X
বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪
১২ বৈশাখ ১৪৩১

এবারও গৃহকরে বৈষম্য!

শাহেদ শফিক
১০ ডিসেম্বর ২০১৭, ১৩:৪২আপডেট : ১০ ডিসেম্বর ২০১৭, ১৮:৩২

গৃহকর, ছবি সংগৃহীত রাজধানীর গোড়ান এলাকার বাড়িমালিক রিপন হাওলাদারের বার্ষিক গৃহকর ছিল ১০ হাজার টাকা। ১৯৯৯ সালে তৈরি বাড়িটির কর এই অর্থবছরে পুনর্মূল্যায়ন করেছে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি)। এতে বাড়িটির কর ধরা হয়েছে ৮৯ হাজার টাকা। এই হিসেবে ১৭ বছরের ব্যবধানে কর বেড়েছে এক লাফে প্রায় ৯ গুণ। সম্প্রতি ডিএসসিসি থেকে এ সংক্রান্ত চিঠি বাসায় এলে হতভম্ব হয়ে পড়েন তিনি।

সিটি করপোরেশন সূত্রগুলো বলছে, কর বাড়ানো হচ্ছে না, বরং তা সমতায়ন করা হচ্ছে। ২৯ বছর ধরে কর পুনর্মূল্যায়ন না করায় একই এলাকায় একেক বাড়ির একেক রকম গৃহকর ছিল। এ বৈষম্য দূর করতেই কর সমতায়নের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। তবে বাড়িমালিকরা বলছেন, সমতায়নের কথা বলা হলেও তা হচ্ছে না, বরং এবারও গৃহকরে বড় রকমের বৈষম্য করা হচ্ছে।

গোড়ানের ওই বাড়িমালিক রিপন হাওলাদার বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘১৭ বছর ধরে সিটি করপোরেশন নির্ধারিত ১০ হাজার টাকা করে গৃহকর পরিশোধ করে আসছি। কিন্তু এখন হঠাৎ করেই কর ৭৯ হাজার টাকা বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। এই টাকা কোথায় থেকে দেবো? এখন তো বাড়িভাড়া বাড়াতে হবে।’ তিনি জানান,  গৃহকর সংক্রান্ত এই চিঠি আসার পর করপোরেশনের কয়েকজন লোক এসে তার বাড়িটি মাপজোখ করে গেছেন।

এই বাড়িমালিক তার পাশের একটি বাড়ির কথা উল্লেখ করে বলেন, ‘ওই বাড়ি এবং আমার বাড়ি একই আয়তনের। সেই বাড়ির যে কর ছিলো, আমারও তা ছিলো। কিন্তু এখন আমার কর ৮৯ হাজার টাকা আর ওই বাড়ির ৪১ হাজার টাকা। এটা কিভাবে সম্ভব? কর সমতায়নের কথা বলে যদি সিটি করপোরেশন আবারও বৈষম্য করে, তাহলে তা বাড়িমালিকরা মেনে নেবে না।’

এর কারণ সম্পর্কে তিনি বলেন, সিটি করপোরেশনের কিছু অসাধু কর্মকর্তা টাকা নিয়ে বিভিন্ন উপায়ে অনেক বাড়ির কর কম ধরেছেন। আর যারা তাদের অন্যায় প্রস্তাবে রাজি হননি, তাদের ওপর করের বোঝা চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে।’

শুধু এই বাড়িমালিকই নন, তার মতো এমন পরিস্থিতির শিকার ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের শত শত বাড়িমালিক। সূত্র জানিয়েছে, কর ‍পুনর্মূল্যায়ন নিয়ে এরই মধ্যে দুই করপোরেশনে কয়েকশ অভিযোগ জমা পড়েছে।

