসহ নারী যাত্রীদের হয়রানির নিত্য ঘটনায় পরিণত হয়েছে। 

নদীতে পানির গভীরতা কম অজুহাত দেখিয়ে ওয়াটার বাস চলাচলের বিরুদ্ধে বিভিন্ন যুক্তি দাঁড় করানো হয়। স্বাভাবিক আকারের একটি মালবাহী ট্রলার চলতে নদীর গভীরতা দরকার হয় ১০ ফুট। বিপরীতে ওয়াটার বাস চলার জন্য পানির গভীরতা লাগে মাত্র ৬ ফুট। অথচ সেই নদীতে ট্রলার চললেও ওয়াটার বাস চালানো হয় না। এভাবে  প্রকল্পটি বন্ধ করে দেওয়ার সব ধরনের আয়োজন সম্পন্ন করে রাখে একটি মহল।

উল্লেখ্য, ২০১০ সালের আগস্ট মাসে প্রায় ২ কোটি টাকা ব্যয়ে দু’টি ওয়াটার বাস নিয়ে রাজধানীর গাবতলী থেকে সদরঘাট পর্যন্ত রুটে নৌ সার্ভিস চালু করেছিল বিআইডব্লিউটিসি। এরপর যাত্রীদের অতিরিক্ত চাপ মোকাবিলায় ২০১৪ সালের নভেম্বর মাসে এই বহরে যুক্ত হয় আরও ৬টি বাস।  

জানা গেছে, বর্তমানে ৮টি ওয়াটার বাস রয়েছে।  এগুলো নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের অধীনস্ত বিআইডব্লিউটিসি পরীক্ষামূলকভাবে পরিচালনার জন্য বেসরকারি কোম্পানিকে দিলেও সুষ্ঠু রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে ওয়াটার বাসগুলো নষ্ট হচ্ছে। নিয়ম অনুযায়ী এই ওয়াটার বাসগুলো প্রতিদিন রাজধানী ঢাকার চারপাশের নৌপথে চলাচল করার কথা। কিন্তু ইজাদার বেসরকারি কোম্পানি ইমরান ট্রেডার্স এই ওয়াটার বাসগুলো চালাচ্ছে না। এছাড়া এই ৮টি জাহাজ দিন শেষে বাদামতলী ঘাটে এনে রাখার কথা থাকলেও সে নির্দেশনাও পালিত হচ্ছে না। জাহাজগুলো যেখানে-সেখানে ফেলে রাখায় এগুলোর বিভিন্ন অংশ ও দামি যন্ত্রাংশ চুরি হচ্ছে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে, এ বিষয়ে জানতে চাইলে মহা ব্যবস্থাপক (যাত্রী) আজমল হোসেন বলেন, ‘এটি প্রধানমন্ত্রীর অগ্রাধিকারভিত্তিক প্রকল্প। তাই এই সার্ভিস বন্ধ হবে না। বাংলাদেশে এই সার্ভিসটি প্রথম হওয়ায় কিছুটা সমস্যা হচ্ছে। তবে তা শিগগিরই কেটে যাবে।’ এক প্রশ্নের জবাবে তিনি আরও বলেন, ‘এটি পরিচালনার দায়িত্ব যাদের দেওয়া হয়েছে, তারা না চালানোর জন্য কিছুটা গড়িমসি করছে। নানা অজুহাতে এটি চালাচ্ছে না। আমরা বিষয়টি দেখছি। প্রয়োজন হলে আমরা ওই প্রতিষ্ঠানটি সঙ্গে সম্পাদিত চুক্তিও বাতিল করবো। নতুন প্রতিষ্ঠানকে পরিচালনার দায়িত্ব দেওয়া হতে পারে।’

এক প্রশ্নের জবাবে আজমল হোসেন জানান, ‘জাহাজগুলো ইমরান ট্রেডার্সে দায়িত্বে। তাদেরই সেগুলো রক্ষণাবেক্ষণ করার কথা। আমরা তাদের কার্যক্রম মনিটরিং করি মাত্র।’  

এ বিষয়ে জানতে চাইলে মাঠপর্যায়ে কর্মরত বিআইডব্লিউটিসির সহকারী মহা-ব্যবস্থাপক বরকতউল্লাহ বলেন, ‘ইজারাদার প্রতিষ্ঠান ইমরান ট্রেডার্স জাহাজগুলো ঠিকমতো চালায় না। বার বার সতর্ক করার পরও বিভিন্ন অজুহাতে এগুলো বসিয়ে রেখেছে তারা। বলছে, লোকসান হচ্ছে। জ্বালানি তেল বেশি খরচ হচ্ছে। দিনে একটি চালালে অন্যটি চালানোর কোনও উদ্যোগ নেয় না। যাত্রীরা এলেও কখন ছাড়বে জাহাজ, তা পরিষ্কার করে জানায় না। ফলে যাত্রীরা অপেক্ষা করে বিরক্ত হয়ে চলে যান। তখন তারা বলেন, যে যাত্রী নাই। কম যাত্রী নিয়ে জাহাজ চালালে করলে কোম্পানির লোকসান হবে।’

এ বিষয়ে জানতে চাইলে ইমরান ট্রেডার্সের মালিক আশরাফ আলী জানিয়েছেন, ‘লোকসান হচ্ছে। যাত্রী কম। তেল লাগে বেশি। বিভিন্ন কারণে যাত্রী আসে না। তাই ঠিকমতো চালানো সম্ভব হয় না।’ তবে প্রথম দিকে এ রুটকে জনপ্রিয় করতে সরকারি ভর্তুকি দিতে হবে বলেও মন্তব্য করেন তিনি।

/এমএনএইচ/
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
ছেলের মৃত্যুর ৪ দিনের মাথায় চলে গেলেন বাবা, গ্রামজুড়ে শোকের ছায়া
ছেলের মৃত্যুর ৪ দিনের মাথায় চলে গেলেন বাবা, গ্রামজুড়ে শোকের ছায়া
গাজা ও ইউক্রেনে যুদ্ধ বন্ধে যুক্তরাজ্যের সঙ্গে কাজ করতে চায় বাংলাদেশ: পররাষ্ট্রমন্ত্রী
গাজা ও ইউক্রেনে যুদ্ধ বন্ধে যুক্তরাজ্যের সঙ্গে কাজ করতে চায় বাংলাদেশ: পররাষ্ট্রমন্ত্রী
অনেক নার্ভাস ছিলেন সাইফউদ্দিন
অনেক নার্ভাস ছিলেন সাইফউদ্দিন
বকশিবাজার মোড়ে বাসের ধাক্কায় পথচারী নিহত
বকশিবাজার মোড়ে বাসের ধাক্কায় পথচারী নিহত
সর্বাধিক পঠিত
মুক্তি পেলেন মামুনুল হক
মুক্তি পেলেন মামুনুল হক
যশোরে আজ সর্বোচ্চ তাপমাত্রা
যশোরে আজ সর্বোচ্চ তাপমাত্রা
২৫ জেলার সব মাধ্যমিক স্কুল-কলেজ-মাদ্রাসা শনিবার বন্ধ
২৫ জেলার সব মাধ্যমিক স্কুল-কলেজ-মাদ্রাসা শনিবার বন্ধ
কেমন থাকবে আগামী কয়েকদিনের আবহাওয়া?
কেমন থাকবে আগামী কয়েকদিনের আবহাওয়া?
নদীতে ধরা পড়ছে না ইলিশ, কারণ জানালেন মৎস্য কর্মকর্তা
নদীতে ধরা পড়ছে না ইলিশ, কারণ জানালেন মৎস্য কর্মকর্তা