বর্তমানে সিটি করপোরেশন থেকে গুলশান এলাকার প্রতি বর্গফুট বাড়িভাড়া নির্ধারণ করে দেওয়া হয়েছে ১৫ থেকে ১৮ টাকা। বনানীতে ১৪ থেকে ১৬, মহাখালীতে ১১ থেকে ১২, নাখালপাড়ায় ৬ থেকে ৭, কল্যাণপুর, পল্লবীতে ৬, উত্তরায় ৫ থেকে ৯, শান্তিবাগে ৫ থেকে ৬, নয়াপল্টনে ৯, শান্তিনগরে ৮ থেকে ৯, জিগাতলায় ৮ ও ধানমন্ডিতে ১১ দশমিক ২৫ টাকা। কিন্তু বাড়ির মালিকরা ভাড়া আদায় করছেন এর চেয়ে দ্বিগুণ থেকে তিনগুণ বেশি হারে।

বাড়িমালিকদের অভিযোগ, কর নির্ধারণে কর্মকর্তারা কারও ক্ষেত্রে সিটি করপোরেশন নির্ধারিত ভাড়া, আবার কারও ক্ষেত্রে বাড়িমালিকের নির্ধারিত ভাড়ার ওপর কর নির্ধারণ করে থাকেন। এক্ষেত্রে পাশাপাশি একই ধরনের দুটি বাড়ির কর ব্যবধান দাঁড়ায় কয়েকগুণ। একে বড় ধরনের বৈষম্য বলে মনে করছেন তারা।

দীর্ঘ ২৯ বছর পর গৃহকর পুনর্মূল্যায়নের উদ্যোগ নিয়েছে দুই সিটি করপোরেশন। এতে কয়েকগুণ বেড়েছে গৃহকর। বলা হচ্ছে–কর বৃদ্ধি নয়, সমতায়ন করা হচ্ছে। কিন্তু বাড়িমালিকদের অভিযোগ, কর বাড়ানোর এ হার অস্বাভাবিক। এতে বিপাকে পড়েছেন অনেকেই। এভাবে কর বাড়ানোর কারণে বাসা ভাড়াসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে প্রভাব পড়বে। এরইমধ্যে এলাকাভিত্তিক বিভিন্ন সংগঠন সিটি করপোরেশনের এ সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ করছে। তবে সিটি করপোরেশন বলছে, এটি গৃহকর বাড়ানো নয়, সমন্বয়। আইনের মধ্যে থেকেই করপোরেশন এ উদ্যোগ নিয়েছে।

জানতে চাইলে দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের প্রধান রাজস্ব কর্মকর্তা ইউসূফ আলী সরদার বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আমরা বাড়ির ট্যাক্স বাড়াচ্ছি না। শুধু বর্তমান ভাড়ার সঙ্গে সমন্বয় করছি। নগরবাসী যেসব বিষয়ের ওপর ভিত্তি করে ভাড়া দিচ্ছেন, তার ওপর ভাড়া সমন্বয় করা হচ্ছে।’ তিনি আরও বলেন, ‘আগে রাজধানীবাসী ১৯৯০ সালের বাড়িভাড়া অনুযায়ী গৃহকর পরিশোধ করতেন। এখন থেকে বর্তমান ভাড়া অনুযায়ী গৃহকর পরিশোধ করবেন। তবে ট্যাক্সের চিঠি ইস্যুর পর থেকেই অনেক অভিযোগ আসছে। তাদের জন্য সুযোগ রাখা হয়েছে। আবেদন করলে কাউন্সিলদের নিয়ে গঠিত ‘কর পর্যালোচনা পরিষদ’ সর্বোচ্চ ১৫ শতাংশ কর কমিয়ে দিতে পারবে।’

বৈষম্যমূলক কর নির্ধারণের অভিযোগের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘আইনের মধ্যে থেকেই কর নির্ধারণ করা হচ্ছে। এক্ষেত্রে কেউ যদি সংক্ষুব্ধ হন, তিনি আপিল করতে পারবেন। এতে সর্বোচ্চ ৪০ শতাংশ কর কমানোর বিধান রয়েছে। আমাদের কারও বিরুদ্ধে কোনও অভিযোগ থাকলে ফোন নম্বরসহ কমিটি গঠন করে দেওয়া হয়েছে। ডিএসসিসির ওয়েবসাইটে সে তালিকা আছে। কারও বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণিত হলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। ’

তবে বাড়িমালিকরা বলছেন, আপিল করেও খুব একটা সুফল পাওয়া যায় না। যে বাড়িটির কর ১০ হাজার থেকে এক লাখ টাকা করা হয়েছে, তার ৪০ শতাংশ কমালেও কর দাঁড়ায় ৬০ হাজার টাকা।

ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) প্রধান রাজস্ব কর্মকর্তা রবীন্দ্র শ্রী বড়ুয়া বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘দীর্ঘদিন কর না বাড়ানোর কারণে সমস্যাটি দেখা দিয়েছে। পাশাপাশি দুটি ভবনের ট্যাক্সের পার্থক্য তৈরি হয়েছে। এ পার্থক্য দূর করতেই এ উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এতে দীর্ঘদিন কর সমতা না করা বাসিন্দাদের কর বেশি বেড়েছে। আবার যাদের কিছুদিন আগে কর নির্ধারণ করা হয়েছিল তাদের বেশি বাড়েনি।’

সূত্র জানায়, ১৯৮৮-৮৯ অর্থবছরে কর সমতায়নের জন্য পঞ্চবার্ষিকী সাধারণ মূল্যায়ন কার্যক্রম গ্রহণ করা হয়। কিন্তু এরপর বিভিন্ন কারণে সে উদ্যোগ আর বাস্তবায়ন করা হয়নি। গত ২৯ বছর ধরে সে নিয়ম বন্ধ ছিল। এ সময়ের মধ্যে পাঁচ তলা ভবন হয়েছে ১০ থেকে ১২ তলা। একতলা ভবন বহুতল হয়েছে। ভাড়া বেড়েছে কয়েকগুণ। কিন্তু কারও গৃহকর বাড়েনি।

সর্বশেষ গত বছরের ১৬ আগস্ট স্থানীয় সরকার বিভাগের নির্দেশে ২০১৬-১৭ অর্থবছর থেকে গৃহকর সমতায়নের উদ্যোগ নেওয়া হয়। এরপর দক্ষিণ সিটি করপোরেশন অঞ্চল-২ ও অঞ্চল-৪ এবং উত্তর সিটি করপোরেশন তার অঞ্চল-১ ও অঞ্চল-৩ এলাকায় গৃহকর সমতায়নের কাজ শুরু করে। গত জানুয়ারিতে উত্তর সিটি করপোরেশন কাজ শেষ করে ফেলে। দক্ষিণ সিটির কর নির্ধারণের পর শুধু চিঠি পাঠানো বাকি ছিল।

সেসময় দুই সিটি করপোরেশনের কর সুপারভাইজারদের বিরুদ্ধে অনিয়মসহ ঘুষ বাণিজ্যের অভিযোগ উঠে। এরইমধ্যে গত ২ ফেব্রুয়ারি ডিএসসিসির উপ-কর কর্মকর্তা তোফাজ্জল হোসেন জমাদ্দারকে সার্কুলার রোডের (ভূতের গলি) নিজ বাসা থেকে ঘুষের টাকাসহ হাতেনাতে আটক করে দুদক।

দুই সিটি করপোরেশনের কর পুনর্মূল্যায়নে সংক্ষুব্ধ হয়ে চলতি বছরের ২২ জানুয়ারি উচ্চ আদালতে একটি রিট করেন সাইফ আলম নামের এক বাড়িমালিক। এতে কর পুনর্মূল্যায়নের ওপর স্থগিতাদেশ দেন আদালত। এরপর গত ৭ আগস্ট আদালতের আদেশে এ স্থগিতাদেশ ওঠে। এতে আবার শুরু হয় কর সমতায়নের কাজ।

স্থগিতাদেশ ওঠার পর উত্তর সিটি করপোরেশন তাদের বাকি তিনটি অঞ্চলে কর নির্ধারণের কাজ শুরু করে। আর দক্ষিণ সিটি করপোরেশন তাদের দুটি অঞ্চলের কর নির্ধারণ সংক্রান্ত চিঠি বাসিন্দাদের কাছে পাঠানো শুরু করে। এই চিঠি হাতে পেয়ে মাথায় হাত পড়েছে বাড়িওয়ালাদের।

কর বাড়ানোর বিষয়ে সম্প্রতি দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র মোহাম্মদ সাঈদ খোকন এক অনুষ্ঠানে সাংবাদিকদের বলেন, ‘আমরা নতুন কোনও গৃহকর বাড়াচ্ছি না। বাড়িমালিকদের কর দেওয়ার ক্ষেত্রে যে বৈষম্য বিদ্যমান রয়েছে, তার সমতায়ন করছি। যে বাড়িমালিক ২৯ বছর আগে বাড়ির ভাড়া পেতেন পাঁচ হাজার টাকা, এখন তিনি সেই বাড়ির ভাড়া পান দুই লাখ টাকা। কিন্তু তিনি পাঁচ হাজার টাকা ভাড়া হিসেবেই বাড়ির কর দিয়ে যাচ্ছেন। অন্যদিকে, তার পাশের বাড়িমালিক নতুন বাড়ি নির্মাণ করায় তার কর অ্যাসেসমেন্ট বর্তমান ভাড়ার ওপরেই করা হয়েছে। যে কারণে তার গৃহকর অন্য বাড়িমালিক থেকে অনেক বেশি। কর দেওয়ার এই যে বৈষম্য, আমরা তার সমতায়ন করছি। একে কর বাড়ানো বলা যাবে না। পুরনো বাড়িমালিকরা গত ২৯ বছর ধরেই আমাদের কর কম দিয়ে আসছেন। আমরা চাইলে আইন অনুযায়ী সেই করকে বকেয়া হিসেবে ধরে এখন আদায় করতে পারি। কিন্তু আমরা জনগণের কথা চিন্তা করে তা করছি না।’

 

/এএম/আপ-এসটি/
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
‘গাজার গণকবরে অন্তত ২০ জনকে জীবন্ত দাফন’
‘গাজার গণকবরে অন্তত ২০ জনকে জীবন্ত দাফন’
‘বাল্যবিয়ে প্রতিরোধে সামাজিক আন্দোলন গড়তে হবে’
‘বাল্যবিয়ে প্রতিরোধে সামাজিক আন্দোলন গড়তে হবে’
প্রতি শ্রেণিতে ৫৫ শিক্ষার্থী ভর্তির নির্দেশ শিক্ষা প্রতিমন্ত্রীর
প্রতি শ্রেণিতে ৫৫ শিক্ষার্থী ভর্তির নির্দেশ শিক্ষা প্রতিমন্ত্রীর
উত্তাল চুয়েট, অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা
উত্তাল চুয়েট, অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা
সর্বাধিক পঠিত
বাংলাদেশ ব্যাংকের চাকরি ছাড়লেন ৫৭ কর্মকর্তা
বাংলাদেশ ব্যাংকের চাকরি ছাড়লেন ৫৭ কর্মকর্তা
কেন গলে যাচ্ছে রাস্তার বিটুমিন?
কেন গলে যাচ্ছে রাস্তার বিটুমিন?
স্কুল-কলেজে ছুটি ‘বাড়ছে না’, ক্লাস শুরুর প্রস্তুতি
স্কুল-কলেজে ছুটি ‘বাড়ছে না’, ক্লাস শুরুর প্রস্তুতি
সিনিয়র শিক্ষককে ‘দেখে নেওয়ার’ হুমকি জুনিয়র শিক্ষকের
সিনিয়র শিক্ষককে ‘দেখে নেওয়ার’ হুমকি জুনিয়র শিক্ষকের
ধানের উৎপাদন বাড়াতে ‘কৃত্রিম বৃষ্টির’ পরিকল্পনা
ধানের উৎপাদন বাড়াতে ‘কৃত্রিম বৃষ্টির’ পরিকল্পনা